আজ শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

Advertise

এই আকাশে আমার মুক্তি আলোয় আলোয়!

ড. কাবেরী গায়েন  

এই অস্থির সময়ে একটু নিরিবিলি থাকবার জন্য ফেসবুক থেকে বিদায় নেই, ফের নতুন ঘটনার অস্থিরতা ফিরিয়ে আনে। অনেকটা যেনো-আমিও এই দুঃসময়ের যাত্রী, তোমাদের সাথে-বলবার জন্য। এবার  যখন  বিদায় নিয়েছিলাম ফেসবুক থেকে, ঘুর্ণাক্ষরেও ভাবিনি নতুন বছরের আগে ফিরবো।

ফ্রান্সের ঘটনার পরে কয়েকদিন স্তব্ধ হয়েই ছিলাম। যখন ফিরে এলাম, গতরাতে, প্রতিবার ফিরে আসার মতোই হোমফিডে একবার চোখ বোলানো; তেমনই দেখতে গিয়ে আজ আনন্দ মজুমদারের ফেসবুক স্ট্যাটাস পড়তে গিয়ে থমকে গেলাম। কী লিখেছে আনন্দ? কার কথা বলছে?

...এবার তিনি নেই। যার জন্য সব।   "আমার এই দেহখানি তুলে ধরো  তোমার ওই দেবালয়ের প্রদীপ করো।"  এসব গান চলছিলো আদ্যোপান্ত, - বহুল শোনা গানের মানে আমার কাছে সম্পূর্ণ নতুন হয়ে উঠছিলো, চিতার হোমাগ্নি আকাশে উঠছিল হাত বাড়িয়ে। ধোঁয়া আর ছাই হয়ে মিশে গেল খোলস-দেহ। ভৈরবের জল টেনে নিল সব। সেই জল বাতাস আর আকাশ মাটিতে মিশে গিয়ে এক অনন্ত জীবন আরও অনন্ত হচ্ছে। আর আমরা দেখছি। ...

জিজ্ঞেস করলাম, কা’র চিতার হোমাগ্নি আকাশে উঠেছে হাত বাড়িয়ে? ছুটুমা কি নেই আর? খানিক্ষণের মধ্যেই খবর পেলাম। মিন্টু, মিন্টু কিবরিয়া জানালো, ছুটুমা নেই। একেবারে নেই? একটু পরেই মানসী অনন্যা জানালো, আমার ফেসবুক বন্ধ ছিলো বলে জানাতে পারেনি। অথচ যেদিন ফেসবুক বন্ধ করে চলে যাই,  সেদিন ওর সাথে দীর্ঘ কথা হয়েছে ছুটুমার শারীরীক অবস্থা নিয়ে। আর যেদিন খুললাম, সেদিন তিনি নেই?

স্মৃতি তুমি সহায়  হও। ২০০২ সালের কথা। পিএইচডি’র তথ্য সংগ্রহের জন্য দেশে যাবো। কিছু গ্রামে যেতে হবে, থাকতে হবে সেখানে। আনন্দ, কবি-অনুবাদক-অধ্যাপক আনন্দময়ী মজুমদারের সাথে তখন আমার নিত্য যোগাযোগ ই-মেল আর ফোনে। আনন্দ কানেকটিকাট/ডিউক আর আমি এডিনবরা। দু’জনেই পিএইচডি করছি।

আনন্দই প্রথম জানালো, তথ্য সংগ্রহের জন্য এক আদর্শ গ্রাম হতে পারে ফুলতলা, পয়গ্রাম। সেখানে ‘আরণ্যক’ নামে এক বাড়ি আছে। সেখানে দু’জন মানুষ থাকেন গোটা গ্রামকে আলোকিত করে - মুকতি মজুমদার আর মোহাম্মদ কায়কোবাদ।  আনন্দ’র ছুটুমা আর সোনাপিসে। আনন্দ’র মুখে শুনে শুনে অর্ধেক মুখস্ত হয়ে গেছে তাঁদের অবয়ব, কাজ আর মানুষকে ভালোবাসার মূর্তি। দেশে ফেরা হলো। অবধারিতভাবে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়েও। সেখানেই কাকী (আনন্দ’র মা) আমাকে জানালেন, ফুলতলার আরণ্যকে আমার জন্য অপেক্ষা করে আছেন ছুটুমা আর সোনাপিসে।

