টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
Advertise
ড. নাদিম মাহমুদ | ১৬ আগস্ট, ২০২৫
অন্তত কয়েক দশক পর আওয়ামী লীগের দখলদারিত্বের হাত থেকে গতকাল 'বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান' মুক্ত হয়েছে। জনগণের শেখ মুজিব যে কতটা শক্তিশালী ও ভালোবাসা পাওয়ার যোগ্য তার নমুনা আমরা গতকাল সর্বস্তরের মানুষের অভিপ্রায়গুলো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে দেখতে পেয়েছি। কিন্তু এই জনপ্রিয়তাকে ভর করে যদি 'আওয়ামী লীগ মনে করে' তারা শক্তিশালী হয়ে গিয়েছে, যদি মনে করে তাদের নেতা-মন্ত্রীদের লুটপাট আর দুর্নীতির কথা মানুষ ভুলে গিয়েছে, চব্বিশের নির্বিচারে ঝরে যাওয়া তাজা প্রাণগুলোর মুখ ভুলে গিয়েছে, তাহলে সেটা হবে অনেকটাই বালুতে মুখ লুকানোর মত ঘটনা।
বঙ্গবন্ধুকে সম্মান জানানোয় যদি এই দলটির নেতা-কর্মীরা মনে করে, তাদের দলটি ভারী হয়ে গিয়েছে, তাহলে তারা এইটুকু যেন মনে রাখে, ফের যদি শেখ মুজিবুর রহমানের উপর ভর করে এই দলটি রাজনীতি করতে আসে, তাহলে যে সম্মান তিনি গতকাল পেয়েছেন, তা আগামী হারাবে। 'বঙ্গবন্ধুকে' আওয়ামী লীগের সম্পদ বানানোর খেসারত তারা যদি বুঝতে না পারে তাহলে আর বলবার কিছু নেই।
মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে জন্ম নেয়া এই রাষ্ট্রটি দীর্ঘদিন মুক্তিযুদ্ধের আসল ঘটনা জানা থেকে বিরত থেকেছিল। বলতে গেলে আশি ও নব্বইয়ের দশকের শুরুর দিক পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ স্মরণ অনেকটাই সীমাবদ্ধতার মধ্যে দিয়ে কেটেছে। ফলে এই দুটি জিনিসকে চেপে ধরে, যুদ্ধাপরাধীরা লাল-সবুজ পতাকা গাড়িতে নিয়ে মন্ত্রিত্ব করে গিয়েছে। অথচ যদি সেই সময় মুক্তিযুদ্ধের বিষয়গুলো সর্বস্তরের মানুষ জানত, পাঠ্যবইয়ে আসত, তাহলে রাজাকারগুলো অন্তত ত্রিশ লাখ শহিদের রক্তের বিনিময়ে পাওয়া এই দেশে মন্ত্রী-এমপি হতে পারত না। কিন্তু সেটা তা করতে পেরেছে, মুক্তিযুদ্ধের কণ্ঠ চেপে ধরে।
দিনশেষে মানুষ যখন জেনেছে, এই রাজাকারগুলোর কথা, বিচারের আওতায় যখন এসেছে, তখন তাদের অনুসারীরা বুঝছে এই দেশে ক্ষমতায় থাকতে হলে হয় মুক্তিযুদ্ধকে মেনে থাকতে হবে নতুবা এটাকে রোধ করে যেতে হবে। আর যখনই মুক্তিযুদ্ধের পাঠ আসবে, তখনই আসবে শেখ মুজিবুর রহমানের ছয় দফা, উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান, সত্তরের নির্বাচন, একাত্তরের সাতই মার্চের কথা। 'বাংলাদেশের' ইতিহাসে তিনি যে নায়ক, তা প্রমাণ করার জন্য কাউকে বলতে হবে না 'শেখ মুজিবুর রহমান' স্বাধীনতার স্থপতি। ইতিহাস যদি নির্মোহভাবে উপস্থাপন করতে বলা হয়, তাহলে তাকে আপনা-আপনি আনতে হবে। শাসক বঙ্গবন্ধুর ত্রুটি-বিচ্যুতি আমাদের মতই থাকবে, কিন্তু দিনেশেষে বাংলাদেশের বঙ্গবন্ধু তা প্রমাণ করার জন্য তার নিন্দুকদের কথা শুনবার প্রয়োজন পড়বে না।
