প্রধান সম্পাদক : কবির য়াহমদ
সহকারী সম্পাদক : নন্দলাল গোপ
টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
Advertise
সাব্বির খান | ৩১ অক্টোবর, ২০১৫
মানবাধিকার প্রশ্নে যে বা যারাই ওকালতি করুক না কেন, এজন্য প্রথম শর্তই হচ্ছে নিরপেক্ষতা বজায় রেখে আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া। নিরপেক্ষতার সংজ্ঞা নিয়ে নানাবিধ মতভেদ থাকতে পারে। কিন্তু সেক্ষেত্রে কোন ধরনের ‘ইজম’-কে প্রশ্রয় দিলে নিরপেক্ষতা চর্চাই বরং প্রশ্নবিদ্ধ হয়, যা কাম্য নয়।
তবে, কেউ কি কখনো সম্পূর্ণভাবে নিরপেক্ষ হতে পারেন? সম্ভবত না! যারা মানবাধিকার নিয়ে চর্চা করেন বা মানবাধিকার সুরক্ষার পক্ষে কাজ করেন, তাঁরা স্বভাবতই মানবাধিকার হরণকারীর বিপক্ষে যাবেন, এটাই সবাই মনে করেন। আর সেক্ষেত্রে মানবাধিকার লঙ্ঘনকারীর কৃতকর্ম, ঘটনার লোমহর্ষকতা, ভুক্তভোগীদের রক্তক্ষরণ অনুভব করা এবং সময়-কালকে বিচার্যবিষয় ভেবেই মানবাধিকারের পক্ষে এডভোকেসী বা ওকালতি করতে হয়। এর কোন একটার সামান্যতম ব্যত্যয় ঘটলেই মানবাধিকার রক্ষার যেকোন এডভোকেসীকে উদ্দেশ্য প্রণোদিত ক্রিয়াকর্ম হিসেবে গণ্য করা যেতে পারে।
বিশ্বের স্বনামধন্য এবং সন্মানিত স্বায়িত্বশাসিত সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের সাউথ এশিয়া রিসার্চ ডিরেক্টর ডেভিড গ্রিফিথের দেয়া ২৭ অক্টোবর, ২০১৫ তারিখের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তি প্রচলিত ধারায় নিরপেক্ষতা বজায় রেখেছিল কি-না এবং সংগঠনের পক্ষে গ্রিফিথের বিবৃতি কোন ধরণর উদ্দেশ্যপ্রণোদিত কি-না, বাংলাদেশের সচেতন জনগণের কাছে এটাই এখন মূখ্য প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বিবৃতির মূল অংশ পড়ার আগে শুধু শিরোনামের দিকে চোখ রাখলেই যেকোন সচেতন ব্যক্তির পক্ষে বোঝা অসম্ভব হবে না যে, জ্ঞাত বা অজ্ঞাতসারে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের বিবৃতিটি শুরুতেই একটি পক্ষ নিয়ে ফেলেছে। তারপর বিবৃতির মূল কথাগুলো যে শিরোনামের সরু রেখা ধরেই এগিয়েছে, তা যেকোন ব্যক্তির পক্ষেই বোঝা সম্ভব। মানবাধিকার রক্ষার ওকালতি কাজে নিয়োজিত অ্যামনেস্টির মত একটা আন্তর্জাতিক সংগঠনের পক্ষে কি এটা তাৎক্ষণিক একটা ভুল, না-কি এর পেছনে কোন উদ্দেশ্য কাজ করেছে, বোদ্ধা সমাজে এটা নিঃসন্দেহে একটা বিস্ময়কর প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে।
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের বিবৃতির শিরোনামে লিখেছে, Bangladesh: Two opposition leaders face imminent execution after serious flaws in their trials and appeals। সোজাসাপ্টা বাংলায় যার অর্থ দাঁড়ায়, ‘বাংলাদেশ: গুরুতর ত্রুটিপূর্ণ বিচার এবং আপিলের রায়ের কারণে দুইজন বিরোধী দলীয় নেতা মৃত্যুদন্ডের সম্মুখিন হতে যাচ্ছেন’। (সূত্র : অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের বিবৃতির লিংক) এই শিরোনামে যে ভুল হয়েছে, তা নিঃসন্দেহে অজ্ঞতার বহিঃপ্রকাশ এবং একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের বিচার ব্যবস্থার প্রতি তাচ্ছিল্য প্রকাশের শামিল।
