প্রধান সম্পাদক : কবির য়াহমদ
সহকারী সম্পাদক : নন্দলাল গোপ
টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
Advertise
তসলিমা নাসরিন | ১৮ জুন, ২০২৪
প্রিন্স মামুনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। প্রিন্স মামুন ছিল লায়লা আক্তারের জিগোলো। সেই অল্প বয়সী তরুণদের জিগোলো বলা হয় যারা টাকা পয়সা আর নানা উপহার সামগ্রীর বিনিময়ে বয়স্কা মহিলাদের সঙ্গ দেয়। মূলত যৌনসঙ্গ। ৪৮ বছর বয়সী লায়লা ২২ বা ২৩ বছর বয়সী মামুনকে জিগোলো হিসেবেই রেখেছিলেন। মামুনকে তিনি প্রায়ই টাকা দিতেন, টাকার বিনিময়ে সুদর্শন তরুণটির সঙ্গ উপভোগ করতেন। মামুনকে শুধু যৌনসঙ্গী হিসেবে ব্যবহার করতেন না, মামুনকে তিনি টাকা রোজগারের জন্যও ব্যবহার করতেন। মামুনের পেছনে তিনি যত টাকা ব্যয় করতেন, সম্ভবত তার চেয়ে বেশি তিনি মামুনের সঙ্গে ভিডিও বানিয়ে আয় করতেন।
জনপ্রিয় টিকটকার মামুন নাচতো, বা গানের সঙ্গে ঠোঁট মেলাতো, তার পাশে রঙ করা পুতুলের মতো দাঁড়িয়ে থাকতেন লায়লা—এসব অর্থহীন রুচিহীন ভিডিও ইউটিউব, ইনস্টাগ্রাম, ফেসবুকে আপলোড করতেন তিনি। শুধু নাচ গানের ভিডিও নয়, মামুন খাচ্ছে, মামুন হাসছে, মামুন খেলছে—সব কিছুর ভিডিও তাঁর করা চাই, মামুনের জন্য ভিউয়ার সংখ্যা এত বেশি ছিল যে তিনি এ থেকে ভাল টাকা রোজগার করতেন। করতেনই বা বলি কেন, রোজগার এখনও করছেন।
লায়লা ধনী। মামুন দরিদ্র। ঢাকার অভিজাত এলাকায় নিজের বাড়িতে তিনি মামুনকে রেখেছেন। মামুনকে খাইয়েছেন, পরিয়েছেন। দামী উপহারসামগ্রীর বিনিময়ে মামুনকে সারাজীবনের জন্য কিনে নেওয়ার চেষ্টা করেছেন। দরিদ্র পরিবারের ছেলে মামুন যা চাইতো, লায়লা তাকে তা-ই দিতেন। নাকের সামনে চব্বিশ ঘণ্টা মুলো ঝুলিয়ে রাখতেন। একসময় মামুনকে বিয়ে করার জন্য তিনি উন্মাদ হয়ে ওঠেন। তিনি সর্বত্র বলে বেড়ান মামুন তাঁর লাইফ পার্টনার। মামুনের কিন্তু কোনও ইচ্ছে নেই তার দ্বিগুণ বয়সী দু'দুবার বিয়ে হওয়া দুই সন্তানের মা'কে বিয়ে করার। চাপাচাপি করলে মামুন শর্ত দেয় তাকে ঢাকা শহরে একখানা বাড়ি কিনে দিতে হবে। অথবা লায়লার নিজের বাড়িটিই তাকে লিখে দিতে হবে। পাকা জিগোলোর মতোই ব্যবহার মামুনের। নাকি মামুন জেনেশুনে এমন এক শর্ত দিয়েছে, যে শর্ত লায়লার পক্ষে মানা সম্ভব নয়, এবং তাহলেই শর্ত না মানার অভিযোগ করে লায়লার নাগপাশ থেকে সে মুক্তি পাবে!
