আজ শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪

Advertise

গ্লানি মোচনের সেতু

ইমতিয়াজ মাহমুদ  

পদ্মা সেতু নির্মাণ আমাদের জন্য আসলেই একটা বিরাট বিশাল ব্যাপার। সংখ্যা পরিসংখ্যান এইগুলি আজকের খবরের কাগজে আছে। আমার মেয়েকে দেখলাম সকাল বেলা আগ্রহভরে পড়ছে এই সেতু হলে ভাল কি হবে আর মন্দ কি হবে ইত্যাদি। কোন একটা কাগজে ইলিশ সংক্রান্ত একটা কুফল হতে পারে পদ্মা সেতু নির্মাণের কারণে এরকম একটা কথাও নাকি লিখেছে। সেগুলি তো আছেই। খবরের কাগজ পড়ার মনোযোগ কমে গেছে বলে এইসব বিস্তারিত পড়িনি।

আমি আমাদের উত্থান দেখি, আমাদের বেড়ে ওঠা দেখি।

আমাদের শৈশবে আমরা দেশের অভাব দেখেছি। একটু বয়স হওয়ার পরে যখন ছাত্র রাজনীতি শুরু করেছি তখন খুব মনোযোগ দিয়ে অর্থনৈতিক উপাত্ত পড়তাম। 'সাপ্তাহিক একতা'র বাজেট পর্যালোচনা পড়তাম। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের বক্তব্য খুব মনোযোগ দিয়ে জানতে চাইতাম। গরীব দেশের মানুষ, এই ব্যাপারটা সবসময় মাথায় গেঁথে থাকতো, বাজেটে বরাদ্ধের খাতগুলি নিয়ে ভাবতাম। আমার এখনো মনে আছে আমাদের খাদ্য ঘাটতি থাকতো প্রতিবছরে ১৬ লক্ষ টন থেকে ২০ লক্ষ টন পর্যন্ত।

কিসব গ্লানিকর ছিল সেইসব দিন।

আমাদের দেশের অর্থমন্ত্রী সেজে-গুজে স্যুট-টাই পরে যেতেন প্যারিসে। সেখানে আমাদের দাতাদের কনসোর্টিয়াম মিটিং হতো। বিশ্বব্যাংক আইএমএফ তো ছিলই, সেই সাথে ছিল বিভিন্ন দেশের বা আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থাগুলি। সেইসব সংস্থার চ্যাংড়া অফিসাররা চেয়ার পেতে হাত পা ছড়িয়ে বসতো আর আমাদের অর্থমন্ত্রী ওদের সামনে হিসাবের খাতা তুলে ধরতেন- কোন খাতে কত টাকা দান চাই, কত টাকা ঋণ চাই এইসব। চাইবার আগে বলতে হতো গতবছরের টাকা কতোটুকু খরচ হয়েছে, কিভাবে খরচ হয়েছে ইত্যাদি। তিন চার বছর আগে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেরিয়েছে এমন কোন ছোকরা-অফিসার হয়তো গলা উঁচু করে আমাদের অর্থমন্ত্রীর কাছে কৈফিয়ত চাইতো আর আমাদের অর্থমন্ত্রী স্যুটের ভিতর ঘামতে ঘামতে সেইসব জবাব দেওয়ার চেষ্টা করতেন।


কিন্তু এইরকম কিন্তু হবার কথা ছিল না। আমরা কি ১৯৭১ সনেও আমেরিকা সহ এদেরকে ঠ্যাঙ্গা দেখাইনি। দেখিয়েছিলাম তো। সেবার বাঙ্গালী মেরুদণ্ড সোজা করে কোমর কশে দাঁড়িয়েছিল। পাকিস্তানীদের বন্ধু তখন আমেরিকা চীন এইসব শক্তি। আমাদের নেতাকে ওরা বন্দী করেছে শুরুতেই। কিন্তু আমর আঁকই থিমকে দাঁড়িয়েছিলাম। না। আমরা তো লড়েই গেছি। রামায়ণে রামের জুতা সিংহাসনে রেখে ভরতের দেশ শাসনের গল্প আছে না? অনেকটা সেরকম, আমরা লড়ে গেছি, জীবন দিয়েছি, কিন্তু জিতেছি তো। জিতি নাই? ঐসব সপ্তম নৌবহর না কি সব দেখিয়েছে আমাদেরকে। বাঙ্গালী পাগলা জাতী, এইসবে ভয় পায়? পায় না।

