আজ শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

Advertise

বিস্মৃতির বিরুদ্ধে স্মৃতির মহাকাব্য ‘১৯৭১’

ড. কাবেরী গায়েন  

‘Identities are the names we give to the different ways we are positioned by, and position ourselves within, the narratives of the past’ (Stuart Hall, 1990:225)

আত্ম-পরিচয় গঠনের অনিবার্য উপাদান হলো স্মৃতি। আত্মপরিচয় বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে যে অংশে স্মৃতি বিশেষভাবে উপযোগী সেটি কেবল ‘সত্য’ দাবিত্বের জন্য নয় বরং কোন ঘটনার ধারাবাহিক অস্বীকৃতি, মুছে ফেলার প্রয়াস বা বিকৃতির বিরুদ্ধে মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত উন্মোচন গোটা প্রক্রিয়াকে মামুলি ঐতিহাসিক বিশ্লেষণ ছাড়িয়ে সংস্কৃতির অংশ করে তোলে। স্মৃতির সামাজিক ও সাংস্কৃতিক চরিত্র তাই কোন জাতির আত্মপরিচয়ের সংকটকালীন মূহুর্তে বিস্মৃতি ও বিচ্যুতির র বিরুদ্ধে সামষ্টিক যুদ্ধকে জারি রাখে, যাকে বলেছেন মিলান কুন্ডেরা, ক্ষমতার বিরুদ্ধে মানুষের প্রতিরোধ হলো বিস্মৃতির বিরুদ্ধে স্মৃতির যুদ্ধ। সাংস্কৃতিক পাঠের অন্যতম অনুসিদ্ধান্ত হলো, পরিচয়ের নির্মাণ একটি প্রক্রিয়া যা কোন অনিবার্য অতীত সম্পর্কে বাইরে থেকে চাপিয়ে দেয়া সিদ্ধান্তের ফলাফল নয় বরং ইতিহাস, সংস্কৃতি এবং ক্ষমতার অবিরাম জটিল এক প্রবাহের ফলাফল।

ক্ষমতা যখন কোন জনগোষ্ঠীর ইতিহাসকে পাল্টে দিয়ে নতুন ইতিহাস নির্মাণ করতে চায়, তখন মূল ইতিহাসের পক্ষে সংস্কৃতি এবং সাংস্কৃতিক চিহ্নগুলো সাক্ষ্য দেয়, সাক্ষ্য দেয় সামাজিক-সাংস্কৃতিক স্মৃতি। বিরুদ্ধ প্রবল শক্তি তাই এই সাক্ষ্যগুলো মুছে ফেলতে চায়। রেসকোর্সের ময়দানকে বানিয়ে ফেলে শিশুপার্ক, ৭ মার্চের স্মৃতিকে মুছে ফেলার জন্য। কিন্তু ক্ষমতা পরাস্ত হয়েছে ৭১-এর ৭মার্চে রেসকোর্সের ময়দানে উপস্থিত থাকা জাতির স্মৃতির কাছে। সেই প্রজন্মের কাছে তাই শিশুপার্ক রেসকোর্সের ময়দান হয়ে তবু থেকে যায়। কিন্তু সেদিন যারা রেসকোর্সে উপস্থিত থাকার জন্য জন্ম নেয়নি, তাদের কী উপায়? এখানেই সংস্কৃতির প্রামাণ্য দলিলের দায়বদ্ধতা। শিল্পের অন্যান্য মাধ্যমের মত কিংবা প্রবলতরভাবে যুদ্ধ প্রামাণ্যচিত্র বা ওয়ার ডকুমেন্টারি একটি শক্তিশালী জরা তৈরি করেছে, বিশেষ করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় থেকে। যুদ্ধ প্রামাণ্যচিত্রেরও নানা ধারা তৈরি হয়েছে উদ্দেশ্য ও উপায়ভেদে।

