প্রধান সম্পাদক : কবির য়াহমদ
সহকারী সম্পাদক : নন্দলাল গোপ
টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
Advertise
জুয়েল রাজ | ২৮ জুন, ২০২৪
যুক্তরাজ্যের সুপ্রিম কোর্টের রায়ে দেশটির স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিরুদ্ধে মানহানি মামলা চালিয়ে যাওয়ার সুযোগ পেয়েছেন একাত্তরের বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে ১৮ জন বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের দায়ে অভিযুক্ত যুদ্ধাপরাধী চৌধুরী মুঈনুদ্দীন। মূলত ২০১৯ সালে যুদ্ধাপরাধী মুঈনুদ্দীনের ফৌজদারি অপরাধের বিবরণসহ একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে যুক্তরাজ্যের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী প্রীতি প্যাটেল সেই প্রতিবেদন তখনকার টুইটার (বর্তমানে এক্স) হ্যান্ডলে শেয়ার করেন। এই টুইটে রিটুইট করেছিলেন ব্রিটিশ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী প্রীতি প্যাটেল, বিবিসির সাংবাদিক মিশাল হুসেইন, মানবাধিকার বিষয়ক ক্যাম্পেইনার পিটার ট্যাটচেল। ওই রিপোর্টে চৌধুরী মুঈনুদ্দীনকে অভিহিত করা হয়েছে ভয়াবহ সহিংস অপরাধের জন্য দায়ী হিসেবে। এর মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশে ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধ।
চৌধুরী মুঈনুদ্দীন অভিযোগ করেছেন তাকে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে উল্লেখ করে হোম সেক্রেটারি তার টুইটে যে মন্তব্য করেছেন, সেটি তার মানহানির কারণ হয়েছে। এর প্রতিবাদ জানিয়ে অনলাইন থেকে প্রতিবেদনটি তুলে নেওয়ার দাবি তুলে ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেন যুদ্ধাপরাধী মুঈনুদ্দীন। তবে তাতে সাড়া দেয়নি ব্রিটিশ সরকার।
এরপর ২০২০ সালের ১৯ জুন মামলা করেন মুঈনুদ্দীন। ওই প্রতিবেদন প্রকাশ্যে এনে যুক্তরাজ্যের ডেটা সংরক্ষণ নীতি লঙ্ঘন করা হয়েছে এবং তাতে ব্যক্তিগত সুনাম ক্ষুণ্ণ ও মানহানি হয়েছে বলে অভিযোগ তোলেন একাত্তরের এই আল-বদর নেতা। সেখানে ৬০ হাজার পাউন্ড ক্ষতিপূরণ দাবি করা হয়।
২০২১ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি মামলার শুনানি হয়। সেখানে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদন আমলে নেওয়া হয়। মুঈনুদ্দীনের নামের সঙ্গে যেসব শব্দ ব্যবহার করা হয়, যেমন যুদ্ধাপরাধী, মানবতাবিরোধী অপরাধী; একাত্তরের ঘাতক- তখন সেগুলো বাতিল করতে কোনো আদেশ দেয়নি হাই কোর্ট।
মামলার শুনানিতে প্রীতি প্যাটেলের পক্ষে যুক্তি দেখানো হয়, মুঈনুদ্দীনের অভিযোগে বিচার এগিয়ে নেওয়া হলে তা হবে যুক্তরাজ্যের ‘আদালতের কার্যপ্রণালীর অপব্যবহার’। সেই যুক্তি আমলে নিয়ে ওই বছরের ১৫ নভেম্বর হাই কোর্ট মামলাটি খারিজ করে দেয়।
