আজ সোমবার, ২৯ এপ্রিল, ২০২৪

Advertise

ডিভাইড এন্ড রুল: এই বংগে যত রংগ

মাসকাওয়াথ আহসান  

পূর্ববঙ্গ আবহমানকাল ধরে ধর্মীয় সম্প্রীতির সবুজ ব-দ্বীপ। এখানে বৌদ্ধ-হিন্দু ও মুসলিম শাসকেরা বিভাজনের রাজনীতি কখনোই করেননি। বিভাজনের রাজনীতি শুরু হয়েছে বৃটিশেরা উপনিবেশ গড়ার পরে। তার আগে দেখবেন আরাকান রাজসভায় হিন্দু-মুসলমান কবি-সাহিত্যিকের সহাবস্থান। মুসলিম শাসক শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহ হিন্দু ধর্ম পালনে সহযোগিতা করেছেন। এমনকি দিল্লির মুঘল শাসকেরাও সিলেট এলাকায় হিন্দুদের জমি পত্তনি দিয়েছেন। ঐসব প্রশাসনে হিন্দুদের কখনোই বৈষম্যের শিকার হতে দেখা যায়নি।

হজরত শাহজালালের মতো যে সুফি সাধকেরা আরব বিশ্ব থেকে শান্তি প্রচারে পূর্ববঙ্গে এসেছিলেন; তারা ভালোবাসার বার্তা দিয়েছেন। তাই তো শাহজালালের মাজারে হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের মানুষ শ্রদ্ধা জানাতে যায়। পূর্ববঙ্গের কৃষকেরা স্ব স্ব ধর্ম পালন করলেও কৃষিকাজই ছিল তাদের প্রধান ধর্ম। মানুষের জন্য খাদ্য উৎপাদনের চেয়ে বড় ধর্ম আর কিছু কি হতে পারে!

বৃটিশেরা জনগণের ঐক্যকে ভয় পেত বলে; ডিভাইড এন্ড রুল বাস্তবায়ন করতে কৃষকদের জমিহারা করে কিছু সহমত লোককে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মাধ্যমে জমিদার করে তোলে। সচ্ছল কৃষক-জেলে-কারিগরেরা দরিদ্র হতে থাকে।
এ কারণেই শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকের কৃষক অধিকার আন্দোলন পূর্ববঙ্গের রাজনীতির পাটাতন তৈরি করে। কংগ্রেসের অভ্যন্তরে সক্রিয় হিন্দুত্ববাদের কাউন্টার হেজিমনি হিসেবে মুসলিম লীগ গড়ে উঠলেও; তা ছিলো অবস্থাপন্নদের রাজনীতি। কিন্তু কৃষক প্রজা আন্দোলনে ধর্ম বিভাজনের কোন জায়গা ছিল না। শেরে বাংলার রাজনীতি তাই ধর্ম নিরপেক্ষ চিন্তার সূতিকাগার বললে ভুল হবে না। কারণ কৃষকের জীবন ধর্ম হচ্ছে কৃষকতা।

বৃটিশ তাঁবেদার জমিদারদের শোষণে হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে বিক্ষুব্ধ হয়ে পূর্ববঙ্গের স্বাধীনতা আন্দোলন গড়ে তোলে। পূর্ববঙ্গের শোষক জমিদারেরা পশ্চিমবঙ্গের কলকাতায় সেকেন্ড হোম গড়ে তোলে। তারা পূর্ববঙ্গ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ভারতের থাকতেই স্বচ্ছন্দ বোধ করে। পশ্চিমবঙ্গকে সঙ্গে না পাওয়ার পরেও পূর্ববঙ্গের হিন্দুরা স্বাধীনতার প্রশ্নে নিরাপোষ ছিল। তারাই মুসলিম লীগকে ভোট দিয়ে পাকিস্তান তৈরির ম্যান্ডেট উপহার দেয়।

নেহেরু কিংবা জিন্নাহ; এদের কারোরই আপত্তি ছিল না; পূর্ববঙ্গ ও পশ্চিমবঙ্গ মিলিয়ে একটি স্বাধীন দেশ হলে। বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী ও ভারতের রাজনীতিক জশওয়ান্ত সিং-এর "জিন্নাঃ ইন্ডিয়া পার্টিশন" গ্রন্থে আমরা এই সত্যের উচ্চারণ দেখি। কংগ্রেসের কিছু নেতা "কলকাতাটা আমাদের চাই"; আর সেকেন্ড হোম গড়া পূর্ববঙ্গের জমিদারদের অনিচ্ছায়; স্বাধীন অবিভক্ত বঙ্গ সম্ভব হয়নি। কিন্তু ইচ্ছেমতো ইতিহাসের ন্যারেটিভ তৈরি করে; পূর্ববঙ্গের পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্ত হবার জন্য "দ্বিজাতি তত্ত্ব"-কে দায়ী করা হয়।