ঢাকায় ফেরার পরে একদিন হঠাৎ ফোন করলেন ছুটুমা, মুকতি মজুমদার। আমি একটু সংকোচ করছিলাম, ওনাদের কোনো অসুবিধা হবে কি না। কষে ধমক দিলেন ছুটুমা- ‘তোমার বিলেতি ভদ্রতা রাখো তো! কবে আসছ, জানাও।’ তাঁর বলার মধ্যে কোনদিন না দেখার দূরত্ব এক মূহুর্তেই গেলো ঘুচে। আনন্দ’র ছুটুমা, আমারো ছুটুমা হয়ে গেলেন।

অবশেষে, অক্টোবর মাসের একদিন এক বড় চটের ব্যাগ ভর্তি প্রশ্নপত্র নিয়ে খুলনার বাসে উঠে পড়লাম খুব সকালে। পথে অন্তত কুড়িবার ফোন, কতোদূর পৌঁছেছি। ফুলতলা বাজারে পৌঁছেছি তিনটার একটু পরে। ভ্যানে উঠবো কি না ভাবছি, এমন সময় সৌম্যমূর্তি নিয়ে এগিয়ে এলেন মোহাম্মদ কায়কোবাদ নামের এক মানুষ। সেই মূহুর্ত থেকে আজীবনের সোনাপিসে। স্নেহের সাথে কাছে টেনে নিলেন, ভ্যানে উঠলাম প্রথমবারের মতো। সোনাপিসের সাথে এসেছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন মাস্টার্স-এর ছাত্রী সন্ধ্যা, এখন সেই বিভাগের শিক্ষক। দু’জনে মিলে যাকে বলে আগলে নিয়ে চললেন আরণ্যকের দিকে।  ১৫/২০ মিনিটের রাস্তায় অন্তত চার-পাঁচবার ফোন করলেন ছুটুমা।

গ্রামে ঢুকতেই হাতের বায়ে কথা সাহিত্যিক হাসান আজিজুল হকের বাড়ি, তার ভাই আনোয়ার হোসেন, আমাদের আনু চাচা, থাকেন তখন, তিনিও নেই আর। তাঁর ছেলেই মিন্টু কিবরিয়া। কয়েক হাত এগোলে ডানদিকে হাসান স্যারের চাচাতো ভাই-এর বাড়ি। আমরা ডাকি বাচ্চু চাচা। আরো কয়েক হাত আগালেই, মাটির পথের শেষ বাড়িটি ‘আরণ্যক’। ভ্যান থামলো গেটের সামনে। গেটে মাধবীলতার ঝাঁড়। সারা বাড়িভর্তি গাছ, বকুলতলা, বাঁধানো  চত্বর। সাদা ধবধবে খোলের বেগুনী পাড়ের শাড়ি পরা, চশমাচোখে ছুটুমা হৈ চৈ করে আমাকে ঘরে ঢোকালেন।

সেই ঘরের মমতাময় শ্রীর কথা আসলে লিখে বলা সম্ভব না। চকচকে পরিস্কার শান বাঁধানো ঘরে, সিঁড়ি বেয়ে ঢুকতেই সারি সারি বই। এক সারি সোফা। সোফাটা বসার উপকরণমাত্র, ঘরটাকে ছাপিয়ে ওঠেনি। জবা ফুল আর পাতায় সাজানো ফুলদানি। রবীন্দ্রসংগীত বাজছে। মনে হলো, সত্যজিৎ-এর ছবিতে ছোট অপুর মতো যেনো আমি, ‘এ কোথায় এলাম রে! এ কী রে!’ বিস্ময় কাটানোর আগেই গরম জল তৈরি। খেয়ে বিশ্রাম নিতে যেতেই হলো। ঘুম এসেছে, এরই মধ্যে পাড়ার ছেলেমেয়েরা জুটেছে গান করার জন্য। গান হচ্ছে, ‘দুই হাতে কালের মন্দিরা যে সদাই বাজে!’ ঘুমের ঘোরে প্রথম মনে হলো বুঝি টেলিভিশনে হচ্ছে, এই গ্রামে এমন সমস্বর শুদ্ধ গান কোথা থেকে আসবে? কিন্তু না, ছুটুমা ডেকে পাঠালেন চত্বরে গান শুনতে যেতে। তখন সূর্য ডুবে যাবে। শতরঞ্চির উপরে সারি দিয়ে গান গাইছে আরণ্যকের পেছনে পাল পাড়াসহ অন্যসব পাড়া আর বাড়ির ছেলেমেয়েরা। খাসা খুলনার ভাষায় কথা বলা ছেলেমেয়েরা একের পরে এক শুদ্ধ সুরে, লয়ে, উচ্চারণে গান করে চলেছে, হারমোনিয়াম বাজিয়ে দিচ্ছেন ছুটুমা। শেষ গানটিঃ মোরা সত্যর পরে মন/আজি করিব সমর্পণ/ জয় সত্যের জয়।