মামুনের পেছনে অঢেল খরচ করে লায়লা হয়তো ভেবেছিলেন নিজের স্বপ্ন পূরণ করবেন, মামুনকে নিজের করে পাবেন। কিন্তু মামুন চায় বাড়ি। মামুনকে লায়লা বাড়ি লিখে দেবেন কথা দিয়েও দেন না। লায়লার দরকার সঙ্গ, মামুনের দরকার টাকা। এই সম্পর্কটি শুরু থেকেই ছিল দেওয়া নেওয়ার সম্পর্ক। বাড়ি না পেয়ে লায়লার সঙ্গে তিন বছরের সম্পর্কের ইতি টানলো মামুন। সম্পর্ক গড়া যেমন মানবাধিকারের অংশ, সম্পর্কের ইতি টানাও মানবাধিকারের অংশ। বিচ্ছেদ মেনে নেওয়া উচিত ছিল লায়লার, কিন্তু তিনি মেনে নেন না। নিজের বয়সের দিকেও তাকান না। বরং বয়স কম দেখানোর জন্য কড়া মেকআপ করেন। কেউ কেউ তো বলে মুখে নানা রকম সার্জারিও নাকি করেছেন সুন্দরী হওয়ার জন্য।
যদিও যে কারোরই যে কোনও বন্ধুত্বের, প্রেমের, বিয়ের, এমনকি জিগোলোর সম্পর্ক চুকিয়ে ফেলার অধিকার আছে, কিন্তু মামুনকে সে অধিকার কিছুতেই দিতে চাননি লায়লা। একবার দুজনের মধ্যে ঝগড়াঝাঁটি এমন হলো যে তিনি মামুনের গায়ে হাত তুললেন, মামুনও একই কাজ করলো, লায়লার মুখ-চোখে রক্ত জমাট বেঁধে গেল, তারপরও মামুনের সঙ্গ ত্যাগ করতে চাননি তিনি। আগেও তিনি মামুনের মার খেয়েছেন। কিন্তু মামুনকেই তিনি চান। মামুন যতবারই তাঁর বাড়ি ছেড়ে চলে যায়, ততবারই তার হাতে পায়ে ধরে তাকে বাড়িতে ফেরত নিয়ে আসেন লায়লা। সামাজিক মাধ্যমে সারাক্ষণই মামুনের জন্য তাঁর কান্নাকাটি চলতে থাকে, মিডিয়ার লোক নিয়ে চলে যান মামুনের গ্রামের বাড়িতে। দুনিয়াকে দেখান মামুনকে তিনি খুব ভালবাসেন। মামুনকে তিনি সত্যিই যদি ভালবাসতেন, মামুন তাঁর 'পায়ের নখের যোগ্য নয়'—এ কথা বলতেন না বারবার, মামুনের বিরুদ্ধে মামলা করে তার সর্বনাশ করতেন না! লায়লার মতো চালাক চতুর নয় মামুন। সে বিশ্বাস করেছিল লায়লা তার ফ্যান, লায়লা তাকে ভালবাসেন, লায়লা তার কোনও ক্ষতি করবেন না। কোনওদিন সে নিশ্চয়ই কল্পনাও করতে পারেনি, লায়লা তাকে একদিন জেলখানায় বন্দি করবেন।
মামুনের পারিবারিক সমস্ত তথ্য প্রকাশ করলেও তাঁর নিজের বয়স কত, তাঁর বিয়ে হয়েছিল কিনা, তাঁর সন্তান আছে কিনা ইত্যাদি পারিবারিক কোনও তথ্যই লায়লা কোনওদিনই প্রকাশ করেননি। মিডিয়া কোনও প্রশ্ন করলে তিনি নানা কায়দা করে উত্তর এড়িয়ে গেছেন। মামুনের পরিবারের দারিদ্র নিয়ে, মামুন এবং তার পরিবারের সবার শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়ে কম তুচ্ছ তাচ্ছিল্য তিনি করেননি। নিজের ধন দৌলত নিয়ে লায়লা সব সময় গর্ব করেছেন। নিজের ডিগ্রি, নিজের বেতন, নিজের বাড়ি গাড়ি নিয়ে তাঁর অহংকারের শেষ নেই। আর মামুনকে কখন কত টাকা দিয়ে সাহায্য করেছেন, মামুনকে কত টাকা দামের কী উপহার দিয়েছেন, সবই বিশ্ববাসীকে বারবারই জানিয়ে দিয়েছেন।
মামুন লায়লাকে বিয়ে করতে রাজি নয় বলে লায়লা এখন মামুনের বিরুদ্ধে ধর্ষণের মামলা ঠুকে দিয়েছেন, মামুন নাকি তাঁকে বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে ধর্ষণ করেছে। এমন বানোয়াট কথা অসৎ না হলে বলা যায় না। বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে যৌন সম্পর্ক করলে প্রতারণা হয়, ধর্ষণ হয় না। অনুমতি ছাড়া যৌনসম্পর্ক করলে হয় ধর্ষণ। লায়লার তো এ ব্যাপারে অনুমতির কোনও অভাব ছিল না। বরং খুব বেশি রকম আগ্রহই ছিল। মামুনকে পাওয়ার জন্য শেষে এমনই মরিয়া হয়ে উঠেছেন লায়লা যে তিনি মামুনকে বাড়ি লিখে দেবেন প্রতিশ্রুতি দিলেন, কাকুতি মিনতি করতে লাগলেন, মামুন যেন তাঁর কাছে ফিরে আসে। মামুন তবু ফিরে আসে না। মামুন যে তাঁকে লাইফ পার্টনার মনে করছে না, মামুন যে তাঁকে ভালবেসে বিয়ে তো করবেই না, এমনকি বাড়ি উপহার দিলেও করবে না, এটি লায়লার সহ্য হয়নি।
