প্রধান সম্পাদক : কবির য়াহমদ
সহকারী সম্পাদক : নন্দলাল গোপ
টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
Advertise
এনামুল হক এনাম | ২৩ এপ্রিল, ২০২৪
আওয়ামী শাসনামলে বিগত প্রায় একযুগেরও বেশি সময়ে দেশের ছাত্ররাজনীতিতে বড় ধরনের নৈতিক স্খলন হয়েছে। আমার সাথে অনেকেই বক্তব্যটি নিয়ে দ্বিমত করতে পারেন, যারা দ্বিমত পোষণ করেন আমি তাদের সম্মান করি, এবং ছাত্ররাজনীতিতে যদি নৈতিক শুদ্ধতা বা সততার অবস্থানের কথা বলেন তবে আমি বলবো এ সংখ্যা নিতান্তই নগণ্য এবং তাদের আপনি ব্যতিক্রম হিসেবে তাদের “সম্পদ” মনে করুন। তবে সবসময়ই স্মরণ রাখা প্রয়োজন, ব্যতিক্রম কখনোই উদাহরণ নয়।
ছাত্ররাজনীতি নিয়ে কলামের শুরুতেই আমি আওয়ামী শাসনামল তথা আওয়ামী লীগের কথা উল্লেখ করেছি। আমি মনে করি বর্তমান ছাত্ররাজনীতির এহেন “দশা”র দায়ভার দীর্ঘ সময়ে ক্ষমতায় থাকা দেশের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দল, “আওয়ামী লীগ” এর উপরই বর্তায়। বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে আদতে ক্ষমতাসীন দলের নৌকায় উঠে নগরের রাজপথ থেকে মফস্বলের বাজার সবই দখল করে ক্ষমতা প্রদর্শন, নিজেকে জাহির, রাজনৈতিক ক্ষমতাবলে টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি সবই চলছে মহাসমারোহে। এই বিষয়টি বুঝতে আপনাকে কোন গবেষণা করতে হবে না, শুধু মাত্র বাসা থেকে বের হয়ে আশপাশের এলাকা ঘুরে আসুন, দেখবেন তথা কথিত ছাত্রনেতার ব্যানার পোস্টার রঙ্গিন সুসজ্জিত নগর। এখানে কিছু প্রশ্ন যুক্তি সংগত ভাবে এসেই যায়। যেমন, ১৮/২০ বছরে সদ্য কৈশোর পেরোনো তরুণের নিজেকে জাহির করার প্রয়োজন পড়লো কেন!! কেনই বা সে জাতীয় নেতাদের ছবি সম্বলিত ব্যানারে নিজের ছবি যুক্ত করে প্রছন্ন ভাবে এলাকা ভিত্তিক প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করবে!! কেনই বা সে স্থানীয় কোন নেতার আজ্ঞাবাহী হয়ে রাস্তায় মিছিল দেবে, কিংবা মাস্তানি করবে!!
পুরো শহর জুড়ে ঈদ শুভেচ্ছা দিয়ে এক ছাত্রনেতার বিশাল ছবি চোখে পড়লো, স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে, এতো ব্যানার তৈরির টাকার সংস্থান কোথায় থেকে হল? তর্কের খাতিরে ধরেই নিলাম, ঐ ছাত্রনেতার পরিবার ধনী, তার ইচ্ছা জেগেছে নিজেকে শহরে প্রতিষ্ঠিত ছাত্রনেতা হিসেবে জাহির করতে, কিন্তু আত্ম প্রচারের এই ধরণের প্রতিযোগিতা যে এক ধরনের মানসিক অসুস্থতা। তাছাড়া ঐ ছেলেটি কি পরিবারের কেউ নেই, যার লজ্জা হয় এহেন কার্যক্রমে। নাকি ছেলের এই অসুস্থ উত্থানে তারা গর্বিত।
অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, নগরের অনেক ছাত্রনেতার সাথে লেখাপড়ার আদৌ কোন সম্পর্ক পর্যন্ত নেই, অনেক নেতার ছাত্রত্ব নেই, অনেকে ছাত্ররাজনীতি করতে হবে বলে কোন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নাম লিখিয়েছেন। লেজুড় ভিত্তিক রাজনীতির কারণে আজকাল ছাত্ররাজনীতি হয়ে গেছে দলীয় আজ্ঞাবাহী প্রতিষ্ঠান। শেষ বার কবে দেখেছেন কোন ছাত্র সংগঠন ছাত্রছাত্রীদের অধিকার আদায়ের জন্য দাবী তুলেছে!! বই, খাতা কলমের দাম কমানোর জন্য রাজপথে মিছিল করেছে!!