মুঈনুদ্দীন তখন যান কোর্ট অব আপিলে। ২০২২ সালের ২৮ জুলাই সেখানেও তার আবেদন খারিজ হয়ে যায় এবং হাই কোর্টের সিদ্ধান্ত ও পর্যবেক্ষণ বহাল থাকে। এর বিরুদ্ধে আপিল করার অনুমতি চেয়ে ২০২৩ সালের ১ ফেব্রুয়ারি যুক্তরাজ্যের সুপ্রিম কোর্টে আবেদন করেন বুদ্ধিজীবী ঘাতক মুঈনুদ্দীন। ওই বছর ১-২ নভেম্বর সুপ্রিম কোর্টের পাঁচ বিচারপতির বেঞ্চে শুনানি শুরু হয়, আট মাসের বেশি সময় পর গত ২০ জুন যুক্তরাজ্যের সুপ্রিম কোর্ট মুঈনুদ্দীনকে তার সেই মানহানির মামলাটি করার সুযোগ দিয়ে রায় প্রকাশ করেছে।
২০২৩ সালের ১-২ নভেম্বর এই মামলার শুনানি হয়। গত ২০ জুন ২০২৪ যুক্তরাজ্যের সুপ্রিম কোর্টের প্রেসিডেন্ট (প্রধান বিচারপতি) লর্ড রিড আদালতের পক্ষে এই রায় ঘোষণা করেন।
প্রধান বিচারপতি লর্ড রিড’র নেতৃত্বে গঠিত বেঞ্চে ৫ জন লর্ড জাস্টিসদের মধ্যে আরও ছিলেন লর্ড সেইলস, লর্ড হ্যামলেন্ড, লর্ড বারোজ ও লর্ড রিচার্ডস। ২০১৯ সালে মানহানি মামলার শীর্ষ ল’ফার্ম কার্টার-রাকের মাধ্যমে চৌধুরী মুঈনুদ্দীন হোম অফিসের বিরুদ্ধে এই মামলা করেন। তার আইনজীবীদের মধ্যে ছিলেন সিনিয়র সলিসিটর অ্যাডাম টিউডর এবং কাউন্সেল জ্যাকব ডিন ও লিলি ওয়াকার-পার।
মামলার বর্ণনায় উল্লেখ করা হয়, ২০১৯ সালে কমিশন ফর কাউন্টারিং এক্সট্রিমিজমের ‘চ্যালেঞ্জিং হেইটফুল এক্সট্রিমিজম’ বিষয়ক ব্রিটিশ হোম অফিসের রিপোর্টে চৌধুরী মুঈনুদ্দীনকে এক্সটিমিজমের সাথে জড়িত বলে অভিযুক্ত করা হয়। এতে ১৯৭১ সালে মানবতা বিরোধী অপরাধের অভিযোগে তার বিরুদ্ধে বাংলাদেশের আইসিটি মামলার রায়কে প্রমাণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়।
এই রিপোর্টের জন্য চৌধুরী মুঈনুদ্দীন ব্রিটিশ হোম সেক্রেটারির বিরুদ্ধে মানহানি মামলায় উল্লেখ করেন, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় কোন রকম মানবতা বিরোধী অপরাধের সাথে তিনি জড়িত নন। বরং বাংলাদেশী কর্তৃপক্ষের অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যা এবং রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত বলে তিনি প্রত্যাখ্যান করেছেন।
সুপ্রিম কোর্টের রায়ে উল্লেখ করা হয়, চৌধুরী মুঈনুদ্দীন ১৯৪৮ সালে পূর্ব বাংলায় জন্মগ্রহণ করেন, যেটি তখন পাকিস্তান রাষ্ট্রের অংশ ছিল। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে বাংলাদেশ রাষ্ট্র স্বাধীনতা লাভ করে। ১৯৭৩ সাল থেকে চৌধুরী মুঈনুদ্দীন যুক্তরাজ্যে বসবাস করছেন এবং ১৯৮৪ সাল থেকে একজন ব্রিটিশ নাগরিক। এই সময়ে তিনি ব্রিটেনে বেশ কয়েকটি সামাজিক ও দাতব্য সংস্থায় বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন।
২০১৩ সালে, স্বাধীনতা যুদ্ধের ৪০ বছরেরও বেশি সময় পরে, মুঈনুদ্দীনকে বাংলাদেশে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছিল, একটি “ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমস ট্রাইব্যুনাল” (“ICT”) দ্বারা তার অনুপস্থিতিতে ১৯৭১ সালের যুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধে মুঈনুদ্দীনকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়।
