আজ রবিবার, ১৩ জুলাই, ২০২৫

Advertise

সাদী মহম্মদ: শেষ পারানির কড়ি কণ্ঠে নিলে

মাসকাওয়াথ আহসান  

ঔপন্যাসিক আর্নেস্ট হেমিংওয়ে একজন অত্যন্ত প্রাণবন্ত মানুষ ছিলেন। সাহিত্য আড্ডাগুলোকে জমিয়ে রাখতেন সেন্স হিউমারের জাদুতে। তিনি আত্মহত্যার বিরুদ্ধেও লিখেছেন। কিন্তু রাতে ঘুমের মধ্যে যুদ্ধের স্মৃতি এসে তাকে এলোমেলো করে দিতো। তার দ্য সান অলসো রাইজেস উপন্যাসের নায়ক জাক বার্নসের মাথার মধ্যে কির কির শব্দ হতো। পোস্ট ট্রমাটিক স্টেস ডিজ অর্ডার যুদ্ধফেরত সৈনিকদের নিয়তি। আর্নেস্ট হেমিংওয়ে সবাইকে অবাক করে দিয়ে আত্মহত্যা করেছিলেন। কিন্তু সৌভাগ্যবান তিনি; সমানুভূতিসম্পন্ন সমাজে জন্ম নিয়েছিলেন। ফলে তার আত্মহত্যার পরে সবাই তার সংগুপ্ত বেদনা অনুভব করতে পেরেছিল। তার মৃত্যুতে প্যারিসের সাহিত্য জগতের মানুষেরা তার লিখে যাওয়া উপন্যাস থেকে পাঠ করে বিদায় জানিয়েছিল। ঔপন্যাসিক তিনি। তার বিদায়ে সাহিত্যপাঠই যোগ্য শেষকৃত্য। সৌভাগ্যবান তিনি, অর্থোডক্স চার্চের লোকেরা এসে বলেনি, বাইবেল থেকে পাঠ না করে উপন্যাস থেকে পাঠ কেন! এ কেমন খ্রিস্টান! এই যে অশালীন কথা বলার যুগ; তাকে ইউরোপ মধ্যযুগে ফেলে এসেছিল। বিংশ শতকে তাই চার্চের মাতবরি ছিল না মানুষের ব্যক্তিজীবনে।

এমনকি সেই তুরস্কের কনিয়েতে কবি জালালুদ্দিন রুমীর মৃত্যুতে তার অনুসারীরা; রুমীর গীতিকবিতা গেয়ে সেই দুই বাহু উপরে তুলে ঘূর্ণায়মান দরবেশের নৃত্য করেছিল। পাকিস্তানের সুফি কবি বুল্লেহ শাহ'র মৃত্যুর পর তার অসাম্প্রদায়িক আহবানের গান গেয়ে পাঞ্জাবের মানুষেরা বিদায় জানিয়েছিল। সিন্ধু প্রদেশের সুফি কবি শাহ আবদুল লতিফ ভিটাইয়ের মৃত্যুতে তার ভক্তরা ধামাল নৃত্য নেচেছিল। এই ধামাল নৃত্য পাকিস্তানে আজো ঐতিহ্যসঞ্জাত সংস্কৃতি।

কবি আমির খসরুর মৃত্যুতে হিন্দুস্তানি রাগসংগীতের আসর বসেছিল। মির্জা গালিবের মৃত্যুতে তার গজল গেয়ে বিদায় জানানো হয়েছিল। দবির ও ছাবেতের মৃত্যুর সঙ্গে হেমিং ওয়ে, রুমী, বুল্লেহ শাহ, লতিফ ভিটাই, আমির খসরু, গালিবের মৃত্যুর পার্থক্য আছে।