২০১০ সালে মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচারের জন্য গঠিত ট্রাইব্যুনাল সারাবিশ্বের কাছে বিভিন্ন প্রশ্নের শুধু কৈফিয়তই দেননি, সে সাথে আইনের ব্যাখ্যা তুলে ধরা সহ প্রয়োজনে আইনের পরিবর্তন ও পরিবর্ধন করেছেন, যা বিশ্বে নজিরবিহীন। পর্যায়ক্রমে এই ট্রাইব্যুনাল সারাবিশ্বে প্রশংসা পেয়েছে এবং বিভিন্ন দেশ বাংলাদেশে গঠিত ট্রাইব্যুনালকে আধুনিক যুগের আদর্শ মডেল হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে।
বিচারকার্যের শুরু থেকেই বাংলাদেশের আইনবিভাগ এবং সংশ্লিষ্ট অন্যান্য সংগঠন ও সংস্থাগুলো বলে আসছে যে, ‘এই বিচারের আওতায় যাদেরই আনা হচ্ছে, তাদের সবাই একাত্তরে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের দায়ে অপরাধী। এই আদালতে কোন রাজনীতিবিদের বিচার হচ্ছে না। আইনের চোখে একজন অপরাধী, সমাজের যে কেউ হোক না কেন, শুধুই অপরাধী হন।'
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে গঠিত ন্যুরেমবার্গ আদালতে শুরু থেকে অদ্যাবধি কোন জেনারেল, মন্ত্রী, আমলা বা রাজনীতিবিদের বিচার হয়েছে বলে শোনা যায়নি। এটা স্বতসিদ্ধ এবং পুরাণ আমল থেকেই অনুশীলিত যে, বিশ্বে বিজয়ীরাই বিজিতের বিচার করে থাকে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে কি মিত্রবাহিনী কাউকে হত্যা করেনি? যুগোশ্লোভিয়ার যুদ্ধে কি ন্যাটোর গুলিতে কেউ মরেনি? কিন্তু তাঁদের কারোই বিচার হয়নি। কারণ যারা আক্রান্ত হয়েছিলো, তাঁদের আত্মরক্ষার অধিকার থেকে পাল্টা আক্রমণ করায় শত্রু মারা গেলে নিশ্চয়ই সেজন্য আত্মরক্ষীর বিচার হয়না। অথচ হাস্যকরভাবে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের বিবৃতিতে সে দাবিই জানানো হয়েছে।
অপরাধীর ভিন্ন কোন পরিচয় থাকে না। অথচ অ্যামনেস্টির বিবৃতিতে এটা স্পষ্ট যে, বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে কোন যুদ্ধাপরাধী বা অপরাধীর বিচার হচ্ছে না। যা হচ্ছে, তা বিরোধী দলীয় রাজনৈতিক নেতাদের বিরুদ্ধে একচেটিয়া বিচার নামের প্রহসন হচ্ছে। এখানে স্বভাবতাই প্রশ্ন তোলা যেতে পারে যে, এই শিরোনামের দ্বারা কি অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিরোধীতা করছে? যুদ্ধাপরাধীদের বিচার না করে তাদের সুরক্ষা দেয়াটা কি মানবাধিকার রক্ষা? যদি তাই হয়, তাহলে অবশ্যই বুঝতে হবে, কোথাও কোন ঘাপলা হচ্ছে। সেক্ষেত্রে সন্দেহ থাকা উচিত নয় যে, বিশ্বে-মানবাধিকার রক্ষার একচেটিয়া ঠিকাদারি নেয়া সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল “এতোদিনের চেনা ঘোড়া নয়, তা শুধুই খচ্চরের দেহে ঘোড়ার খোলস মাত্র”।
মানবতাবিরোধী অপরাধে মৃত্যুদণ্ড পাওয়া সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী এবং আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদকে বিচার প্রক্রিয়া থেকে মুক্তি দিয়ে ১৯৭১ সালের স্বাধীনতাকামীদের বিচার চেয়েছে মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল। তাদের বক্তব্য, ‘সরকারবিরোধী রাজনৈতিক নেতা হিসেবেই সাকা চৌধুরী বা আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদ এবং অন্যদের মানবতাবিরোধী অপরাধে বিচারের আওতায় আনা হয়েছে। তাদের বিচার হলে ‘একইরকম অপরাধে’ কেনো মুক্তিযোদ্ধাদের বিচারের আওতায় আনা হবে না সেই প্রশ্নও তুলেছে অ্যামনেস্টি’ (সুত্র: সিলেটটুডে২৪.কম)।
