টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
Advertise
শুভাশিস ব্যানার্জি শুভ | ২০ সেপ্টেম্বর, ২০২৫
এ কথা অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই যে, আমরা সবাই এখন প্রযুক্তি বলয়ে আবদ্ধ। বলা যেতে পারে, প্রযুক্তি বলয়ে বিশ্ব। প্রযুক্তি জীবনকে সহজ করেছে। আরামপ্রদ করছে। করছে বিস্মিত। এই ধারা চলমান। এখন আমরা খুব সহজেই তথ্য আদান-প্রদান করতে পারি। জানতে পারি, জানাতেও পারি। কিন্তু যেটা পারি না, সেটা হচ্ছে অতীতে ফিরে যেতে। অতীতকে পুনর্জীবিত করতে। বিজ্ঞানের ভাষায় প্রযুক্তি হলো পণ্য ও সেবা উৎপাদন বা কোনো উদ্দেশ্য সাধনের জন্য ব্যবহৃত কৌশল, পদ্ধতি, দক্ষতা ও যন্ত্রের সমষ্টি। এটি বিজ্ঞানের ব্যবহারিক প্রয়োগ, যার মাধ্যমে মানুষের বাস্তব জীবনের সমস্যা সমাধান করা হয় এবং জীবনকে সহজ করা হয়। গ্রিক শব্দ 'টেকনিক' (যার অর্থ শিল্প বা নৈপুণ্য) থেকে 'প্রযুক্তি' শব্দটি এসেছে। এসব যন্ত্রের মন্ত্রে আমাদের থেকে ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে মানবিকতা। যন্ত্র নিয়ন্ত্রিত জীবনে কমছে আবেগ, বাড়ছে বৈষম্য।
সংকোচিত আবেগ এবং বর্ধিত বৈষম্যের বেড়াজালে বই পড়ার যে চিরাচরিত অভ্যাস সেটায় ব্যাঘাত সৃষ্টি হয়েছে। সমীক্ষা অনুসারে, বাংলাদেশিরা বছরে গড়ে ৬২ ঘণ্টা বই পড়ে। সেই হিসাবে বাংলাদেশিরা গড়ে দৈনিক ১০ মিনিট ১৯ সেকেন্ডের অল্প কিছু বেশি সময় বই পড়ে। বাংলাদেশিরা বছরে গড়ে পৌনে তিনটি বই পড়ে। আর সবচেয়ে কম বই পড়া দেশ হিসেবে তালিকায় থাকা আফগানরা পড়ে আড়াইটি বই! এমন অবস্থায় বই নিয়ে নতুন কিছু চিন্তা করা বা বই লেখায় লেখকরা বাধ্য হয়ে মুখ ঘুরিয়ে নিচ্ছেন। প্রকাশনা সংস্থা গুলোর অধিকাংশই বন্ধ হয়ে গেছে। তরুণ লেখকরা লিখছেন অনলাইন পোর্টালে। ই-বুক বা অডিও বুক ঠাঁই পেয়েছে পাঠক-শ্রোতা'র সঙ্কল্পে। এমন বাস্তবতায় নিজ উদ্যোগে মুদ্রিত বইকে পাঠকের সামনে নিয়ে আসার সাহসী পদক্ষেপ নিয়েছেন সত্তরের দশকের সাড়া জাগানো কবি ও সাহিত্যিক সালেহ আহমদ।
সাবেক সচিব ইলিয়াস আহমেদ এই প্রসঙ্গে লিখেছেন, "বেশ অনেক কাল থেকেই আর গল্প, উপন্যাস পড়া হয় না। পড়ার তাগিদ পাই না। অথচ এক সময় শারদীয় 'দেশ', 'আনন্দবাজারের' গল্প উপন্যাস গোগ্রাসে গিলেছি। এখন জীবনের অপরাহ্ণ কাল। যতটুকু ফুরসত মেলে বেছে বেছে পড়ি। পড়ব বলে ভেবেছি, এমন কত শত বই তবু আর পড়া হবে না। ফেসবুকে নানা খবর মেলে। একদিন জানা গেল সালেহ আহমদের 'ঝরো পাতা ঝরো' উপন্যাসিকাটি নতুন করে আবার ছাপা হয়েছে। খবরটা জেনে পুনরায় বইটি পড়ার তীব্র ইচ্ছে জাগে। সালেহ'র এ উপন্যাসিকাটি প্রথম পড়েছিলাম সত্তর সালে সেকালের নয়ন-শোভন কিশোর মাসিক 'টাপুর টুপুর'-এ। প্রকাশমাত্র ব্যাপক প্রশংসিত