প্রধান সম্পাদক : কবির য়াহমদ
সহকারী সম্পাদক : নন্দলাল গোপ
টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
Advertise
রেজা ঘটক | ২৯ নভেম্বর, ২০১৫
নেপাল দক্ষিণ এশিয়ার একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র। নেপালে দীর্ঘদিন ধরে চলতে থাকা রাজনৈতিক সংকট যখন নতুন করে আলোর মুখ দেখার পথে, ঠিক তখনই প্রতিবেশি ভারত নেপালের উপর তার সাম্রাজ্যবাদী আচরণ আরও দৃঢ় করেছে।
নেপালে সদ্য প্রবর্তিত নতুন সংবিধান ভারতের পছন্দ হয়নি। তাই ভারত থেকে নেপালগামী সব ধরনের নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য সরবরাহ কৌশলে বন্ধ করে দিয়েছে ভারতের মোদি সরকার। ভারত নেপালের সীমান্ত পুরোপুরি সিল করে দিয়েছে। নেপালে এখন তীব্র খাদ্য ও জ্বালানী সংকট চলছে। জিনিসপত্রের দাম চরমভাবে ঊর্ধ্বমুখী। কাঠমান্ডুতে গ্যাস নেই। কেরোসিন নেই। খাদ্যদ্রব্যের দাম ভয়াবহ রকমের চড়া।
ভারতের অঘোষিত বাণিজ্যিক অবরোধের পাল্টা জবাব হিসেবে নেপালে সকল ভারতীয় টেলিভিশন চ্যানেল বন্ধের জন্য কয়েকদিন ধরে কাঠমান্ডুতে বনধ চলেছে। নেপাল সরকার বাধ্য হয়ে ভারতীয় টিভি চ্যানেল বন্ধ ঘোষণা করেছে। ব্রাভো নেপাল। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, নেপাল একদিন ঠিকই ঘুরে দাঁড়াবেই।
এপ্রিল মাসের ভয়াবহ ভূমিকম্পের পর নেপাল এমনিতে যেখানে দারুণভাবে অর্থনৈতিক সংকটে পড়েছে। তার উপর ভারতের এই আচরণ কোনো ভাবেই আন্তর্জাতিক অঙ্গনে গ্রহণযোগ্য নয়। নেপালের গোটা যোগাযোগ ব্যবস্থা যেখানে এখনও চালু হয়নি। পর্যটন হোটেলগুলো এখনও বন্ধ।
নেপালের প্রধান আয়ের উৎস হলো পর্যটন। এপ্রিল মাসের ভয়াবহ ভূমিকম্পের পর নেপাল এখনও সেই আর্থিক সংকট কাটিয়ে উঠতে পারেনি। তার উপর নতুন করে ভারতের চাপিয়ে দেয়া অঘোষিত বাণিজ্যিক অবরোধ মোটেও প্রতিবেশি সুলভ আচরণ নয়। এটা ভারতের সুস্পষ্টভাবেই সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের প্রচেষ্ঠা।
নেপালে ২৩৯ বছরের রাজতন্ত্রের অবসান ঘটেছিল ২০০৭ সালে। তারপর নেপালের রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ফেরাতে নতুন সংবিধান প্রবর্তনের জন্য দু'বার ভোট গ্রহণ হয়। প্রথমবার নির্বাচিত প্রতিনিধিরা সংবিধানের খসড়া তৈরি করেন। দ্বিতীয়বারের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা সংবিধান প্রবর্তন করেন। নেপালের সাংবিধানিক কাঠামোর ভেতরেই এসব পরিবর্তন হয়েছে। যা নিয়ে ভারতের পছন্দ অপছন্দের ব্যাপারটি স্বাধীন নেপালের অভ্যন্তরীণ বিষয়ের প্রতি হস্তক্ষেপের সামিল।
শেষ পর্যন্ত চলতি বছর সেপ্টেম্বর মাসে নেপাল একটি নতুন সংবিধান পায়। এটি নেপালের ষষ্ঠ সংবিধান। কিন্তু এবারের সংবিধানে দক্ষিণের তেরাই প্রদেশের মধেসি, থারু ও জনাজতি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অধিকারকে বঞ্চিত করা হয়েছে, এমন অভিযোগ করেছে ভারত। আর এসব ভারতীয় বংশোদ্ভূত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে আন্দোলনে যেতে সমর্থন যোগাচ্ছে স্বয়ং ভারতের মোদি সরকার।