এই যে আরণ্যক বলছি, বলছি ছুটুমা আর সোনাপিসের কথা। তাঁরা দুজনেই ছিলেন অধ্যাপক, সরকারী বিএল কলেজের। দীনেশচন্দ্র সেন-এর বাগানবাড়িতে বাড়িটা বানিয়েছেন দর্শনের অধ্যাপক মুকতি মজুমদার আর বাংলা সাহিত্যের অধ্যাপক মোহাম্মদ কায়কোবাদ, তাঁদের অবসর নেবার পরে। সেই বাড়িটিই আরণ্যক। দু’জনেই মুক্তবুদ্ধির মানুষ। মুকতি মজুমদার মহেশ্বরপাশা জমিদার বাড়ির ছোট মেয়ে। ধারালো চেহারা, অপূর্ব গান করেন, খুলনার সব সাংস্কৃতিক আন্দোলনের পুরোধা ব্যক্তিত্ব। সারা পরিবার ছিলো সংস্কৃতি চর্চার আবাস। ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটির সূচনালগ্নের সংগঠকদের একজন। শিবির অধ্যুষিত বিএল কলেজ ক্যাম্পাসে  শিবিরের  বিরুদ্ধে  স্পষ্ট সাহসী অবস্থান নিয়েছেন। আর কিংবদন্তীতূল্য অধ্যাপক কায়কোবাদ প্রগতিশীল আন্দোলনের অসীম সাহসী ব্যক্তিত্ব। নিঃসন্তান এই দম্পতি তাঁদের বাড়ির পেছনের পালপাড়া, নিকেরিপাড়া, শালপাড়া- সব বাড়ির ছেলেমেয়েদের বুকে তুলে নিয়েছেন।

তারা এ’বাড়িতে পড়ে, গান করে, নাটক করে, খোল বাজায়, ঘুমায়। ছূটুমা মুখে তুলে দেন ‘তাসের দেশ’ কিংবা ‘ফাল্গুনী’ নাটকের পাঠ। দীর্ঘদিন ধরে মহড়া করতে করতে যেদিন নাটক করতে বকুলতলার মঞ্চে ওঠে, সেদিন আর কারো প্রম্পটের দরকার হয় না। ওরা করে বাংলা নববর্ষ, বিজয় দিবস, রবীন্দ্র-নজরুল জয়ন্তী। এ বাড়িতে আসেন উদীচীর সভাপতি, প্রগতিশীল রাজনীতি আর সাংস্কৃতিক আন্দোলনের সাথে জড়িত মানুষেরা। আসেন হাসান আজিজুল হক, সনৎ কুমার সাহা। ছুটুমা তো গান-নাচ-নাটক নিয়ে ব্যস্ত, আর পেছনে সবকিছুর যোগান দিয়ে যান অধ্যাপক কায়কোবাদ। ভারত থেকে আসেন শিল্পী-সাহিত্যিকরা। অনুষ্ঠানের সময় হলেই ম্যারাপ পড়ে, চেয়ার আর মাইক আনা হয়। যারা রাতে থাকবেন, তাদের জন্য সোনাপিসে বাড়তি তোষক, লেপ ভাড়া করে আনেন শীতের রাত হলে। তিনি করেন নীরবে।