এক পাগল নেতা ছিলেন তখন হাল ধরে। সেই পাগল ভদ্রলোক দেশ স্বাধীনের পর অর্থমন্ত্রী হলেন। বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট না কি যেন ছিলেন তখন ম্যাকনামার নামে এক লোক। সে এসেছে বাংলাদেশে, নতুন দেশ, গরীব দেশ, বিশ্বব্যাংক সাহায্য করবে। আমাদের অর্থমন্ত্রীর অফিসে ফিয়ে সাহেব জিজ্ঞাসা করেন, বল তোমরা কি চাও, কত সাহায্য চাও। সেই পাগল অর্থমন্ত্রী বলে কিনা আমাদের গরু বাধার জন্যে অনেক দড়ি দরকার হবে, পারলে কিছু দড়ি দাও। এর বেশী সাহায্য করার সামর্থ্য তোমাদের নাই।

কিন্তু আই পাগলকেও তো আমরা মেরে ফেলেছি। মেরুদণ্ড-ওয়ালা লোকগুলিকে মেরে আমরা বিশ্বব্যাংকের পায়ে গিয়ে পরেছিলাম।


আমরা বিকাশের অপুজিবাদি ধারার কথা বলতাম। যেসব বুদ্ধিমান বন্ধুরা আমাদের বিপক্ষে ছিলেন ওরা আমাদেরকে বলতেন, 'পুঁজি পাবে কোথায়? বিদেশী সাহায্য, বিদেশী বিনিয়োগ এইসব ছাড়া কিভাবে বিকাশ হবে দেশে?' দেশের অবস্থা এত হতদরিদ্র ছিল যে আমাদের কোন যুক্তিই ওদের কাছে গ্রহণযোগ্য মনে হতো না।

এর মধ্যে দেশে একটা সুশীল সমাজের উদ্ভব শুরু হলো। ওরা সুশাসনের কথা বলা শুরু করলো। সুশাসন মানে কি? সুশাসন মানে রাজনীতি নিরপেক্ষ প্রতিষ্ঠান সমূহ দেশ পরিচালনা করবে। আমরা নাকি অতোটা শিক্ষিত জনগোষ্ঠী নই, সিদ্ধান্ত গ্রহণে আমাদের অংশগ্রহণ দিয়ে নাকি কিসসু হবেনা। ইংরেজি-জানা সায়েবসুবা ধরনের লোকজনকে দেশের বিভিন্ন নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠানের সাথে সংশ্লিষ্ট করতে হবে। সেই সাথে থাকবে এনজিওগুলি। এরা মিলেই নাকি আমাদের ভাগ্য গঠন করে দিবে। একবাক্য বললে রাষ্ট্র ওদের কাছে একটা কর্পোরেশন, যেটার দরকার এফিশিয়েন্ট ম্যানেজমেন্ট।

আমরা অসহায়ের মত ফ্যালফ্যাল করে ওদের কথা শুনতাম। কি বলে এইসব? মিনমিনে কণ্ঠে বলার চেষ্টা করতাম, যে না, রাষ্ট্র তো ভাই কোন কর্পোরেশন না। কর্পোরেশনের হৃদয় থাকেনা, কিন্তু হৃদয় ছাড়া রাষ্ট্র হয়না। রাষ্ট্র একটু রাজনৈতিক সমিতি, দেশের সকল মানুষ এটার সদস্য, সকলেই সমান গুরুত্বপূর্ণ। আর গণতন্ত্র হচ্ছে আপাতত জ্ঞাত সবচেয়ে উত্তম পন্থা। সুশীল সমাজের লোকেরা বলতেন, না, গণতন্ত্র তো ঠিকই আছে, তবে কিনা থার্ড ওয়ার্ল্ড কান্ট্রিগুলিতে ইত্যাদি ইত্যাদি।