মোটা দাগে যুদ্ধ-প্রামাণ্যচিত্রের দু'টি ব্যবহার খুব তাৎপর্যপূর্ণ, দুই ভিন্ন প্রেক্ষাপটে। যুদ্ধকালীন নির্মিত প্রামাণ্যচিত্রে কোনো রাষ্ট্র কেন যুদ্ধে অংশগ্রহণ করবে, সেই নৈতিক অবস্থানটি তৈরি করতে প্রয়াস দেখা যায়, এগুলো প্রায়শই থাকে প্রোপাগান্ডা-মূলক। ফ্রাঙ্ক কাপরা ও তার সহযোগীদের নির্মিত ৭টি প্রামাণ্যচিত্র এ’বিষয়ের শ্রেষ্ঠ উদাহরণ। কেনো আমেরিকার সৈন্যরা যুদ্ধে যাবে এই প্রশ্নের উত্তর দেবার জন্যই নির্মিত তাঁর Prelude to War (1942), The Nazis Strike (1943), Divide and Conquer (1943), The Battle of Britain (1943), The Battle of Russia (1943), The Battle of China (1944), and War Comes to America (1945)| যুদ্ধে যাওয়ার জন্য ব্রিটিশ Royal Air Force (RAF) কে উদ্বুদ্ধ করার উদ্দেশ্যে নির্মিত প্রথম ব্রিটিশ প্রোপাগান্ডা চলচ্চিত্র )-কে উদ্বুদ্ধ করার উদ্দেশ্যে নির্মিত প্রথম ব্রিটিশ প্রোপাগান্ডা চলচ্চিত্র The Lion Has Wings (Michael Powel, Adrian Brunel, Brian Desmond Hurst, Alexander Korda, 1939) এমনই এক প্রামাণ্যচিত্র।

আর যুদ্ধোত্তরকালে বিজয়ী রাষ্ট্র উপস্থাপন করে তার জনগণের আত্মত্যাগ ও বীরত্বের কাহিনী। বিজিত রাষ্ট্রের প্রামাণ্যচিত্র মূলত ব্যাপৃত থাকে তার বিজয়ী না হওয়ার পেছনের কারণগুলোর ব্যাখ্যায়। সেসব কারণের মধ্যে নিজস্ব জনগণের বীরত্ব সত্ত্বেও কীভাবে কোন ভুলের কারণে কিংবা সহযোগী কোনো রাষ্ট্রের ভুল সিদ্ধান্ত বা কোনো খণ্ডযুদ্ধে যদি তাদের বিজয় হয়ে থাকে, সেসবের উপস্থাপনে। অপর কোনো রাষ্ট্রকে অধিগ্রহণের কারণে যদি অনেক বেশি নিন্দিত হতে হয়, তবে তার যৌক্তিকতা হাজিরেও সচেষ্ট দেখা যায় বিজিত দেশের যুদ্ধ-চলচ্চিত্রকে। তবে যুদ্ধ প্রামাণ্যচিত্রের আরেক ধারা এসব প্রোপাগান্ডা চরিত্র ছাড়িয়ে মানবিক অভিজ্ঞতা এবং অনুভূতিকে তীব্র করে তোলে, অথবা অতীত অবশেষ থেকে ইতিহাসকে ফিরিয়ে আনতে সচেষ্ট হয়, এবং এসব প্রামাণ্যচিত্র যুদ্ধ অভিজ্ঞতা থেকে আসা ব্যক্তিগত স্মৃতিকে এমনভাবে তুলে ধরে যা দর্শককে জীবনের চেয়ে বিশাল ((larger-than-life)) কোন অভিজ্ঞার মুখোমুখি হবার অনুভূতি দেয়। এ’জাতীয় প্রামাণ্যচিত্রগুলো দেখা যায় সাধারণত কোন যুদ্ধ সংঘটিত হবার অনেক পরে, ইতিহাসের বিস্মৃতির বিরুদ্ধে যে যুদ্ধ সেই যুদ্ধে অংশ নেবার জন্য।

যুদ্ধকালীন পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতোই বাংলাদেশের ওপর চাপিয়ে দেয়া পশ্চিম পাকিস্তানের যুদ্ধকে মোকাবিলা করার প্রয়োজনীয়তা বাইরের পৃথিবীকে জানানো অনিবার্য হয়ে উঠেছিলো ১৯৭১ সালে। সেই অনিবার্যতা থেকে জহির রায়হানকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছিলো কিছু প্রামাণ্যচিত্র তৈরির। প্রথমেই তিনি নির্মাণ করেন Stop Genocide। এ প্রামাণ্যচিত্রটি এ দেশের ওপর চাপিয়ে দেয়া পাকিস্তানের গণহত্যার অপরাধ এবং বাংলাদেশের যুদ্ধ ঘোষণার যৌক্তিকতাকে এত সফলভাবে প্রমাণ করতে সক্ষম হয় যে তারই ধারাবাহিকতায় একের পর এক নির্মিত হয় আলমগীর কবিরের চিত্রনাট্য ও Liberation Fighters,, জহির রায়হানের চিত্রনাট্য ও পরিচালনায় A State is Born Ges Innocent Millions ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পরে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের উপর যে কালো পর্দা নেমে আসে রাজনীতিতে, তার প্রভাব আমরা দেখি চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রিতেও। প্রামাণ্যচিত্রের কথা বলতে গেলে, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক বিস্মৃতিকে ফের স্মৃতিতে প্রবলভাবে ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে তারেক মাসুদের মুক্তির গান (১৯৯৫) আর মুক্তির কথা (১৯৯৯) ব্যাপক ভূমিকা রাখে। তানভীর মোকাম্মেলের যাত্রা যদিও স্বল্পদৈর্ঘ্য কাহিনীচিত্র হুলিয়া (১৯৮৫) থেকে এবং প্রধানত মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক কাহিনীচিত্রে কিন্তু তাজউদ্দীন আহমেদ: নিঃসঙ্গ সারথি (২০০৬) থেকে যুদ্ধ-ইতিহাসের পথে তার প্রামাণ্যচিত্র নিয়ে যে অভিযাত্রা, তারই ধারাবাহিকতার সাম্প্রতিকতম এবং বিশদতম সংযোজন ১৯৭১।

