প্রধান সম্পাদক : কবির য়াহমদ
সহকারী সম্পাদক : নন্দলাল গোপ
টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
Advertise
ফরিদ আহমেদ | ১১ আগস্ট, ২০২৪
গণআন্দোলনের মাধ্যমের এরশাদের যখন পতন ঘটেছিল, আমরা প্রবলভাবে উল্লসিত ছিলাম, আনন্দের জোয়ারে ভাসছিলাম। দেশে গণতন্ত্র আসবে, সেই খুশিতেই আত্মহারা ছিলাম। আমরা কেউ তখন বলি নাই যে দেশ স্বাধীন হয়েছে। দেশ তো কোনো বিদেশি শক্তির পরাধীন ছিলো না যে এরশাদের পতনের ফলে স্বাধীনতা এসেছে আমাদের জন্য। এর বদলে আমরা বলতাম দেশ স্বৈরাচার মুক্ত হয়েছে।
এইবার শেখ হাসিনার দীর্ঘ স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে জনতার জয় হয়েছে। অনেকেই উল্লাস করছে দেশ স্বাধীন হয়েছে বলে। হয়তো অতি আনন্দে এবং অতি আবেগে তারা এই কথা বলছে। এর অন্তর্নিহিত কোনো অর্থ নেই। আবার কারও কারও কাছে হয়তো এর গভীর অর্থও আছে। জামায়াতে ইসলামি বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিপক্ষে ছিল। পাকিস্তান ভেঙে বাংলাদেশ হোক, সেটা তারা চায়নি। চায়নি বলে পুরো একাত্তর সাল জুড়ে এরা বাংলাদেশে নারকীয় এক পরিস্থিতি তৈরি করে রেখেছিল। স্বাধীনতাকামী মানুষদের নৃশংসভাবে হত্যা করেছে তারা। সেই সময়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছে আওয়ামী লীগ। যে কারণে জামায়াতের কাছে আওয়ামী লীগ হচ্ছে চিরশত্রু। আওয়ামী লীগের পতন তাই জামায়াত এবং শিবিরের কাছে দেশ স্বাধীন হবার আনন্দ দেবে, এটাই স্বাভাবিক। এদের হিসাব আলাদা।
যাদের আবেগে কোনো অন্তর্নিহিত অর্থ নেই তাদের জন্য বলছি, একটা শক্তিশালী স্বৈরাচারের পতন হয়েছে বাংলাদেশে। এটা অবশ্যই অনেক আনন্দের ঘটনা এবং আমাদের জন্য আশাব্যঞ্জক বটে। এটা গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের পথে আমাদের সাহায্য করবে। দেশে গণতন্ত্র হলে, গণতান্ত্রিক চর্চা ধারাবাহিক হলে, এখন যে ভয়হীন একটা সময় পার করছে, বাক-স্বাধীনতা ভোগ করছেন, সেটা চিরস্থায়ী হবে। আর এটাকে যদি বিপ্লব ভাবেন, দেশ স্বাধীন হওয়া ভাবেন, তবে সেটার পরিণতি খুব ভয়াবহ হবে। গণতন্ত্রে আর ফেরা হবে না আমাদের। এক স্বৈরাচারের হাত থেকে রক্ষা পেয়ে আরেক স্বৈরাচারের হাতে গিয়ে পড়তে হবে আমাদের তখন। যেটার লক্ষণ খুব সূক্ষ্মভাবে এখনই দেখা যাচ্ছে।
গণআন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনার পলায়নের পরে ড. ইউনুসকে প্রধান করে একটা অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করা হয়েছে। এই সময়টা বাংলাদেশের জন্য একটা ক্রান্তিকাল ছিল। শেখ হাসিনা যদি দেশে থেকে একটা গ্রহণযোগ্য অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের হাতে ক্ষমতা ছাড়লে আমাদের ওই ক্রান্তিকালটা দেখতে হতো না। ধীরে সুস্থে আলোচনার মাধ্যমে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করা যেতো, হাসিনার পদত্যাগের পরপরই তারা কার্যকর হতো। এতে করে বাংলাদেশ যে প্রায় তিন দিন সরকার-বিহীন ছিল, সেটা হতো। কার্যকর কোনো সরকার না থাকার কারণে অশুভ শক্তি যে যেভাবে পারে সুযোগ নিয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী-পক্ষ স্বাধীনতার স্মৃতিচিহ্ন আছে এমন সব স্থাপনাগুলোকে ধ্বংস করেছে, সাম্প্রদায়িক শক্তি হিন্দুদের উপর আক্রমণ করেছে, ডাকাতশ্রেণি ডাকাতি করতে নেমেছে।