তাদের এই বক্তব্য- এবং বাংলাদেশের আভ্যন্তরিন বিচারব্যবস্থার প্রতি উদ্বিগ্নতাকে যদি আমলে নেই, তাহলে অবশ্যই তাদের এই চর্চার অণুশীলন সর্বক্ষেত্রেই দেখতে পাওয়া উচিত বলে আমি মনে করি। কিন্তু তা না হলে এটা ভাবা কি অমূলক হবে না যে, বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের বিরুদ্ধে অ্যামনেস্টির দেয়া বিবৃতি বা সংবাদ বিজ্ঞপ্তি একটি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত কাজই শুধু নয়, একই সাথে জামায়াত আদলে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারপ্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত করতে আরো একটি সংগঠিত চক্রান্ত!
সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী এবং আলী আহসান মুহম্মদ মুজাহিদকে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত থেকে ফাঁসির রায় দেয়া হয়, পরবর্তিতে যে রায় উচ্চ আদালতেও বহাল থাকে। এই রায়ে অসন্তুষ্ট হয়ে এবং বিরোধীতা করে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশলাল বিবৃতি দেয়। তাঁরা মনে করে, ‘মৃত্যুদণ্ড শুধুমাত্র সন্ত্রাসের দিকে ঠেলে দিবে। ন্যায্য বিচার ছাড়া মৃত্যুদণ্ড আরো বিরক্তিকর’ (সুত্র: সিলেটটুডে২৪.কম)।
অন্যদিকে, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল তাঁদের রিপোর্টে ৩১ জুলাই ২০১৪-এ উল্লেখ করেছিল যে, বাংলাদেশে ডেথ সেলে মৃত্যুদণ্ড প্রাপ্ত ব্যক্তির সংখ্যা ছিল অন্তত ১১৭২। একই রিপোর্ট তাঁরা আরো বলেছে, ২০১৩-তে বাংলাদেশে অন্তত ২২০ জনকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে। আমার জানামতে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশলাল গত দুই বছরে বাংলাদেশে মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্তদের গড় একটা তালিকা তৈরি করেছিল শুধু, যা বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয় থেকে সহজেই সংগ্রহ করা সম্ভব। কিন্তু একবারের জন্যও তাঁরা ‘যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচানের আদলে’ কোন ওকালতি তো দুরের কথা, একটা বিবৃতি পর্যন্তও দেয়নি। তাহলে কেন তাঁদের এই স্ববিরোধীতা?
মৌলবাদী যে সংগঠনটি বাংলাদেশে একাত্তরে লাখ লাখ মানুষ হত্যা করেছে, তাঁদের বিচারে স্বচ্ছতার প্রশ্ন তুলে অপরাধীদের বাচাতে অ্যামনেস্টি যখন বিবৃতি দেয়, তখন যুদ্ধাপরাধী, মৌলবাদ এবং জঙ্গীবাদের তল্পিবাহক হিসেবে তাদের ভাবতে কি খুব বেশি অসুবিধা হওয়ার কথা! অথচ ভাবখানা এমন যে, বাংলাদেশে শুধু বিরোধী দলীয় রাজনীতিবিদদেরই ফাঁসিতে ঝুলানো হচ্ছে।
আমরা জানি, যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচানোর জন্য এবং বাংলাদেশের ট্রাইব্যুনালকে অকেজো করার লক্ষ্যে সারাবিশ্বে যুদ্ধাপরাধী দল বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী কোটি কোটি টাকা খরচ করছে এবং বিশ্বের শ্রেষ্ঠ লবিস্ট ফার্মগুলোকে মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে তাদের সহযোগীতা করতে নিয়োগ দিচ্ছে। কিন্তু অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালকে দিয়ে টাকার বিনিময়ে কি এই ধরণের বিবৃতি দেয়ানো কি সম্ভব?