অথচ উলটো দেখেছি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অরাজনৈতিক সংগঠন ছাত্রছাত্রীদের দাবী আদায়ে সোচ্চার হতে, নিজেরা অর্থ সাহায্য তুলে অসুস্থ ছাত্রছাত্রীদের চিকিৎসা সেবায় পাশে দাড়াতে, ব্লাড ব্যাংক গড়ে তুলতে, স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন তৈরি করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, এলাকাভিত্তিক পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা অভিযান চালাতে, বৃক্ষ রোপণ করতে। যতই যাই বলেন না কেন, দলীয় আজ্ঞাবাহী সকল ছাত্রসংগঠনই নিজের দলের স্বার্থের বাইরে গিয়ে সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের পাশে দাঁড়ায় না, দাঁড়ালে তা ঐ ব্যতিক্রমেরই অংশ।
একজন ছাত্রনেতার কেন প্রয়োজন পড়বে নিজের গাঁটের টাকা খরচ করে এয়ারপোর্ট থেকে গাড়ি, মোটরসাইকেলের বহর নিয়ে শহরে প্রবেশ করবে? এই টাকার উৎস কি? অনুগ্রহ করে বলবেন না, সাধারণ কর্মীরা নিজের পকেটের টাকা খরচ করে কারও শোভাযাত্রায় অংশ নেবে। ছাত্র হিসেবে এই ধরণের গাড়ির বহর নিয়ে ট্রাফিক জ্যামে নাকাল নগরের মানুষের নাভিশ্বাস তুলে হাস্যকর রাজনৈতিক চর্চায় ন্যূনতম লজ্জাবোধ নেই এদের!!!
আরেকটা বিষয় খেয়াল করলে দেখবেন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মারামারি এবং হত্যাকাণ্ডের মহান দায়িত্ব নিয়ে বসে আছে ছাত্র সংগঠনগুলো। প্রভাব বিস্তার, ভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শ দমন এইসব হত্যাকাণ্ডের মূল কারণ। পিতামাতা একটি ছেলেকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রেরণ করেন ছেলে উচ্চশিক্ষায় দীক্ষিত হয়ে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার জন্য। লাশ হয়ে বাড়ি ফেরার জন্য নয়। শত শত পিতার কাঁধে সন্তানের ভারবাহী লাশের পেছনে বিকৃত এই ছাত্ররাজনীতিই জড়িত। একবার হিসেব করে দেখুন, জাতীয় নেতা এমনকি স্থানীয় নেতাদের সন্তান কয়জন পাবেন যাদের সন্তান ছাত্ররাজনীতিতে জড়িত কিংবা আদৌ দেশের কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়ে!!