দবির আর ছাবেত এই পৃথিবীতে এসেছে খেয়ে-প্রাতঃক্রিয়া করে-সন্তান উৎপাদন করে আর কুচুটেপনা করে মরে যেতে। এই মৃত্যু একটি পিঁপড়ের মৃত্যুর চেয়েও কম গুরুত্বপূর্ণ। কারণ পৃথিবীতে দবির ও ছাবেত কেবল কুচুটেপনা আর গায়ে মানে না আপনি মোড়লের পোদ্দারি ছাড়া আর কোন দাগ রেখে যায়নি।

ফলে দবির ও ছাবেতের পক্ষে এটা বোঝা প্রায় অসম্ভব; সাদী মহম্মদ কে ছিলেন! কেন তার মৃত্যুতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম জুড়ে শোকের ছায়া! বাংলাদেশে রবীন্দ্র সংগীত শিল্পী হিসেবে যে কজন মানুষ লাখো শ্রোতার হৃদয় জয় করেছেন; সাদী সেই বিরলপ্রজদের একজন।

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তার চোখের সামনে তার পিতাকে নৃশংসভাবে হত্যা করেছিল পাকিস্তানি খুনে সেনারা। পিতৃহারা সাদীর মাঝে কোন প্রতিশোধ স্পৃহা ছিল না; কারণ তিনি মানুষ হিসেবে ছিলেন ভালোবাসার ও মায়ার একজন। তার জীবনাচরণ ছিল সংগীত সাধনার; যাপিত জীবনে রবীন্দ্র সংগীতের সত্য সুন্দর ও মঙ্গলের বাণীগুলো চর্চা করতেন। তিনি অন্য গো গেটার সেলিব্রেটি শিল্পীদের মতো রবীন্দ্র চেতনার লিপ সার্ভিস দিতেন না। শৈশবে বাবা হারানোর স্মৃতি এসে মাথার মধ্যে কষ্টের গোলক পাকালে তিনি রবীন্দ্র সংগীতে আশ্রয় নিতেন। শোককে তিনি সুরের শক্তিতে রূপান্তর করেছিলেন।

বিসিএস তথ্য ক্যাডারের কর্মকর্তা হিসেবে সাড়ে ছয় বছর জাতীয় বেতার ভবনে দায়িত্ব পালনকালে তিনি ছিলেন আমাদের নিয়মিত অতিথি। তিনি নিঃশব্দে আসতেন; দেখা হলে গল্প করতেন; তারপর গান রেকর্ড করে ফিরে যেতেন। তার জীবন চর্যাটি অনুসরণ করলে এটা শেখা যায়; মানুষ যত খ্যাতিমান হয়; ততো তাকে বিনয়ী হতে হয়। উনার মাঝে যে অপরিমেয় প্রাণপ্রবাহ ছিল; তা দেখে আর্নেস্ট হেমিংওয়ের কথাই যেন মনে পড়ে যায়। যিনি আমার ডেস্কের সামনে বসে জীবনের রূপ-রস-গন্ধ আস্বাদ করে আনন্দযজ্ঞে আমন্ত্রণ জানাতেন; বিশেষ অনুষ্ঠানের সংগীত রেকর্ডিং-এর পর শোনার সময় বার বার আমার দিকে তাকাতেন! কারণ উনার কাছে শ্রোতা ছিলেন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। অনেকসময় তাকে রিকশায় তুলে দিয়ে অফিসে ফিরতাম।

এরপর প্রায় দুই দশক পেরিয়েছে। একবিংশের ঢাকা মোহরের ঝনঝনানিতে; ফাঁপা প্রদর্শনবাদিতায়, সংগীতের নামে অসুরের দাপাদাপিতে ভরে গেছে। পদ পদবি পদকের জন্য পড়িমরি করে দৌড়ে বেড়ানো মিডিক্রেসির কোলাহলে; এ শহর সাদীর মতো সাবস্ট্যান্সসম্পন্ন সাধকের বসবাসের অনুপযুক্ত হয়ে গিয়েছিল। শহীদ-পরিবারের ছেলে বলে মিডিয়ায় কক্ষনো সেন্স অফ এনটাইটেলমেন্ট ছিল না তার। কারণ তার অনন্য গায়কী; গাঢ় কণ্ঠ, সুরের ওপর দখল, বাণীর সঙ্গে বন্ধুত্ব আপনা হতেই একটা এনটাইটেলমেন্ট তৈরি করেছিল কোটি শ্রোতার হৃদয়ে।