আমরা জানি, পাবলিকলী অ্যামনেস্টি সম্পূর্ণ স্বায়ত্বশাসিত এবং নিরপেক্ষ একটি সংগঠন। তারা কারো তল্পীবাহক না হতে কোন দেশের সরকারের কাছ থেকে কোন ধরণের অনুদান বা সাহায্য-সহযোগীতা গ্রহণ করেন না। অন্তত অ্যামনেস্টির ওয়েব সাইটে সেকথাই লেখা আছে। কিন্তু তারপরেও বিভিন্ন সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে যে, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বিভিন্ন খাত থেকে পাওয়া তাদের বার্ষিক অনুদানের বিশাল একটা অংশ বিভিন্ন দেশের সরকারের কাছ থেকে পাচ্ছে।
উদাহারণ হিসেবে বলা যেতে পারে যে, ২০১১ সালে যুক্তরাজ্য সরকারের ডিপার্টমেন্ট ফর ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট থেকে ৮৪২,০০০ ইউরো অনুদান হিসেবে গ্রহণ করেছিল। ২০০৯ সালে সংগঠনটির প্রাপ্ত মোট অনুদানের ১% পরিমাণ ছিল ২.৫ মিলিয়ন ইউরো এবং এই অর্থ তারা পেয়েছিল বিভিন্ন দেশের সরকারের কাছ থেকে। ২০০৮ সালে ১ মিলিয়ন ইউরো, ২০০৭ সালে ১ মিলিয়ন ইউরো এবং ২০০৬ সালে পেয়েছিল ২ মিলিয়ন ইউরো। যুক্তরাজ্য অ্যামনেস্টির দাতা দেশগুলোর মধ্যে তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে, যাদের কাছ থেকে অ্যামনেস্টি প্রতিবছর অনুদান নিয়ে থাকে।
২০০৭ সালে ইউরোপীয়ান কমিশনের কাছ থেকে তারা পেয়েছিল ২৫৯,০০০ পাউন্ড। এছাড়াও অ্যামনেস্টি যাদের কাছ থেকে নিয়মিত অনুদান পেয়ে থাকে তাদের মধ্যে নেদারল্যান্ড, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইসরায়েল, সৌদি আরব ছাড়াও আরো বেশ কিছু দেশ। কিন্তু অ্যামনেস্টি বরাবরই অস্বীকার করে যে তারা কোন দেশের সরকারের কাছ থেকে কোন অনুদান গ্রহণ করে থাকে। এক্ষেত্রে শুধুমাত্র এই অনুদানের কথাটাই যদি আমলে নেয়া হয়, তাহলে তারা যে নীতি-নৈতিকতার ধার না ধেরে সম্পূর্ণ অনৈতিক মিথ্যার বেসাতি করছে, এব্যাপারে কোন সন্দেহ থাকে না। ঠিক একই যুক্তিতে ধরে নেয়া যেতেই পারে যে, যুদ্ধাপরাধীদের কাছ থেকেও বিশাল অংকের অনুদানের বিনিময়ে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষ হয়ে বাংলাদেশের আদালতের বিরুদ্ধে জঘন্য মিথ্যা বিবৃতি দিয়েছে!
