প্রধান সম্পাদক : কবির য়াহমদ
সহকারী সম্পাদক : নন্দলাল গোপ
টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
Advertise
রেজা ঘটক | ১৭ নভেম্বর, ২০১৫
রক্তাক্ত প্যারিস:
ফরাসিদের কাছে ১৩ নভেম্বর ২০১৫ দিনটি এখন ব্ল্যাক ফ্রাইডে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এ শুক্রবারের সন্ত্রাসী হামলা ফ্রান্সের ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়ংকর হামলা। ওই সন্ত্রাসী হামলায় অন্তত ১৩২ জন নিহত হয়েছে, ৩৫৩ জন আহত হয়েছে, যাদের মধ্যে ৯৬ জনের অবস্থা এখনো আশঙ্কাজনক।
ইতোমধ্যে ইসলামিক স্টেট (আইএস) ওই হামলার দায় স্বীকার করেছে। ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ফ্রাঁসোয়া ওলাঁদ ওই হামলার জন্য সরাসরি আইএসকে দায়ী করেছেন। ওই হামলায় জড়িত আট জঙ্গীর সাতজন নিজেদের কাছে থাকা সুইসাইডাল বোম দিয়ে নিজেদের মৃত্যু নিশ্চিত করেছে, আর একজন পুলিশের গুলিতে মারা গেছে।
ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসের যে ছয়টি স্থানে শুক্রবার হামলা চালানো হয়, সেখান থেকে একটি সিরিয়ান পাসপোর্ট উদ্ধার করা হয়েছে। এছাড়া রবিবার প্যারিসের পূর্বাঞ্চলীয় মুনথাইও শহরতলীতে পরিত্যক্ত অবস্থায় কালো রঙের একটি সিয়াট গাড়ি উদ্ধার করা হয়েছে। যার ভেতর পাওয়া গেছে তিনটি কালাশনিকভ রাইফেল। ধারণা করা হচ্ছে, এই গাড়িটিও হামলাকারীরা ব্যবহার করেছিল। এছাড়া বাতাক্লাঁ কনসার্ট হলের বাইরে বেলজিয়ামের নাম্বার প্লেটসহ একটি ভক্সওয়াগন পোলো গাড়ি পাওয়া গেছে। যেখানে শুক্রবারের হামলায় অন্তত ৯০ জন নিহত হয়।
নিহত হামলাকারীদের মধ্যে অন্তত একজনের পরিচয় সনাক্ত করতে পেরেছে ফরাসি পুলিশ। যার নাম ওমর ইসমাইল মোস্তেফা। মোস্তেফার পরিবারের ছয় জনকে আটক করেছে ফরাসি পুলিশ। ওদিকে হামলায় জড়িত সন্দেহে বেলজিয়ামে সাতজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, হামলার সঙ্গে জড়িত ছিল অন্তত তিনটি গ্রুপ। যাদের কেউ কেউ হয়তো সীমান্ত পাড়ি দিয়ে বেলজিয়ামে পালিয়েছে।
চলতি বছর ৭ জানুয়ারি প্যারিসের শার্লে এবদোর অফিসে হামলার পর শুক্রবারের সন্ত্রাসী হামলা ছিল ফ্রান্সে চলতি বছরে দ্বিতীয় বারের মত সবচেয়ে বড় সন্ত্রাসী হামলা। জানুয়ারি মাসের হামলায় অন্তত ১২ জন নিহত হয়েছিল। শুক্রবারের হামলার পর গোটা ফ্রান্স জুড়ে জরুরি অবস্থা জারী করা হয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এই প্রথম ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট সেদেশে জরুরি অবস্থা জারী করেছেন। শনিবার থেকে ফ্রান্সে পালিত হচ্ছে তিনদিনের রাষ্ট্রীয় শোক। ফ্রান্সে সন্ত্রাসী হামলার পর সারা বিশ্ব থেকে বিভিন্ন সরকার ও সেদেশের জনগণ ফ্রান্সের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করেছেন।