তিনি মুক্তিযুদ্ধের চেতনার লিপ সার্ভিস দেবার লোক ছিলেন না; এই চেতনা তার বুকের গভীরে বসবাস করতো। তাই তো নিজেকে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্বশীল উজ্জ্বল গায়ক হিসেবে গড়ে তোলার সাধনা করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু স্মরণে তার গাওয়া "সেদিন আকাশে শ্রাবণের মেঘ ছিল" অন্যতম শ্রেষ্ঠ এক সংগীত; কারণ সেখানে শিল্পীর গভীর অনুভব ছিল। তিনি বঙ্গবন্ধুকে হারানোর বেদনা থেকে উচ্চারণ করেছেন প্রতিটি শব্দ।

তিনি তেলাঞ্জলির আসরে যাবার মতো খর্ব মানুষ ছিলেন না; মানুষ হিসেবে তার উচ্চতা ছিল স্থূল সৌন্দর্য ধারকদের চেয়ে অনেক বেশি।

"ওমা তোমার কোলে জনম আমার মরণ তোমার বুকে
তোমার পরে খেলা আমার দুঃখে সুখে।
তুমি অন্ন মুখে তুলে; তুমি শীতল জলে জুড়াইলে."..
সাদী মুহাম্মদ চলে অনন্তলোকে চলে যাবার পর তার কণ্ঠে শুনছিলাম,
"ওমা অনেক তোমার খেয়েছি গো অনেক নিয়েছি মা
তবু জানিনে যে কীইবা দিয়েছি গো মা
আমার জনম গেলো বৃথা কাজে
আমি কাটানু দিন ঘরের মাঝে
তুমি বৃথা আমায় শক্তি দিলে শক্তিদাতা
ও আমার দেশের মাটি তোমার পরে ঠেকাই মাথা।"

পৃথিবীর প্রতিটি সম্পূর্ণ মানুষের মধ্যে এই অতৃপ্তি থাকে; কী করা গেল-গেল না; তা নিয়ে আত্মদহন থাকে। মৃত্যুর আগের এক ইন্টারভিউতে তিনি বলছেন, গানের অর্থ যত বুঝেছি; তত গাইবার আত্মবিশ্বাস হারিয়েছি যেন। মহৎ শিল্পীর এই যে পারফেকশনের আকাঙ্ক্ষা; অনেককে শুধু এই নিজেকে অতিক্রম করতে না পারার কষ্ট পোড়ায়। যখন অন্য কারো সঙ্গে তার আর প্রতিদ্বন্দ্বিতা থাকে না।

আমাদের এই গজদন্তের মিনারে বসে থাকা অতি আত্মবিশ্বাসী উপমানবদের পক্ষে এটা বোঝা অসম্ভব; চিত্রকর ভ্যান গগ কেন আত্মঘাতী হয়েছিলেন। চারপাশের খেলনা মানুষ যখন একজন সৃজনশীল মানুষকে বুঝতে পারে না; তখন সেই স্থবির শহরের জনারণ্যে একা মানুষটির অন্যলোকে চলে যাওয়াই যেন শ্রেয়তর। যেখানে শিল্প-সংগীতের অন্য মায়েস্ত্রোরা অপেক্ষা করছেন তার জন্য।

বিদায় সাদী ভাই!

মাসকাওয়াথ আহসান, সাংবাদিক, সাংবাদিকতা শিক্ষক

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অধ্যাপক ডা. শেখ মো. নাজমুল হাসান ২৭ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৮ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪৭ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৫ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬৪ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৮ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১১০ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪৫ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩২ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪৩ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯৪ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ২৭ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ শাখাওয়াত লিটন