ছুটুমা আমাকে পাড়ার ছেলেমেয়েদের দিয়ে টিম করে দিলেন তথ্য সংগ্রহের দুরুহ কাজটা করার জন্য। সবচেয়ে বড় গ্রাম ছিলো এই পয়গ্রাম। ২০৮ জন নারীর সাক্ষাৎকার নেয়া হয়েছিলো এই গ্রাম থেকে। তাঁর কঠিন নিয়মে সকাল ন’টার মধ্যে টিম নিয়ে বের হয়ে যাওয়া, একটার মধ্যে বাসায় ফিরে খাওয়া-বিশ্রাম, ঠিক তিনটায় ফের বের হয়ে যাওয়া আর সন্ধ্যা নাগাদ বাসায় ফিরে আসা। রাতে প্রশ্নপত্র দেখে মিলিয়ে ফেলা কোথাও কোনো অসংগতি আছে কি না। তিন সপ্তাহের চেয়ে একটু বেশি এই কাঠামো মেনে এমন সুচারুভাবে কাজ হয়েছিলো! আর সোনাপিসে আমাকে নিয়ে গেছেন ডিসি অফিস থেকে শুরু করে সব জায়গায়, চোখের ডাক্তারের কাছে। ভয়ঙ্কর চোখ উঠেছিলো সেবার। পূজার ভেতরে আমার ফেরার পালা। অবিশ্বাস্য, সোনাপিসে নিজের হাতে আমাদের বাসার জন্য নাড়ু বানিয়ে দিয়েছিলেন। এসব অবিশ্বাস্য ভালোবাসাময় দিনের কথা। ঢাকায় ফিরে এলাম, ফিরে এলাম এডিনবরাতে। সপ্তাহে নিয়ম করে ফোন দিতাম। কোন সপ্তাহে দেরি হলে সোনাপিসে ফোন করতেন। আমি ভালো আছি, এটুকু শুনবার জন্য- ‘মাগো, ভালো আছো তুমি, এটুকুই জানতে চাই শুধু।’

দেশে ফিরে যাবার পরে বহুবার গেছি আরণ্যকে। সে আমার গুণে নয়। তাঁদের সব আয়োজনে এই মেয়েটাকেও তাঁদের চাই-ই চাই। কতোজনের সাথে আত্মীয়তা হয়েছে ওখানে! লাল্টুর দরদভরা গান, প্রবীরদার নাটক, বিএল কলেজের তরুণ অধ্যাপকদের কবিতা, নাটক, গান। রাজীব, মিন্টু, অরুণ, মিতা, লুবনা, তানিয়া। আমি আজ কার কথা বাদ দিয়ে কার কথা বলি! কায়সার যখন গান করে কে বলবে সে ছুটুমা’র কোন কথা না শোনা ছেলে। রানুদি বোন বানিয়ে নেন। ছুটুমার ভাই, গণিতবিদ সুব্রত মজুমদার স্যার আর কাকীর সাথে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্পর্ক আরণ্যকে গিয়ে নতুন মাত্রা পায়। ভারত থেকে আসেন সুশীল সাহা, তাঁর মেয়ে রাকা। আসেন শিল্পী গৌতম বরণ অধিকারী। সাহিত্যিক জুলফিকার নাইয়া। সবার জন্য অবারিত দ্বার। আরণ্যক ট্রাস্টি বানিয়েছেন, আমাকেও রেখেছেন সেখানে।  

প্রতিবছর  বৈশাখে ‘আরণ্যক’ নামে যে সাহিত্য পত্রিকা বের হয়, সেই পত্রিকা আসে। সোনাপিসে যোগাযোগ করেন, পাঠিয়ে দেন। শেষবার গেছি প্রায় তিন বছর হতে চললো। হঠাৎ শুনলাম সোনাপিসে অসুস্থ, অপারেশন হয়েছে। খুলনা গেলাম সপ্তাহ খানেকের জন্য। রোজদিন কাকীর সাথে ফুলতলা থেকে খুলনা মেডিক্যালে যাই। ছুটুমা শুধু বলেন, কয়েকদিন সময় নিয়ে আসবি। এরই কয়েকমাস পর থেকে ফোনে বুঝতে পারি ছুটুমা’র কথা একটু বুঝি অসংলগ্ন। অনেক কথা বলার পরে ফের জিজ্ঞেস করেন, ‘কে বলছিস?’ বুক ভেঙ্গে যায়।

