আজ শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

Advertise

সিলেটে বুদ্ধিজীবী হত্যা: মাটিতে লেগে আছে রক্তের দাগ

পাপলু বাঙ্গালী  

আমার পাড়ার রাস্তায় রক্তের দাগ। বাড়িতে বাড়িতে আর্ত চিৎকার। শহরের রাজপথে অসংখ্য মানুষের দেহ। স্কুলে-কলেজে-বিশ্ববিদ্যালয়ে-হাসপাতালে, ঘরবাড়িতে মানুষের রক্ত। আগুন জ্বলছে চৌহাট্টায়, বোমা পড়ছে টিলাগড়ে, গুলি হচ্ছে সদর হাসপাতালে। শিশুর কান্না আমি শুনতে পাই। নির্যাতিত নারীর চিৎকার আমার কানে এখনো লাগে। অসহায় বাবার চোখের জল গড়িয়ে পড়ে আলোহীন টেবিলে। বাঙলার শ্রেষ্ঠ মানুষের কন্ঠরোধ  করা বুটের আওয়াজ আমি শুনতে পাই। মাটিতে পড়ে আছে লাশ, আকাশে ফেনা তুলছে ধোঁয়া। সুরমায় ভেসে যায় অসংখ্য সুন্দর মুখ। দেয়ালে দেয়ালে আমাদের মুক্তির বার্তা। এখনো শুনতে পাই। এখনো জেগে আছে আমার শহর। আমাদের পাড়া, বাপ-দাদার স্মৃতিজড়িত গ্রাম, স্কুল পালানো গলিপথ, খেলার মাঠ, যৌবনা সুরমা নদী। ভুলে যেতে চাই না। ভুলে যেতে চাই না শহরের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের। যাদের আত্মত্যাগে মাটি, গাছ, নদী, মানুষ; সর্বোপরি আমি।   

মুক্তি অথবা মৃত্যু। লাতিন আমেরিকার মহান কমিউনিস্ট বিপ্লবী চে গেভারারার সংকল্প। পরবর্তীতে সারা বিশ্বের অসংখ্য মুক্তিকামী মানুষের সংকল্প হয়ে দাঁড়িয়েছে চে'র এই বজ্রকঠিন সংকল্প। কখনো অসংখ্য মানুষের মৃত্যু মুক্তি নিয়ে আসে। মুক্তির তৃষ্ণা ধর্ম-বর্ণ, লিঙ্গ বৈষম্যকে ঊর্ধ্বে তুলে মানুষের রক্তে মহাকাব্য লিখে রাখে। আমরা মুক্ত হতে চেয়েছিলাম, আমরা একটা নির্ভেজাল আকাশ চেয়েছিলাম, আমরা আমাদের মাটি, মানুষ, সংস্কৃতিকে রক্ষা করতে জীবন দিয়েছিলাম। সেখানে কোন কার্পণ্য ছিলো। আমেরিকার স্কলারশিপ, ইংল্যান্ডের চমকানো রাত আমাদের কিচ্ছু ভালো লাগে নি। আমাদের ভালো লেগেছিল সুরমা-যমুনার পার, আমাদের ভালো ধুলোমাখা গ্রামের মেঠোপথ, আমাদের ভালো লেগেছিল বাউলের কণ্ঠ, আমাদের ভালো লেগেছিল মাছ-ভাত। আমাদের কাছে মহান ছিল আমাদের মা-মাটি। আমাদের বিরাট কাজ ছিল মাটি-মানুষ-সংস্কৃতি রক্ষার দায়িত্ব।  

এটা অবধারিত সত্য, বুদ্ধিজীবীরাই জাগিয়ে রাখেন জাতির বিবেক, জাগিয়ে রাখেন তাদের "রচনাবলীর মাধ্যমে, সাংবাদিকদের কলমের মাধ্যমে, গানের সুরে, বিদ্যালয়ে পাঠদানে, চিকিৎসা সেবায়, প্রকৌশলে, রাজনীতি ইত্যাদির মাধ্যমে জনগণের সান্নিধ্যে এসে। একটি জাতিকে নির্বীষ করে দেবার প্রথম উপায় বুদ্ধিজীবী শূন্য করে দেয়া। বুদ্ধিভিত্তিক চর্চার এবং মুক্তচিন্তার ফেরিওয়ালাদের হত্যা করা। ২৫ মার্চ রাতে এই প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল অতর্কিতে, তারপর ধীরে ধীরে, শেষে পরাজয় অনিবার্য জেনে ডিসেম্বর ১০ তারিখ হতে ১৫ ডিসেম্বরের মধ্যে দ্রুতগতিতে।