গত ৪০ দিন ধরে ভারতের বিহার ও উত্তর প্রদেশ সীমান্তবর্তী তেরাই প্রদেশে মধেসি, থারু ও জনাজতি সম্প্রদায়ের সংখ্যালঘুরা সংবিধান বাতিলের জন্য আন্দোলন করছেন। তারা সীমান্ত পথে ভারতের সাথে নেপালের আমদানি বাণিজ্য বন্ধ করে দিয়েছে। যা থেকে গোটা নেপালে চলছে এখন মারাত্মক খাদ্য ও জ্বালানী সংকট।
এর আগে ২০০৭ সালে নেপালে রাজতন্ত্রের অবসানের পর নেপালি কংগ্রেস দলের রামবরণ যাদব প্রথম গণপরিষদ নির্বাচনের পর ২০০৮ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছিলেন। গত ২০ সেপ্টেম্বরে নেপালে নতুন সংবিধান ঘোষণার পর দেশটিতে আবার নতুন করে প্রেসিডেন্ট, ভাইস প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী, পার্লামেন্ট স্পিকার এবং ডেপুটি স্পিকার নির্বাচন করা হয়। যার ধারাবাহিকতায় ২৮ অক্টোবর ২০১৫ সালে নেপালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রতিপক্ষ নেপালি কংগ্রেস দলের কুল বাহাদুর গুরুংকে পরাজিত করে জয়লাভ করেন ক্ষমতাসীন দল সিপিএন-ইউএমএল (কমিউনিস্ট পার্টি অব নেপাল- ইউনাইটেড মার্কসিস্ট লেনিনিস্ট)-এর ভাইস চেয়ারপার্সন বিদ্যা দেবী ভান্ডারি। এর আগে ১১ অক্টোবর নেপালের নতুন প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়েছেন ক্ষমতাসীন সিপিএন-ইউএমএল দলের কে পি শর্মা অলি (খাদগা প্রসাদ শর্মা অলি)। উল্লেখ্য ৬০১ সদস্যের নেপালি কনস্টিটিউট অ্যাসেম্বলি নেপালের নতুন সংবিধান প্রবর্তন করে।
কিন্তু নেপালে নতুন সংবিধান গৃহীত হওয়ার পর নতুন করে যে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকট সৃষ্টি হয়েছে, তার পেছনে রয়েছে ভারতের সুস্পষ্ট ইন্ধন। একটি ফেডারেল সরকার গঠনের লক্ষ্যে সংবিধানে নেপালকে যে ৭টি প্রশাসনিক ইউনিটে বিভক্ত করা হয়েছিল, তার বিরুদ্ধে দেশটির দক্ষিণে সমতলভূমিতে বসবাসকারী মাধেসি, থারু ও জনজাতি জাতিভুক্ত সংখ্যালঘু সম্প্রদায় আন্দোলন করছে। তাদের বক্তব্য হলো, নতুন সংবিধানে এভাবে নেপালকে বিভক্ত করে যে শাসনব্যবস্থা নির্ধারণ করা হয়েছে তাতে তাদের স্বার্থ ক্ষুণ্ণ ও খর্ব হয়েছে। দেশকে প্রশাসনিকভাবে বিভক্ত করার পরিবর্তে তাদের স্বার্থ যাতে সংবিধানে যথাযথভাবে রক্ষিত হয়, তার ব্যবস্থা করতেই তাদের এই আন্দোলন।
সদ্য গৃহীত সংবিধানকে পরিবর্তনের এই দাবিতে তারা টানা ৪০ দিন যেভাবে আন্দোলন করেছেন, তাতে নেপালে এখন এক নতুন রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকট তৈরি হয়েছে। ফলে নেপালের সমগ্রিক অর্থনীতি এবং জনজীবনেও মারাত্মক বিপর্যয় সৃষ্টি হয়েছে।