পেছনের ইতিহাস:
১৯৭৯ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের আফগানিস্তান আগ্রাসনকে মোকাবেলা করার জন্য তৎকালীন সোভিয়েতদের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ মদদে আফগানিস্তানে তালেবান সন্ত্রাসীদের উত্থান ঘটে। কান্দাহারে তালেবান হেটকোয়ার্টারে সরাসরি মার্কিন সিআইএ'র তত্বাবধানে তখন তালেবানদের প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র সরবরাহ করা হয়। ১৯৮৫ সালে সোভিয়েত নেতা মিখাইল গর্বাচেভ আফগানিস্তান থেকে সোভিয়েত সেনা প্রত্যাহারের ঘোষণা দেন।
১৯৮৮ সালে আফগানিস্তান থেকে সর্বশেষ সোভিয়েত সেনাদের প্রত্যাহারের পর তালেবান জঙ্গীরা আফগানিস্তানের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখলের লড়াইয়ে লিপ্ত হয়। সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত আর পাকিস্তানের অর্থ, অস্ত্র আর প্রত্যক্ষ সমর্থনে এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বীকৃতি নিয়ে ১৯৯৬ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর মোল্লা ওমরের নেতৃত্বে কাবুল দখলের মাধ্যমে তালেবানরা আফগানিস্তানে ক্ষমতায় এসে ইসলামিক রিপাব্লিক অফ আফগানিস্তান বা ‘তালেবানিস্তান’ কায়েম করে।
তালেবান জঙ্গীদের সৃষ্টি করাতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরাসরি ভূমিকা ছিল। পরবর্তী সময়ে তালেবানরা ক্ষমতাচ্যুত হলে তালেবানদের সহায়তায় এগিয়ে আসে সৌদি ধনকুবের ওসামা বিন লাদেন। আফগানিস্তানের পাহাড়ি অঞ্চলে তখন লাদেনের নেতৃত্বে গঠিত হয় আল-কায়েদা জঙ্গী গোষ্ঠী। শুরুতে আল-কায়েদা অস্ত্র, গোলাবারুদ ও প্রশিক্ষণ সহায়তা পেয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, সৌদি-আরব, পাকিস্তান, সংযুক্ত আরব-আমিরাত ও কুয়েতের কাছ থেকে। ধীরে ধীরে মার্কিন সৃষ্ট আল-কায়েদা এক সময় খোদ মার্কিনীদের বিরুদ্ধেই চোখ রাঙাতে শুরু করলো।
কেনিয়া ও তিউনিশিয়ায় মার্কিন দূতাবাসে বোমা হামলার জন্য আল-কায়েদাকে দায়ী করলো যুক্তরাষ্ট্র। এরপর শুরু হলো ওসামা বিন লাদেন ও জর্জ ডব্লিউ বুশের সন্ত্রাস দমন বনাম জঙ্গী উত্থান খেলা।
নাইন ইলেভেন:
