একদম ভাবিনি, উনি এত শিগগির এবং এত সহজে চলে যাবেন। এখনো মনে হচ্ছে, তিনি অটোয়ায় আছেন অথবা দূরে কোথাও, আবার তার সাথে দেখা হবে। যখন শুনলাম তিনি নেই, ভাবলাম এ এমন কী, উনি ফিরবেনই আবার। এতই সাদামাটা ছিল তার জীবন-যাপন, তাতে এমন মনে হওয়াটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। এমনই হয়, কখনো কারো কারো সান্নিধ্য এমন করেই সব কিছু মনে করিয়ে দেয়। ওনার সাথে আমার পরিচয় খুব অল্প সময়ের। প্রথম দেখি ওনাকে ওনার ইংরেজি গল্প-গ্রন্থ, The Little Garden in the Corner-এর প্রকাশনা উৎসবে, কাব্য সাধক ফেরদৌস নাহারের পশ্চিমে হেলান দেয়া গদ্য গ্রন্থের সাথে যৌথভাবে। তখন তার বইটায় অটোগ্রাফ নেয়া ছাড়া, আর কোন রকম আলাপচারিতায় যুক্ত হই নি।
তার "শূন্য" বইটা পড়ার মাধ্যমে শুরু হলো তাকে জানা। কোন এক বই-কফির আড্ডায় মনিরুল ইসলাম সাহেব অতি সংক্ষেপে "শূন্য" সম্পর্কে বললেন। আমি সাথে সাথেই মনি সাহেবের কাছ থেকে বইটা নিয়ে নিলাম। এবং অনেক পরে বইটা পড়ে শেষ করলাম। বইটা পড়ে বুঝলাম, এসএসসি পাশ সকল বাংলাদেশি ছাত্র-ছাত্রীদের এই বইটি পড়া উচিৎ। জেনে-শুনে সচেতনভাবে না পড়লে বিজ্ঞান সম্পর্কে সম্যক ধারণা বা আকর্ষণ যে তৈরি হয় না, এই বইটি পড়ে সে উপলব্ধিটা হলো। সে সাথে বুঝলাম আমাদের নিজেদের অগ্রগতির স্বার্থেই বিজ্ঞানের বিকাশ বা বিবর্তনের ইতিহাস জানা উচিৎ। শূন্যের আবিষ্কার বা উদ্ভব সভ্য পৃথিবীর লুকিয়ে থাকা ধর্মের অন্ধকারকে বেশি করে আঙ্গুল উঁচিয়ে দেখিয়ে গেল।
তারপর একদিন ওনার সাথে কথা হলো বিশেষতঃ ধর্মের অপ-প্রভাব নিয়ে। তার "শূন্য" বইটা সম্পর্কে মতামত জানালাম। বললাম, বাংলা ভাষার ব্যবহারে তিনি খুবই সচেতন। এও জানালেন, পরবর্তী সংস্করণে কিছুটা সংশোধন করা হবে। অভিজিৎ রায়ের সাথে "শূন্য থেকে মহাবিশ্ব" নামে বইটি প্রকাশিত হবে। ওটা সংগ্রহের অপেক্ষায় রইলাম।
২০১৪ সালে বই-কফির আড্ডার সর্বশেষ বৈঠকে মীজান রহমানগণিতজ্ঞ মীজান রহমানকে আমার জানা হয় নি, যেহেতু গণিত সম্পর্কে আমি তত জ্ঞান রাখি না। কিন্তু "শূন্য" বই পড়ে বুঝলাম, উনি সহজে অনেক কিছু বুঝিয়ে বলতে পারেন, যা তার পান্ডিত্যকে প্রমাণ করে। অথচ সাদাসিধে একজন মানুষ সাহিত্য, ধর্ম, রাজনীতি, বিজ্ঞান প্রভৃতি বিবিধ বিষয় নিয়ে অবলীলায় গভীর আলোচনা করে যান। এমনই ছিল তার জ্ঞানের বহর।
উনি আমাদের কাছে গণিতজ্ঞের চাইতেও ছিলেন বড় অভিভাবক। বলতেন, ক্যানাডায় যখন আছি তখন ইংরেজিতেই কাব্য এবং গদ্যচর্চা করা উচিৎ। তার জানার হাত ধরেই আমরা প্রথম জানলাম বাঙালি ক্যানেইডিয়ান লেখক গালিব ইসলাম এবং তার উপন্যাস Fire in the Unnameable Country-র কথা। জানলাম, জিয়া রহমান হায়দার এবং তার উপন্যাস, In the Light of What We Know-এর কথা। তিনি আমাদের গত বছরের সর্বশেষ বই-কফির আড্ডায় জিয়া হায়দার রহমানের এই বইটি সম্পর্কে অল্প কথায় দারুণ বললেন। তাতেই বইটি পড়ার আগ্রহ তৈরি হয়ে গেছে। আমাদের তিনি বলতেন, শুধু বাংলাদেশ নয়, ক্যানাডা তথা পৃথিবীর সর্বশেষ ঘটনাবলী সম্পর্কে প্রয়োজনীয় খোঁজ-খবর রাখতে।