আলোচনার স্বার্থে যুদ্ধাপরাধী দল বাংলাদেশ জামায়াত ইসলামী সম্বন্ধে দুই-একটি কথা বলে নেয়া প্রয়োজন বলে মনে করছি। বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী একটি আন্তর্জাতিক সংগঠনের বাংলাদেশি শাখা। এটির সূচনা হয়েছিল উপমহাদেশের বিতর্কিত ধর্মীয় রাজনীতিক আবুল আলা মওদুদীর নেতৃত্বে, ১৯৪১ সালের ২৬ আগস্ট। তখন এর নাম ছিল জামায়াতে ইসলামী, হিন্দ। বর্তমানে জামায়াতে ইসলামী শুধু বাংলাদেশে নয়, মিশর ও উত্তর আফ্রিকার মুসলিম ব্রাদারহুড এবং আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের তালেবান ও আল কায়েদার সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে জঙ্গি মৌলবাদের আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্ক সৃষ্টি করেছে। জামায়াতে ইসলামী এবং মুসলিম ব্রাদারহুডের এক ও অভিন্ন দর্শন হচ্ছে, ‘ধর্মের নামে ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য যে কোনো ধরনের হত্যা, নির্যাতন ও সন্ত্রাস ইসলামসম্মত।’
মিসরের মুসলিম ব্রাদারহুড আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত একটি সন্ত্রাসী জঙ্গি সংগঠন, যার বলয় মিসর পেরিয়ে সারাবিশ্বেই বিস্তৃত। নামে ভিন্নতা থাকলেও আদর্শগত মিলের কারণে আল কায়েদা, আইএস, আনসারুল্লাহ, মুজাহিদিন, ব্রাদারহুড নামের বিশ্বের তাবৎ জঙ্গি-মৌলবাদী সংগঠনগুলোর সাথেই বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর দ্বিপাক্ষিক সুসম্পর্ক বিদ্যমান।
প্যালেস্টাইনে ইজরায়েলের দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে বিশ্বের সব সচেতন নাগরিকই অবস্থান নিয়েছে। মানবাধিকারের অতিমাত্রায় অবমাননা সম্ভবত ইজরায়েল ছাড়া বিশ্বের অন্য কোথায় হয়না। তারপরেও মানবাধিকার রক্ষার নিরপেক্ষ এডভোকেসীর জন্যও অ্যামনেস্টিকে সর্বত সতর্ক থাকাই সবার কাম্য। অথচ সেক্ষেত্রেও দেখা যায় যে, সংগঠনটির এক ধরনের রেডিক্যাল চরমপন্থার দিকেই ঝুকে থাকার প্রবণতা। ২০১০ সালে এন্টি-ইজরায়েলী, দখলদারিত্ব, প্যালেস্টাইন ও প্যালেস্টাইন কতৃপক্ষ বিষয়গুলোর উপর গবেষণার জন্য অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশলান নিয়োগ দেন ডেবোরা হাইম নামের এমন একজনকে যিনি নিজে একটিভিস্ট। তিনি ইজরায়েলী দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে হামাস কতৃক প্রেরিত আত্মঘাতি-বোমারুদেরকে সঠিক মনে করতেন। তিনি প্যালেস্টাইনের চরমপন্থীদের সাথে এক হয়ে ইজরায়েলবিরোধী বিভিন্ন একশনেও অংশগ্রহণ করেছেন। অথচ নিরপেক্ষতাকে বৃদ্ধাঙ্গুলী দেখিয়ে জঙ্গী ভাবধারার একজনকে নিয়োগ দেয়া কতটুকু নৈতিক ও নিরপেক্ষতা, তা বিবেচনার বিষয় বৈ-কি!