থার্ড ওয়ার্ল্ড থার্ড ওয়ার্ল্ড শুনতে ভাল লাগতো না। থার্ড ক্লাস থার্ড ক্লাস মনে হতো। মনটা ছোট হয়ে থাকতো। আমরা গরীব। আমাদের দেশ আমাদের মা, আমদের ভিখিরি মা। ভিখিরি জননী আমাদের দুবেলা খাবারের জোগান দিতে পারেনা। আমাদের আর বক্তব্য কি? আমাদের আবার মতামত কি? সাহেবরা আমাদেরকে টাকা দেয়, আমরা সাহেবদের কথা শুনবো।

আমরা চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলতাম, আইএমএফ ওয়ার্ল্ড ব্যাঙ্ক এদের ফাঁদে পরবেন না। ঐ নাগরিক সমাজ নাকি সুশীল সমাজ, উনারা তো আবার সাহেবদের সাথে গলাগলি, উনারা আমাদেরকে বকা দিতেন। না, দান ছাড়া হবেনা। ঋণ ছাড়া হবেনা। সেইসব দান আর ঋণের টাকার উচ্ছিষ্ট অংশ কিছু নাগরিক সমাজ আর সুশীল সমাজের লোকেরা পেতেন। কনসাল্ট্যান্সি ইত্যাদি নাম দিয়ে। ঐ ছুড়ে ছেয়া খুদ কুড়াতেই দিশী সাহেবরা বিক্রি হয়ে যেত।


কিন্তু আমরা তো দাঁড়িয়ে গেছি। আমাদের মাটিতে আমরা যথেষ্ট ফসল ফলাই- খাদ্য ঘাটতি নাই। ওরা বলেছিল কৃষিতে সাবসিডি দিয়ো না, আমরা ওদের কথা শুনিনাই। ফলাফল তো এখন দেখতেই পাচ্ছেন।

আমাদের কৃষক, আমাদের শ্রমিক ওরা দেশকে দাড় করিয়ে দিয়েছে। আমাদের ছেলেরা আমাদের মেয়েরা হাড়ভাঙ্গা কাজ করে- দেশে করে বিদেশে করে। ওদের ঘামে রক্তে আমাদের জোর হয়। দেশ নিজের পায়ে দাঁড়াচ্ছে। একটা যমুনা সেতু বানাতে গিয়ে আমাদের ধার দেনা দানের টাকা এইসব নেওয়ার পরেও দেশের সব মানুষকে সারচার্জ দিতে হয়েছে দিনের পর দিন। কিন্তু পদ্মা সেতুর টাকা তো মনে হচ্ছে বাংলাদেশ কোনরকম ঝামেলা ছাড়াই নিজের পকেট থেকে বের করে দিয়ে দিচ্ছে।


আমাদের দেশে একজন মানুষ ছিলেন। আকাশ ছুঁই ছুঁই তাঁর উচ্চতা। ঠাটার মত তাঁর কণ্ঠ। সারা দুনিয়ার বড় বড় নেতাদেরকে ওঁর সামনে মনে হতো বামনের মত। তিনি এই দেশের ভুখা-নাঙ্গা মানুষকে একটা জাত্যভিমান উপহার দিয়েছিলেন। ১৯৭২ সনের ১০ই জানুয়ারি লক্ষ লক্ষ লোকের সামনে চোখে জলে ভিজতে ভিজতে ধরা গলায় তিনি বলেছিলেন, বাঙ্গালী মাথা নত করতে জানেনা। সারা দুনিয়ার মানুষকে চ্যালেঞ্জ করে তিনি বলেছিলেন, দেখে যাও, আমার বাঙ্গালী মানুষ হয়েছে।

আমরা তো লোকটাকে মেরে ফেলেছি। কিন্তু লোকটাকে বড় মনে পরে। যখনই বাঙ্গালী বড় কিছু করে, মনে হয় এই লোকটা তো বাঙ্গালীকে দুনিয়ার সামনে উঁচু জায়গায় দেখতে চেয়েছিলেন।

যে লোকগুলি আমাদের শিরদাঁড়াটা দেখিয়ে দিয়েছিলেন ওদের কাছে খুব লজ্জায় থাকতাম। এক পদ্মা সেতুতে সেই লজ্জার খানিকটাও কি কাটবে না?

ইমতিয়াজ মাহমুদ, অ্যাডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট। ইমেইল: [email protected]

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪১ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬৩ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩১ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯০ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৬ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