আজকের যে পাকিস্তান; সেখানে কোথাও মুসলিম লীগ স্পষ্ট ম্যান্ডেট পায়নি পাকিস্তান গড়ার। এই ম্যান্ডেট পূর্ববঙ্গের উপহার। পূর্ববঙ্গে মুসলিম লীগকে শুধু মুসলমানরা ভোট দিলে পাকিস্তান গড়ার ম্যান্ডেট তৈরি হতো না। পূর্ববঙ্গের হিন্দুরাই এই স্পষ্ট ম্যান্ডেটের কারিগর।

কাজেই পূর্ববঙ্গে তাদের অধিকার সূর্যালোকের মতো উজ্জ্বল। বৃটিশ স্তাবক জমিদার শ্রেণিকে হিন্দুদের প্রতিনিধিত্বশীল করে তোলে ধরে ইচ্ছামত ইতিহাস লিখে "হিন্দু মানেই ভারত ভক্ত" এই অশ্লীল ন্যারেটিভ তৈরি একটি ঘৃণ্য মানসিকতা।

প্রত্যেকটা স্বাধীনতাই তস্কর ও লুন্ঠক শ্রেণির আঙুল ফুলে কলাগাছ হবার সুযোগ। ফলে স্বাধীন পাকিস্তানের হিন্দুদের ওপর চড়াও হয়ে মুসলমানদের একটি অংশ যে অনৈতিক কাজ করেছে; তার ঋণ প্রজন্মের পর প্রজন্ম শোধ করতে হচ্ছে।

পাকিস্তানের বৈষম্য ও শোষণের বিরুদ্ধে লড়াই করে বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পেছনে হিন্দুদের অনেক রক্ত ও ত্যাগ থাকার পরেও স্বাধীন বাংলাদেশে কথায় কথায় "ভারত চইলা যা" বলার যে অশুভ তৎপরতা তা আজো আমাদের অসুখী রয়ে যাবার কারণ। ১৯৪৭ এর পর হিন্দু সম্পত্তি দখল ও ১৯৭১ এর পর অবাঙালি সম্পত্তি দখল; এইভাবে ঢাকায় যে স্যুডো এলিট গড়ে উঠেছে; পাকিস্তান আমল ও বাংলাদেশ আমলে ক্ষমতাসীন সরকারকে তেলাঞ্জলি দিয়ে গণশত্রুদের ঢাকায় একটি প্লট জোগাড়; এইভাবে যে মহানগরী গড়ে উঠেছে; তা অভিশপ্ত হতে বাধ্য। একারণেই ঢাকা ভালোবাসার শহর থেকে ধীরে ধীরে মৃত্যুর শহরে রূপান্তরিত হয়েছে।

বৃটিশ আমলের হিন্দু শোষক জমিদার হিন্দুদের প্রতিনিধিত্বশীল নয়; পাকিস্তান আমলের শোষক মুসলিম জমিদার মুসলমানদের প্রতিনিধিত্বশীল নয়। কাজেই পালা করে হিন্দুদের ভারত চলে যেতে বলা ও মুসলমানদের পাকিস্তান চলে যেতে বলা'র উদ্ধত যে ডাকাতেরা রয়েছে; তাদের স্মরণ করিয়ে দেয়া উচিত এই দেশ কারো বাবার নয়। এই দেশ প্রতিটি মানুষের।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যে ধর্মনিরপেক্ষতার পাটাতনে বাংলাদেশ স্বাধীন করার অঙ্গীকার করেছিলেন; তা আসলে শেরে বাংলা, মওলানা ভাসানী ও সোহরাওয়ার্দীর অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ ও দেশচিন্তার ধারাবাহিকতা। এই ধর্মনিরপেক্ষতা ধর্মহীনতা নয়; যে যার ধর্ম পালন; এর মাঝ দিয়ে সম্প্রীতিময় এক কল্যাণ রাষ্ট্র গড়ে তোলাই বাংলাদেশ চিন্তার গোড়ার কথা।

মাসকাওয়াথ আহসান, সাংবাদিক, সাংবাদিকতা শিক্ষক

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪২ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬৩ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০৩ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩১ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯০ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৬ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