প্রধান সম্পাদক : কবির য়াহমদ
সহকারী সম্পাদক : নন্দলাল গোপ
টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
Advertise
জুয়েল রাজ | ১০ জুলাই, ২০২৪
পহেলা জুলাই থেকে চলছে কোটা বিরোধী অবরোধ, বলা যায় সারা দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছে এই আন্দোলন। ২০১৮ সালে কোটা পদ্ধতি বাতিল করার আগ পর্যন্ত সরকারি চাকরিতে নিয়োগে ৫৬ শতাংশ পদ বিভিন্ন কোটার জন্য সংরক্ষণ করা হতো। এর মধ্যে মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের জন্য ছিল ৩০ শতাংশ, নারী ১০ শতাংশ, জেলা ১০ শতাংশ, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী ৫ শতাংশ, প্রতিবন্ধী ১ শতাংশ কোটা। এই কোটা সংস্কার করে ১০ শতাংশ করার দাবিতে ২০১৮ সালে আন্দোলনে নামে বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ।
সেই সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, "ছাত্ররা কোটা ব্যবস্থা চায় না। তারা আন্দোলন করেছে। ফলে কোটা ব্যবস্থা বাতিল করে দেওয়া হয়েছে। এনিয়ে আর আলোচনা করার বা হা-হুতাশ করার কিছু নেই। আমি বলে দিয়েছি থাকবে না।”
সেই থাকবে নাকি কীভাবে কার্যকর করা যায়, সেজন্য ক্যাবিনেট সেক্রেটারিকে দিয়ে একটি কমিটি করে দেয়া হয়েছে, যাতে এটা বাস্তবায়ন করা যায়। এরপর ওই বছরের ৪ অক্টোবর একটি প্রজ্ঞাপন জারি করে কোটা ব্যবস্থা পুরোপুরি বাতিল করে দেয় সরকার।
তবে ২০২১ সালে কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হাইকোর্টে রিট করলে গত ৫ জুন এক রায়ের মাধ্যমে আবারও ফিরে আসে কোটা। এরপর কোটা বাতিলে গত ১ জুলাই আন্দোলনে নামেন শিক্ষার্থীরা। কোটা নিয়ে আন্দোলনে বারবার আলোচনায় আসে মুক্তিযোদ্ধা কোটার বিষয়টি। এই৩০ শতাংশ কোটা নিয়েই মূলত যত মাথাব্যথা বা সমস্যা।মুক্তিযোদ্ধা কোটা নিয়ে নানা প্রসঙ্গ, দ্বিমত, আলোচনা আছে। মুক্তিযোদ্ধা কোটা ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু চালু করেছিলেন। পরে নানা সময় এর কলেবর বা সুযোগ সুবিধা বৃদ্ধি পেয়েছে। মুক্তিযোদ্ধারা যারা ৭১র মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন তারা কি কোটার জন্য কিংবা ভাতার জন্য অথবা রাষ্ট্রীয় সুবিধা ভোগের জন্য যুদ্ধে গিয়েছিলেন? নিশ্চয় নয়। তারা জানতেনই না দেশ কবে স্বাধীন হবে,স্বাধীন দেশে আদৌ ফিরতে পারবেন কী না, অথবা জীবিত থাকবেন না কখন শহীদ হবেন তার কিছুই তাদের জানা ছিল না।শুধুমাত্র একটি মুক্ত স্বাধীন দেশের জন্য তারা জীবন বাজি রেখেছিলেন।
স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে বাংলাদেশ সেই ঋণমুক্তির দায় থেকেই, আমার মত এবং ধারণা মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের সন্তানদের জন্য এই কোটা পদ্ধতি চালু করেছিলেন বঙ্গবন্ধু।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা শহুরে জীবনে অভ্যস্ত, প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা অর্জন করা শিক্ষার্থীরা জানেন না ।প্রত্যন্ত অঞ্চলের একটা ছেলে মেধা দিয়েই লিখিত পরীক্ষায় পাস করে যদি মুক্তিযোদ্ধা পোষ্য কোটায় একটা চাকরি পায় তাতে আপনাদের মেনে নিতে সমস্যা কোথায়? আমরা যারা প্রত্যন্ত এলাকা থেকে উঠে এসেছি দেখেছি দরিদ্র মুক্তিযোদ্ধাদের,তাদের সন্তানদের কি অমানবিক পরিশ্রম করে পড়ালেখা করিয়েছেন, দিনশেষে এদের সন্তানরা যখন দ্বিতীয়, তৃতীয় শ্রেণির চাকরীতে নিয়োগ পেয়েছে, মানুষগুলোর আনন্দ এবং সুখ দেখেছি।
