প্রধান সম্পাদক : কবির য়াহমদ
সহকারী সম্পাদক : নন্দলাল গোপ
টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
Advertise
জুয়েল রাজ | ২৮ এপ্রিল, ২০২৪
গাজা এবং ইসরায়েল ইস্যুতে, গাজায় ইসরায়েলের হামলা ও মানবাধিকার লঙ্ঘন নিয়ে বিশ্বমানবতা যখন এক কাতারে দাঁড়িয়ে ফিলিস্তিনের সাধারণ মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে, পৃথিবীর নানা প্রান্তে মানুষ প্রতিবাদ জানাচ্ছে ঠিক তখন হঠাৎ দেখি বাংলাদেশে বিকল্প হিসাবে ইন্ডিয়া বয়কট নামে একটি গোষ্ঠী সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সরব হয়ে উঠেছেন।
প্রথম কয়েকদিন বুঝতে একটু সময় লেগেছে। হঠাৎ করে ইন্ডিয়া বয়কট! ইন্ডিয়া বয়কট বিষয়টা আসলে কী? সেই হিসাবটা মেলাতে পারছিলাম না। এবং কারা সেই বিষয়টা নিয়ে সরব হয়েছেন বাংলাদেশ ভারত সম্পর্কের অবনতি, কী নিয়ে? একটু খোঁজ নিতে চাইলাম।
মানুষ হোক কিংবা পণ্য হোক অথবা রাষ্ট্র হোক যে কেউ চাইলে বয়কট করতেই পারে। ব্যক্তিগত জীবনে ও আমরা বহু মানুষকে নানাভাবেই বয়কট করি, সেটা একেবারেই স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। কিন্তু প্রসঙ্গ যখন দুইটি রাষ্ট্র, এবং প্রতিবেশী রাষ্ট্র, বাকি হিসাব নিকাশ না হয় নাই টানলাম, সেখানে তর্ক বিতর্ক, কৃতজ্ঞ অথবা কৃতঘ্ন ইত্যাদি আলোচনা চলে আসে। বয়কট ইসরায়েল যেভাবে আমরা হাজার মাইল দূরে বসে করতে পারি তত সহজে বয়কট ইন্ডিয়া করা যায় না।
প্রতিবেশী রাষ্ট্র হিসাবে ভারতের সাথে বাংলাদেশের টানাপড়েনের সম্পর্ক আছে নানা ইস্যুতে। কিছু মীমাংসিত কিছু বিষয় এখনো অমীমাংসিত রয়ে গেছে। যা নিয়ে বারবারই আলোচনা হয়ে আসছে। বিশেষ করে সীমান্তে হত্যা ও তিস্তা হিস্যা সবচেয়ে বেশি আলোচিত।কিন্তু তা কোন অবস্থায়ই ভারতকে বয়কট করার মত অবস্থায় নয়। অতীতে আমরা দেখেছি আন্তর্জাতিক আদালতের মাধ্যমে বাংলাদেশ ভারতের সাথে সমুদ্রসীমা নির্ধারণ করে সেখানে নিজেদের দখল নিয়েছে।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যারা এই বয়কট তত্ত্বের জন্ম দিয়েছেন তাদের সম্পর্কে এক ধরণের ধারণা আছে সাধারণ মানুষের। উনারা কেউ অস্ট্রেলিয়া কেউ ফ্রান্স বসে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তা প্রচার শুরু করেন। কিন্তু বাংলাদেশের আভ্যন্তরীণ বাস্তবতা পুরোটাই ভিন্ন। চলতি সপ্তাহেই একটি সংবাদ দেখলাম তিনদিনে ভারত থেকে দেশে ফিরেছেন পনের হাজার পর্যটক। বাংলাদেশে ভারতীয় দূতাবাসে ভিসার জন্য লাইন দেখলে পিলে চমকে যাওয়ার মত অবস্থা। ভিসা দিতে দেরি হওয়ার কারণে, কম দিনের ভিসা দেয়ার কারণে মানুষ বরং ইন্ডিয়াকে উল্টো গালাগাল দিচ্ছে। এই রকম পরিস্থিতিতে আসলে এই ইন্ডিয়া বয়কট মুভমেন্ট কতোটা বাস্তবসম্মত। অথবা ভারতের বিকল্প হিসাবে আমাদের সামনে আর কোন দরজা খোলা আছে?