ছবি পরিচিতি: ‘সবচেয়ে সেরা সময়, সবচেয়ে বেদনার সময়’!

চার্লস ডিকেন্সকে স্মরণ করে এই প্রামাণ্যচিত্রের পরিচিতিতে বলা হয়েছে, “১৯৭১ সাল স্বাধীনতা অর্জনের কারণে বাংলাদেশের মানুষের কাছে গৌরবের এক বছর হলেও ১৯৭১ সালে এদেশের মাটিতে ঘটেছিলো ভয়াবহ সব হত্যাকাণ্ড, ধ্বংস ও নিপীড়নের অসংখ্য করুণ সব ঘটনা। ১৯৭১ সাল বাংলাদেশের মানুষের জীবনে, যথার্থই ছিলো চার্লস ডিকেন্সের ভাষায় - ‘সবচে সেরা সময়, সবচে বেদনার সময়’! সেই অবিস্মরণীয় ১৯৭১ সালের মূল ঘটনাবলী নিয়ে নির্মিত হয়েছে তানভীর মোকাম্মেলের তিন ঘণ্টা পঁয়ত্রিশ মিনিট দৈর্ঘ্যের গবেষণানির্ভর মেগা-ডকুমেন্টারি “১৯৭১”।

প্রামাণ্য-চিত্রটির গবেষণা, চিত্রনাট্য ও পরিচালনা: তানভীর মোকাম্মেল/চিত্রগ্রহণ: আনোয়ার হোসেন /সম্পাদনা: মহাদেব শী/আবহসঙ্গীত: সৈয়দ সাবাব আলী আরজু/ সহকারী পরিচালক: উত্তম গুহ ও সৈয়দ সাবাব আলী আরজু/ ভাষ্যপাঠ: চিত্রলেখা গুহ/ দৈর্ঘ্য: ৩ঘন্টা ৩৫ মিনিট/ নিবেদক: সিমিন হোসেন রিমি ও সাইফুর রহমান/প্রযোজনা: কিনো-আই ফিল্মস/ নির্মাণকাল: ডিসেম্বর, ২০১১

প্রায় সাত বছর ধরে গবেষণা ও শুটিং করে এই প্রামাণ্যচিত্রটি নির্মাণ করা হয়েছে। মোট আড়াইশ’ ঘণ্টা ফুটেজ শুট করা হয়। বাংলাদেশের ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, দিনাজপুর, রংপুর, বগুড়া, জয়পুরহাট, সিরাজগঞ্জ, ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ, খুলনা, যশোর, বরিশাল ও কুষ্টিয়াসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চল এবং ভারতের কলকাতা, দিল্লী এবং যেসব জায়গায় শরণার্থী শিবির গড়ে উঠেছিলো এমন কিছু জায়গাতেও প্রামাণ্যচিত্রটির শুটিং করা হয়। এছাড়া ইউরোপ-আমেরিকার বিভিন্ন ফিল্ম আর্কাইভ ও অন্যান্য উৎস থেকে প্রামাণ্যচিত্রটির জন্য বেশ কিছু দুষ্প্রাপ্য ফুটেজ সংগ্রহ করা হয়েছে। প্রামাণ্যচিত্রটির জন্য সর্বমোট ১৭৬ জনের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করা হয়েছে, যাঁদের মধ্যে রয়েছেন মুক্তিযোদ্ধা, রাজনীতিবিদ ও ছাত্রনেতা, সেক্টর কমান্ডার, গণহত্যা থেকে বেঁচে যাওয়া মানুষ, ধর্ষিত নারী, শরণার্থী শিবিরে বসবাসকারী মানুষ ও প্রত্যক্ষদর্শী।‘প্রথম অধ্যায়’ ও ‘শেষ অধ্যায়’ এভাবে আলাদা দুই পর্বে প্রামাণ্যচিত্রটি প্রদর্শন করা হবে।