সংবাদপত্রে তো প্রায়ই দেখি বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষায় কোন কোন ইউনিটে ১ শতাংশ দুই শতাংশ উত্তীর্ণ হয়েছেন।যোগ্য প্রার্থীর অভাবে নিয়োগ প্রক্রিয়া বাতিল, এসব তো গণমাধ্যমে প্রকাশিত। সর্বশেষ প্রশ্নপত্র ফাঁসের যে মহোৎসবের সংবাদ দেখলাম, এরপর তো কোন কর্মকর্তা দেখলেই মনে প্রথম প্রশ্নটাই আসবে প্রকৃত মেধাবী না ফাঁস প্রশ্নের মেধাবী? আপনি কোন মেধা নিয়ে যুদ্ধটা করতে আসছেন? মেধাবী মানে কি গ্রন্থগত মুখস্থ বিদ্যা দিয়ে আপনি একটা চাকরি বাগিয়ে নিয়ে দেশ ও জাতিকে উদ্ধার করে দিবেন ?সম্ভব না আপনি বড়জোর মতিউর বা বেনজির হতে পারবেন।
যদি সহনশীল না হতে পারেন, পরের উপকারে না লাগেন, এই শিক্ষা শুধু ঘুষ খাওয়ার টাকার মেশিন ছাড়া আপনি আর কিছুই না। প্রকৃতি মেধাবীরা কখনো কোটার আশা করেনা। প্রতিযোগিতা ভয় পায়না। তার মেধাই তাকে অভীষ্ট লক্ষ্যে পোঁছে দেয়।
এমন বহু মানুষকে জানি, যারা নানা বৈষম্য মোকাবেলা করে জীবনে জয়ী হয়েছেন।
আপনারা যারা এই আন্দোলন করছেন, আপনাদের চোখের সামনে দেখছেন চাকরী পেয়ে রাতারাতি চারপাশে লোকজন এখন আর কোটি পতি নয়, মিলিয়নপতি বিলিয়নপতি বনে যাচ্ছেন। সেই লোভটা সংবরণ করতে পারছেন না হয়তো।
মেধাবীরা প্রতিযোগিতা ভয় পায় না। কোটা পদ্ধতি পৃথিবীর সব দেশেই কম বেশি আছে ।
৪৩তম বিসিএস পরীক্ষায় লিখিত পরীক্ষা দিয়েছিলেন মোট১৩ হাজার ৬৭১ জন। লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পেরেছেন মাত্র ৯ হাজার ৮৪০ জন।এখন লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ এই ৯ হাজার ৮৪০ জন থেকে মৌখিক পরীক্ষার মাধ্যমে নিয়োগ পাবে মাত্র ২ হাজার ১৬৩ জন। আর এই সংখ্যার সাথে ভাগাভাগি হবে কোটার।
বারবার যে ৫৬ ভাগ কোটার কথা বলা হচ্ছে মূলত তো শতভাগ পরীক্ষার্থীই ঘুরেফিরে এর ভিতরে থাকছেন। কোটায় যারা আসবেন তারা তো সব শিক্ষার্থীর সাথে প্রতিযোগিতা করে চূড়ান্ত নিয়োগে আসবেন।
২০১৮ সালের আন্দোলনের আমি এই একটা জায়গায় আমি একমত ছিলাম, কোটায় কোনও ধরনের বিশেষ পরীক্ষা নেয়া যাবে না (কিছুক্ষেত্রে সাধারণ শিক্ষার্থীরা চাকরি আবেদনই করতে পারেননা কেবল কোটায় অন্তর্ভুক্তরা পারে)।
আমাদের বন্ধুদের অনেকে কোটার সুযোগ নিয়ে চাকরিতে সুপারিশ প্রাপ্ত হয়েছেন। প্রকৃত অর্থেই এরা মেধাবী ছিল হয়ত কোটা তার নিয়োগ প্রক্রিয়াটাকে সামান্য সহায়তা করেছে। এবং দেশের প্রতি দায়িত্বের প্রতি তাদের দায়িত্বশীলতার প্রমাণও পেয়েছি। তাদের দেশপ্রেম নিয়ে, মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হিসাবে দায়বদ্ধতার শপথ দেখেছি। বাকিটা সময় বলে দেবে। কতটা সত্য কিংবা মিথ্যা। কারণ বেনজির মতিউর গং ভয় লাগিয়ে দিয়েছে আমাদের।
১৯৪৮ সালে জাতিসংঘের মানবাধিকারের সার্বজনীন ঘোষণাপত্রে বলা হয়েছে "সমস্ত মানুষ এবং সমস্ত জাতির জন্য অর্জনের একটি সাধারণ মানদণ্ড" হিসাবে গৃহীত, UDHR জাতিগুলিকে "জাতীয়তা, বসবাসের স্থান, লিঙ্গ, জাতীয় বা জাতিগত নির্বিশেষে" সমস্ত মানুষকে "স্বাধীন এবং মর্যাদা ও অধিকারে সমান" হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়।
