প্রধান সম্পাদক : কবির য়াহমদ
সহকারী সম্পাদক : নন্দলাল গোপ
টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
Advertise
সাব্বির খান | ০৬ নভেম্বর, ২০১৫
মাদ্রাসার একজন ছাত্র, যাকে আমাদের চোখে খুবই সাধারণ মানুষ হিসেবেই মনে হয় এবং তা-ই সত্যি। জামায়াত, শিবির বা হেফাজতের একজন কর্মী ‘ইজম’ ভিন্ন হলেও আমাদের সবার মতই সাধারণ মানুষ। কিন্তু এদের মাঝ থেকেই যখন কেউ জঙ্গি সন্ত্রাসের সাথে জড়িয়ে পড়ে এবং দেশের অভ্যন্তরে যখন খুন-হত্যা, বোমাবাজির মত বিভিন্ন লোমহর্ষক ঘটনা ঘটায়, আমাদের সবার দৃষ্টিতে তখনও আমরা তাদের আমাদের মতই আমজনতা ভেবে বসে থাকি। আর ভুলটা এখানেই হয়। তাদের প্রতি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির কারণে বিভিন্ন অঘটন ঘটার পরে এর সম্পূর্ণ দায়ভার সরকার এবং পুলিশ প্রশাসনের উপর চাপিয়ে দিয়ে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলি। এটা শুধু হঠকারীতাই নয়, একই সাথে দেশের প্রতি ভয়ংকর অমানবিকতাও।
এ কাজে সর্বাগ্রে এগিয়ে আছে কিছু পেশাজীবী কলম-কর্মী, যারা কোন না কোন ভাবে সংবাদমাধ্যমের সাথে জড়িত। তাঁদের কর্মক্ষেত্রের পেশাগত আক্রোশের সব ব্যাপারেই সরকারের উপরে দায় চাপিয়ে দেয়। এটা কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। প্রচার-প্রচারণা এবং সরকারবিদ্বেষী মনোভাব ছড়াতে অনলাইনে এখন আর ‘বাঁশের কেল্লা’ বা জামাত-শিবিরের খুব একটা প্রয়োজন হয় না।
বিভিন্ন পদধারী সংবাদমাধ্যমের কর্মী পরিচয়ে সমাজের উপর তাঁরা এক ধরনের প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়। ব্যক্তিগত বিভিন্ন ‘ইজম'-এর আড়ালে তাঁদের পাবলিক পরিচয়কে ব্যবহার করে খুব ঠান্ডা মাথায় ফেসবুক/টুইটারের মত অনলাইন সামাজিক মাধ্যমের দ্বারা তাঁরা মানুষকে প্রভাবিত করার প্রয়াস পায়। ক্ষুরধার লেখনির মাধ্যমে ইনিয়ে-বিনিয়ে "কেস্ট বেটাই চোর" আদলে জঙ্গীদের প্রতিহত বা ধরতে না পারার সবটুকু দায় সরকারের উপর চাপিয়ে দেয়। এতে পুরো একটা জাতি অতি সহজেই তাঁদের এই "দুই অক্ষর"-এর জ্ঞান গরিমার কাছে ধরাশায়ী হয়ে বিশ্বাস করতে শুরু করে যে, সরকার ইচ্ছে করেই জঙ্গিদের ধরছে না এবং সেই সাথে "নিপাত যাক" জাতিয় মনোভাব পোষণ করে সরকারের প্রতি। পর্দার আড়ালের "কলম-কর্মী"-রা তখন আশার আলোয় আরো বেশি উদ্দিপ্ত হয়। অন্তত ফেসবুকের বিভিন্ন আলামতে সেটাই প্রকাশ পায়।
