প্রধান সম্পাদক : কবির য়াহমদ
সহকারী সম্পাদক : নন্দলাল গোপ
টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
Advertise
রাজু আহমেদ | ২৫ মে, ২০২৪
১৯৭৬ সালের ২৯ আগস্ট, বাংলায় ১২ ভাদ্র ১৩৮৩ বঙ্গাব্দের সকাল ১০টা ১০ মিনিট। বাংলার আকাশ থেকে বিদায় নিলো আরও একটি নক্ষত্র। তাই চিৎকার করে বলতে ইচ্ছা করে এপ্রিল নয়, অভিশপ্ত মাস যদি বলতেই হয় তবে বাংলা দেশী-ভাষীদের জন্য সেটা অবশ্যই আগস্ট। বাংলাদেশের কবি, বাংলা ভাষার কবি গণমানুষের প্রিয় কাজী নজরুল ইসলাম। প্রেম-সাম্য-দ্রোহের প্রকাশে যিনি বাংলা ভাষা-ভাষীদের হৃদয় মন্দিরে যুগান্তরজুড়ে বিরাজ করবেন স্বমহিমায়-স্বভাস্বর হয়ে তিনি আর কেউ নন, আমাদের জাতীয় কবি, মহৎপ্রাণ কাজী নজরুল ইসলাম।
তার প্রয়াণ দিবসে শোক গাঁথা লিখতে বসিনি। তার শূন্যতার যে ক্ষতের কথা তিনি অমর সৃষ্টিতে গেঁথে গেছেন, ‘যেদিন আমি হারিয়ে যাব, বুঝবে সেদিন বুঝবে!/অস্তপারের সন্ধ্যাতারায় আমার খবর পুঁছবে-বুঝবে সেদিন বুঝবে।’-সেটুকুর উপলব্ধি করতে বসেছি মাত্র।
কায়িকভাবে তার অস্তিত্ব নেই বটে কিন্তু মানবতার প্রতি পরতে পরতে, পরশে পরশে তিনি জড়িয়ে ছিলেন, আছেন এবং থাকবেন সহস্রাব্দের পর সহস্রাব্দ।
মা, মাটি ও মানুষের কবি হিসেবে তিনি সমাজের সকল অকল্যাণ, অন্যায়, অবিচারের বিরুদ্ধে অবিচল প্রচার চালিয়েছেন। অন্যায়ের সাথে কখনো আপোষ নয় বরং দ্বিধাহীন চিত্তে বলতে সাহস করেছেন, ‘আমি বেদুইন, আমি চেঙ্গিস,/আমি আপনারে ছাড়া করি না কাহারে কুর্নিশ।/আমি বজ্র, আমি ঈশান-বিষাণে ওঙ্কার,/আমি ইস্রাফিলের শিঙ্গার মহা-হুঙ্কার।’ শুধু দ্রোহ নয় তিনি ছিলেন প্রেমের মূর্ত প্রতীক। প্রেমের প্রকাশে রচিয়াছেন, ‘একে ঐ চাউনি বাঁকা/সুর্মা-আঁকা, তায় ডাগর আঁখি।/বাধিতে তায় কেন সাধ/যে মরেছে ঐ আঁখি-বাণে।’
আজীবন তিনি মানবতা-সাম্যের কথা বলেছেন। কবির প্রতিবাদে, ‘কুলি বলে এক বাবু সা’ব তারে ঠেলে দিল নিচে ফেলে!/চোখ ফেটে এল জল,/এমনি করিয়া জগৎ জুড়িয়া মার খাবে কি দুর্বল?’। আবার কবি আশার বাণী শুনিয়ে বলেছেন, ‘আসিতেছে শুভদিন,/দিনে দিনে বহু বাড়িয়াছে দেনা, শুধিতে হইবে ঋণ!’। কবির সৃষ্টিতে চমৎকারভাবে অঙ্কিত হয়েছে সমাজে মানবসৃষ্ট ঘৃণ্য বৈষম্যের চিত্র। যে সময়টাতে নারীরা অবহেলা, লাঞ্ছনা-গঞ্জনা নিয়ে সমাজে করুণভাবে উপেক্ষিত ছিল তখন তিনি বজ্রকন্ঠে উচ্চারণ করেছেন, ‘নর যদি রাখে নারীরে বন্দী, তবে এর পর যুগে/আপনারি রচা ঐ কারাগারে পুরুষ মরিবে ভুগে।/যুগের ধর্ম এই-/পীড়ন করিলে সে-পীড়ান এসে পীড়া দেবে তোমাকেই!’