ইন্ডিয়া বয়কট হলে কী লাভ, কী ক্ষতি? ইন্ডিয়া বয়কট এই মুভমেন্টের মূল কথা হচ্ছে যাবতীয় ইন্ডিয়ান পণ্য বর্জন। যাতে করে দেশের রপ্তানি বাণিজ্যে ভাটা পড়ে এবং আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ২০২৩ সালের একটি প্রতিবেদনে, বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২১-২২ অর্থবছরে ৮ হাজার ৯১৬ কোটি মার্কিন ডলারের পণ্য আমদানি করেছে বাংলাদেশ। এর মধ্যে ১ হাজার ৩৬৯ কোটি ডলারের পণ্য আমদানি করা হয় ভারত থেকে। সেই অর্থবছরে বাংলাদেশ ভারতে রপ্তানি করে ১৯৯ কোটি ডলারের পণ্য। সেখানে ২০২২ সালে ভারতের মোট আমদানির পরিমাণ ছিল ৭২৩ বিলিয়ন ডলার বা ৭২ হাজার ৩০০ কোটি ডলার।
ইকোনমিক টাইমসের প্রতিবেদন অনুসারে, ভারতের পঞ্চম বৃহত্তম রপ্তানি গন্তব্য হচ্ছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ ভারতের তুলনায় অনেক ছোট অর্থনীতির দেশ হলেও সেখান থেকে বিপুল আমদানি করে। মূলত ভৌগোলিক নৈকট্যের কারণে ভারত থেকে বাংলাদেশের আমদানি এতটা বেশি। এতে সময় ও খরচ দুটোই কম লাগে। তবে ভারত এখন বাংলাদেশের বৃহত্তম আমদানি উৎস নয়, সেই জায়গা এখন চীনের।
ওই প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, গেল অর্থবছর শেষে ভারতের মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপির আকার দাঁড়াবে ৩ লাখ ৪০ হাজার কোটি ডলার। তাতে বিদেশি বাণিজ্যের হিস্যা হবে ৪৮ শতাংশ। তবে দেশটির পণ্যের চেয়ে সেবা রপ্তানির পরিমাণই বেশি। বাংলাদেশ ভারতের পঞ্চম বৃহত্তম বাণিজ্য অংশীদার হওয়া সত্ত্বেও সে দেশের শীর্ষ ১০ আমদানি উৎসের মধ্যে বাংলাদেশ নেই। তার মানে পণ্যের চেয়ে ভারত এখন সেবা, যন্ত্রাংশ, উৎপাদনের কাঁচামাল রপ্তানি করে বেশি। সব মিলিয়ে আসলে বয়কট ইন্ডিয়া বেশ জটিল সমীকরণের বিষয়।
এপ্রিলের ২২ তারিখে বাংলাদেশে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে এক মানববন্ধনে জাতীয়তাবাদী নবীন দলের উদ্যোগে ভারতীয় পণ্য বর্জন ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে এক মানববন্ধন হয়। বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা কাউন্সিলের সদস্য জয়নুল আবেদিন ফারুক সেখানে বলেন, দেশে গণতন্ত্র না ফেরা পর্যন্ত ‘ভারতীয় পণ্য বর্জন’ এর আন্দোলন অব্যাহত থাকবে। ভারতীয় পণ্য বর্জনের এই আন্দোলন চলছে, চলবেই। আমরা আপনাদের (ভারতের) বিরুদ্ধে নই, আমরা আপনাদের সরকারের বিরুদ্ধে। বাংলাদেশে অনেক গরিব মানুষ ভারতে আছেন, গণতন্ত্রকামী মানুষও ভারতে আছেন, আমরা তাদেরকেও সমর্থন করি। জয়নুল আবেদিন ফারুক বলেন, ‘বাংলাদেশ গণতন্ত্রকে গলাটিপে হত্যা করার সহযোগী আপনারা (ভারত সরকার)। তাই আপনাদেরকে আমরা মানি না।
সর্বশেষ যখন মানবাধিকার সংগঠনের ব্যানারে রাজনৈতিকভাবে অধিক পরিচিত লোকজন ভারতীয় দূতাবাসের সামনে বয়কট ইন্ডিয়া" শিরোনামে প্রতিবাদ সমাবেশের আয়োজন করেন তখন বিষয়টা পরিস্কার হয়ে যায়। এবং আয়োজক কমিটি গণমাধ্যমে যে বক্তব্য দেন তাতে করে আয়োজনের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সামনে চলে আসে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বা অনলাইন টেলিভিশনে সরাসরি সম্প্রচারের কারণে ইন্ডিয়া বয়কট ইস্যুতে যারা সমবেত হয়েছিলেন তাদের বক্তব্যে মূলত কোন প্রতিবাদ বা বয়কটের তেজ দৃশ্যমান হয়নি। বরং অনলাইনে যে বক্তব্য উনারা দিয়েছেন সবই গতানুগতিক বিএনপি নেতা জয়নাল আবেদীন ফারুকের বক্তব্যের অনুকরণ মাত্র।
তাই বয়কট ইন্ডিয়া আসলে বিএনপির একটি রাজনৈতিক কর্মসূচি বলেই মনে হয়েছে। রাজনীতির ময়দানে আওয়ামী লীগের কাছে কোণঠাসা বিএনপি এবারের উপজেলা নির্বাচনেও দলীয় ভাবে অংশ নিচ্ছে না। যদিও তৃণমূলে নেতাকর্মীরা সেই নির্দেশ মানছেন বলেও মনে হচ্ছে না। সুনামগঞ্জের চার উপজেলায় ৬ জন বিএনপির পদধারী নেতা নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন বলে সংবাদ দেখালাম, সারা বাংলাদেশের চিত্র এর চেয়ে খুব বেশি ভিন্ন হওয়ার কথা নয়।
আমার ধারণা, ইসরায়েল ইস্যু এবং ভারত ইস্যুকে বিএনপি এক মোড়কে নিয়ে এসে কর্মীদের মাঠে রাখার কৌশল নিয়েছে। বয়কট ইন্ডিয়া করতে হলে আগে ইন্ডিয়া নির্ভরতা কমাতে হবে। শুধু মুখের কথায় সম্ভব নয়। বাংলাদেশকে আগে প্রস্তুত করতে হবে। যেমন করে বাংলাদেশের ফ্রিল্যান্সারদের পক্ষে সম্ভব নয় ইসরায়েল বয়কট করা।
ফ্রিল্যান্সিং খাত থেকে বছরে এক বিলিয়ন ডলার আয় করছে বাংলাদেশ। বিশ্বের টপরেটেড ফ্রিল্যান্সারদের ৬৪ শতাংশই বাংলাদেশি বর্তমানে বিশ্বে ফ্রিল্যান্সিংয়ের বাজার দেড় ট্রিলিয়ন ডলার। এ বাজারে কাজ করছে সাড়ে ছয় লাখ বাংলাদেশি। কর্মী সরবরাহের হিসাবে যা বিশ্বে দ্বিতীয়। এবং এই ফ্রিল্যান্সিং পুরোটাই নিয়ন্ত্রণ করে ইসরায়েল।
মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।
আপনার মন্তব্য