২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের টুইন টাওয়ার ও পেন্টাগনে সন্ত্রাসী হামলার মাধ্যমে একবিংশ শতকে সন্ত্রাসবাদ ও বিশ্ব নিরাপত্তা ব্যবস্থা সম্পূর্ণ নতুন ঘটনার দিকে মোড় নিল। মার্কিন প্রসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ নাইন ইলেভেনের হামলার জন্য আল-কায়েদাকে দায়ী করলেন। আর সন্ত্রাসবাদ দমনে সর্বাত্মক যুদ্ধ ঘোষণা দিলেন। এবার আল-কায়েদা দমনে পাকিস্তানকে ব্যবহার করা শুরু করলো যুক্তরাষ্ট্র।
সন্ত্রাসবাদ দমনের মার্কিন কৌশলকে পুঁজি করে ২০০৩ সালে ইরাকে সর্বাত্মক আগ্রাসান চালায় যুক্তরাষ্ট্র। সাদ্দাম হোসেনের পতনের মাধ্যমে গোটা ইরাক এক রক্তাক্ত মরুভূমিতে পরিণত হয়। ধ্বংস করা হয় ইরাকের হাজার বছরের ইতিহাস ও সংস্কৃতির যাবতীয় কিছু। লুটপাট করা হয় ইরাকের সকল সম্পদ। একই কৌশলে যুক্তরাষ্ট্র সর্বাত্মক অভিযান চালায় আফগানিস্তানে। একবিংশ শতকের প্রথম দশকে ইরাক ও আফগানিস্তানকে (দুইটি দেশকে) সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দেয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সন্ত্রাস দমনের থিওরি দিয়ে। কিন্তু আল-কায়েদার সঙ্গে গোপনে তাদের অস্ত্র ব্যবসা চলতে থাকে। শেষ পর্যন্ত ওবামা প্রশাসন পাকিস্তানে অভিযান চালিয়ে ওসামা বিন লাদেনকে ঘায়েল করে। ব্যাকফূটে চলে যায় আল-কায়েদা।
আরব বসন্ত:
২০১০ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তাদের ন্যাটো মিত্রদের কৌশল নিবদ্ধ হয় মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকার উপর। মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে মার্কিন মদদপুষ্ট গণ-বিক্ষোভকে পশ্চিমা সাংবাদিকরা প্রচার করতে লাগলো ‘আরব বসন্ত’ হিসেবে।
১৮ ডিসেম্বর তিউনিসিয়ায় মোহাম্মদ বোয়াজিজির পুলিশে দুর্নীতি ও দুর্ব্যবহারে প্রতিবাদে আত্মাহুতির মাধ্যমে শুরু হয় বিদ্রোহ। তিউনিসিয়ায় জেসমিন বিপ্লবের ফলে ১৪ জানুয়ারি শাসক জেন এল আবেদিন বেন আলির পতন ঘটে এবং তিনি সৌদি আরবে পালিয়ে যান। তিউনিসিয়ার বিপ্লব সফল হওয়ার পাশাপাশি অন্যান্য আরব দেশেও তখন আত্মাহুতির কারণে অস্থিরতা শুরু হয়। ফলে আলজেরিয়া, জর্ডান, মিশর ও ইয়েমেনে বিদ্রোহ শুরু হয়। ২৫ জানুয়ারি থেকে মিশরে বিদ্রোহ শুরু হয় এবং ১৮ দিনব্যাপী বিদ্রোহের পরে ৩০ বছর ধরে শাসন করা প্রেসিডেন্ট হোসনে মুবারক ১১ ফেব্রুয়ারি পদত্যাগ করেন।
২০১১ সালের ফেব্রুয়ারিতে গাদ্দাফিবিরোধী বিক্ষোভ ও লড়াই শুরু হয়। ২০১১ সালের ১৭ই ফেব্রুয়ারি লিবিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর বেনগাজিতে গাদ্দাফিবিরোধী বিক্ষোভ শুরু হয়। বেনগাজিতে একটি থানার কাছে হাজার হাজার জনতা গাদ্দাফি বিরোধী বিক্ষোভ শুরু করে। টানা নয় মাস বিক্ষোভ ও লড়াইয়ের পর ২০ অক্টোবর সিরতে গাদ্দাফির নিহতের মাধ্যমে লিবিয়ায় সরকার বিরোধী বিক্ষোভের অবসান ঘটে।