লায়লা যখন বুঝলেন মামুন তাঁর নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে, সে তার নিজের শর্তে জীবন যাপন করছে, তখন তিনি মামুনকে হুমকি দিতে থাকেন তাঁকে বিয়ে না করলে, বা তাঁর সঙ্গে একত্রবাস না করলে, তাঁর সঙ্গে আগের মতো ‘কন্টেন্ট ক্রিয়েট’ না করলে বা ভিডিও না বানালে তিনি মামুনের বিরুদ্ধে দায়ের করা ধর্ষণের মামলা তুলে নেবেন না। যখন দেখেছেন মামুনকে ফিরিয়ে আনা যাচ্ছে না, তখন বলেছেন, তাঁকে নব্বই লক্ষ টাকা না দিলে তিনি মামলা তুলে নেবেন না। মামুনকে কী করে হেনস্থা করা যায়, কীভাবে তাকে নিঃস্ব করা যায়, তিনি ভাল জানেন। এবং তিনি তা করছেন। এভাবেই তিনি তাঁর অনুদার এবং প্রতিশোধপরায়ণ চেহারাটি প্রকাশ করছেন।
মামুনের প্রেমিকা এবং শয্যাসঙ্গী হিসেবে নিজেকে লায়লা সেলিব্রিটি ভাবতেন। মামুনকে জেলে পাঠিয়েও তিনি নিজেকে সেলিব্রিটি ভেবেছেন। জেলে পাঠিয়ে সমালোচিত হয়েছেন বলে লোকের সহানুভূতি অর্জনের জন্য যা বলা দরকার তা মিডিয়াকে বলেছেন, এসব কথা আগে কখনও উচ্চারণ করেননি। তাঁর এক কন্যা প্রতিবন্ধী। তিনি ৩০ লক্ষ টাকা ধার করেছেন মামুন আর মামুনের পরিবারকে সাহায্য করতে গিয়ে। কন্যাদের জন্য তাঁর কিছুই সঞ্চয় নেই।
মামুনের বড় দুই ভাই বোন বোবা। তারা কথা বলতে পারে না। তার অসহায় মা বাবা আর ভাই বোনের জন্য টিকটক থেকে উপার্জিত টাকা দিয়ে একখানা একতলা বাড়ি বানিয়েছে মামুন, পরিবারের মানুষগুলোর মাথা গোজার ঠাঁই হয়েছে। কিছুদিন আগে ঢাকায় একটি সেলুনের ব্যবসা শুরু করেছে সে। হাজারো ভক্ত মামুনকে দেখতে এসেছিল। সেই সেলুনের উদ্বোধনের দিন লায়লা গিয়েছেন। প্রেস কনফারেন্সের ভিড়ে সবাইকে দেখিয়ে নিজের ওড়না দিয়ে মামুনের মুখের ঘাম মুছে দিয়ে দরদী প্রেমিকার অভিনয় করে আসার দুদিন পর লায়লা ধর্ষণের মামলা ঠুকে দিয়েছেন মামুনের বিরুদ্ধে।
লায়লার আত্মীয় স্বজন মিলিটারিতে, ক্যান্টনমেন্ট থানার পুলিশও মনে হয় মিলিটারির আদেশ পালন করতে এক পায়ে দাঁড়িয়ে থাকে। সত্যিকার নারীনির্যাতক আর ধর্ষকরা দেশময় ঘুরে বেড়াচ্ছে, পুলিশ তাদের গ্রেপ্তার করে না। আর মামুনের মতো স্ট্রাগল করা এক তরুণকে তড়িঘড়ি গ্রেপ্তার করেছে। রিমান্ডে নেওয়া হবে বেচারাকে, বেধড়ক পেটানো হবে। যে তরুণ লায়লার চক্রান্তের শিকার, সে এখন শিকার হচ্ছে মিথ্যে মামলার, ফেঁসে গেছে আইনের মারপ্যাঁচে। মামুনের আত্মীয়স্বজন লায়লার আত্মীয়স্বজনের মতো প্রভাবশালী নয়। সুতরাং মামুনকে ভুগতে হচ্ছে, ভুগতে হবে। না বুঝে সে আটকে গেছে লায়লার পাতা ফাঁদে। মামুনকে মুক্ত করার জন্য, আশা করছি, মানবাধিকারের জন্য যে আইনজীবীরা লড়েন, এগিয়ে আসবেন।
লায়লা আর মামুনের এই দ্বন্দ্ব বা লড়াই আসলে নারীবাদ আর পুরুষতন্ত্রের লড়াই নয়, এ ধনী আর দরিদ্রের লড়াই, সবল আর দুর্বলের লড়াই, দম্ভ আর অসহায়ত্বের লড়াই, শিকারি আর শিকারের লড়াই।
নারী হয়ে জন্ম নিয়েছে বলেই সে ভাল, সে সত্যবাদী, এ আমি মনে করি না। পুরুষ যেমন বদমাশ হতে পারে, নারীও তেমন বদমাশ হতে পারে।
মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।
আপনার মন্তব্য