যুক্তরাজ্যের সুপ্রিম কোর্ট সেই দীর্ঘ রায়ে উল্লেখিত কিছু বিষয়, বাংলাদেশের জন্য অশনি সংকেত, কারণ সেখানে বলা হয়েছে- আইসিটি আসলে “ইন্টারন্যাশনাল” নয় বরং বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ আইনি ব্যবস্থার একটি প্রতিষ্ঠান ছিল। এটি বিশেষ আইন দ্বারা আহবান করা হয়েছিল যার জন্য বাংলাদেশের সংবিধান সংশোধনের প্রয়োজন ছিল, যাতে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের কাছ থেকে মৌলিক পদ্ধতিগত সুরক্ষাগুলি সরানো যায়। আইসিটি প্রমাণ এবং পদ্ধতির সাধারণ নিয়ম দ্বারা সীমাবদ্ধ ছিল না, এবং “অপরাধের গ্রহণযোগ্য প্রমাণ হিসাবে সেই সময় থেকে সংবাদপত্রের প্রতিবেদনের উপর নির্ভর করার অনুমতি দেওয়া হয়েছিল (প্রকৃতপক্ষে জনাব মুঈনুদ্দীনের দোষী সাব্যস্ত হওয়া প্রাথমিকভাবে এই ধরনের প্রতিবেদনের উপর নির্ভর করে)। আশ্চর্যজনকভাবে, মানবাধিকার সংস্থা, জাতিসংঘ, ইইউ এবং যুক্তরাজ্যের পার্লামেন্ট দ্বারা আইসিটি সর্বজনীনভাবে নিন্দা করা হয়েছিল।
আইসিটি সম্পর্কে গুরুতর উদ্বেগ এবং তিনি সম্ভাব্য মৃত্যুদণ্ডের সম্মুখীন হওয়ার কারণে মুঈনুদ্দীন তা করেননি, এবং (যেমন সুপ্রিম কোর্ট আজ স্বীকৃতি দিয়েছে) বাস্তবসম্মতভাবে বিচারে উপস্থিত হওয়ার আশা করা যায় না। তিনি কোনো যথাযথ প্রক্রিয়া বা আইনি প্রতিনিধিত্বের কার্যকর প্রবেশাধিকার থেকে বঞ্চিত ছিলেন। যেকোনো আপিল সম্পূর্ণরূপে নিরর্থক হত (এবং আবার তার উপস্থিতি এবং সম্ভবত মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা প্রয়োজন হত – এমন একটি ভাগ্য যা ইতিমধ্যেই অন্য অভিযুক্ত ব্যক্তির উপর ঘটেছে)। যুক্তরাজ্যের তাকে প্রত্যর্পণ করার কোনো সম্ভাবনা ছিল না (বা এমনকি কোনো প্রত্যর্পণের অনুরোধও)। প্রকৃতপক্ষে, ইন্টারপোল মুঈনুদ্দীনের গ্রেপ্তারের জন্য একটি রেড নোটিস প্রত্যাহার করেছে, যা আইসিটি প্রক্রিয়া সম্পর্কিত মৌলিক উদ্বেগের আলোকে বাংলাদেশের অনুরোধে জারি করা হয়েছিল।
চৌধুরী মুঈনুদ্দীন তার যুক্তরাজ্যের আইনজীবীদের মাধ্যমে অভিযোগের নির্দোষতা স্পষ্ট করার জন্য বারবার এবং জোরালোভাবে অব্যাহত রেখেছেন। বাংলাদেশের আদালতে দোষী সাব্যস্ত হওয়ার ছয় বছর পর, ২০১৯ সালে হোম অফিস একটি রিপোর্ট (the Report) প্রকাশ করেছে যা কমিশন ফর কাউন্টারিং এক্সট্রিমিজম, হোম অফিসের একটি অ-সংবিধিবদ্ধ কমিটি, “চ্যালেঞ্জিং হেইটফুল এক্সট্রিমিজম” শিরোনামে তৈরি করেছে। হার্ড কপিতে প্রচারিত হওয়ার পাশাপাশি, প্রতিবেদনটি প্রায় ৫০০০ বার অনলাইনে ডাউনলোড করা হয়েছে এবং হোম অফিসের সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাকাউন্টগুলোর ৯ লাখ অনুসারীদের কাছে পৌঁছেছে। হাই কোর্ট যেমন খুঁজে পেয়েছে, প্রতিবেদনে মুঈনুদ্দীনকে উল্লেখ করা হয়েছে যে পাঠকরা বুঝতে পেরেছেন যে তিনি ১৯৭১ সালের যুদ্ধের সময় যুদ্ধাপরাধের জন্য দায়ীদের একজন ছিলেন এবং করেছিলেন।
