আজ বৃহস্পতিবার, ১১ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

Advertise

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ভয় কিসে?

ড. নাদিম মাহমুদ  

দেশের রাজনৈতিক অঙ্গন থেকে কার্যত গত এক বছর ধরে আওয়ামী লীগের সুইচ অফ। এই দলটি বাংলাদেশের জন্য ভয়ের কারণ দেখিয়ে 'অন্তর্বর্তীকালীন সরকার' কার্যত টুঁটি চেপে ধরেছে, সাংগঠনিক কার্যক্রম নিষিদ্ধ করেছে। শ্বাস-প্রশ্বাস বন্ধ করার সব কৌশল প্রয়োগ করেছে। এমন একটি পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগের কোন কেন্দ্রীয় নেতা-কর্মী দেশে গত এক বছর দৃশ্যমান হয়নি, দু'একটি ঝটিকা মিছিল ব্যতীত দলটি বাংলাদেশ জুড়েই নিষ্ক্রিয়। হাজার হাজার নেতা-কর্মী জেলে।

সাংগঠনিক কার্যক্রমহীন একটি দল, যখন দেশের রাজনীতির বাহিরে, ভোটের হিসেবের বাহিরে চলে গিয়েছে তখন মাঝে মধ্যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। সরকারের ভিতর চাপা একটি ভয় কাজ করে। অনেকটাই ঘর পোড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখলে ডরের মত সরকার ভাবে ওই বুঝি আওয়ামী লীগ ফিরে আসছে। ওই বুঝি ওরা কোন পরিকল্পনা করেছে, ওই বুঝি মিছিলটি আওয়ামী লীগের।

যেহেতু ওই দলটির কার্যক্রম নেই, তাই সরকারের ভিতর এই সন্দেহ দানা বাধা স্বাভাবিক। কারণ, তারা তো আর বুঝতে পারছে না, আওয়ামী লীগ কী করছে, কী চাচ্ছে। ফলশ্রুতিতে আমরা দেখতে পেলাম, মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু ইস্যুগুলোকে এই সরকার বড্ড বেশি ভয় পায়। এখনো এই সরকার হয়ত মনে করে, বঙ্গবন্ধুকে নিঃশেষ করতে না পারলে আওয়ামী লীগের কবর রচনা হবে না, তাই গত এক বছর তারা সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছে, আঘাত করেছে। মুক্তিযুদ্ধ আওয়ামী লীগের আইডেনটি হতে পারে ভেবে, চব্বিশকে একাত্তরের মুখোমুখি করার চেষ্টা করছে, বাংলাদেশ ২.০, দ্বিতীয় স্বাধীনতা প্রচার করেও যখন কার্যোদ্ধার করতে পারছে না, তখন সরকার কিছুটা বিচলিত। আওয়ামী লীগকে হেনেস্তা করতে গিয়ে সরকার এই গণ-অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষা থেকে কয়েক মাইল দূরে ছিটকে পড়েছে তা টেরই পায়নি।

উনারা মনে করেছে, আওয়ামী লীগ যেসব প্যারামিটারের ভিতর আছে, সেইগুলোকে নিষ্প্রভ করতে পারলে দেশ থেকে এই চেতনার মানুষগুলো নির্মূল হয়ে পড়বে। ফলে একটার পর একটা বিতর্কিত কাজ করে, গণ-অভ্যুত্থানটার শক্তিকে খেয়ে ফেলছে। যার কারণে, হরহামেশায় সরকারকে রিচার্জ করার জন্য বিভিন্ন রাজনৈতিক দলকে ডাকছে, ঐক্যমত্যের কথা বলে নিজের ভিতর জমে থাকা ভয়-ভীতি কিছুটা প্রশমনের সুযোগ মিলছে।

প্রশ্ন হলো, এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কেন, এমন প্রতিশোধপরায়ণ হলো? উনারা কি জানে না, এই দেশ থেকে আওয়ামী লীগ, শেখ মুজিব, একাত্তর কখনোই নিঃশেষ করা যাবে না? উনারা মনে করে না, এই দেশে যখন কোন অপরাধীর উপর জুলুম চালানো হয়, তখন সাধারণ মানুষের সহানুভূতি আরও বেশি প্রবল হয়?