ধর্মীয় কুসংস্কারের পাঁচিল ভাঙ্গার জন্য তিনি সর্বদা সচেষ্ট ছিলেন। তার বহু কবিতা-রচনায় এ ব্যাপারে অনেক দর্শন পাওয়া যায়। তার অমর সৃষ্টি, ‘মানুষ এনেছে গ্রন্থ;-গ্রন্থ আনেনি মানুষ কোনো!/আদম দাউদ ঈসা মুসা ইব্রাহিম মোহাম্মদ/কৃষ্ণ বুদ্ধ নানক কবীর,-বিশ্বের সম্পদ।/আমাদেরি এঁরা পিতামহ, এই আমাদের মাঝে/তাঁদেরি রক্ত কম-বেশি ক’রে প্রতি ধমনীতে রাজে।’
নজরুলে রচনায় ঘোড়ায় সাওয়ায় হয়ে অধ্যয়ন করা চলে না। তার রচনার প্রতিটি শব্দ, বাক্য বারবার পাঠ করে তার মর্মার্থ উপলব্ধি করতে হবে। বাংলাদেশের জাতীয় কবি হলেও দুর্ভাগ্যজনকভাবে আজ বাংলাদেশের মানুষের কাছ থেকে নজরুলকে বহুদূরে সরিয়ে রাখা হয়েছে। অশুভ শক্তির উত্থানে নজরুলের চর্চা কমে যাচ্ছে নিয়ত। নজরুলের সুরে তাল মিলিয়ে আমরাও বলতে চাই, ‘আর কতকাল থাকবি বেটি মাটির ঢেলার মূর্তি-আড়াল?/স্বর্গ যে আজ জয় করেছে অত্যাচারী শক্তি চাঁড়াল।’।
সাম্যহীন, ভ্রাতৃত্বহীন এবং মানবতাহীনতায় আমাদের চারপাশে আজ অশান্তির দাবানল জ্বলছে। অথচ নজরুলের আদর্শ-দর্শনকে যদি সাধারণ মানুষের কাছাকাছি ফিরিয়ে দেওয়া যেত, তবে সকল মানুষ শান্তির পরশ পেত। নজরুলের কবিতাই আজ নজরুলকে জিইয়ে রাখছে। অশুভ শক্তির তীব্র আগ্রাসনের পরেও নজরুল তার স্বমহিমায় তাঁর ভক্ত-অনুরক্তদের হৃদয় মাঝে শ্রদ্ধা-সম্মানপূর্ণ স্থায়ী আসনে বসবাস করছে।
তিনি যেমন বলেছেন, ‘মিথ্যা শুনিনি ভাই,/এই হৃদয়ের চেয়ে বড়ো কোনো মন্দির-কাবা নাই।’ তেমনি আমরাও বুকে হাত দিয়ে যেন বলতে পারি, আমাদের নজরুল আমাদের হৃদয়ে বেঁচে থাকবে আজন্মকাল ব্যাপিয়া।
আজ নজরুলের শোকে স্মরণসভা হলেও মানবের হৃদয়ের মণিকোঠায় নজরুল কখনো অস্তমিত যাওয়ার ক্ষণজন্মা নয়। নজরুল মহাপ্রাণ। ভালোবাসার মুক্ত খাঁচায় আপনগুনে রাজ করবেন নজরুল। পাঠক-শ্রোতার ভালোবাসায় বেঁচে থাকবেন নজরুল।
মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।
আপনার মন্তব্য