প্রধান সম্পাদক : কবির য়াহমদ
সহকারী সম্পাদক : নন্দলাল গোপ
টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
Advertise
অসীম চক্রবর্তী | ১০ ডিসেম্বর, ২০১৫
ঘুম থেকে উঠেই দেখি ফেসবুক জুড়ে দেশের প্রিয় বন্ধুদের আনাগোনা। যেসব বন্ধু প্রযুক্তিতে খানিকটা এগিয়ে তারা নানা ধরনের প্রক্সি সার্ভার ব্যবহার করে টুকটাক ফেসবুক করেছেন। কিন্তু বেশিরভাগ বন্ধুদের কুশল জানিনা গত তিন সপ্তাহ ধরে। লন্ডনের ডিসেম্বর মানেই প্রচণ্ড ঠাণ্ডা। সেই ঠাণ্ডা সকালে ঘুম থেকে উঠে দেশের বন্ধুদের চ্যাট বক্সের বাতি সবুজ দেখে প্রচণ্ড ভালোলাগা বিছানা ছাড়লাম।
প্রাথমিক পর্যায়ে জঘন্য খুনি রাজাকার সালাউদ্দিন কাদের এবং মুজাহিদের ফাঁসি কার্যকরের প্রাক্কালে ফেসবুক, স্কাইপ, ভাইবার, হোয়াটসআপ বন্ধের সিদ্ধান্তকে সাধুবাদ জানিয়েছিলাম। কারণ বিগত দিনে আমরা দেখেছি সোশ্যাল মিডিয়ার অপব্যবহার করে কিভাবে একাত্তরের খুনি রাজাকারের বুনিয়াদরা নানা ধরনের ন্যক্কারজনক ঘটনার ছক কষেছে। বিভিন্ন ধরনের উস্কানিমূলক মিথ্যা বানোয়াট পোস্টের মাধ্যমে তরুণ এবং অপেক্ষাকৃত কম শিক্ষিত ফেসবুক ব্যবহারকারীদের মধ্যে হিংসাত্মক জিঘাংসা ছড়িয়ে দিয়েছে। অনলাইনে ভাইরাল হওয়া সেইসব ভুয়া মিথ্যা পোস্ট না বুঝে শেয়ার করেছেন আমার খুব কাছের অনেক প্রগতিশীল মানুষও।
সোশ্যাল মিডিয়ার উপর খড়গ নেম আসার পরে আমার অনেক সাংবাদিক বন্ধুরা এবং ফেসবুক সেলিব্রেটিরা বিষয়টাকে বাক স্বাধীনতার উপর হস্তক্ষেপ বলে আখ্যায়িত করেছেন। তবে ব্যক্তিগতভাবে সেই সময় আমি সরকারের সিদ্ধান্তকে বুদ্ধিমত্তা সিদ্ধান্ত বলেই ধরে ছিলাম। সপ্তাহ খানেক ফেসবুক বন্ধ থাকলে কোনো মহাভারতই অশুদ্ধ হবার কথা নয়। আমরা ডিজিটাল হচ্ছি, কিন্তু এতই ডিজিটাল এখনো হইনি যে ফেসবুকই আমাদের অন্যতম বাক স্বাধীনতার মাধ্যম?
তবে সপ্তাহ পেরুনোর পরেও যখন আমাদের দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা নানা ধরনের মন্তব্য করে বিষয়টাকে প্রচণ্ড রকমের বিতর্কিত করে তুলেছেন তখন খটকা লাগলো। মানুষের প্রাণ বাঁচানোর জন্য সোশ্যাল মিডিয়া বন্ধের সিদ্ধান্ত ভালো কিন্তু প্রাণ বাঁচানোর অজুহাতে তিন সপ্তাহ সোশ্যাল মিডিয়া করলে সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন আসে আসলে আমরা কার প্রাণ বাঁচানোর চেষ্টা করছি ?
প্রতিপক্ষ নানা ভাবে সমালোচনা ও মিথ্যাশ্রয়ী হয়ে কুৎসা রটনা করবেই। এদের কাছ থেকে রেহাই পাওয়ার যদি কেউ গা ঢাকার চেষ্টা করে তবে সেটা আত্মহত্যার সামিল। এর মধ্যে সবচেয়ে ভয়ংকর বিষয় হচ্ছে নিউজে দেখলাম খোদ সরকারের দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা ফেসবুক ব্যবহার করছেন দেদারছে।
তো যা বলছিলাম, প্রাথমিক পর্যায়ে সোশ্যাল মিডিয়া বন্ধের সিদ্ধান্তকে সাধুবাদ জানালেও প্রথম ধাক্কাটা খাই একটা ঘটনা নিয়ে। বাংলাদেশ থেকে একটা ছাত্র তার সদ্যপিএইচডি করতে বাংলাদেশ থেকে এসেছে আমার ফ্যাকাল্টিতে। ফান্ডিং ও পেয়েছে ইউরোপিয়ান একটি সংস্থা থেকে। কিন্তু বিপত্তি হলো সেই ছাত্রের মাসিক স্কলারশিপের টাকা একাউন্টে আসতে একটু দেরী হচ্ছিলো। হাতের ক্যাশ ও প্রায় শেষের পথে। সঙ্গত কারণে সে ফ্রি ওয়াই ফাই নেট ব্যবহার করে দেশে মা বাবার সাথে যোগাযোগ করত ফেসবুক ,ভাইবার, হোয়াটসআপে। সদ্য দেশ থেকে এসেছে তাই তার জানা নেই কিভাবে কলিং কার্ড দিয়ে বাংলাদেশে ফোন করতে হয়। কলিং কার্ড দিয়ে দেশে ফোন করতে হলেও আছে নানা ধরনের হ্যাপা। এই যেমন ল্যান্ড লাইন ফোনের দরকার অথবা পোস্ট পেইড মোবাইল ফোনের। এই দুটোর কোনটাই এখনো ব্যবস্থা করতে পারেনি সে। এর মধ্যে একদিন সকালে গিয়ে দেখি সে খুবই বিমর্ষ। জিজ্ঞেস করলেই বলে উঠলো মা বাবার জন্য মনটা খারাপ। কথা বলতে ইচ্ছা করছে। কিন্তু অনাকাঙ্ক্ষিত এইসব ঘটনার জন্য পারছেনা যোগাযোগ করতে।