দাম দিয়ে কিনেছি বাংলা, কারো দানে পাওয়া নয়

এ প্রামাণ্যচিত্রের টাইটেল পেজ শুরু হয়েছে ‘দাম দিয়ে কিনেছি বাংলা, কারো দানে পাওয়া নয়’ গানটির উদাত্ত ডাকের মধ্য দিয়ে যা শুরুতেই প্রতিষ্ঠিত করে দেয় এই প্রামাণ্যচিত্রের মুড, দর্শক প্রস্তুত হতে থাকেন যে দামে বাংলাকে কেনা হয়েছে, সেই দামের মুখোমুখি হতে। প্রথম অধ্যায়ে রয়েছে মোট দশটি এপিসোড।

প্রাক-কথন

এ যাবৎকালে নির্মিত মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্র বা প্রামাণ্যচিত্রে ইতিহাসটি শুরু হতে দেখেছি ’৭০-র নির্বাচনকে ঘিরে। কিন্তু এখানে শুরুতেই প্রাক-কথন অংশে দেখিয়ে দেয়া হয় ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাব এবং পরবর্তী সময়ে লাহোর প্রস্তাবে ভারতের পূর্ব ও পশ্চিম অংশের মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলগুলোর সার্বভৌম রাষ্ট্রসমূহ বা ‘states’গঠনের সিদ্ধান্তকে কীভাবে মুসলিম লীগের নেতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ টাইপের ভুল বলে ‘state’ বানিয়ে দেন এবং বলেন যে পাকিস্তান হবে কেন্দ্র শাসিত একক রাষ্ট্র। বাংলাকে ভাগ করে পূর্ববঙ্গ, পাঞ্জাবকে ভাগ করে পাঞ্জাবের পশ্চিম অংশ এবং সিন্ধু, বেলুচিস্তান ও উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশগুলো নিয়ে গঠন করা হলো পাকিস্তান। এই অংশটিতে বিশেষ করে ১৯৪৭-এর দেশভাগের সময়কার কিছু দুর্লভ ফুটেজের বিষয়টি উল্লেখ করতেই হয়।

দেশভাগের একটি আর্কাইভাল দৃশ্যের উল্লেখ না করলেই নয়। ট্রেনভর্তি মানুষ ভারত থেকে পাকিস্তানে ঢুকছে। একটি মাত্র শট এবং একটি শটই যথেষ্ট।পূর্ব বাংলা অংশটি পরিচিতি লাভ করলো পূর্বপাকিস্তান হিসাবে এবং বাকি অংশ পরিচিতি লাভ করলো পশ্চিম পাকিস্তান হিসাবে। এর পরই আর্কাইভাল ফুটেজ থেকে নির্মিত ফুটেজে চলে যাওয়া হলো, যেখানে খুব পরিষ্কার করে দেখিয়ে দেয়া হলো কীভাবে কৃষকের মাথার ঘাম পায়ে ফেলা শ্রমে উৎপাদিত পাটকে পশ্চিম পাকিস্তানের শিল্পপতিরা শিল্পের কাঁচামাল হিসাবে ব্যবহারের জন্য পূর্বপাকিস্তানকে দেখছে উপনিবেশ হিসাবে। দেখিয়ে দেয়া হলো ভাষার উপর আঘাত আর বিশিষ্ট রবীন্দ্রসংগীত বিশেষজ্ঞ ওয়াহিদুল হক মাত্র কয়েকটি কথায় দ্বিজাতিতত্ত্বের অসারতার কথা আর তার পেছনের বঞ্চনার কথাটি বলে দিলেন। মূলধারা ’৭১-এর লেখক মঈদুল হাসান বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, চুয়ান্নর যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ভাসানী, আইয়ুব খান, ১৯৬১ সালে রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী, দুই অর্থনীতি এবং সাংস্কৃতিক বৈষম্যের বিষয় বিশদ তুলে ধরলেন।