২০১৯ সালের ডিসেম্বরে কার্টার-রাকের মাধ্যমে পাঠানো মুঈনুদ্দীনের অভিযোগের প্রাথমিক চিঠির পরে, হোম অফিস ক্ষমা চাইতে বা প্রতিকারের জন্য তার অন্যান্য দাবিতে সম্মত হতে অস্বীকার করে, পরিবর্তে রিপোর্টের অনলাইন সংস্করণ থেকে আপত্তিকর শব্দগুলো সরানোর প্রতিক্রিয়া সীমিত করে। (এবং তারপরেও চার মাস পরে)। মুঈনুদ্দীনের কাছে মানহানির মামলা করা ছাড়া কোনো বিকল্প ছিল না। একটি প্রতিরক্ষা জমা দেওয়ার পরিবর্তে (যা হোম অফিস এখনও তিন বছরেরও বেশি সময় ধরে করেনি), স্বরাষ্ট্র সচিব মুঈনুদ্দীনের দাবিকে বাতিল করার জন্য আদালতে আবেদন করেছিলেন, জোর দিয়েছিলেন যে এটি প্রক্রিয়ার অপব্যবহার ছিল।
বিশেষ করে, এটা দৃঢ়ভাবে বলা হয়েছিল যে মুঈনুদ্দীনের মানহানির দাবিটি বাংলাদেশে আইসিটি দ্বারা তার ২০১৩ সালের দোষী সাব্যস্ত হওয়ার উপর একটি অনুপযুক্ত সমান্তরাল আক্রমণ হিসাবে (ইংরেজি) হাই কোর্টে একটি মানহানির দাবি ব্যবহার করার প্রচেষ্টা ছাড়া আর কিছুই নয়। হোম অফিসের পক্ষ থেকে দৃঢ়ভাবে বলা হয়েছিল যে মুঈনুদ্দীনের আইসিটি কার্যক্রমে (এবং তারপরে তার দোষী সাব্যস্ত হওয়ার পরে আপিল করার) একটি উপযুক্ত সুযোগ ছিল এবং এটি না করা তার সিদ্ধান্ত ছিল। স্বরাষ্ট্র সচিব আরও জোর দিয়েছিলেন (সেই দাখিলকে সমর্থন করার জন্য কোনও উপযুক্ত প্রমাণ ছাড়াই) যে যুক্তরাজ্যে মুঈনুদ্দীনের খ্যাতি ইতিমধ্যেই একজন দোষী সাব্যস্ত যুদ্ধাপরাধীর মতো ছিল এবং স্বরাষ্ট্র সচিবকে প্রমাণ করার চেষ্টা করার জন্য। ৫০ বছরেরও বেশি আগের ঘটনা সম্পর্কিত অভিযোগের সত্যতা, মুঈনুদ্দীনকে অভিযোগের সত্যতা পাওয়ার জন্য ইংরেজ আদালত ব্যবহার করা থেকে বিরত রাখতে হবে।
প্রথম দৃষ্টান্তে, হাইকোর্ট স্বরাষ্ট্র সচিবের দাখিলের সাথে একমত হয়েছিল, যার ফলে দাবিটি বাতিল হয়ে যায়. আপিল আদালত, ২ থেকে ১ সংখ্যাগরিষ্ঠতার দ্বারা, সম্মত হয়েছে, যদিও একটি শক্তিশালী ভিন্নমতের রায় সংখ্যাগরিষ্ঠের পদ্ধতিকে “unprincipled” (একটি সমালোচনা এখন সুপ্রিম কোর্ট দ্বারা অনুমোদিত) হিসাবে বর্ণনা করেছে। ১ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ -এ সুপ্রিম কোর্টে আপিল করার অনুমতি দেওয়া হয়েছিল।