২০১০ সালে অপর এক ঘটনায় লন্ডনস্থ অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের প্রধান কার্যালয়ের জেন্ডার ইউনিটের প্রধান গীতা সায়গালকে বরখাস্ত করা হয়। গীতা সায়গাল লন্ডস্থ কেজ ইন্টারন্যাশলানের (Cage international) প্রধান মোহাম্মদ বেগের সাথে অ্যামনেস্টির বিশেষ সংশ্লিষ্টতার বিরুদ্ধে খোলামেলা সমালোচনার জন্য বরখাস্ত হন। কেজ প্রধান মোহাম্মদ বেগের সাথে বিশ্বের বিভিন্ন জঙ্গী মৌলবাদের, বিশেষ করে আল কায়দার গোপন সংশ্লিষ্টতার কথাই তখন গীতা সায়গাল বলেছিলেন। ২০১৫ সালে এই কেজ প্রধানের আইসিস এর কসাই নামে খ্যাত ‘জিহাদী জন’-এর পক্ষে পাবলিকলী ওকালতির কারণে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল খুবই বিব্রত হয় এবং মোহাম্মদ বেগের সাথে সংশ্লিষ্টতা ত্যাগ করে। অথচ বেগের জঙ্গী মৌলবাদের সাথে সংশ্লিষ্টতার সমালোচনার কারণে গীতা সায়গালকে অপমানজনকভাবে বহিস্কৃত হতে হয়েছিল।
অপর এক ঘটনায় অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের ডিরেক্টর অব ফেইথ এন্ড হিউম্যান রাইটসের ইয়াসমিন হুসেইন ২০১৫ সালে মিসরে এক ভিজিটে সেখানকার ব্রাদারহুড এর এক নেতার বাসায় আতিথেয়তা গ্রহণ করে রাত্রিযাপন করেছিলেন। এছাড়াও তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন ইসলামিক রেডিকেল গ্রুপের সাথে গোপন যোগাযোগের অভিযোগ রয়েছে। উল্লেখ্য যে, ইয়াসমিনের স্বামীর কিছুদিন পূর্বে বৃটেনের আদালতে বৃটেনে এবং আরব দেশগুলোর ইসলামিস্টদের সাথে গোপন ষড়যন্ত্রে লিপ্ত থাকার প্রমাণ পাওয়া গেছে (সূত্র : দ্যা টাইমসইউকে)। অথচ ইয়াসমিন হুসাইনকেই অ্যামনেস্টির শীর্ষ পদে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। উগ্রজঙ্গীবাদে সংশ্লিষ্টদের সাথে যৌথভাবে কাজ করে অথবা তাদেরকে অ্যামনেস্টির শীর্ষ পদে বসিয়ে কি বিশ্বে মানবাধিকার রক্ষা হবে কিভাবে তা আমার বোধগম্য নয়।
উপরের বিভিন্ন এবং খুবই সংক্ষিপ্ত আকারের আলোচনায় এটাই শুধু প্রমাণ হয় যে, আদর্শবাদী, মানবাধীকার রক্ষার একচ্ছত্র অধিকর্তার ভূমিকায় যে সংগঠনটিকে আমরা এতোদিন জেনেছি, সে নিজে আসলে কতটুকু আদর্শবাদ বা নৈতিকতায় বিশ্বাসী সে ব্যাপারে সন্দেহের অবকাশ নেই। সাদা-কালো অক্ষরে লেখা টেক্সটে যে নৈতিকতার কথা খোদ অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের কাছে বিশ্বের কোটি কোটি মানুষ জেনেছে, তার সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার সময় নিঃসন্দেহে এখন বর্তমান।
৩০ লক্ষ বাঙালির রক্তে কেনা যে স্বাধীনতা, তা নিয়ে ‘নুইসেন্স’ এর অধিকার কারো নেই। আদর্শ এবং সততাই যদি বিশ্বাসের মূল ভিত্তি হয়, তাহলে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালকে একচুল পরিমাণও বিশ্বাস করার কোন নৈতিক অবস্থান নেই। তাদের তৈরি বিবৃতি বা সংবাদ বিজ্ঞপ্তির সেক্ষেত্রে একেবারেই মূল্যহীন একটা সাদা কাগজে কিছু কথার কথা মাত্র। এথেকে বাঙালি জাতি তথা সারা বিশ্বের কাছে আরো একবার উন্মুক্ত হলো যে, আরো একটি জামায়াতের অর্থে নিয়োগপ্রাপ্ত লবিস্ট ফার্ম, “দ্য অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল”।
মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।
আপনার মন্তব্য