ছাত্ররাজনীতির সবচেয়ে মেধাবী মানুষরা এদেশে জন্ম নিয়েছেন ষাটের দশকে। রাজনৈতিক ভিন্নমত, ভিন্ন সংগঠন ঐ সময়ে সুন্দর সহবস্থানে নিজেদের মত প্রকাশ করতো, রাজনৈতিক চর্চা করতো। বাংলাদেশের জাতীয় রাজনীতির উজ্জ্বল মেধাবী মুখগুলো আদতে ষাটের দশকেরই প্রোডাক্ট। যারা আপাদমস্তক অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির চর্চা করতেন, মুক্তচিন্তা করতেন। দেশ ও জাতি নিয়ে ভাবতেন। রাজনীতির এই সুদিন মূলত হারাতে শুরু করে স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে ভিন্ন মতকে দমন আর প্রভাব বিস্তারের চর্চায়। দেশের রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের সবচেয়ে বড় ঘটনা ঘটে ১৯৭৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ৭ টি ছাত্রের লাশ দিয়ে। ইতিহাসে আজও যা আলোচিত সেভেন মার্ডার মার্ডার নামে পরিচিত। ছাত্রনেতা শফিউল আলম প্রধান সিগারেটে আগুন ধরিয়ে ঠাণ্ডা মাথায় পুরো হত্যাকাণ্ডের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। গুলি করে ৭জন ছাত্রকে হত্যা করা হয়েছিল যাদের অধিকাংশের মাথা ছিল গুলির মূল লক্ষ্য বিন্দু। পুরো মিশন শেষ করে ধীরে সুস্থে হেটে হেটে বের হয়ে যান প্রধান এবং তার সহযোগীরা। এখানে উল্লেখ্য, যারা নিহত হয়েছিল, এবং যারা হত্যা করেছিল, সবাই একই ছাত্র সংগঠনের কর্মী বা নেতা ছিলেন।
বঙ্গবন্ধু হত্যা, সামরিক শাসন, এতো কিছুর পরও আমরা নব্বুইয়ের গণ অভ্যুত্থানে গণতন্ত্রের দাবীতে আমরা প্রচুর মেধাবী আর চৌকশ ছাত্রনেতা পেয়েছি। ঘাত প্রতিঘাত, প্রতিহিংসা যতই থাকুক, আমার নিজের চোখের দেখা ছাত্ররাজনীতির মেধাবী সুসময় ছিল আশি থেকে শুরু করে নব্বুইয়ের দশক। এই সময়ে দলমত নির্বিশেষে সব ছাত্র নেতাদের মাঝে একটি সৌহার্দ্য কাজ করতো। ছাত্রনেতারা নিজেদের যোগ্যতায় আলোকিত হতেন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এমন কি এলাকায়ও পরিচিত হতেন সম্মানের সহিত। আজকালের মত নিজেদের নাম ছবি ব্যানার পোস্টারে ছাপিয়ে নিজেদের জাহির করতেন না। ছাত্রনেতারা স্থানীয় বা জাতীয় বড় নেতাদের নির্লজ্জ পদলেহনও করতেন না। পা চাটা ছাত্ররাজনীতির সবচেয়ে খারাপ সংস্কৃতি শুরু হয়েছে ২০০৯/১০ সালের পরবর্তী সময়ে। ব্যক্তিপুজায় মগ্ন, কোন যোগ্যতা ছাড়া ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের পা চেটে পদ বাগিয়ে নিয়ে প্রভাব বিস্তার করা, চাঁদাবাজি টেন্ডারবাজি করা তথাকথিত ছাত্রনেতাদের পেশায় পরিণত হয়েছে। দল বা দেশের প্রতি ন্যূনতম কমিটমেন্ট নেই এইসব ব্যক্তিবর্গের, ছাত্রছাত্রীদের স্বার্থের দাবীতে সোচ্চারের কথা বাদই দিলাম। জয়জয়কার চলছে সেইসব নেতাদের, যারা দলীয় প্রধানের সবচেয়ে কাছের লোক, রাজনৈতিক যোগ্যতা থাকুক আর নাই থাকুক।
নিয়মিত হত্যাকাণ্ডের পাশাপাশি খোদ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সীমানায় ধর্ষণ, মাদক এইসব খবর পত্রিকার পাতায় নিয়মিত। কোন ছাত্র সংগঠন কখন, কোথায় এইসব অনাচারের বিরুদ্ধে রাজপথে মিছিল করেছে? সোচ্চার হয়েছে? প্রগতিশীল ছাত্রনেতা আজ কারা? ছাত্রছাত্রীদের স্বার্থ, দেশ ও জাতিকে নিয়ে ভাবনা বাদ দিয়ে ছাত্ররাজনীতি আজ অনেকের কাছে পেশা। বছরের পর বছরের তারা ছাত্রত্বের তকমা লাগিয়ে নিজেদের পকেট ভারি করার রাজনীতি করেন। ছাত্ররাজনীতি করে যদি প্রতিষ্ঠিত হওয়া যায় তবে লেখাপড়ার কি দরকার!!