কোটা পদ্ধতি সারা পৃথিবীতেই বিদ্যমান আছে, এমন কি সব নাগরিকের মৌলিক অধিকার পূরণ করার পরও ব্রিটেনের মত দেশে প্রতিটা জায়গায় সেটি হোক আবাসন, হোক চিকিৎসা শিক্ষা সব জায়গায় আবেদন বা কোন ফরম পূরণ করতে গেলে আলাদা একটা কলাম আছে সেখানে উল্লেখ থাকে আপনি কি কোনোদিন ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে ছিলেন কী না? যদি থাকেন দেশের প্রতিটা সেবায় তারা অগ্রাধিকার পেয়ে থাকেন, তাদের সন্তান পরিবার অগ্রাধিকার পেয়ে থাকেন।
বাংলাদেশে ছাত্র আন্দোলনের বর্ণাঢ্য যে ইতিহাস সেখানে শিক্ষা আন্দোলন থেকে রাজনৈতিক আন্দোলন সবই ছিল। সাধারণ মানুষ সেসব আন্দোলনে ব্যাপক ভাবে সম্পৃক্ত হয়েছে। কারণ সাধারণ মানুষের জন্য, মানুষের মুক্তির জন্য, অধিকারের জন্য তারা আন্দোলন করেছেন।এরা আসলে মেধাবী ছিলেন না। মেধাবী হলে হাজার হাজার কোটি টাকার সম্পদ গড়ে প্রজন্মের পর প্রজন্ম বসে বসে খেতে পারতেন।
বাংলাদেশের ইতিহাসে ছাত্র আন্দোলনের এক অন্যতম দৃষ্টান্ত হলো ভাষা আন্দোলন। ১৯৫২ সালে, ঢাকার ছাত্ররা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে আন্দোলনে নামে। ২১ফেব্রুয়ারি, ছাত্রদের রক্তক্ষয়ী আন্দোলনের পরিণামে বাংলাভাষা রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃত হয়।
১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন – শরীফ শিক্ষা কমিশনের বিরুদ্ধে – সেখানে ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়ন নেতৃত্ব দেয়। ১৯৬৯ সালে, বাংলাদেশের ছাত্ররা পাকিস্তানি শাসনের বিরুদ্ধে গণঅভ্যুত্থান গড়ে তোলে। এই আন্দোলনে ছাত্ররা মুখ্য ভূমিকা পালন করে এবং এটি বাংলাদেশের স্বাধীনতার সংগ্রামের পথপ্রদর্শক হিসেবে কাজ করে।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়, ছাত্ররা মুক্তিবাহিনীর সংগঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তারা পাকিস্তানি শাসনের বিরুদ্ধে স্বাধীনতার লড়াইয়ে অংশ নেয়।
১৯৯০ সালের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে ছাত্ররা এরশাদ সরকারের পতনের জন্য আন্দোলন করে। এই আন্দোলনে ছাত্ররা সরাসরি অংশগ্রহণ করে এবং এরশাদ সরকারের পতন ঘটায়।
২০১৩ সালের গণজাগরণ মঞ্চ ও ছাত্রদের বিরাট অংশগ্রহণ ছিল।
২০১৮ সালে, ঢাকায় দুটি শিক্ষার্থীর মৃত্যুতে শিক্ষার্থীরা সড়ক নিরাপত্তার দাবিতে আন্দোলনে নামে। এই আন্দোলন ব্যাপক জনসমর্থন পায় এবং সরকারকে সড়ক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বাধ্য করে।
অতীতের কোন আন্দোলন আদালতে গড়ায়নি। কিন্তু কোটা আন্দোলন গড়িয়েছে। তার মানে এর পক্ষ বিপক্ষ দুইটাই আছে। এখন যারা আন্দোলন করছেন তাদের আদালতের সাথে আইনি মোকাবেলা করতে হবে।
কোটা নিয়ে বারবার কূটচাল কেন? বারবার মুক্তিযোদ্ধাদের হেয় করার এক ধরণের প্রবণতা পরিলক্ষিত হয়। এত মেধাবী লইয়া বাংলাদেশ কি করিবে? বাংলাদেশে এতো মেধাবী আছে এই আন্দোলন না হইলে জানা হইত না।
যুদ্ধাপরাধী মঈনুদ্দিন এর একটি মামলার রায় দিল আদালত যে রায়ে হয়ত ইতিহাসের পাতায় তাকে আর ঘাতক বলার ও সুযোগ থাকবে না। এই মেধাবীরা যদি সরকার কে চাপ দিত আন্তর্জাতিক ভাবে এই মামলা লড়বার জন্য। মেধাবীরা যদি মাঠে নামতেন দুর্নীতির বিরুদ্ধে, দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে, প্রশ্নপত্র ফাঁসের বিরুদ্ধে এই আন্দোলন হত খুশি হতাম। বুঝতাম মেধাবী দেশপ্রেমিক প্রজন্ম দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। কিন্তু দুর্ভাগ্য আমরা পেয়েছি এক ঝাঁক বিসিএস লোভী প্রজন্ম।
মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।
আপনার মন্তব্য