তিউনিসিয়া, মিশর ও লিবিয়ার পর সরকার বিরোধী গণবিক্ষোভ শুরু হয় অন্যান্য আরব দেশগুলোতেও। এ পর্যন্ত আলজেরিয়া, ইয়েমেন, বাহরাইন, মিশর, ইরান, জর্ডান, লিবিয়া, মরক্কো, তিউনিসিয়ায় বড় ধরনের বিদ্রোহ হয়েছে। আর ইরাক, কুয়েত, মৌরিতানিয়া, ওমান, সৌদি-আরব, সোমালিয়া, সুদান ও সিরিয়াতে ছোট আকারের বিদ্রোহ হয়েছে।
মার্কিন মদদপুষ্ট এসব গণবিদ্রোহে প্রতিবাদের ভাষা হিসেবে হরতাল, বিক্ষোভ প্রদর্শন, জনসভা, র্যালি প্রভৃতি কর্মসূচির পাশাপাশি দেশব্যাপী সাংগঠনিক কাজ, যোগাযোগ এবং রাষ্ট্রীয় প্রচারণায় জনগণের মধ্যে সচেতনতা গড়ে তুলতে ফেসবুক, টুইটারের মত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে ব্যাপকভাবে কাজে লাগানো হয়। পাশাপাশি এসব বিদ্রোহী গ্রুপগুলোকে অস্ত্র ও গোলাবারুদ দিয়ে সরাসরি সহযোগিতা করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তাদের ন্যাটো মিত্ররা। আর এসব সন্ত্রাসী জঙ্গীগোষ্ঠীদের অর্থ সহায়তা প্রদান করে সৌদি-আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কুয়েত, বাহরাইন সহ কয়েকটি আরব মুসলিম দেশ। মার্কিন মিত্রদের এখানে কৌশল ছিল রাজনৈতিক অস্থিরতার আড়ালে অস্ত্র ব্যবসা ও তেলের দখল।
ইসলামিক স্টেট অব ইরাক অ্যান্ড সিরিয়া বা আইএসআইএস:
আল কায়েদা থেকে তৈরি হওয়া সুন্নি মুসলমানদের নতুন জঙ্গি সংগঠনের নাম হলো আইএসআইএস বা ইসলামিক স্টেট অব ইরাক অ্যান্ড সিরিয়া ৷ ইরাকে সাদ্দাম হোসেনের পতনের পর সাদ্দামের রিপাবলিকান আর্মি থেকে পলাতক সেনা, ইরাক ও সিরিয়ায় হতাশাগ্রস্থ সুন্নি মুসলমানদের বিদ্রোহী গোষ্ঠী এবং আল-কায়েদার অবশিষ্টাংশ মিলে গঠিত হলো আইএস জঙ্গী সংগঠন।
সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাসার আল আসাদের পতন ঘটানোর জন্য মার্কিন মিত্রদের মদদে ও ইসরাইলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের প্রত্যক্ষ প্রশিক্ষণে গড়ে তোলা হয় বর্তমান সময়ের সবচেয়ে ভয়ংকর জঙ্গী সংগঠন আইএস বা ইসলামিক স্টেটকে। সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাসার আল আসাদের পেছনে ইরান ও রাশিয়ার সরাসরি সমর্থন থাকায়, মার্কিন মিত্রদের সৃষ্ট আইএস এখন বুমেরাং হয়ে দেখা দিয়েছে। ইতোমধ্যে ইরাক ও সিরিয়ার বিশাল এলাকা দখল করে তারা খিলাফত কায়েম করেছে।