সোনা পিসে, ছুটুমা’কে ফোন করে পাওয়া যায় না সেও তো অনেক মাস হলো। এক-আধটু শুনি, সোনা পিসে ভালো নেই। খুলনায় এক ছাত্রীর বাসায় আছেন যত্নে। সেই নম্বরে যোগাযোগ করার চেষ্টা করি। একদিনই ধরতে পেরেছিলাম, কিন্তু শুনলাম তিনি কাউকে চিনতে পারেন না। মাত্র বছর দেড়েকের মধ্যে কী এমন হলো? এরই মধ্যে আমি অসুস্থ হয়েছি প্রচন্ড। এবছর কিভাবে কেটে গেলো জানিনা। স্যাবাটিক্যাল নিয়েছিলাম এক বছরের। অসুস্থতার কারণে ছয় মাস পরে যখন প্লেনে ওঠার অনুমতি মিলেছে ডাক্তারের, ততোদিনে মাথায় আনসার উল্লাহ বাংলা টিমের হুমকি। দেশ ছাড়ার রাতেও ফোন করার চেষ্টা করেছি দু’জনকেই। পারিনি কথা বলতে। মাস দেড়-দুয়েক আগে, বিদেশে বসেই সুশীল সাহা কাকার ফেসবুক থেকে ছবি দেখি সোনাপিসের স্মৃতিহারানো অবয়ব। স্নেহ নিম্নগামী। তাঁরা যতোদিন বোধে ছিলেন, আমি তাঁদের স্নেহের বৃত্ত থেকে দূরে যেতে পারিনি, যেদিন তাঁরা অসমর্থ হলেন, আমি যেতে পারলাম না। আজ বিদেশ-বিভূঁইয়ে হঠাৎ জানা যে, ছুটু মা নেই। ভাবছি, সোনাপিসে কি বুঝতে পারছেন, ছুটুমা যে নেই আর?

সেই কতবছর আগে দুই ধর্মে জন্ম নেয়া দুই মানুষ ভালোবেসে কাছাকাছি এসেছিলেন। সমাজের কুসংস্কারকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে যে যাঁর ধর্ম পালন করে/না করে সারাজীবন কাটিয়ে দিলেন, এতোটুকু জুলুম কারো উপরে না করে। তৈরি করলেন, ভালোবাসার নতুন ধর্ম। সমাজের কুসংস্কারকে তোয়াক্কা করলেন না, অথচ সমাজের মানুষদের বুকে নিয়েই চললেন। খুলনার ফুলতলার পয়গ্রামের মতো গ্রামে। ছূটুমা বলতেন, দেশের পরিস্থিতি যাই-ই হোক, দেশের মাটি ছেড়ে কোথাও যাওয়া যাবে না। তাঁদের মহেশ্বর পাশার জমিদার বাড়ি শত্রু সম্পত্তি হয়েছে। ছুটুমার দিদি ফুলমা এলেন একবার ভারত থেকে। আমিও তখন আরণ্যকে। তাঁর বড় ইচ্ছে, নিজেদের ভিটেটা একবার দূর থেকে দেখে আসবেন। আমার সাথে পরামর্শ করলেন। আমরা যাবো, কিন্তু ছুটুমা সকালে ডেকে বললেন, ‘কোথায় যাবি রে তোরা? খবরদার, মহেশ্বরপাশার দিকে যাবার চেষ্টা করবি না।’ হয়তো অভিমান, হয়তো ছেড়ে দিয়ে ধরে রাখতে চাওয়ার মতো বিড়ম্বনা নেই বলেই। আমাদের আর যাওয়া হলো না।  শুধু বলতেন, তাঁর মৃত্যুর পরে যেনো রবীন্দ্র সংগীত গাইতে গাইতে শ্মশানে পুড়িয়ে দেয়া হয়। তাঁর এই ইচ্ছা রাখা হয়েছে। গান গাইতে গাইতে গেছে তার হাতে তৈরি হওয়া ছেলেমেয়েরা।

