আজ মঙ্গলবার, ১৫ অক্টোবর, ২০২৪

Advertise

কালের পালে জিইয়ে নজরুল

রাজু আহমেদ  

১৯৭৬ সালের ২৯ আগস্ট, বাংলায় ১২ ভাদ্র ১৩৮৩ বঙ্গাব্দের সকাল ১০টা ১০ মিনিট। বাংলার আকাশ থেকে বিদায় নিলো আরও একটি নক্ষত্র। তাই চিৎকার করে বলতে ইচ্ছা করে এপ্রিল নয়, অভিশপ্ত মাস যদি বলতেই হয় তবে বাংলা দেশী-ভাষীদের জন্য সেটা অবশ্যই আগস্ট। বাংলাদেশের কবি, বাংলা ভাষার কবি গণমানুষের প্রিয় কাজী নজরুল ইসলাম। প্রেম-সাম্য-দ্রোহের প্রকাশে যিনি বাংলা ভাষা-ভাষীদের হৃদয় মন্দিরে যুগান্তরজুড়ে বিরাজ করবেন স্বমহিমায়-স্বভাস্বর হয়ে তিনি আর কেউ নন, আমাদের জাতীয় কবি, মহৎপ্রাণ কাজী নজরুল ইসলাম।

তার প্রয়াণ দিবসে শোক গাঁথা লিখতে বসিনি। তার শূন্যতার যে ক্ষতের কথা তিনি অমর সৃষ্টিতে গেঁথে গেছেন, ‘যেদিন আমি হারিয়ে যাব, বুঝবে সেদিন বুঝবে!/অস্তপারের সন্ধ্যাতারায় আমার খবর পুঁছবে-বুঝবে সেদিন বুঝবে।’-সেটুকুর উপলব্ধি করতে বসেছি মাত্র।

কায়িকভাবে তার অস্তিত্ব নেই বটে কিন্তু মানবতার প্রতি পরতে পরতে, পরশে পরশে তিনি জড়িয়ে ছিলেন, আছেন এবং থাকবেন সহস্রাব্দের পর সহস্রাব্দ।

মা, মাটি ও মানুষের কবি হিসেবে তিনি সমাজের সকল অকল্যাণ, অন্যায়, অবিচারের বিরুদ্ধে অবিচল প্রচার চালিয়েছেন। অন্যায়ের সাথে কখনো আপোষ নয় বরং দ্বিধাহীন চিত্তে বলতে সাহস করেছেন, ‘আমি বেদুইন, আমি চেঙ্গিস,/আমি আপনারে ছাড়া করি না কাহারে কুর্নিশ।/আমি বজ্র, আমি ঈশান-বিষাণে ওঙ্কার,/আমি ইস্রাফিলের শিঙ্গার মহা-হুঙ্কার।’ শুধু দ্রোহ নয় তিনি ছিলেন প্রেমের মূর্ত প্রতীক। প্রেমের প্রকাশে রচিয়াছেন, ‘একে ঐ চাউনি বাঁকা/সুর্মা-আঁকা, তায় ডাগর আঁখি।/বাধিতে তায় কেন সাধ/যে মরেছে ঐ আঁখি-বাণে।’

আজীবন তিনি মানবতা-সাম্যের কথা বলেছেন। কবির প্রতিবাদে, ‘কুলি বলে এক বাবু সা’ব তারে ঠেলে দিল নিচে ফেলে!/চোখ ফেটে এল জল,/এমনি করিয়া জগৎ জুড়িয়া মার খাবে কি দুর্বল?’। আবার কবি আশার বাণী শুনিয়ে বলেছেন, ‘আসিতেছে শুভদিন,/দিনে দিনে বহু বাড়িয়াছে দেনা, শুধিতে হইবে ঋণ!’। কবির সৃষ্টিতে চমৎকারভাবে অঙ্কিত হয়েছে সমাজে মানবসৃষ্ট ঘৃণ্য বৈষম্যের চিত্র। যে সময়টাতে নারীরা অবহেলা, লাঞ্ছনা-গঞ্জনা নিয়ে সমাজে করুণভাবে উপেক্ষিত ছিল তখন তিনি বজ্রকন্ঠে উচ্চারণ করেছেন, ‘নর যদি রাখে নারীরে বন্দী, তবে এর পর যুগে/আপনারি রচা ঐ কারাগারে পুরুষ মরিবে ভুগে।/যুগের ধর্ম এই-/পীড়ন করিলে সে-পীড়ান এসে পীড়া দেবে তোমাকেই!’