আওয়ামী লীগকে যদি কেউ এই মুহূর্তে জোর করে এনেও ক্ষমতায় বসিয়ে দিলে তারা দেশ পরিচালিত করতে পারবে না। ৫ আগস্টের পর যে শক্তি বাংলাদেশে চাড়া দিয়ে উঠেছে, সেই শক্তির বিপরীতে আওয়ামী লীগ জৌলুস ছড়ানো শুধু কঠিন না, কঠিনতর বটে। তৃণমূল থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া একটি দলকে ভয় পেয়ে, ইউনূস সরকার একের পর এক যেসব 'ক্ষমতাচর্চা' করেছে, তা কেবল নিষ্প্রয়োজনীয় ছিল না, বরং অযাচিত ছিল।

যে খাবার হজম করতে পারবেন না, সেই খাবার না খাওয়ায় শ্রেয়। আওয়ামী লীগ চেয়েছিল জামায়াতকে স্ন্যাকস হিসেবে খেতে, কিন্তু দিনশেষ পারেনি। জামায়াতে ইসলামী একাত্তরে পাকিস্তানিদের সাথে যোগসাজশ করে লাখ লাখ মানুষ মারার সহযোগী হওয়ার পর এই দেশের মানুষ দলটিকে ফেলে দেয়নি, সেখানে চব্বিশের ছাত্র-জনতার হত্যার অভিযোগে সাধারণ মানুষ কি আওয়ামী লীগকে মুছে ফেলবে? এমন ন্যারেটিভ যেসব উর্বর মস্তিষ্ক থেকে এসেছে, তারা মূলত দেশে একটি অস্থিতিশীলতার মধ্যে বছরের পর বছর লড়াই করুক, এমনটি প্রত্যাশা করে।

আওয়ামী লীগের লুটেরাদের বিচার করতে হবে। দুর্নীতিবাজ ও অপরাধীদের সনাক্ত করতে হবে। কিন্তু গত এক বছরে এই সরকার ঠিক কতজন আওয়ামী লীগের মন্ত্রী-এমপির বিরুদ্ধে দুর্নীতির প্রমাণ পেয়ে শাস্তি দিতে পেরেছে? কতজনের দুর্নীতির অকাট্য দলিল জনগণের কাছে বিশ্বাসযোগ্য করে তুলেছে?

করতে পারেনি। কারণ, এই সরকার যে ফ্যাসাদে দেশটাকে পরিচালিত করছে, তা দীর্ঘমেয়াদের 'প্রতিশোধ' পরায়ণতাকে উসকে দিয়েছে। রাজনৈতিক দমন-পীড়নের চরিত্র দেখিয়ে আওয়ামী লীগের প্রতি সাধারণ মানুষের সহানুভূতি বাড়িয়ে দিয়েছে, যার দায় এই সরকারের অপরিপক্ব সিদ্ধান্ত।

এই সরকার ও তার সহযোগীদের চোখে বিএনপি ও আওয়ামী লীগ সমকাতারে। এই দু'ই দলকে কোণঠাসা করে 'গণতান্ত্রিক' যাত্রার যে দীর্ঘমেয়াদী কৌশল রচিত করেছে, তা আগামীতে উগ্রবাদীতা আমাদের দুঃখের কারণ হয়ে দাঁড়াবে। এমন একটি পরিস্থিতি তৈরি হবে, এই দেশের রাজনীতি পুরোটাই 'ধর্মীয়' মোড়কে চলে যাবে। এখানে রাজনীতি করতে হলে এই জিনিসটির বাহিরে কেউ যেতে পারবে না। ফলে গণতান্ত্রিক চর্চায় আগামীতে ভোট পড়লেও দেশ পরিচালনা উনুনের উপর চলবে, মুখ থুবড়ে পড়ার সম্ভাবনা বেশি থাকবে।

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ফরাসি দার্শনিকদের চাণক্য একদিন দেশটাকে রক্তপাতের নরমভূমিতে পরিণত করবে। মানুষের পছন্দ/অপছন্দের উপর ছুরি চালানোর খেসারত পুরো জাতিকে দিতে হবে। ইতিহাসের এই দায় গিয়ে পড়বে, ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ এবং অন্তর্বর্তীকালীন অধ্যাপক ইউনূস সরকারের কাঁধে। তাদের ব্যর্থতার দায় জনগণ কেন মেনে নেবে? জনগণের পছন্দ/অপছন্দ ঠিক করে দেয়ার দায়িত্ব অন্তর্বর্তীকালীন সরকারই বা কেন নেবে?

ড. নাদিম মাহমুদ, গবেষক, ক‍্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়, যুক্তরাষ্ট্র

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অধ্যাপক ডা. শেখ মো. নাজমুল হাসান ২৭ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৮ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭২ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৫০ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬৪ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৮ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১১০ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. নাদিম মাহমুদ ৩৭ ড. মাহরুফ চৌধুরী ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪৫ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩২ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪৩ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯৪ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ৩২ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