দীর্ঘ চার বছর ধরে সিরিয়ার আসাদের সরকারি বাহিনীর সঙ্গে আইএস সহ অন্যান্য বিদ্রোহী গ্রুপের মধ্যে চলতে থাকা গৃহযুদ্ধে এখন পর্যন্ত অন্তত তিন লাখ মানুষ নিহত হয়েছে। মার্কিন ও তাদের ন্যাটো মিত্ররা একদিকে রাতের অন্ধকারে আইএস-এর কাছে অস্ত্র ও গোলাবারুদ বিক্রি করছে। আর দিনের আলোয় ভালোমানুষ সেজে সন্ত্রাসবাদ দমনের নামে সেখানে আইএস বিরোধী ড্রোন হামলা চালিয়ে বিশ্ববাসীর চোখকে নিজেদের মিডিয়ার প্রোপাগাণ্ডায় এক ধরনের বিশ্বাসযোগ্যতা স্থাপন করতে চেষ্টা করেছে।
সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো, গোটা মধ্যপ্রাচ্যে অশান্তির যে নায়ক সেই ইসরাইলের বিরুদ্ধে আইএস এখন পর্যন্ত কোনো হামলা চালায়নি। যা থেকে প্রমাণ হয় যে, আইএস-এর পেছনের শক্তি হলো আমেরিকার বাবা স্বয়ং ইসরাইল। মধ্যপ্রাচ্যে এভাবে রাজনৈতিক অস্থিরতা জিইয়ে রেখে এতোদিন মার্কিন ও তাদের পশ্চিমা মিত্ররা অস্ত্র ব্যবসা ও তেলের দখলের উপর একক আধিপত্য বিস্তার করতে সক্ষম হয়েছিল। আরো মজার ব্যাপার হলো, মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন নেতৃত্বাধানীন এসব অপকর্মের প্রধান সহযোগী ও অর্থদাতা হলো আবার কয়েকটি আরব মুসলিম দেশ। মধ্যপ্রাচ্যে এসব সন্ত্রাসী জঙ্গীগোষ্ঠীদের অর্থ সহায়তা প্রদান করে সৌদি-আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কুয়েত, ইয়েমেন, কাতার, বাহরাইন সহ কয়েকটি আরব মুসলিম দেশ। যারা সবাই মার্কিনীদের মিত্র। আর এদের অস্ত্রের চোরাচালানের প্রধান ঘাটি হলো আরেক মার্কিন মিত্র দেশ তুরস্ক।
ইউরোপমুখী শরণার্থী মিছিল:
সিরিয়ায় চলতে থাকা চার বছরের গৃহযুদ্ধে অন্তত তিন লাখ মানুষ নিহত হয়েছে। আহত হয়েছে অন্তত দশ লাখ মানুষ। গৃহযুদ্ধের ভেতর থেকে প্রাণে বাঁচতে সমুদ্র পথে শুরু হয় ইউরোপমুখী শরণার্থীদের যাত্রা। বেশ কয়েকটি জাহাজ ডুবিতে অসংখ্য মানুষ প্রাণ হারানোর পর বিশ্ব মিডিয়ায় সিরিয়ার শরণার্থীদের উপর মানবিক আচরণের আহবান আসে। তারই অংশ হিসেবে হঠাৎ জার্মান ঘোষণা দেয় আট লাখ শরণার্থীদের তারা আশ্রয় দেবে।
ইতালি, তুরস্ক, গ্রিস, মিশরে পালিয়ে যাওয়া কয়েক লাখ শরণার্থীদের পাশাপাশি নতুন করে সিরিয়া শরণার্থীদের গণযাত্রায় শেষ পর্যন্ত ইউরোপ নিজেদের মধ্যে অন্তত এক লাখ ৬০ হাজার শরণার্থী ভাগ করে নেবার সিদ্ধান্ত নেয়। এরপর থেকে সিরিয়ার শরণার্থীদের নিয়ে গোটা ইউরোপের দৃশ্যপট হঠাৎ করে পাল্টে যেতে শুরু করলো।
সিরিয়ায় রাশিয়ার হামলা:
চলতি বছর ৩০ অক্টোবর হঠাৎ করে সিরিয়ার গৃহযুদ্ধের দৃশ্যপটে নতুন পরিবর্তন ঘটল রাশিয়ার আসাদ বিরোধী হামলার মাধ্যমে। আসাদের সরকারি বাহিনীর সহায়তায় রাশিয়ার পাশাপাশি ইরান ও লেবাননের হিযবুল্লাহ গ্রুপ যোগ দেওয়ায়, টনক নড়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তাদের পশ্চিমা মিত্রদের। কাস্পিয়ান সাগর থেকে মাত্র এক সপ্তাহের রাশিয়ান মিসাইল ও বিমান হামলায় আইএস-এর হেডকোয়ার্টারের পতন ঘটে। কোণঠাসা হয়ে পড়ে আইএস।
চার বছর ধরে আইএস দমনের নামে মার্কিন মদদপুষ্ট ন্যাটো যে নাটক করেছে, মাত্র এক সপ্তাহের রাশিয়ার হামলায় আইএস-এর ব্যাপক ক্ষতিতে নড়েচড়ে বসে মার্কিন ও তাদের মিত্ররা। আইএস-এর দখলে থাকা তেলখনিগুলো চলে যায় রাশিয়ার দখলে। মাথা গরম হয়ে যায় মার্কিনীদের। এবার মার্কিনীরা প্রোপাগাণ্ডা থিওরি অবলম্বন করে। প্রচার করতে থাকে রাশিয়ার ছোড়া মিসাইলে ইরানের জনবহুল এলাকায় বেসামরিক লোকজন হতাহত হয়েছে। কিন্তু ইরান তা অস্বীকার করে হিযবুল্লাহর সঙ্গে স্থলপথে আইএস বিরোধী সামরিক অভিযান চালানোর হুমকি দেয়। আর তখনই পাল্টে যায় মার্কিনীদের সিরিয়া কৌশল।
এরপর রাশিয়ার কাছে সরাসরি প্রস্তাব দেয় যুদ্ধ বিরতির। সেই প্রস্তাবের একটা শর্ত হলো সিরিয়ার ক্ষমতা থেকে আসাদকে বিদায় নিতে হবে। আর তেলখনিগুলো নিজেদের মধ্যে নতুন শর্তে ভাগ ভাটোয়ারা হবে। কিন্তু আসাদের সরকারি বাহিনীর পক্ষে রাশিয়ার হামলা এতটা সফল হয় যে, গোটা মধ্যপ্রাচ্যে এখন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন খুবই জনপ্রিয় নেতায় পরিনত হয়। যে কারণে আমেরিকা ও তাদের পশ্চিমা মিত্রদের এখন রাতের ঘুম হারাম। কারণ পশ্চিমাদের মধ্যপ্রাচ্য নীতিতে এখন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিনকে পক্ষে টানাইটাই সবচেয়ে কঠিন চ্যালেঞ্জ।
পশ্চিমাদের মধ্যপ্রাচ্য নীতি:
যতদিন মধ্যপ্রাচ্যে তেল ও গ্যাস থাকবে, ঠিক ততদিন সন্ত্রাস দমনের নামে পশ্চিমা বিশ্ব মধ্যপ্রাচ্যে একদিকে নিজেদের পছন্দমত জঙ্গী সংগঠন সৃষ্টি করবে, আর তাদের কাছে রমরমা অস্ত্র ব্যবসা চালু রাখবে। অন্যদিকে এসব জঙ্গী সংগঠনের মাধ্যমে তেল ও গ্যাসের দখল নিজেদের কব্জায় রাখবে। থিউরি এখানে সুস্পষ্ট, অস্ত্র বেচে তেল নাও। এতদিন মার্কিন ও তাদের পশ্চিমা মিত্ররা যে সুবিধা মধ্যপ্রাচ্যে ভোগ করেছিল, হঠাৎ সেখানে পুতিন বড় ধরনের ভাগ বসানোর কারণে এখন ভোল্ট পাল্টে মার্কিন নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা গোষ্ঠী বলছে, যুদ্ধ বিরতির মাধ্যমে একটা সমাধানের চেষ্টা করা হোক। আর মধ্যপ্রাচ্যের মূল অশান্তির যে নাটের গুরু, সেই ইসরাইলের ব্যাপারে এসব পশ্চিমা মাতবরদের একচক্ষু নীতির ফলেই বর্তমান বিশ্বের সন্ত্রাস বা জঙ্গী উত্থানের প্রধানতম কারণ।