বিচারক আরও উল্লেখ করেন, “আমার সেক্রেটারি অফ স্টেটের দাখিলকে বিবেচনা করা উচিত ছিল যে দাবিদারের পদক্ষেপটি প্রক্রিয়ার অপব্যবহার কারণ [রাষ্ট্র সচিবের] পক্ষে তার প্রস্তাবিত প্রতিরক্ষাকে অযৌক্তিক হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করা কঠিন।” [জোর যোগ করা হয়েছে]। এটা মেনে নেওয়া কঠিন যে, সেক্রেটারি অফ স্টেট যদি দাবিদারের বিরুদ্ধে তার অভিযোগের সত্যতা প্রতিষ্ঠা করতে অক্ষম হন, তাহলে তিনি দায়মুক্তির সাথে দাবিদারের মানহানি করতে পারেন। প্রমাণের বোঝা [মানহানির দাবিতে একটি সত্য প্রতিরক্ষা প্রতিষ্ঠায়] আসামির কাছে প্রমাণের অপ্রতুলতার ঝুঁকি বরাদ্দ করে। যদি সেক্রেটারি অফ স্টেট ৫০ বছরেরও বেশি আগে দাবিদারের আচরণের বিষয়ে যে অভিযোগটি প্রকাশ করতে বেছে নিয়েছিলেন তার সত্যতা প্রতিষ্ঠা করতে অক্ষম হন, তবে রিপোর্ট প্রকাশ করার আগে তার এটি ভাবা উচিত ছিল ।
চৌধুরী মুঈনুদ্দীন বলেছেন: “আজকের রায়ের জন্য আমি সুপ্রিম কোর্টের প্রতি গভীর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে চাই। একজন গর্বিত এবং দীর্ঘস্থায়ী ব্রিটিশ নাগরিক হিসেবে যিনি আমাদের বিচার ব্যবস্থায় তার বিশ্বাস রেখেছেন, আমার নিজের সরকারের করা এই ধরনের গুরুতর এবং মিথ্যা অভিযোগের জন্য আমার খ্যাতি প্রমাণ করার অধিকার প্রত্যাখ্যান করা হতাশাজনক ছিল। আমি আনন্দিত যে, আমার প্রাথমিক অভিযোগের চার বছরেরও বেশি সময় পরে, আমি এখন আবারও সেই প্রমাণটি অনুসরণ করতে সক্ষম হয়েছি, যেটিকে আমি বেশ কয়েক বছর অতিবাহিত বলে মনে করি।”
এখন ব্রিটেনের আদালত তার নিজের গতিতেই অগ্রসর হবে, চৌধুরী মুঈনুদ্দীন যে কোন ভাবে তাকে নির্দোষ প্রমাণ করার চেষ্টা করবেন। কারণ তিনি খুব ভাল ভাবেই জানেন বিপক্ষে খুব শক্তিশালী প্রতিপক্ষ থাকবে না । আর যদি কোন ভাবে সেখানে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে পারেন, তাহলে বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধের বিচারকে আন্তর্জাতিক ভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করার সেই সুযোগটা পেয়ে যাবে।
২০১৩ সাল থেকে দেশে বিদেশে লবিষ্ট নিয়োগ করে, নানা রকম প্রপাগান্ডা, গুজব, ভুল তথ্য পরিবেশন করে ও জামায়াতে ইসলামী ও তার অনুঘটকগণ ঘটাতে পারেনি, সেই কাজটা আদালতের রায়ে হয়ে যাবে। তাই তার অনুসারীরা এখানে সর্ব শক্তি নিয়োগ করবে চৌধুরী মঈনুদ্দীকে নির্দোষ প্রমাণের।
হোম অফিস তখন যে বক্তব্য দিয়েছিল, বিশেষ করে, এটা দৃঢ়ভাবে বলা হয়েছিল যে মুঈনুদ্দীনের মানহানির দাবিটি বাংলাদেশে আইসিটি দ্বারা তার ২০১৩ সালের দোষী সাব্যস্ত হওয়ার উপর একটি অনুপযুক্ত সমান্তরাল আক্রমণ হিসাবে (ইংরেজি) হাই কোর্টে একটি মানহানির দাবি ব্যবহার করার প্রচেষ্টা ছাড়া আর কিছুই নয়। সেই কাজটিই চৌধুরী মুঈনুদ্দীন করেছেন। সমান্তরাল আক্রমণ। উচ্চ আদালতের রায়কে খুব সাধারণ ভাবে দেখলে একজন নাগরিকের আদালতে প্রবেশ বা অভিযোগ করার ক্ষমতাটুকু দিয়েছে।