হয়েছিল। আমিও পড়ে মুগ্ধ হয়েছিলাম। অবিশ্বাস্য লেগেছিল- প্রায় আমারই সমবয়সী, মাত্র দাড়ি-গোঁফ গজিয়েছে এমন তরুণের পক্ষে, কৈশোর-ছাড়ছি-ছাড়ছি বয়সের দুই কিশোর-কিশোরীর ভালোলাগা, প্রেম নিয়ে এমন মনোগ্রাহী লেখা কী করে সম্ভব! এখলাস উদ্দিন আহমদের 'টাপুর টুপুর'-ও এমন প্রেমগন্ধী গল্প, তার আগে কিশোরদের পত্রিকায় প্রকাশযোগ্য বিবেচনা করেনি। সেই যে সত্তরে বয়ঃসন্ধির উন্মাদনায় ভালোলাগা, মুগ্ধতা তারই টানে দেরি না করে প্রকাশককে ফোন করলাম। তিনি বইটা পাঠাবেন বলেও পাঠালেন না। পরে 'রকমারি' ভরসা। যেদিন পেলাম সেদিন অফিসে বসেই ছোট্ট উপন্যাসিকাটি পড়ে শেষ করলাম। বয়ঃসন্ধি কাল বলি বা তরুণ বয়স বলি, সে আমরা পেরিয়ে এসেছি অনেক আগে। ফলে মুগ্ধ হবার, তীব্রভাবে আবেগাক্রান্ত হবার মনটা প্রায় মৃত। তবুও 'ঝরো পাতা ঝরো' পড়ে আবারও ভালো লাগলো। দু/এক জায়গায় চোখ ভিজেও গেল। মনে হলো বুড়ো মনে জমে থাকা শ্যাওলা-পানার অন্তরালে কোথাও সে বয়ঃসন্ধির আবেগের কিছু অবশেষ এখনো রয়ে গেছে।"
উল্লেখ্য, সালেহ আহমেদ জন্মসূত্রে সিলেটের স্থায়ী বাসিন্দা হলেও পিতার চাকরির সূত্রে শৈশব থেকে তিনি বেড়ে উঠেছেন, রাজধানী ঢাকায়। ১৯৫০ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর সিলেটের পারকুল গ্রামে জন্ম নেয়া সালেহ আহমেদ মতিঝিল গভর্নমেন্ট বয়েজ হাই স্কুল থেকে এসএসসি পাশ করেন। পরে, নটরডেম কলেজ থেকে এইচএসসি পাশ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা সাহিত্যে অনার্স পাশ করেন। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর তিনি 'দৈনিক বাংলার বাণী' পত্রিকার মাধ্যমে কর্ম জীবন শুরু করেন। পরে, যোগ দেন সরকারি চাকরিতে। সরকারি চাকরির একঘেয়েমি জীবনে তিনি বন্দি থাকতে পারেননি। চাকরি ছেড়ে শুরু করেন ব্যবসা। মালয়েশিয়া'র 'লয়াং ইমান'-এর সাথে যৌথ সহযোগিতায় 'লয়ং ইমাস বাংলাদেশ লিমিটেড'-এর প্রতিষ্ঠাতা তিনি। তাঁর লেখা অসংখ্য উপন্যাসের মধ্যে, 'নদী হয় সাঁকো হয়', 'একটি কালো মেয়েরে গল্প' বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
সালেহ আহমদ রচিত 'ঝরো পাতা ঝরো' পড়ে সাবেক সচিব ইলিয়াস আহমেদ আরও লিখেছেন, "'ঝরো পাতা ঝরো'-র গল্পটা সাদামাটা, সহজ, সরল। কোনো নেগেটিভ চরিত্র নেই, কোনো সঙ্কট নেই, সম্পর্কে কোনো প্রতিবন্ধকতাও নেই। তবু গল্পটা জমে যায়। কেননা গল্পটা আমাদের চেনা জানা, বন্ধুবান্ধব কারো। এ ছাড়া অন্য কারণ - সালেহ'র কবিতার মতো গদ্য, পরিপার্শ্বের চিত্রময় বর্ণনা এবং পরিমিত কথন। কোথায় ঠিক থামতে হবে, এটা সালেহ খুব ভালো জানেন। সর্বোপরি 'ঝরো পাতা ঝরো'-র সংলাপগুলো গল্পটাকে ভিন্ন মাত্রা দিয়েছে। বলতে গেলে প্রায় কোনো একটা সংলাপকেও অতি নাটুকে বা বানানো মনে হয় না। আমার তো মনে হয়, হুমায়ুন আহমেদের আগে, হুমায়ুন আহমেদের মতো এমন সহজ, স্বাভাবিক সংলাপ নির্মাণ একটা বিশেষ ঘটনা। উপন্যাসিকাটিতে চরিত্রদের কথোপকথন হঠাৎ মাঝপথে থেমে যায়। মনে হয়, আরও তো কথা ছিল, শেষ তো হলো না। শেষ না হবার এ অপূর্ণতার বোধ পাঠককে ধরে রাখে, বই ছেড়ে উঠতে দেয় না। 