এখন একবার ভাবুন সেই ছেলেটির অবস্থা ? এইটা শুধু মাত্র একটি উদাহরণ। এইভাবে হয়তো আরও হাজারো ঘটনা ঘটেছে বিগত তিন সপ্তাহে।
প্রাণ বাঁচাতে সোশ্যাল মিডিয়া বন্ধ করার মন্তব্যটি ছিলো অনেকটাই অপেশাদার মন্তব্য। সোশ্যাল মিডিয়া বন্ধ করে কি কান্তজির মন্দিরে বোমা বিস্ফোরণ থামানো গেছে? ঢাকনা বিহীন ম্যানহোলে পড়ে মরে যাওয়া শিশুটিকে বাঁচানো গেছে? যায়নি। এবং এই ভাবে প্রাণ বাঁচানো যায়না। তবে কিছুদিনের জন্য হয়তো নিজেদের একটু স্বস্তিতে রাখা যায়।
পৃথিবীর নানা দেশে বিপৎকালীন অবস্থাকে মোকাবিলা করার জন্য নানা সময়ে নানা ধরনের সংবাদ মাধ্যম বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে নানা সময়ে। এদের মধ্যে কিছু সিদ্ধান্ত ছিলো খুবই সময়োপযোগী আবার বেশিরভাগ সিদ্ধান্ত ছিলো অনেকটাই একনায়কতন্ত্রের খড়গ। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি জান্তারা আমাদের প্রায় সব সংবাদ মাধ্যমকে বন্ধ করে দিয়েছিলো। সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান এবং স্বৈরাচারী এরশাদের আমলে আমাদের দেশের প্রতিটা সংবাদ মাধ্যমকে একটি বিশেষে অবজারবেসনের মধ্যদিয়ে প্রকাশ করতে হতো।
বিএনপি আমলে বাংলাদেশেও আমরা দেখেছি কিভাবে একুশে টেলিভিশনকে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিলো। চীনে ফেসবুক বন্ধ প্রায় অনেকদিন ধরে। তবে দেরিতে হলেও বর্তমান সরকার কর্তৃক দৈনিক আমারদেশ পত্রিকা বন্ধ করে ঘৃণা প্রচারক মাহমুদুর রহমানকে গ্রেফতারের ঘটনা ছিলো খুবই ইতিবাচক।
ইন্টারনেট এর প্রসারণ এবং বাংলাদেশের মানুষের কর্ম সংস্থানের জন্য ইন্টারনেট এবং সোশ্যাল মিডিয়ার গুরুত্ব বাড়ছে দিনের পরে দিন, এবং এর জন্য সরকারের আইটি বান্ধব ডিজিটাল বাংলাদেশ নীতি অবশ্যই প্রশংসা যোগ্য । হরতাল হলে বাংলাদেশের বিশাল এক শ্রেণীর মানুষের আয় রোজগারের পথ যেমন বন্ধ হয়ে যায় ঠিক তেমনি ইন্টারনেট এবং সোশ্যাল মিডিয়ার সাথে মানুষের আয় রোজগারের সম্পর্ক বাড়ছে দিনে দিনে।
বাংলাদেশের একটি বিশাল জনগোষ্ঠী মধ্যপ্রাচ্য সহ পশ্চিমা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অবস্থান করছে। সারাদিনেক কর্ম ব্যস্ত দিনের পরে হয়তো প্রিয়জনের পোস্ট করা ছবি ভিডিও অথবা ইনবক্সে পোস্ট করা প্রিয়জনের ক্ষুদে বার্তা মুছে দেয় সকল ক্লান্তি, একাকীত্ব অবসাদ।
একটি সমস্যাকে আরও একটি সমস্যা দিয়ে মোকাবিলা করা বোকামি। সমস্যাকে মোকাবিলা করতে হয় সমাধানের পথ বের করে। চুল কাটলে চুল গজায় কিন্তু নাক কাটলে নাক আর কখনই গজায় না। একটা খালের পানি হয়তো বাঁধ দিয়ে আটকানো সম্ভব কিন্তু উত্তাল পদ্মাকে কখনই বাঁধ দিয়ে রোধ করা সম্ভব হয়। উত্তাল পদ্মাকে বশে আনতে দরকার সুদক্ষ পরিকল্পনা এবং তার বাস্তবায়ন। নানা ক্ষেত্রে সাফল্যে ভরপুর বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকারের উপর অনেক দায়িত্ব সেই দায়িত্ব কর্মের মাধ্যমেই সমাধান করতে হবে। সাধারণ মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার এবং বাক স্বাধীনতার ক্ষেত্রে ও আরও দায়িত্বশীল হবে বলেই বিশ্বাস করি।
মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।
আপনার মন্তব্য