উল্লেখযোগ্য ব্যাপার হলো, এসব সন্ত্রাসী দল বা জঙ্গী সৃষ্টিতে এসব পশ্চিমা মাতবররাই সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রেখেছে।
প্যারিসে সন্ত্রাসী হামলার পর এখন হয়তো মধ্যপ্রাচ্যে পশ্চিমা নীতিতে কিছুটা পরিবর্তন আসবে। সেই পরিবর্তন হবে ইঙ্গো-মার্কিন পক্ষ থেকে ফ্রান্স হয়তো সরাসরি আইএস ধ্বংস করার সর্বাত্মক যুদ্ধে এখন কৌশলগত কারণে রাশিয়ার পক্ষে যোগ দেবে। নতুবা ফ্রান্সকে পক্ষে রাখতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বৃটেনকে সঙ্গে নিয়ে আইএসকে নির্মুল করে নতুন কোনো জঙ্গী সংগঠন সৃষ্টি করায় মনোযোগ দেবে। সেক্ষেত্রে সকল পশ্চিমা জোট একত্র হয়ে আইএসকে দমনে মনোযোগী হতে পারে। কারণ, জঙ্গী দমনের আড়ালে তাদের আসল নজর যেখানে মধ্যপ্রাচ্যের তেল ও গ্যাস সম্পদ। আবার কৌশলগত কারণে সন্ত্রাস বা জঙ্গীবাদ পুরোপুরি নির্মুল করলে অস্ত্র ব্যবসা আর থাকে না। তাই মধ্যপ্রাচ্যে নতুন নতুন সন্ত্রাসী জঙ্গীগোষ্ঠী সৃষ্টিতেও হয়তো নতুন করে মনোযোগী হবে এসব পশ্চিমা মোড়লগণ।
জঙ্গী উত্থানে ধর্মের ব্যবহার:
পশ্চিমাদের সৃষ্ট সন্ত্রাসবাদের বিস্তার বা জঙ্গী উত্থানের পেছনে একটা কমোন কৌশল হলো মুসলমানদের ধর্মীয় অনুভূতি। শুরুতে এরা এসব সন্ত্রাসীদের অস্ত্র, গোলাবারুদ ও প্রশিক্ষণ দিয়ে সহায়তা করে। তারপর এদের সঙ্গে চলে অস্ত্র ও তেল ব্যবসা। আর এসব জঙ্গী বা সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলো যখন নিজেদের একটু শক্তিশালী মনে করতে শুরু করে, তখনই এরা ধর্মকে ব্যবহার করে খোদ যাদের হাতে তাদের উত্থান, তাদেরকেই নিশানা করে। তারপর এরা মার্কিন ও পশ্চিমা লোক ও স্থাপনার উপর হামলা করার চেষ্টা করে।
গোটা মধ্যপ্রাচ্যে প্রায় প্রতিটি মুসলিম দেশেই পশ্চিমা মদদপুষ্ট এক বা একাধিক এ ধরনের সন্ত্রাসী জঙ্গী গ্রুপ রয়েছে। প্রায় প্রত্যেকটি সন্ত্রাসী গোষ্ঠী ইসলামকে ধর্ম হিসেবে ব্যবহার করছে। এসব জঙ্গী গোষ্ঠীর দাবি করা ইসলামের সঙ্গে মূল ইসলাম ধর্মের বা শান্তিপ্রিয় মুসলমানদের কোনো সম্পর্ক নেই। মধ্যপ্রাচ্য ও মুসলিম দেশগুলোর অন্যতম সন্ত্রাসী সংগঠনগুলো হলো ইসলামিক স্টেট বা আইএস, হামাস, হিযবুল্লাহ, আল-কায়েদা, তালেবান, লস্কর-ই-তৈয়্যবা, আল-শাবাব, বোকো হারাম। মজার ব্যাপার হলো, এসব সন্ত্রাসী জঙ্গী গোষ্ঠী অস্ত্র, গোলাবারুদ ও প্রশিক্ষণ পায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তাদের পশ্চিমা মিত্রদের কাছ থেকে। আবার সন্ত্রাসবাদ দমনে সেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে সারাবিশ্বে প্রচারণা চলে।
প্যারিস হামলার পর ইউরোপ এখন কোনপথে যাবে?