এই শীতের রাতে, বিদেশে, প্রচন্ড ঝড়ো হাওয়ায়, সারা পৃথিবীর উন্মত্ততার মধ্যে ছুটুমা’র চোখ দু’টো উজ্জ্বল্ভাবে তাকিয়ে আছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দাবিতে তাঁদের দু’জনের সাথে আমিও দাঁড়িয়েছি ফুলতলায়। ছুটুমা বিশ্বাস করতেন, এদের বিচার হবেই। কিছু রায় শুনে যেতে পেরেছেন, নিশ্চয়ই শান্তি পেয়েছেন। যতীন সরকারের মতো তিনিও বলতেন, পাকিস্তান মনস্তত্বের কথা। বলতেন, এদেশ স্বাধীন হয়েছে মুক্তিযুদ্ধ করে, পাকিস্তান মনস্তত্ব এখানে টিকবে না। সমস্ত প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে এই দু’জন অপার সাহসী মানুষের যুদ্ধ জয়ী হয়েছে বলেই বিশ্বাস করি। সব জয় চোখে দেখা যায় না। তাঁরা দু’জন হয়তো শেষ জীবনের কিছুদিন একাকী কাটিয়েছেন, কিন্তু তৈরি করে গেছেন পথ, সবার জন্য। কী বিশ্বাসের সাথে গাইতেন তিনি, ‘যদি দন্ড সহিতে হয়/তবু মিথ্যা বাক্য নয়’। এই শিখানো বৃথা যায় কি? আনন্দ লিখেছে তাঁর নশ্বর দেহ ধোঁয়া আর ছাই হয়ে জলে মিশে গেছে। ‘সেই জল বাতাস আর আকাশ মাটিতে মিশে গিয়ে এক অনন্ত জীবন আরও অনন্ত হচ্ছে।’

ছুটুমা’র নামই তো মুকতি। পাকিস্তান আমল, স্বাধীন দেশের সামরিক শাসন, ধর্মীয় মৌলবাদের উত্থান বড় কষ্ট দিয়েছে তাঁকে, তাঁর পরিবারকে। কোনদিন বৈষয়িক কোনো অনুযোগের একটি শব্দও শুনিনি তাঁর মুখে। শুধু কষ্ট ছিলো, বাংলাদেশ যেমন হবে ভেবেছিলেন, তেমন হয়নি। তবু তিনি মুক্তির গান করে গেছেন, অনন্ত জীবনের কথা শুনিয়ে গেছেন। সবেদা গাছের শিশিরবিন্দুতে, বকুলতলার মঞ্চে, একুশে ফেব্রুয়ারীর গানে, কলাবতী ফুলের রঙ্গে, সূর্যাস্তের আবীরে, ভোরের পায়চারীতে, শিশুদের গলায় তিনি অনন্ত জীবনের সুর তুলে গেছেন। আমি ‘আরণ্যক’-কে দেখতে পাচ্ছি। মালতীলতা ঠিকঠাক ঝুলছে তো? একটু পরেই শুরু হবে ছুটুমার ডাকাডাকি। ওপথ ধরে যেই-ই যাবে, তাকেই ডেকে দু’চারটে কথা বলে সন্দেশ খাইয়ে বিদায় দেবেন, সন্ধ্যেবেলা আসার কথা মনে করিয়ে দেবেন।

যুদ্ধাপরাধী ছাড়া তিনি সবাইকে ভালোবেসেছেন। সেই ভালোবাসা মুক্তি হয়ে, অভয়  হয়ে ছড়িয়ে পড়ছে নিশ্চয়ই। আমার অনেকদিনের অশান্ত মন তাঁর উজ্জ্বল চোখের সামনে দাঁড়িয়ে। বাইরে প্রচন্ড ঝড়ো বাতাস। খানিক পরেই এখানে সকালের আলো ফুটবে। হিংসায় উন্মত্ত পৃথিবীতে তাঁর ভালোবাসাভরা চোখের সামনে দাঁড়িয়ে আমি। ভালোবাসা ছাড়া মুকতি নেই। ভালোবাসা ছাড়া মুক্তি নেই।

ড. কাবেরী গায়েন, অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪১ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬২ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩০ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯০ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৫ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