'ঝরো পাতা ঝরো' সত্তর দশকের উন্মাতাল সময়ে ঢাকা থেকে দূর কোনো শহরে মধ্যবিত্ত পরিবারের উঠতি বয়সের দুই বয়ঃসন্ধির কিশোর কিশোরীর মনোজগতের হদিস দেবে। সে সময়ের সাদামাটা সাজে দুই কিশোর কিশোরীকে নিয়ে আঁকা এবারের প্রচ্ছদটা দারুণ লেগেছে। স্মৃতিময় পাঠ।"
বাংলা ভাষায় প্রথম কিশোরদের জন্য উপন্যাস লিখেছিলেন দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদার। 'চারু ও হারু' শীর্ষক উপন্যাসটি ঢাকা থেকে প্রকাশিত 'তোষণী' পত্রিকায় ধারাবাহিক আকারে প্রকাশিত হয়েছিল। পরে ১৯১২ সালে এটি একটি পুস্তকাকারে প্রকাশিত হয়। কিন্তু বাংলা ভাষায়, বাংলাদেশে প্রথম কিশোর 'প্রেম' নিয়ে উপন্যাস কে লিখেছেন? এই প্রশ্নের উত্তর নেই গুগলে। জানাও নেই অনেকের। অথচ এই বিষয়টি ঐতিহাসিক। প্রচারের অভাবে এভাবেই ইতিহাস থেকে অনেক কিছু বাদ পড়ে যায়। ফলে ইতিহাস রচনা হয় আংশিক সত্যের ভিত্তিতে। যা অধিকাংশ ক্ষেত্রে বিকৃত এবং বিব্রতকর। যেমন, বাংলা সাহিত্যের প্রথম কিশোর উপন্যাস লেখকের নামের পাশে 'সালেহ আহমদ'-এর নামটিও ঠাঁই পেতে পারতো। কারণ, 'ঝরো পাতা ঝরো' বাংলাদেশে প্রথম কিশোর 'প্রেম'-এর উপন্যাস। অপরদিকে, বাংলাদেশে কিশোরদের জন্য প্রথম গোয়েন্দা এবং অ্যাডভেঞ্চারমূলক উপন্যাস হচ্ছে 'পাথারিয়া খনি রহস্য'। এই উপন্যাস রচয়িতা শাহরিয়ার কবির।
সত্তরের দশকে প্রকাশিত 'ঝরো পাতা ঝরো' সম্পর্কে আমরা আদৌ কিছু জানতে পারতাম না যদি এটির লেখক স্বপ্রণোদিত হয়ে আমাদের সামনে না আসতেন। এ ধরণের উদ্যোগকে স্বাগত জানাতে হয়। শ্রদ্ধা ও সম্মান করতে হয়। প্রতিটি জাতির নিজস্ব ভাষা, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি এবং ইতিহাস থাকে। যেগুলো রক্ষার দায় নিতে হয় জাতিকে। অন্যথায়, এগুলো কালের গর্ভে বিলীন হয়ে যায়। এমন বিড়ম্বনা নিশ্চয়ই আমাদের কাম্য নয়। আমরা সালেহ আহমদকে তাঁর রচনা এবং উদ্যোগকে স্বাগত জানাই। আমরা চাই প্রযুক্তি নির্ভর এই যুগে 'ঝরো পাতা ঝরো' বইটি মুদ্রিত সংস্করণের পাশাপাশি ইন্টারনেট (ই-বুক) সংস্করণে সংরক্ষিত থাকুক। অতীত ঘিরে বর্তমান এবং বর্তমানকে কেন্দ্র করেই ভবিষ্যৎ। সুতরাং অতীত-বর্তমানের এই সমীকরণে ইতিহাস যেন সঠিক পথে থাকে, সেই বিষয়ে যথেষ্ট সচেতনতা অবলম্বন করার দৃঢ় প্রত্যয় হোক আমাদের নিত্য দিনের পথ চলার অঙ্গীকার।
মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।
আপনার মন্তব্য