শুক্রবারের প্যারিস হামলা মূলত খোদ ইউরোপের হৃৎপিণ্ডে ছুরিকাঘাতের সমান ৷ একদিকে আইএস বিরোধী সন্ত্রাস দমন তৎপরতা বাড়াতে এখন উদ্যোগী হবে পশ্চিমা বিশ্ব। পাশাপাশি সিরিয়া থেকে ইউরোপমুখী চলমান শরণার্থীদের ঢলকে এখন আর গণহারে গ্রহণ না করার কৌশল নিতে পারে ইউরোপ। ইতোমধ্যে প্যারিসে হামলার পর, পোল্যান্ড কোনো সিরিয়া শরণার্থী নেবে না বলে ঘোষণা দিয়েছে। সেক্ষেত্রে উন্নত জীবনের আশায় সিরিয়ার শরণার্থীদের ইউরোপমুখী যাত্রায় একটা পরিবর্তন আসবে। এমন কী ইতোমধ্যে যেসব আরব-শরণার্থী ইউরোপীয় দেশগুলো গ্রহণ করেছে, তাদের আবার ফেরত পাঠানোর উদ্যোগ নিতে পারে। যা হবে চরম অমানবিক।
একই সঙ্গে যদি ইসলামিক স্টেট বা আইএ জঙ্গী গোষ্ঠীর পশ্চিমাদের বিরুদ্ধে আরো সন্ত্রাসী কার্যক্রম অব্যাহত থাকে, তাহলে বর্তমানে প্রচলিত এক ভিসায় ইউরোপের কয়েকটি দেশ ভ্রমণের যে সুবিধা এখন চালু আছে, এটি ভেঙ্গে যেতে পারে। এমন কি ইউরোপীয় ইউনিয়নের যে এক মুদ্রা এক ভিসা কার্যক্রম তাও ব্যর্থ হতে পারে। ভেঙ্গে পড়তে পারে খোদ ইউরোপীয় ইউনিয়ন জোট। কারণ মধ্যপ্রাচ্য ইস্যুতে রাশিয়ার সঙ্গে অন্যান্য ইউরোপীয় দেশের স্বার্থের বিরাট পার্থক্য বর্তমানে দৃশ্যমান। যেখান থেকে রাশিয়ার পেছনে হাঁটার সুযোগ খুবই কম। পাশাপাশি সারাবিশ্বে মুসলমানদের উপর পশ্চিমাদের দৃষ্টিভঙ্গি আরো কঠোর হবে। যে কারণে পশ্চিমা বিভিন্ন দেশে ডানপন্থীদের উত্থান আরো শক্তিশালী হতে পারে। যা বিভিন্ন পশ্চিমা দেশে অভিবাসী আইনে আরো কঠোরতা জারী হতে পারে। বিশেষ করে মুসলমানদের উপর নিপিড়ন আরো বাড়তে পারে।
মধ্যপ্রাচ্যে ইসরাইল ও ফিলিস্তিন সমস্যাকে যতদিন না পশ্চিমা বিশ্ব স্থায়ী সমাধান না টানবে, ততদিন ইসরাইলের ইসারায় আমেরিকার প্রত্যক্ষ মদদে পশ্চিমা বিশ্ব মধ্যপ্রাচ্য নিয়ে সন্ত্রাস বা জঙ্গী উত্থান বনাম সন্ত্রাস দমন নাটক খেলতে থাকবে। কারণ এই খেলায় অস্ত্র ব্যবসা আর তেলের দখল জড়িত। এই খেলায় বিশ্ব মানবতা কেবল পশ্চিমাদের নাটকের মঞ্চ।
যতদিন পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী গোষ্ঠী এই সন্ত্রাস সৃষ্টি ও সন্ত্রাস দমনের নাটক নিজেরা বন্ধ না করবে, ততদিন জঙ্গী উত্থান বা বিস্তারের কোনো স্থায়ী সমাধান হবে না। কারণ এই বিষয়ের সমাধানও এই পশ্চিমা মোড়লদের হাতেই। ২০১৬ সালের মার্কিন নির্বাচনে আবার যদি রিপাবলিকান পার্টি ক্ষমতায় আসে, তাহলে বরং গোটা বিশ্বেই সন্ত্রাসের আরো বিস্তার ঘটারই সম্ভাবনা রয়েছে।
মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।
আপনার মন্তব্য