তার সাথে আমার প্রথম এবং সর্বশেষ ই-মেইল যোগাযোগ ছিল, আমার একটা চলচ্চিত্রের স্ক্রিপ্ট সম্পর্কে তার নিজস্ব মতামত। তার অবস্থান থেকে চমৎকারভাবেই তিনি তার মত প্রকাশ করলেন। কিন্তু এত দ্রুত তিনি তার মতামত জানালেন যে, মনে হয় নি, উনি দূরের কেউ। আপনজনদের কাছেও বোধ হয়, এইসব ব্যাপারে এত দ্রুত উত্তর আশা করা যায় না। মতামত প্রদানে তার ঋজু মনোভাবটা পরিষ্কার বোঝা গেল। আমিও আশা করেছিলাম, পরবর্তীতে এসব নিয়ে তার সাথে আলাপ হবে। আরো পরিচিতি এবং ঘনিষ্ঠতা বাড়বে।
বড় অসময়ে তিনি চলে গেলেন। কাউকে টের পেতে দিলেন না। তার বয়স ৮২, এটাও কখনো বুঝে উঠিনি, মনে হয় নি। মনে হতো, তিনি আরো পাঁচ বছর অনায়াসে কাজ চালিয়ে যাবেন, আমাদের অভিভাবক হয়ে থেকে রীতিমত প্রেরণা যুগিয়ে যাবেন। একবারও তার হঠাৎ করে মরে বসার আলামত টের পাইনি। এইজন্যই বলছি, তিনি রীতিমত গাড়ি চালিয়ে অটোয়া থেকে টোরন্টো এসেছেন, গিয়েছেন, কখনো কখনো কাউকে তার গাড়িতে চড়িয়ে অটোয়া ঘুরে দেখিয়েছেন। নিজে নিজেই রাঁধতেন-বাঁধতেন অতিথি আপ্যায়ন করতেন। এসবই কিন্তু বেশি দিন আগের ঘটনা নয়। একজন বয়স্ক লোকের বার্ধক্যজনিত ক্লান্তি তাকে কখনো সেভাবে স্পর্শ করেছে বলে মনে হয় নি।
২০১৪ সালে বই-কফির আড্ডার সর্বশেষ বৈঠকে মীজান রহমান হালকা-পাতলা ছিপছিপে অমায়িক জ্ঞানী এই লোক এত সাদামাটা ছিলেন যে, তার মুখের মিষ্টি শিশুসুলভ হাসিটিই বেশি চোখে পড়ে। এত বয়সে এত পরিষ্কার, উজ্জ্বল কারো মাথা থাকে, ভাবতে পারি নি। একজন পরিপাটি বয়স্ক ভদ্রলোক। কখনো দেখিনি তার চিন্তা বা স্মরণ-শক্তিতে গোলমাল পেকে গেছে।
এতটুকু জেনেছিলাম, তিনি সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে নাশতা সেরেই এই অবসর জীবনে লেখাপড়ার কাজে লেগে যেতেন। মনে হতো, তিনি তার প্রতিটা সময়কে কাজে লাগাচ্ছেন। শুনেছি, দুপুরে শুধু উনি ফল খেতেন। স্বাস্থ্য সম্পর্কে এত সচেতন লোক যে ভেতর ভেতর মৃত্যু চিন্তাও করতেন সেটা টের পেলাম, যখন তাকে বলেছিলাম, সম্ভবতঃ গত অক্টোবরে (২০১৪), এই ফ্রেব্রুয়ারীতে (২০১৫) আমাদের বই-কফির আড্ডায় গালিব ইসলামকে আমন্ত্রণ জানিয়ে তার বইটা সম্পর্কে আলোচনা বা প্রশ্নোত্তর পর্বের আয়োজন করার। তিনি নিজেদের মধ্যে বইটির আলোচনাকে প্রথমতঃ গুরুত্ব দিয়েছিলেন। আর বলেছিলেন, ফেব্রুয়ারী তো অনেক দেরী, ততদিন যদি বাঁচি! জ্বী স্যার, সেটা আপনিই শুধু জানতেন, আমাদের কাছে পুরোটাই ছিল অজ্ঞাত। আপনার হাসি-খুশি ঋজু সাদামাটা ভাবটাই আমরা দেখে যেতে পেরেছি। এতটুকুই এখন বড্ড সৌভাগ্য মনে হচ্ছে!
আপনার আলোকিত পথ আমাদেরও আলোকিত করুক, আলোর পথে ধাবিত করুক।
আপনার মন্তব্য