আমরা জানি, জামায়াত-শিবিরের অনলাইন বেশিরভাগ কর্মীরাই পেইড ওয়ার্কার। তারা বেশ পরিচিত এবং সোজাসাপ্টা। কিন্তু সুশীলের তকমায় আটা এইসব কলম-কর্মীরা যে জঙ্গিদের লুকানো এজেন্ডাই পূরণ করছে, তা খালি চোখে দেখাও যায় না, বিশ্বাস করাতো দুরের কথা! পদবীধারী কলম-কর্মীদের ‘দুই-অক্ষর’ জ্ঞানের সীমাহীনতা যখন সমাজে পাঠশালার মত প্রতিষ্ঠানিক রূপ পায়, তখন সরকার এবং প্রশাসন খুবই অসহায় বোধ করে, যা বাংলাদেশে এখন দৃশ্যমান।
মাদ্রাসার ছাত্র বা ধর্মীয় রাজনীতির সাথে জড়িত কোন মানুষ কি কখনো খুনী বা বোমারু হয়? অথচ তারা দিব্যি সেই কাজগুলোই করে যাচ্ছে। আর যখনই তারা এই কাজে লিপ্ত হয়ে হাত পাকায়, তখন তাদের আমরা ‘জঙ্গি’ বলি। মৌলবাদের সাথে সম্পৃক্ততার কারণে পরিচয়ের ব্যাপ্তি বেড়ে হয় ‘জঙ্গি-মৌলবাদী’। কিন্তু জঙ্গি হওয়ার জন্য যে প্রশিক্ষণ এবং অণুশীলন দরকার তা কোথা থেকে এবং কিভাবে আসছে তা কি আমাদের কলম-কর্মীরা জানেন বা জানার চেষ্টা করেন? হয়ত জানেন। কিন্তু কলম পেশা এবং লুকানো ইজমের সুবিধার্থে সে বিষয়টি এড়িয়ে যান শুধুই সরকারকে ঘায়েল করার জন্য।
পাকিস্তানের আইএসআই কট্টর মৌলবাদীদের সম্পূর্ণ সামরিক কায়দায় এবং শৃংখলায় বিভিন্ন রণকৌশল সহ বিভিন্ন ভারি অস্ত্রচালনায় প্রশিক্ষণ দেয় এবং সাদা পাঞ্জাবীর আড়ালে এক একজন দুর্ধর্ষ জঙ্গি তৈরি করে, এটা পৃথিবীতে গোপন কিছু নয়। একইভাবে সিআইএ আল-কায়েদাকে সামরিক প্রশিক্ষণ দিয়েছিল এবং সাম্প্রতিক সময়ে সিরিয়ায়ার আইএসআইকে দিয়েছে।
তাহলে বিষয়টি দাড়ালো এমন যে, সাদা পাঞ্জাবী-পায়জামার ভিতরে যে দুর্ধর্ষ মৌলবাদী জঙ্গি তৈরি করছে, তারা অবলীলায় হতে পারতেন এক একজন কর্নেল, মেজর, লেফটেনেন্ট অথবা জেনারেল। উর্দী পোষাকে থাকলে তাদের বুকেও ঝুলতে পারতো বিভিন্ন র্যাঙ্কের স্টার আর মেডেল। কিন্তু জঙ্গিদের সে সৌভাগ্য হয় না। তাদের মেডেল আর স্টারগুলো গচ্ছিত থাকে জীবনের ওপারে, যেখানে হুরপরীরা শারাব সাগরে জলকেলি করে।
এবার প্রসঙ্গে আসা যাক। এইসব সর্বোচ্চ সামরিক প্রশিক্ষণে শিক্ষিত জঙ্গিরা যখন অপারেশন চালায়, কাউকে হত্যা করে বা বোমাবাজী করে, তা যে মহল্লার মাস্তানদের আদলে হয় না, তা সাম্প্রতিক ঘটে যাওয়া বিভিন্ন ঘটনা থেকেই প্রতিয়মান হয়। আর এসব জঙ্গিরা যখন একটা কমান্ডো অভিযান (সামরিক ভাষায়) চালায়, তা যে ইজরায়েলের মোসাদ, আমেরিকার সিআইএ, রাশিয়ার সাবেক কেজিবি, ভারতের ‘র অথবা যুক্তরাজ্যের এমআই৫ এর চেয়ে কোন অংশে কম পারদর্শী হয় না, বাংলাদেশ পুলিশের ব্যর্থতাই তার সাক্ষ্য দেয়।