ধর্মীয় কুসংস্কারের পাঁচিল ভাঙ্গার জন্য তিনি সর্বদা সচেষ্ট ছিলেন। তার বহু কবিতা-রচনায় এ ব্যাপারে অনেক দর্শন পাওয়া যায়। তার অমর সৃষ্টি, ‘মানুষ এনেছে গ্রন্থ;-গ্রন্থ আনেনি মানুষ কোনো!/আদম দাউদ ঈসা মুসা ইব্রাহিম মোহাম্মদ/কৃষ্ণ বুদ্ধ নানক কবীর,-বিশ্বের সম্পদ।/আমাদেরি এঁরা পিতামহ, এই আমাদের মাঝে/তাঁদেরি রক্ত কম-বেশি ক’রে প্রতি ধমনীতে রাজে।’

নজরুলে রচনায় ঘোড়ায় সাওয়ায় হয়ে অধ্যয়ন করা চলে না। তার রচনার প্রতিটি শব্দ, বাক্য বারবার পাঠ করে তার মর্মার্থ উপলব্ধি করতে হবে। বাংলাদেশের জাতীয় কবি হলেও দুর্ভাগ্যজনকভাবে আজ বাংলাদেশের মানুষের কাছ থেকে নজরুলকে বহুদূরে সরিয়ে রাখা হয়েছে। অশুভ শক্তির উত্থানে নজরুলের চর্চা কমে যাচ্ছে নিয়ত। নজরুলের সুরে তাল মিলিয়ে আমরাও বলতে চাই, ‘আর কতকাল থাকবি বেটি মাটির ঢেলার মূর্তি-আড়াল?/স্বর্গ যে আজ জয় করেছে অত্যাচারী শক্তি চাঁড়াল।’।

সাম্যহীন, ভ্রাতৃত্বহীন এবং মানবতাহীনতায় আমাদের চারপাশে আজ অশান্তির দাবানল জ্বলছে। অথচ নজরুলের আদর্শ-দর্শনকে যদি সাধারণ মানুষের কাছাকাছি ফিরিয়ে দেওয়া যেত, তবে সকল মানুষ শান্তির পরশ পেত। নজরুলের কবিতাই আজ নজরুলকে জিইয়ে রাখছে। অশুভ শক্তির তীব্র আগ্রাসনের পরেও নজরুল তার স্বমহিমায় তাঁর ভক্ত-অনুরক্তদের হৃদয় মাঝে শ্রদ্ধা-সম্মানপূর্ণ স্থায়ী আসনে বসবাস করছে।

তিনি যেমন বলেছেন, ‘মিথ্যা শুনিনি ভাই,/এই হৃদয়ের চেয়ে বড়ো কোনো মন্দির-কাবা নাই।’ তেমনি আমরাও বুকে হাত দিয়ে যেন বলতে পারি, আমাদের নজরুল আমাদের হৃদয়ে বেঁচে থাকবে আজন্মকাল ব্যাপিয়া।

আজ নজরুলের শোকে স্মরণসভা হলেও মানবের হৃদয়ের মণিকোঠায় নজরুল কখনো অস্তমিত যাওয়ার ক্ষণজন্মা নয়। নজরুল মহাপ্রাণ। ভালোবাসার মুক্ত খাঁচায় আপনগুনে রাজ করবেন নজরুল। পাঠক-শ্রোতার ভালোবাসায় বেঁচে থাকবেন নজরুল।

রাজু আহমেদ, কলাম লেখক। ইমেইল: [email protected]

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অধ্যাপক ডা. শেখ মো. নাজমুল হাসান ২৭ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৮ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৪ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬৪ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০৯ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪২ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩২ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪৩ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯৩ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ২১ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ শাখাওয়াত লিটন শাবলু শাহাবউদ্দিন