ফলে চব্বিশের ক্ষমতাগ্রহীরা পূর্বের শিক্ষা থেকে নিশ্চিত হয়েছে, এই দেশে মুজিববাদ-মুর্দাবাদ না হয়, একাত্তরের পাশে চব্বিশকে দাঁড় করানো না যায়, রিসেট না দেয়া যায় তাহলে 'মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাংলাদেশ' থেকে কেউ দখল করতে পারবে না। বাংলাদেশ ২.০ করা যাবে না। রাজাকার মতাদর্শের কাউকে ক্ষমতায় আনা যাবে না। ফলশ্রুতিতে তারা দেখল, বঙ্গবন্ধুই একমাত্র শক্তি, যাকে নাই করে দিলে মুক্তিযুদ্ধের শক্তিক্ষয় হবে, মানুষকে বোকা বানানো যাবে। কিন্তু ওই মানুষগুলো জানে না, গত ৫৪ বছর ধরে যেসব নথি-পত্র আমরা পেয়েছি, মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে জেনেছি, ততবারই 'বঙ্গবন্ধু' প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছেন। এখন হাত বাড়ালে, গুগল করলে লাখ লাখ লেখা, ছবি, তথ্য ইন্টারনেটে ভেসে বেড়াচ্ছে। যুদ্ধাপরাধীদের কার কোন অপরাধে ফাঁসি হয়েছে, তার দালিলিক প্রমাণাদি ঘুরে বেড়াচ্ছে। সুতরাং আপনিও চাইলেও একাত্তরের জঘন্য অপরাধের জন্য জামায়াতের 'রাজাকার' অভিযুক্তদের 'নিষ্পাপ' বানাতে পারবেন না। বানাতে গেলে অনেকটাই আপনারা ক্লাউন হয়ে যাবেন।
আবার শেখ মুজিবুর রহমানকে হাজারো তকমা দিয়ে তাকে কলুষিত করতে পারবেন না। যেটা আপনাদের পূর্ব-পুরুষরা 'বঙ্গবন্ধু নিয়ে যে ন্যারেটিভ করেছিল, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে পাকিস্তানের পক্ষে থাকার যে যুক্তি দেখিয়েছিল, সেই একই চেনানো পথে হাঁটার কারণে তারা যেমন প্রত্যাখ্যাত হয়েছিল, ঠিক তেমনি আপনারা পুরাতন পথে হাঁটার কারণে 'নিক্ষিপ্ত' হবেন। অথচ এই চব্বিশ আপনাদের আমাদের মাঝে অনেক সম্ভাবনাময় পথ তৈরি করেছিল। মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুকে যদি সেই 'রাজাকারদের' ন্যারেটিভের ফাঁদে যদি পা না দিতেন, তাহলে এই দেশে আওয়ামী লীগের রাজনীতি 'অপ্রাসঙ্গিক ও জটিল' হয়ে পড়ত। কিন্তু আপনাদের দ্বিচারিতায় আওয়ামী লীগ ফেরানোর পথটি আপনারাই করে দিয়েছেন।
এখানে আমাদের মত সাধারণ মানুষ, যারা দেশটাকে ভালোবাসে, মুক্তিযুদ্ধকে সামনে রেখে বঙ্গবন্ধুর অবদানকে স্বীকার করে দেশটাকে এগিয়ে নেয়ার স্বপ্ন দেখে সেই মানুষগুলোকে আপনারা মিসগাইড করেছেন। আপনারা মুক্তিযুদ্ধকে নিয়ে বিতর্কিত করেছেন, বঙ্গবন্ধুকে ফেলে দিতে গিয়ে চব্বিশকে কলঙ্কিত করেছেন। আর সেই জন্য, আপনাদের 'রিসেট' বাটন 'রি-ইনস্টল' বাটন হিসেবে শেখ মুজিবুর রহমানকে বুক পেতে গ্রহণ করেছে। তাকে শ্রদ্ধা জানাচ্ছে। এই শ্রদ্ধা এতোটাই নিখাদ ও পবিত্র যে পঁচাত্তরের হত্যাকাণ্ডের পর শেখ মুজিবুর রহমান এতোটাই ভালোবাসায় সিক্ত হয়েছেন কি না তাতে আমার সন্দেহ জাগে।
তাই মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে আপনি তর্কে জড়াবেন তো এই দেশের মাটি ও মানুষের কাছে প্রত্যাখ্যানের শিকার হবেন তাতে কোন সন্দেহ নেই। কালকের ঘটনার পর নিশ্চয়, মনের ভিতর প্রশ্ন জাগছে, বত্রিশ নাম্বার বাড়ি ভাঙলাম, হাজার হাজার ভাস্কর্য ভাঙলাম, তার নাম মুছে দিলাম, এরপরও কি করে এই দেশের মানুষ 'শেখ মুজিবকে স্মরণ' করে? মুজিববাদ যে মুর্দাবাদ নয়, তা নিশ্চয় এখন বুঝতে পেরেছেন? যদি না বুঝতে পারেন, তাহলে ওই স্লোগানে বুঁদ থাকুন আর আগামী বছর এই দিনের জন্য অপেক্ষা করুন, এই দেশের সাধারণ মানুষ আপনাদের জবাব পোক্তভাবে দিয়ে দেবে।
মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।
আপনার মন্তব্য