খুব সংক্ষিপ্ত ভাবে বললে, আগে আপিল আদালতের নেওয়া সিদ্ধান্ত এবং প্রক্রিয়াকে দৃঢ়ভাবে প্রত্যাখ্যান করেছে. এবং লর্ড রিড পর্যবেক্ষণ করেছেন (অনুচ্ছেদ ৩৬ এ): “... ব্যক্তিদের তাদের নাগরিক অধিকার নির্ধারণের জন্য আদালতে প্রবেশের মৌলিক অধিকার রয়েছে। সেই অধিকারটি বহু শতাব্দী ধরে সাধারণ আইন দ্বারা স্বীকৃত হয়েছে, এবং ম্যাগনা কার্টা থেকে আইন দ্বারা সুরক্ষিত হয়েছে। মূলত আদালতে মামলা চালিয়ে যাওয়ার যে মৌলিক অধিকার সেই অধিকারটুকু ফিরে পেয়েছেন চৌধুরী মুঈনুদ্দীন। কিন্তু এই মামলার বিষয়বস্তু সুদূর প্রসারী প্রভাব পড়বে বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থার উপর।
বাংলাদেশে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি একটি আনুষ্ঠানিক প্রতিবাদ জানিয়েছে। তারা এ রায়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে তিন সংগঠনের যৌথ বিবৃতিতে বলা হচ্ছে, “১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় আমাদের বরেণ্য বুদ্ধিজীবীদের পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ডে চৌধুরী মুঈনুদ্দীনের জড়িত থাকার প্রামাণিক দলিল রয়েছে।
“তা সত্ত্বেও তাকে ব্রিটিশ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বিরুদ্ধে মানহানি করার জন্য ক্ষতিপূরণ চেয়ে মামলা করার অনুমতি দেওয়ার সুপ্রিম কোর্টের সিদ্ধান্তটি বাংলাদেশে সংঘটিত যুদ্ধাপরাধের জন্য ন্যায়বিচারের প্রতি একটি মারাত্মক আঘাত বলে আমরা মনে করি।
“বিশ্বের প্রতিটি দেশের নিজস্ব বিচার ব্যবস্থা আছে, যা স্বাধীন ও সার্বভৌম হিসেবে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। আমরা মনে করি, বাংলাদেশ যেমন যুক্তরাজ্যের আদালতের রায়ের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকবে, তেমনি যুক্তরাজ্যও বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের মত নিজস্ব আইনি প্রক্রিয়ায় চৌধুরী মুঈনুদ্দীনের মামলার রায়ের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করবে। কিন্তু মূল উদ্যোগটা নিতে হবে বাংলাদেশ সরকারকে, আন্তর্জাতিক ভাবে পর্যাপ্ত পরিমাণ সাক্ষ্য প্রমাণ আছে আদালতে তাকে অপরাধী প্রমাণ করার।
চ্যানেল ফোর যখন ১৯৯৫ সালে 'ওয়ার্ল্ড ওয়ার ক্রাইম ফাইল' শিরোনামে ডকুমেন্টারি প্রচার করে, সেসময় সেই প্রতিবেদন বিস্তারিত ফাইল বাংলাদেশ সরকারকে পাঠিয়েছিল। তখনকার বিএনপি সরকার সেই ফাইল কী করেছিল বা আদৌ ফাইলটি আছে, না গায়েব হয়ে গেছে- তা কেউ জানেন কিনা জানি না। কারণ ১৯৭১ সালে পাকিস্তান থেকে ব্রিটেনে আসার পর, জিয়াউর রহমান এবং এরশাদ দুইজনই চৌধুরী মুঈনুদ্দীনকে বাংলাদেশে স্বাগত জানিয়েছিল এবং দুর্ভাগ্যজনক ভাবে তাকে পুলিশি নিরাপত্তা ও দেয়া হয়েছিল ।
আওয়ামী লীগ সরকার ১৯৯৬ সালে রাষ্ট্র পরিচালনায় আসলে, ১৯৯৭ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর শহীদ প্রফেসর গিয়াস উদ্দীনের বোন ফরিদা বানু রমনা থানায় চৌধুরী মুঈনুদ্দীনের বিরুদ্ধে প্রথম হত্যা মামলা করেছিলেন। পরবর্তীতে রমনা থানা থেকে মুন্সী আতিক নামে এক গোয়েন্দা কর্মকর্তা ঘটনা তদন্তে লন্ডন এসে ছিলেন। এবং যতদূর জানা যায়, ফিরে গিয়ে একটা তদন্ত প্রতিবেদনও জমা দিয়েছিলেন।