প্রয়াত একজন সম্মানিত অর্থমন্ত্রী গভীর রাতে একটি অনুষ্ঠানে অংশ গ্রহণ করে বক্তৃতা দিচ্ছিলেন, একটি ছাত্র সংগঠন বার বার উনার নামে স্লোগান দিয়ে পুরো অনুষ্ঠান গরম করেছিল। ব্যাপারটায় তিনি বিরক্ত হয়ে জিজ্ঞেস করেছিলেন, তোমরা কারা? যখন জানলেন তারা ছাত্র সংগঠনের কর্মী, তখন তিনি ক্ষোভ নিয়ে বেলেছিলেন, রাতে এই সময়ে বাসায় ফিরবে, বই নিয়ে লেখাপড়া করবে, এতো রাতে এখানে এসে স্লোগান দিচ্ছো কেন!! তোমরা কেমন ছাত্র!!! সৌভাগ্যবশত ঐ অনুষ্ঠানে আমি উপস্থিত ছিলাম। ভেবে দেখুন তো, ছাত্রদের নিয়ে এতো চমৎকার চিন্তা কয়জন নেতা করেন!! কি অদ্ভুত এক অপসংস্কৃতিতে জড়িয়ে গেল আমাদের গর্বের ছাত্ররাজনীতি!!!
বিগতকালের ছাত্ররাজনীতিতে অংশ নেয়া কর্মী, ছাত্র নেতারা প্রচুর বই পড়তেন, ইতিহাস, দর্শন, বহির্বিশ্বের রাজনীতি সবই ছিল তাদের নখরদর্পে। নিয়মিত সেইসব ছাত্রনেতা দৈনিক পত্রিকায় কলামও লিখতেন দেশ এমনকি বহির্বিশ্বের বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে। মেধাবী সেই সব ছাত্রনেতারাই কালক্রমে দেশের নেতৃত্ব স্থানীয় হয়েছেন, কঠিন সময়ে দেশ ও জাতিকে আলো দেখিয়েছেন। বর্তমানের মেধাশূন্য ছাত্ররাজনীতি আগামীর বাংলাদেশকে কি উপহার দেবে তা ভেবে শংকিত হই।
আপনারা যারা সিনিয়র নেতারা আছেন, নেতৃত্বে আছেন, তারা বর্তমান ধারায় চলা ছাত্ররাজনীতি নিয়ে একটু ভাবেন অনুগ্রহ করে। আপনারা তো আজ হোক কাল হোক রাজনীতি থেকে অবসর নেবেন, নীতি নৈতিকতা বিহীন বিকৃত অসুস্থ মানসিকতার একটি রাজনৈতিক প্রজন্ম রেখে যাচ্ছেন, তারা কখনোই দেশ ও জাতীর জন্য সুফল বয়ে আনবে না।
একটি সত্য ঘটনা দিয়ে কলামটি শেষ করি। বছর কয়েক আগের কথা। পারিবারিক চাপে একটি বিয়ের আলাপে অংশ নিতে হয়েছিল। আমি ছিলাম মেয়ে পক্ষের। দেখাদেখির এক পর্যায়ে ছেলের বাড়িতে আমরা দাওয়াত খেতে গেলাম। আনুষ্ঠানিকতার এক পর্যায়ে ছেলের সাথে কথা হল। আমার প্রথম প্রশ্নই ছিল, আপনি কি করছেন এখন? ছেলে গর্ব করে বললো, ছাত্র”!!!” করি, “অমুক” গ্রুপ। পাশে বসা ছেলের বাবা খুশি খুশি ভঙ্গিতে বলে উঠলেন, আপনারা পাড়ার মোড়ে দেখেননি, “অমুক” ভাইয়ের বড় ব্যানারে আমার ছেলের ছবি!!
মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।
আপনার মন্তব্য