প্রধান সম্পাদক : কবির য়াহমদ
সহকারী সম্পাদক : নন্দলাল গোপ
টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
Advertise
কবির য়াহমদ | ১৩ নভেম্বর, ২০১৫
নিজ বাবা-মা হত্যার দায়ে এক মেয়ের ফাঁসির আদেশ দিয়েছেন আদালত। পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) কর্মকর্তা মাহফুজুর রহমান ও তাঁর স্ত্রী স্বপ্না রহমানকে হত্যা করার দায়ে এই দম্পতির মেয়ে ঐশী রহমানকে ফাঁসির আদেশ দিয়েছেন আদালত।
২০১৩ সালে সংঘঠিত এ হত্যাকাণ্ডের বিচারের প্রাথমিক পর্যায় সম্পন্ন হতে দুই বছরের বেশি সময় লাগল। বৃহস্পতিবারের (১২ নভেম্বর) এ রায় এক সপ্তাহের মধ্যে বেশ কয়েকটি চাঞ্চল্যকর হত্যা মামলার একটি অন্যতম রায়। একই সপ্তাহে সিলেটের শিশু রাজন, খুলনার শিশু রাকিব এবং আরেক শিশু ফরহাদ হত্যা মামলার মত প্রধান অভিযুক্তদের ফাঁসির আদেশ দেওয়া হয়। ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-৩-এর বিচারক সাঈদ আহমেদ আলোচিত এই মামলার রায় ঘোষণা করেন।
নানা কারণে ঐশী এ রায় নিয়ে বিস্তর আলোচনা হয়েছে, কারণ হত্যাকাণ্ডের শিকার তার বাবা-মা এবং বাবা ছিলেন একজন পুলিশ কর্মকর্তা। একই সঙ্গে ঐশী প্রাপ্তবয়স্ক, না অপ্রাপ্তবয়স্ক এবং সে মাদকাসক্ত ছিল অথবা না- সে আলোচনা হয়েছে। ধারণা করি, এ আলোচনা চলবে আরও।
রায়ের পর্যবেক্ষণে আদালত বলেছেন, হত্যাকাণ্ডটি ছিল পরিকল্পিত ও নৃশংস। সাক্ষ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে দেখা গেছে, ঘটনার সময় আসামি ঐশী প্রাপ্তবয়স্ক ছিলেন। নৃশংস হত্যাকাণ্ড বিবেচনায় ঐশীকে ফাঁসির দণ্ড দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে আদালত উল্লেখ করেন, ‘যেখানে শিশু ও নারী নির্যাতন দমনের পক্ষে আমাকে রায় দিতে হয় সেখানে উল্টো রথে এসে আজ এই মামলায় আমাকে রায় দিতে হচ্ছে। এটা আমার জন্য কঠিন।’ ফলে অনুমান করা যায়, কঠিন এক পরিস্থিতির মুখে দাঁড়িয়ে আইনী দিক বিবেচনা করত এ ফাঁসির রায় দেওয়া হয়েছে।
মামলার বিচারিক পর্যায়ের বিভিন্ন সময় আসামিপক্ষের আইনজীবিরা দাবি করেছেন, ঐশী অপ্রাপ্তবয়স্ক এবং সে মাদকাসক্ত ছিল। আসামির বয়সের বিষয়াদি আদালত পর্যবেক্ষণে নিয়েছেন এবং তাকে প্রাপ্তবয়স্ক হিসেবেই বিবেচনা করেছেন।
মামলার রায়ের পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং সুধী সমাজে ব্যাপকভাবে আলোচিত হচ্ছে বয়স বিবেচনায় এ দণ্ড কম হতে পারত কিনা। এ নিয়ে দ্বিধা-বিভক্ত অনেকেই। যারা দণ্ড কম হওয়া সঙ্গত মনে করছেন তাদের দাবি ঐশীর বয়স কম এবং তাকে ফাঁসির দণ্ড না দিয়ে শোধরানোর সুযোগ দেওয়া যেত।
এদিকে, অনেকেই আবার মাদকাসক্তির বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে মাদকদ্রব্যগুলো যারা সমাজে ছড়াচ্ছে তাদের শাস্তি দাবি করেছেন। তাদের দাবি মাদক ব্যবসায়িদের সমাজে-রাষ্ট্রে রেখে এরকম কম বয়েসী একটা মেয়েকে ফাঁসির আদেশ না দিয়ে অন্য শাস্তি দেওয়া যেত।