ভারতের সঙ্গে নেপালের প্রধান বাণিজ্যিক পথ এই দক্ষিণ অঞ্চলের তেরাই প্রদেশ, যেখানে মাধেসি, থারু ও জনজাতি সম্প্রদায়ের বসবাস। তারা এখন এই পথ অবরোধ করে ভারত থেকে জ্বালানিসহ সব ধরনের পণ্য আমদানি বন্ধ করে দিয়েছে। নেপাল সীমান্তের ওপারে হাজার হাজার ট্রাক অচল অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে। ফলে নেপালে তীব্র জ্বালানি সংকটসহ নানা ধরনের নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের তীব্র অভাব সৃষ্টি হয়েছে।
ইতোমধ্যে জ্বালানি সংকট মোকাবেলা করার জন্য নেপাল সরকারের পক্ষ থেকে রাষ্ট্রীয় ‘নেপাল অয়েল কর্পোরেশন’ বিদেশী জ্বালানি সরবরাহকারীদের কাছে অনুরোধ করেছে আকাশপথে বিমানে ব্যবহৃত তেল, বন্দরের জন্য ব্যবহৃত তেল, পেট্রল, ডিজেল ইত্যাদি সরবরাহের জন্য। সরকারি দপ্তর থেকে নেপালবাসীদের জ্বালানী ব্যবহারের প্রতি সচেতন হবার এবং মৃতব্যয়ী হবার আহবান জানানো হয়েছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, নেপালের প্রয়োজনীয় জ্বালানির পুরোটাই বাধ্য হয়েই ভারত থেকে আমদানি করতে হয়। এর আগে নেপাল জ্বালানির বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে চীন থেকে জ্বালানি সংগ্রহ শুরু করলে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা হিসেবে ১৯৮৯ সালে রাজীব গান্ধীর কংগ্রেস সরকার নেপালে জ্বালানি সরবরাহ পুরোপুরি বন্ধ করে দিয়েছিল। হঠাৎ করে ভারত থেকে তখন জ্বালানি সরবরাহ বন্ধ হওয়ায় নেপাল তখনও এক চরম জ্বালানি সংকটের মুখোমুখি হয়েছিল। আংশিকভাবে এ সংকট লাঘব করার উদ্দেশ্যে তখন নেপাল সরকার বাংলাদেশ ও সিঙ্গাপুর থেকে বিমানযোগে কিছু জ্বালানি পাওয়ার ব্যবস্থা করেছিল। কিন্তু সেই সংকট কাটাতে অপ্রতুল সরবরাহ সত্ত্বেও জ্বালানি সমস্যা মোকাবেলার জন্য নেপালে তখন কাঠ ব্যবহার শুরু করেছিল। তখন ব্যাপক আকারে গাছপালা কেটে হিমালয়ের পাদদেশে বনাঞ্চল উজাড় করা হয়েছিল। ব্যাপকহারে এভাবে গাছ কাটার ফলে তখন নেপালের অর্ধেকের বেশি, প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ বনাঞ্চল ধ্বংস হয়ে ব্যাপক পরিবেশ সংকট সৃষ্টি হয়েছিল। যে পরিবেশ সংকট থেকে নেপাল এখন পর্যন্ত পুরোপুরি মুক্ত হতে পারেনি।
ভারত মূলত বাণিজ্যিক ক্ষেত্রে নেপালের স্বাধীন নীতি অনুসরণের বিরোধিতা করেই তখন শাস্তিস্বরূপ নেপালের ওপর তাদের নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখার উদ্দেশ্যে সাম্রাজ্যবাদী আচরণ দেখিয়েছিল। এবার নেপাল নতুন সংবিধান প্রতর্বনের পর যখন আবার রাজনৈতিকভাবে স্থিতিশীলতার দিকে যাত্রা শুরু করেছে, ঠিক তখন ভারতের বিহার ও উত্তর প্রদেশ সীমান্তবর্তী দক্ষিণের তেরাই প্রদেশে মধেসি, থারু ও জনজাতি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়দের সুস্পষ্টভাবে উসকানি দিয়ে ভারত আবারও প্রতিবেশী দেশ নেপালের উপর তাদের সাম্রাজ্যবাদী আচরণের পুনরাবৃত্তি করল।