১৯৭১ সাল সিলেট শহর। হানাদার বাহিনীর বর্বর ধ্বংসলীলায় যখন মানুষ দিশেহারা পলাতক, এমন ভয়ঙ্কর অনিশ্চিত সময়ে প্রিয় মাতৃভূমির মানুষের সেবায় সংকল্পে স্থির ও নির্ভীক ছিলেন সিলেট মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সার্জারি বিভাগের প্রধান ডা. শামসুদ্দিন আহমদ। প্রায় জনশূন্য সিলেট শহরে থেকে মুমূর্ষু যুদ্ধাহত বীরদের তিনিই ছিলেন একমাত্র ভরসা। ক্ষুদ্র কিন্তু মানসিকভাবে বিরাট মেডিকেল টিমের অগ্রসৈনিক ছিলেন তিনি। তাঁর মেডিকেল টিমে ছিলেন তরুণ তুর্কি ইন্টার্ন ডাক্তার শ্যামল কান্তি লালা। যার সবুজ হৃদয়ে ছিল দেশের মানুষের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা। ভয়ঙ্কর নিরাপত্তাহীন সময়েও তিনি জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের সেবা করে গেছেন। চারিদিকে বারুদের গন্ধ,শহর পুড়ছে, মানুষ মরছে দেদারসে কিন্তু তিনি ছিলেন অবিচল। পড়ে থাকা মা-বোনের লাশের উপর দিয়ে হাঁটা আর বর্বর রাজাকার-হানাদারদের বিষাক্ত জিহ্বার মধ্যে তিনি ছিলেন বাংলাদেশের সাহস। যার সেবার বদৌলতে রণাঙ্গনে অসংখ্য অগ্নিশিখা মজুদ হয়েছে। যারা সুস্থ হয়ে লড়াই করেছে, মা-মাটির জন্য। সেই মেডিকেল টিমে আরেকজন ছিলেন। তিনি সদাহাস্যজ্জ্বল, দৃঢ় মনোবলের মানুষ এম্বুলেন্সচালক কোরবান আলী। যার কাজ ছিলো যখনই গুলির শব্দ কানে আসতো তখনই রাজপথে ছুটে গিয়ে আহত মা-বোন-ভাইকে গভীর মমতায় কোলে করে নিয়ে আসা। তাঁর সাহস অসংখ্য মানুষ বাঁচিয়েছে।

যেখানে পাকিস্তান সাপ-বিচ্ছুদের ভয় ছিল, ভয় ছিল তারই মায়ের কোল থেকে জন্ম নেওয়া হিংস্র রাজাকারদের। সেখানে নিজের জীবন কোরবান করার নেশায় ছুটে গেছেন আহতদের পাশে। তাদের সুস্থ করতে তুলে দিয়েছেন মেডিকেল টিমের হাতে। দিবারাত্রি আহতদের সেবা করেছেন। বাংলার মাটির মতো আগলে রেখেছেন বুকে। ব্যথা হলে বলেছেন, ওগুলো সেরে যাবে তেমন কিছু না। আহার-নিদ্রা ভুলে সেই মেডিকেল টিমের আরেকজন মানুষ অপারেশন থিয়েটারের সেবক মাহমুদুর রহমান। বর্বর হানাদার আর দোসর দালালরা এই দামাল ছেলেদের ঠেকাতে না পেরে, নির্মমভাবে হাসপাতালের ভেতর হত্যা করেছিল। বর্বরতা মাপা যায় না। গেলে জানা যেতো যারা চিকিৎসারত অবস্থায় ডাক্তার এবং রোগি হত্যা করে। তারা কত নিকৃষ্টতম বর্বর। তবে আমরা বুঝতে পারি, অনুভব করতে পারি, চোখ দিয়ে দেখতে পারি হিংস্র বর্বরতা।

এখানেই শেষ নয়। এই হত্যার প্রতিবাদ এবং মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করায় হত্যা করায় সিলেট মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ ও সুপারেন-টেনডেণ্ট লে. কর্নেল ডা. জিয়াউর রহমান'কে। এভাবেই সারা বাংলাদেশ তথা সিলেটে অনেক মহান সন্তানকে হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসর রাজাকার-আলবদর-আলশামস হত্যা করেছে। জাতিকে মেধাশূন্য করে দিতে চেয়েছিল পাকিস্তানি এবং তাদের দোসর রাজাকাররা।

৪৪ বছর চলছে। মুক্তবুদ্ধি চর্চা তীব্রশিখায় বাঙলার মুক্তি আন্দোলন যে সর্বগ্রাসী রূপ পরিগ্রহ করেছিল, তাকে দাবাতেই বুদ্ধিজীবী হত্যা করা হয়েছিল। সর্বব্যাপি বাংলাদেশের আগামীর চিন্তক এবং চিন্তাকে ঠেকিয়ে দিতে-এই বর্বরতা চালানো হয়েছিল। আজও আমরা সে একই হিংস্র হায়েনাদের রাষ্ট্রীয় মদদে উত্থান পরিলক্ষিত করছি। একদিকে উগ্র ধর্মান্ধরা চাপাতি দিয়ে মুক্তবুদ্ধির মানুষকে হত্যা করছে। অন্যদিকে রাষ্ট্র খুন হওয়া মানুষদের বিচার না করে ৫৭-ধারার মতো মধ্যযুগীয় আইন দিয়ে তথাকথিত ধর্মানুভূতিকে এবং রাষ্ট্রীয়তন্ত্রকে সুরক্ষা দিতে চাচ্ছে। যা মুক্তিযুদ্ধের কাঙ্ক্ষিত স্বদেশ বিনির্মাণের বড় বাঁধা এবং একাত্তরের শহীদদের সঙ্গে প্রতারণা।

মুক্তচিন্তক রাজীব হায়দার, অভিজিৎ রায়, ওয়াশিকুর বাবু, অনন্ত বিজয় দাস, নীলয় নীল এবং আরেফিন ফয়সাল দিপন হত্যাকারীদের বিচার করতে হবে। ধর্মভিত্তিক রাজনীতি মুক্তিযুদ্ধের কাঙ্ক্ষিত স্বদেশের মধ্যে কোন রূপেই ছিল না। সেই রাজনীতি নিষিদ্ধ করতে হবে।

মানুষেই ইতিহাসের উপাদান। মানুষই মুক্তির মহাকাব্যের স্রষ্টা। মুক্তিযোদ্ধা এবং মহান বুদ্ধিজীবীদের অসমাপ্ত কাজই আমাদের কাজ। আমরা ভুলে যেতে চাই না একাত্তর-এবং একাত্তরের শহীদদের স্বপ্ন।

পাপলু বাঙ্গালী, প্রগতিশীল ছাত্র আন্দোলনের সাবেক কর্মী। ইমেইল: [email protected]

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪১ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬২ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩০ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯০ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৫ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