চাঞ্চল্যকর এ হত্যাকাণ্ড নিয়ে সামাজিক যে বিভক্তি, মত-প্রতিমত-ভিন্নমত রয়েছে সেটা আমলে নিলে বলা যায় অধিকাংশ মতের সঙ্গে একমত আবার ভিন্নমত পোষণ করা যায়। ঐশী প্রাপ্তবয়স্ক এটা আদালতে প্রমাণ হয়েছে। এবং একজন প্রাপ্তবয়স্ক খুনী হিসেবে সে শাস্তি তার জন্যে নির্ধারণ করেছেন। আদালত যখন সিদ্ধান্তে পৌঁছান তখন এর স্বপক্ষে বিভিন্ন দলিলাদি যাচাই বাছাই সাপেক্ষেই পৌঁছান। সে হিসেবে বয়স সম্পর্কিত বিষয়টির নিষ্পত্তি হয়ে যায়।
সামাজিক বিভক্তির এ জায়গায় যারা কম শাস্তির পক্ষে কথা বলছেন তাদের দাবির পক্ষে আমিও বলতাম যদি পুরো অপরাধ ও সামাজিক প্রভাবকে আমি একান্তই ব্যক্তিক দিক দিয়ে বিবেচনা করতাম। কিন্তু ঐশীর রায়ের ক্ষেত্রে সে সুযোগ কি ছিল? ছিল না! কারণ এ হত্যাকাণ্ড ও মামলা ছিল আলোচিত এবং চাঞ্চল্যকর এক ঘটনা। দেশের অধিকাংশই এ হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে ওয়াকিবহাল। এক্ষেত্রে সামগ্রিকভাবে চিন্তা না করার সুযোগ খুব কম। কারণ এ ধরনের একটা মামলার রায় যখন অন্য অনেক রায় ও অপরাধকে বিবেচনা করা হয় তাহলে তার শাস্তি সর্বোচ্চই হওয়া দরকার।
যে কোন ঘটনার অব্যবহিত পর পরই অপরাধীদের প্রতি সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি থাকে, ‘নো মার্সি’। এরপর এ অবস্থান থেকে সমাজ মানসিকতা আস্তে আস্তে সরতে থাকে। অপরাধকে অপরাধ হিসেবে না দেখে অপরাধীকে অপরাপর সাধারণ মানুষ হিসেবে দেখা শুরু হয়। ফলে একটা সময় থেকে অপরাধীরা সহানুভূতি পেতে শুরু করে। দীর্ঘ পর্যবেক্ষণ থেকে বলা যায়, এটা মানুষের সহজাত আচরণ।
যখন অপরাধীকে অপরাধী হিসেবেই দেখা হয় তখন সমাজ মানসিকতা সে অপরাধীর শাস্তি দাবি করে। দিন গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে ব্যক্তির সে অপরাধ রাষ্ট্রের ব্যর্থতা হিসেবেই পরিগণিত হতে শুরু করে। তখন সহানুভূতিশীল সমাজ অপরাধীকে শাস্তি দেওয়ার চাইতে রাষ্ট্রের ব্যর্থতাকে বড় করে দেখে অপরাধকে ছোট করে দেখতে শুরু করে। এর কারণ হতে পারে পারিপার্শ্বিকতা অথবা বিচারিক প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রিতা। তবে এর মাধ্যমে প্রকারান্তরে যে অপরাধকে আস্কারা দেওয়া হচ্ছে সে ক’জন বিবেচনায় আনেন?
আবার অন্যদিকে, অপরাধী এবং অপরাধীদের প্রতি সহানুভূতির রকমফের আছে সামাজিক অবস্থানের কারণে। সামাজিক এবং রাজনৈতিকভাবে যারা উচ্চ অবস্থানে তাদের প্রতি গণ-সহাভূতি এবং বিচারিক-সহানুভূতি দুটোই লক্ষণীয়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, রাস্তার অথবা সামাজিক বিভিন্ন স্তরের মধ্যকার কম সুবিধাপ্রাপ্ত একটা লোক যদি কোন পাপ করে তবে একে অপরাধের পর্যায়েও সমাজ অনেকটাই আগ্রহি হয়ে ওঠে। বিপরিত ক্ষেত্রে সামাজিকভাবে উচ্চ-অবস্থানের কেউ যদি অপরাধও করে তবে একে পাপের পর্যায়ে নামিয়ে আনতেও উদগ্রীব হয়। এটা কি মানুষের ব্যক্তিগত উচ্চাকাঙ্ক্ষা থেকে উৎসারিত যেখানে সবাই নিজেকে দেখতে চায়, এটা বিশাল এক প্রশ্নবোধক হয়ে দাঁড়ায়!