উচ্চমার্গীয় সামরিক প্রশিক্ষণে শেখানো হয় যে, কিভাবে ইলেক্ট্রনিক্স ডিভাইস ব্যবহার করতে হয়, পালানের পথ আগেই কিভাবে ঠিক করতে হয় এবং পেছনে কোন ধরনের মোটিভ না রেখে অপারেশেন সফল করতে হয়। বিগত বছরগুলোতে করা জঙ্গিদের সন্ত্রাসী ঘটনাগুলো বিশ্লেষণ করলেও একধরনের চৌকষ সামরিক আদলের প্রশিক্ষণের ছাপ দেখতে পাওয়া যায়। এই কায়দাগুলো কোন মার্গীয় হয়, এটা বোঝার জন্য নিশ্চয়ই বিশিষ্ট জ্ঞানধারী হতে হয় না।
এসব জঙ্গি মোকাবেলায় বা খুঁজে বের করা কি সাধারণ পুলিশ, ডিবি বা সিএইডির পক্ষে সম্ভব? হয়ত সম্ভব। কিন্তু তাদের কি যথেষ্ট লজিস্টিক বা প্রশিক্ষণ আছে? নাকি এদের প্রতিহত, মোকাবেলা এবং ধরার কাজের জন্য ওদের মত সামরিক সমকক্ষ প্রশিক্ষিত বাহিনীর দরকার?
অথচ এই ভুলটাই সরকার সব সময় করছে। উচ্চ পর্যায়ের সামরিক শিক্ষায় প্রশিক্ষিত জঙ্গিদের মোকাবেলা করতে আমরা সাধারণ পুলিশবাহিনীর উপর নির্ভর করছি, যা শুধু অবাস্তবই নয়, একই সাথে ভয়ংকর বালখিল্য। ভাবনার এই সাধারণ ভুলের কারণেই একের পর এক ব্লগার, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবি, প্রকাশক, লেখক, এমনকি পুলিশও মরছে জঙ্গীদের হাতে এবং তাদের কাউকেই প্রতিহত করা তো দুরের কথা, খুঁজেও পাওয়া যাচ্ছে না। আমাদের দেশের পুলিশবাহিনী অন্যান্য হাজার কাজের ফাঁকে একটা সামরিক কমান্ডো গেরিলা বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়ছে এবং এর ফলাফলে আমরা যা দেখতে পাচ্ছি, তা কি নিশ্চইয়ই খুব অস্বাভাবিক নয়।
এক্ষেত্রে সরকারের যে ভুল হচ্ছে, তা হলো জঙ্গিদের ‘আন্ডার-এস্টিমেট’ করা এবং আমাদের ‘কলম-কর্মী'-দের যে ভুল হচ্ছে, তাহলো জঙ্গিদের বিরুদ্ধে পুলিশবাহিনীর শক্তিকে ‘ওভার-এস্টিমেট’ করা।
দেশের সার্বিক পরিস্থিতিতে এটা বোঝা যায় যে, যারা জেনে বা না জেনে, জ্ঞানে বা অজ্ঞানতায় অহেতুক পাবলিক সেন্টিমেন্টকে সিম্পলী কলমের জোরে দিকভ্রষ্ট করছেন, তাঁদের উচিত অন্য যেকোন সময়ের চেয়ে সরকারের পাশে দাঁড়িয়ে আরো বেশি নৈতিক দায়িত্ব পালন করা। এতে জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে সরকারের যুদ্ধ জয় কিছুটা সহজ হবে এবং বাংলাদেশ আরো একটা পাকিস্তান বা আফগানিস্তান হওয়া থেকে রেহাই পাবে।
ভুলে গেলে চলবে না, জাতির সচেতনতার বিকল্প নেই। এ দায় আমাদের সবার।
মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।
আপনার মন্তব্য