ভারত শুরু থেকেই নেপালে রাজতন্ত্র উচ্ছেদ থেকে প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা এবং নেপালকে একটি ‘হিন্দু রাষ্ট্রে’র পরিবর্তে একটি ধর্মবিযুক্ত রাষ্ট্র করার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। যা নেপাল সরকারের বিরুদ্ধে, নেপালি কংগ্রেস এবং ইউএমএল কমিউনিস্ট জোট ও নেপালের মাওবাদী পার্টি, তথা নেপালের সকল প্রধান রাজনৈতিক দলের বিরুদ্ধে এবং গোটা নেপালবাসীর বিরুদ্ধেই ভারতের সুস্পষ্ট যুদ্ধ ঘোষণার সামিল। তবে এবার নেপালের বিরুদ্ধে ভারতের প্রধান কৌশল সরাসরি সরকারিভাবে কোনো পদক্ষেপ না নিয়ে, তাদের সাম্রাজ্যবাদী বাণিজ্যিক আগ্রাসনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে মাধেসি, থারু ও জনজাতি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে। যারা আসলে জাতিগতভাবে ভারতীয় বংশোদ্ভূত। ভারতীয় বংশোদ্ভূতদের কাজে লাগিয়ে ভারতের মোদি সরকার দক্ষিণাঞ্চলের নেপালের প্রধান বাণিজ্যপথে গত ৪০ দিন ধরে অবরোধ সৃষ্টি করেছে। ফলে ভারতের সঙ্গে নেপালের পণ্য আমদানি সম্পূর্ণরূপে বন্ধ হয়ে গেছে। যা নেপালে এক মারাত্মক অর্থনৈতিক সংকট সৃষ্টি করেছে।
একদিকে ভারতের মোদি সরকার মুখে প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে, অন্যদিকে সাম্রাজ্যবাদী আচরণ দিয়ে প্রতিবেশি ছোট্ট নেপাল রাষ্ট্রের উপর বাণিজ্যিক অবরোধ সৃষ্টি করেছে। নেপালের নতুন সংবিধানে যদি সত্যিই দক্ষিণের মধেসি, থারু ও জনজাতি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়দের সুবিধা থেকে বঞ্চিত করা হয়, সেজন্য রাজনৈতিক সমাধানই একমাত্র পথ। আর সেজন্য সেই সিদ্ধান্ত নেবে নেপালের জনগণ। ভারত যেভাবে ভারতীয় বংশোদ্ভূত নেপালি মাধেসি, থারু ও জনজাতি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে ব্যবহার করে এখন নেপালে বাণিজ্যিক সংকট সৃষ্টি করেছে, তা মোটেও প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে সুস্পর্ক রাখার প্রতিশ্রুতি তুলে ধরে না। বরং এতে ভারতের সাম্রাজ্যবাদী চরিত্রের নতুন রূপে আবির্ভাবের এক দৃষ্টান্তই কেবল প্রতিষ্ঠিত হয়।
ভারতের অঘোষিত বাণিজ্যিক অবরোধের পাল্টা জবাবে আজ নেপালে ভারতের সকল টেলিভিশন চ্যানেল বন্ধ করে দিয়েছে। রাজনৈতিক ভাষ্যকাররা বলছেন, এর ফলে নতুন করে আবার নেপালের অপর বৃহৎ প্রতিবেশি চিনের প্রতি নির্ভরতা বাড়বে। যা ভারতের জন্য মোটেও স্বস্তির নয়। যে কারণে ভারত চাইছে, অঘোষিত বাণিজ্যিক অবরোধের মাধ্যমে নেপালকে ঘায়েল করতে।
সদ্য প্রতিষ্ঠিত নেপালের নতুন সরকার বর্তমানে সৃষ্ট রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সমস্যা মোকাবেলায় এখন কৌশলের পরিবর্তে যতোটা দূরদৃষ্টি ও প্রজ্ঞার পরিচয় দেবেন, তত দ্রুতই কেবল নেপালের চলমান সংকটের সমাধান হতে পারে। নতুবা নেপালকে নতুন করে এক তীব্র অর্থনৈতিক সংকটের ভেতর দিয়ে সামনের দিনগুলি পাড়ি দিতে হবে।
মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।
আপনার মন্তব্য