দেশে কোনো সরকার না থাকাতে তাড়াহুড়ো করে সরকার গঠন করতে হয়েছে। এটা যেহেতু নির্বাচিত সরকার না, সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল এর প্রধান হিসাবে কাউকে নিয়োগ দেওয়া। এ ক্ষেত্রে ড. ইউনুসের চেয়ে যোগ্য কোনো ব্যক্তি এই মুহূর্তে বাংলাদেশে ছিল না। শান্তিতে নোবেল বিজয়ী তিনি। বাংলাদেশের সবচেয়ে হাই প্রোফাইল ব্যক্তিত্ব। তিনি এই দায়িত্ব নেওয়াতে তেমন কোনো বিতর্ক হয়নি, সবাই সহজেই মেনে নিয়েছেন।
আমি আগেই বলেছি, এই আন্দোলনের মাধ্যমে স্বৈরাচারের পতন ঘটেছে শুধু। স্বৈরাচার পতনের আন্দোলন ছিল এটা, কোনো বিপ্লব না। কাজেই এই অনির্বাচিত সরকারের প্রধান কাজ হবে দ্রুততম সময়ে বাংলাদেশকে গণতান্ত্রিক রাস্তায় ফিরিয়ে দেওয়া, যে রাস্তা থেকে শেখ হাসিনা দেশটাকে সরিয়ে নিয়েছিলেন। এর বাইরে শুধুমাত্র রুটিন কাজগুলোই তারা করবে।
এই সরকার গঠনের পরেই কিছুটা অস্বস্তিতে ছিলাম আমি। মনে হচ্ছিলো যে এই সরকার দীর্ঘায়িত হতে পারে। দুইদিন আগে দেবুর একটা পোস্টে এই সরকার সাংবিধানিকভাবে বৈধ কিনা সেই আলোচনা করার এক পর্যায়ে আমি বলেছিলাম যে, “আমার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় আমাকে সতর্ক করছে যে এই সরকার দীর্ঘায়িত হতে পারে। সেটা হলে দেশের জন্য আরও বড় সংকট তৈরি হবে। এক সংকট থেকে বাঁচতে, না বাঁচতে আরেক সংকটে পড়াটা বিরাট হতাশাজনক হবে। আমি তীব্রভাবে আশা করছি যে আমার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় ভুল সতর্কবার্তা দিচ্ছে আমাকে।"
আমার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ের যে সতর্কবার্তা সেটার পিছনেও মূলত ড. ইউনুসই দায়ী। এখনকার প্রজন্ম জানে না, কিন্তু আমরা জানি ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হবার জন্য ড. ইউনুসকে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। তিনি মাত্র তিন মাসের জন্য সরকার প্রধান হতে আগ্রহী হননি (তিনি অবশ্য পরে এটাকে অস্বীকার করেছিলেন)। তিনি চেয়েছিলেন দীর্ঘ সময়ের জন্য দেশের দায়িত্ব নেবেন। এর জন্য তিনি 'নাগরিক শক্তি' নামে একটা দলও গঠন করেছিলেন। সেই সেনা শাসনের সময়ে যখন সব রাজনৈতিক দলের কার্যক্রম নিষিদ্ধ ছিল, ড. ইউনুস তাদের প্রশ্রয়ে নির্বিঘ্নে রাজনৈতিক কার্যক্রম চালিয়ে গিয়েছেন। যদিও মাত্র তিন মাস পরেই তিনি সেই দলের সমাপ্তি ঘোষণা করেন।