এর বাইরে, ব্রিটেন এবং ইউরোপে জঙ্গিদের মদদদাতা, পৃষ্ঠপোষক এবং সংশ্লিষ্ট সংগঠন ও ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে তদন্ত করে ২১০৫ সালের ১৭ ডিসেম্বর হাউজ অফ কমন্সে "মুসলিম ব্রাদার হুড রিভিউ: মেইন ফাইন্ডিং" শিরোনামে এগারো পৃষ্ঠার একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল। প্রায় এক বছরের বেশি সময় ধরে যুক্তরাজ্য এবং ইউরোপের বারোটি দেশের পররাষ্ট্র দপ্তর এবং গোয়েন্দা বিভাগের সহায়তায় পরিচালিত হওয়া এই তদন্ত প্রতিবেদনে উঠে আসে ব্রিটেন এবং ইউরোপে মুসলিম ব্রাদারহুড, হামাসসহ নানা ধরনের ইসলামিক জঙ্গি সংগঠনের দীর্ঘদিনের সম্পর্ক। যুক্তরাজ্যস্থ অন্য সংগঠনের পাশাপাশি এই দীর্ঘ সম্পর্কের অন্যতম প্রধান অকুস্থল হিসেবে বিভিন্ন মসজিদ এবং সংগঠন হিসেবে জামায়াতে ইসলামীকে অভিযুক্ত করা হয়েছিল। ব্রিটেনের অভিজ্ঞ দুইজন সরকারি আমলা স্যার জন জেনকিন্স এবং চার্লস ফার কর্তৃক পরিচালিত এই তদন্তে উঠে আসে কিভাবে পশ্চিমা বিশ্বের উদার অভিবাসন নীতি এবং আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে নামে বেনামে বিভিন্ন চ্যারিটি সংগঠনের মাধ্যমে ফান্ড কালেকশন করে সেই টাকা গরিব-দুঃস্থদের নাম ভাঙিয়ে বিভিন্ন মুসলিম দেশের জঙ্গি সংগঠনদের আর্থিক সহায়তা দান করা হয়।
প্রতিবেদনটিতে আরও উল্লেখ করা হয়েছিল বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল থেকে মৃত্যুদণ্ডাদেশপ্রাপ্ত পলাতক যুদ্ধাপরাধী চৌধুরী মুঈনুদ্দীনের 'ইসলামিক ফোরাম ফর ইউরোপ (IFE)' ব্রিটিশ মূলধারার রাজনীতিতে খুবই সক্রিয়। পূর্ব লন্ডনের টাওয়ার হ্যামলেটের স্থানীয় সরকারের কিছু অংশ 'রেসপেক্ট পার্টি'- এদের দ্বারা সমর্থিত। রিপোর্টে ইসলামিক ফোরাম ফর ইউরোপ (IFE) এর সাথে সম্পৃক্ততার বিষয়টিও সেখানে উল্লেখ করা হয়। উক্ত রিপোর্ট প্রকাশের পর সেই সময়কার ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন, হাউজ অব পার্লামেন্টে তার এর লিখিত বক্তব্যে বলেন, "আমরা ইতিমধ্যে এই তদন্ত রিপোর্ট গুরুত্বের সাথে আমলে নিয়েছি এবং যথাযোগ্য পদক্ষেপ নেওয়া শুরু করেছি। ব্রিটেনে বসবাস করে ব্রিটেনে অথবা বিশ্বের যেকোনো দেশে জঙ্গিবাদের পৃষ্ঠপোষকদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেবে সরকার।
বাংলাদেশ সরকারের এখন উচিত আদালতে বাংলাদেশের পক্ষে প্রতিনিধি নিয়োগ করে চৌধুরী মুঈনুদ্দীনকে অপরাধী হিসাবে প্রমাণ করা। সেটি করতে ব্যর্থ হলে বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধের পুরো বিচার প্রক্রিয়া আন্তর্জাতিকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে থাকবে।
মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।
আপনার মন্তব্য