সামাজিক এ বিভক্তি বিবেচনায় আনলে বলতে হয়, ঐশীর এ ফাঁসির রায় আমাদের অনেক প্রশ্নের মুখোমুখি করে দিয়েছে। সেক্ষেত্রে যে কেউই বিভ্রান্ত হতে পারে। বয়স বিবেচনায় অপরাধকে হালকা করে দেখা উচিত, নাকি অপরাধকে অপরাধ হিসেবেই দেখা উচিত? তবে এ ক্ষেত্রে বলা যায়, সামাজিক স্থিতি এবং ভবিষ্যত অপরাধ নির্মূলের স্বার্থে বিচার হওয়া উচিত অপরাধের, বয়সের নয়। আবার এও প্রশ্ন আসে মাঝে মাঝে আলোচিত অথবা চাঞ্চল্যকর অনেক অপরাধের শাস্তি হয় বয়স বিবেচনায়ও। সাক্ষাৎ প্রমাণ যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযম, আবদুল আলিম। সে সব জায়গায় অপরাধের শাস্তি বয়স বিবেচনায় লঘু দেওয়া হয়েছে।
ঐশী শিশুর সংজ্ঞায় পড়ে না, আদালত সেটা নিশ্চিত করেছেন। এ ধরনের চাঞ্চল্যকর হত্যা মামলাগুলোর বিচার কিংবা রায় পরের অনেক রায়ের ক্ষেত্রে দৃষ্টান্তসম বিবেচনায়ও হয়ত সর্বোচ্চ শাস্তির রায় ঘোষণা করেছেন আদালত।
ঐশী মাদকাসক্ত ছিল- এ অজুহাতে তার শাস্তি কম হয়ে শাস্তি হওয়া উচিত মাদক ব্যবসায়িদের- এমন মত যারা প্রকাশ করছেন তারা কি বিবেচনায় নিচ্ছেন মামলার বিচারিক প্রক্রিয়া কিংবা চার্জশিটে মাদক মূখ্য কোন উপাদান ছিল না। এটাকে একটা অজুহাত হিসেবে উপস্থাপন করেছেন আসামির আইনজীবিরা। ফলে আদালত হত্যা মামলার বিচার করেছেন, মাদক থেকে বিস্তার হওয়া সামাজিক বিশৃঙ্খলাকে আমলে নিয়ে হত্যার ঘটনার মত অপরাধকে গুরুত্বহীন করেন নি। তবে নিম্ন আদালতের রায় হিসেবে রায়ের পর্যবেক্ষণে এ বিষয়টির উল্লেখ না হলেও উচ্চ আদালতে এ মামলার বিচারিক অন্যান্য পর্যায়ে বিষয়টি আলোচিত হতেও পারে।
ঐশীর এ রায়ের পর সামাজিক এ বিভক্তি অনেকটাই আবেগ থেকে উৎসারিত, এটাই স্বাভাবিক। তাই যে কেউ আবেগযুক্ত হয়ে বলতেই পারে বয়স বিবেচনায় শাস্তি কঠোর হয়েছে। আবার আবেগমুক্ত হয়ে কেবল হত্যাকাণ্ডের ভয়াবহতা ও ভবিষ্যত অপরাধীদের অপরাধ সম্পর্কে সতর্কতা বার্তা দিতেও বলতে পারে অপরাধ বিবেচনায় শাস্তি যথোপযুক্ত হয়েছে।
সামাজিক এ বিভক্তির যথোপযুক্ত বিশ্লেষণ উচ্চ আদালত থেকে আসা সম্ভব। ঐশীর আইনজীবিরা যেহেতু বলছেন তারা উচ্চ আদালতে যাবেন সেহেতু সেখান থেকে আরও অনেক পর্যবেক্ষণ ও মত-ভিন্নমত আসতেও পারে।
সমাজবদ্ধ জীব হিসেবে সামাজিক মত-প্রতিমত-ভিন্নমত কিংবা বিভক্তি নিয়েই আমাদের নিত্য বাস। মানুষের ভিন্ন ভিন্ন এ চিন্তা-ভাবনাকে ইতিবাচক হিসেবে দেখলে বলা যায় এটা অবশ্যই আশাব্যঞ্জক যে মানুষ সমাজ নিয়ে, রাষ্ট্র নিয়ে, আইন-আদালত নিয়ে ভাবছে। এই ভাবনাগুলো একে অন্যের সঙ্গে অনেক ক্ষেত্রেই সাংঘর্ষিক হলেও বলা যায়, অধিকাংশ মতই যৌক্তিক। তবে কোন যুক্তি কোন সময়, কোন সমাজে, কখন-কিভাবে কাজে লাগানো দরকার সেটা নিশ্চয়ই ভাববে রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকেরা।
সৎ নীতিনির্ধারক, আইন প্রণেতা ও বিচারকগণ এ ক্ষেত্রে এগিয়ে আসবেন এ আশা করাই যায়। চূড়ান্ত বিচারে ঐশীর শাস্তি কি হবে সেটা ভবিষ্যতই নির্ধারণ করবে। তবে এ রায় ঘিরে মাদক ব্যবসায়ি ও মাদকসৃষ্ট বিভিন্ন বিশৃঙ্খলা যেহেতু সামনে আসলো সেহেতু এর একটা বিহিত হলেই আপাতদৃষ্ট সামাজিক বিভক্তি সামাজিক শৃঙ্খলার পথ দেখিয়ে দিতে পারে!
মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।
আপনার মন্তব্য