২০০৭ সালে যিনি স্বল্প সময়ের জন্য সরকার প্রধান হতে আগ্রহী হননি, দীর্ঘ সময় ক্ষমতায় থাকার জন্য সেনা প্রশ্রয়ে রাজনৈতিক দল গঠন করেছিলেন ফাঁকা মাঠে, তিনি এইবার স্বল্পকালীন সময়ের জন্য ক্ষমতা নেবেন, সেটা আমার জন্য বিস্ময়ের ছিল। যদিও আমি জানি সময়ের সাথে সাথে মানুষ বদলায়, তাদের চিন্তা-ভাবনা এবং আকাঙ্ক্ষারও বদল হয়, ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি হয়। ড. ইউনুসেরও হয়তো সেটাই হয়েছে। তিনি হয়তো সত্যি সত্যিই চাচ্ছেন দেশের জন্য কিছু একটা করার। দেশকে গণতান্ত্রিক পথে নিয়ে যাওয়াটাও বিশাল একটা কাজই।
আমার এই আশাবাদে জল ঢেলে দিয়েছেন এই অন্তর্বর্তী সরকারের একজন উপদেষ্টা ফরিদা আখতার। তিনি বলেছেন, "অন্তর্বর্তী সরকার আর কেয়ারটেকার সরকার এক নয়।" তিনি সেই পার্থক্যকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেছেন, “‘আগে যেটা হতো, একটা সরকারের মেয়াদ ফুরিয়ে গেলে নির্বাচন দেওয়ার জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকার হতো। তারা রুটিন ওয়ার্ক করত। কিন্তু এটা একটা গণ-অভ্যুত্থান এবং আন্দোলনের মাধ্যমে তৈরি হওয়া সরকার। কাজেই এর প্রধান কাজ নির্বাচন না। এর প্রধান কাজ হলো যে সমস্যাগুলো তৈরি হয়েছে, এগুলোকে অ্যাড্রেস করা। নির্বাচন তার মধ্যে একটা। সময়মতো আমরা এটা নিয়ে সিদ্ধান্ত নেব।"
আন্দোলনের সময়ে শিক্ষার্থীদের একটা দাবি ছিলো রাষ্ট্র সংস্কারের। সে বিষয়ে বলতে গিয়ে তিনি বলেছেন, “রাষ্ট্র সংস্কার একটা দীর্ঘমেয়াদি কাজ এবং বড় কাজ। এটাকে মাথায় রেখে ইমিডিয়েট যে সমস্যাগুলো আছে, ল অ্যান্ড অর্ডার সিচুয়েশন, সংখ্যালঘুদের ওপর আক্রমণ, পাশাপাশি নানা রকম যে অসুবিধাগুলো তৈরি হয়েছে, সেগুলো আমরা আগে দেখব। আমাদের প্রথম কাজ হচ্ছে, বর্তমান পরিস্থিতিতে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ঠিক করা। তারপর দীর্ঘমেয়াদিগুলো নিয়ে কাজ হবে।"
উনার বক্তব্য থেকে পরিষ্কার যে তাঁরা একটা সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর তাঁরা করতে চাচ্ছেন না। বরং রাষ্ট্র সংস্কারের মতো দীর্ঘমেয়াদী কাজগুলোকে তাঁরা প্রাধান্য দিচ্ছেন।
আন্দোলনের সময় রাষ্ট্র সংস্কারের দাবি ছিল, এটা সত্য। কিন্তু, সেই সংস্কার কোনো অনির্বাচিত সরকার করার অধিকার রাখে না। সেগুলো করবে জনগণের নির্বাচিত সরকার। এই সরকার একটা আপৎকালীন সরকার। রুটিন কাজের বাইরে কোনো ধরনের বড় কাজ বা নীতিনির্ধারণ করতে যাওয়াটা সংবিধান পরিপন্থী হবে। দেশের জন্য, জনগণের জন্য সেটা মোটেও শুভ কিছু হবে না।
হাসিনা মানুষকে ভোটের অধিকার থেকে বঞ্চিত করেছিল, তার পরিণতি কী হয়েছে সেটা আমরা চোখের সামনেই দেখেছি। এর আগে ফখরুদ্দিন-মঈনউদ্দিনের অনির্বাচিত সরকারও জোর করে ক্ষমতায় থাকার চেষ্টা করেছিল, তাদেরও পতন ঘটেছিল। এরাও যদি একই কাজ করতে যায়, এদের পরিণতিও একই হবে। এটাই ইতিহাসের শিক্ষা।
সমস্যা হচ্ছে, ইতিহাসের শিক্ষা কেউ নেয় না। এটাও ইতিহাসের আরেক শিক্ষা।
মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।
আপনার মন্তব্য