ব্রিগেডিয়ার (অব:) মজুমদার আর মেজর জেনারেল শফিউল্লার সাক্ষাৎকারে উঠে এলো পাকিস্তানের মিলিটারি একাডেমি যা কাকুল একাডেমি নামে পরিচিত, সেখানকার অভিজ্ঞতা- বাঙালি অফিসারদের সেখানে ‘বাঙালি বাবু’ বা ‘চাউল খানেওলা বাঙালি’ হিসাবে হেনস্তা করার এবং সাতদিনেও একবার ভাত না খেতে দেবার অভিজ্ঞতা। ফুটবলার কাজী সালাউদ্দীন জানালেন তিনি বিদেশে পড়তে যেতে পারেননি টাকা থাকা সত্ত্বেও, পাকিস্তানী সরকার তাকে পাসপোর্ট দেয়নি। আলী যাকের, রেহমান সোবহান এবং বঙ্গবন্ধু তিনজনের বয়ানেই স্পষ্টভাবে উচ্চারিত হলো, ‘পূর্ব পাকিস্তান ছিলো এক ঔপনিবেশিক বাজার।’ এরপর ১৯৬৫’র ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ, ১৯৬৬ সালে লাহোরে উত্থাপিত ৬-দফা, ১৯৬৮ সালে আইয়ুব খানের ক্ষমতায় আসা, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় শেখ মুজিবুর রহমানসহ নেতাদের গ্রেফতার, ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, ১৯৭০-এর নভেম্বরে উপকূলীয় জেলাগুলোতে জলোচ্ছ্বাস এবং ৭ ডিসেম্বর মুজিবকে ক্ষমতায় যেতে না দেবার জন্য ইয়াহিয়ার সাথে ভূট্টোর হাত মেলানোর কাহিনীকে পর পর গেঁথে মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিকে নির্মিতি দেয়া হয়েছে এই অংশে। পাকিস্তানী কবি আহমেদ সালিম-এর সাক্ষাৎকার এই পর্বের একটি উল্লেখযোগ্য সংযোজন। তিনি বললেন, ‘সংসদীয় গণতন্ত্রের মূলনীতি যে সংখ্যাগরিষ্ঠ দল সরকার গঠন করে। সেই দিক থেকে মুজিবুর রহমানকে সরকার গঠন করতে না দেয়া ঠিক হয়নি।’

এই পর্বে তোফায়েল আহমেদ এবং আবদুর রাজ্জাকের সাক্ষাৎকার ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। একটি অজানা তথ্য পাওয়া যায় জনাব আবদুর রাজ্জাকের সাক্ষাৎকারে। তিনি জানান, এইসব দিনগুলোর কোন একদিন বঙ্গবন্ধু তাদেরকে চিরকুট দিয়ে জানান, ‘আমি না থাকলে তাজউদ্দিন তোমাদের নেতা।’ ইতিহাসের এই অখ্যানভাগ অমূল্য।

ষড়যন্ত্রের নীলনকশা

পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ যখন তাদের দেয়া নির্বাচনী ম্যান্ডেট হিসাবে পাকিস্তানের শাসনভার গ্রহণের জন্য দিন গুনছেন তখন জেনারেল ইয়াহিয়া, জেনারেল হামিদ, জেনারেল পীরজাদা এবং অন্যান্য সামরিক জান্তাকে ভুট্টো তার লারকানার প্রাসাদে ‘হাঁস শিকার’ করার আমন্ত্রণ জানান। আর ১লা মার্চ পাকিস্তান জাতীয় পরিষদ অধিবেশন মুলতবি ঘোষণা করেন ইয়াহিয়া। মুক্তিযোদ্ধা মেজর (অব:) কামরুল হাসান ভূঁইয়া জানান ষড়যন্ত্রে অংশগ্রহণকারী পাকিস্তানী মিলিটারি হকস (HAWKS)-এর কথা। এদের মধ্যে ছিলেন প্রিন্সিপ্যাল স্টাফ অফিসার লেফটেন্যান্ট জেনারেল পীরজাদা, পাকিস্তান আর্মির চিফ অফ স্টাফ জেনারেল আবদুল হামিদ খান, চিফ অব জেনারেল স্টাফ লেফটেন্যান্ট জেনারেল গুল হাসান, মেজর জেনারেল ওমর, আইএসআই-র মেজর জেনারেল আকবর। এই নিরেট তথ্যের পাশাপাশি আমরা দেখতে থাকি পূর্বাণী হোটেল থেকে বঙ্গবন্ধুর অসহযোগ আন্দোলনের ঘোষণা, অসহযোগ আন্দোলনের ফুটেজ যা হাইকোর্টের বিচারপতি থেকে প্রেসিডেন্ট ভবনের বাবুর্চি পর্যন্ত সকলেই পালন করতে থাকেন। বিষয়টি হিউমারের সাথে উপস্থাপন করেন ড. কামাল হোসেন। এই অসহযোগ চলাকালে হঠাৎ একদিন ইয়াহিয়া খানের মিলিটারি সেক্রেটারি জেনারেল কন্ট্রোল রুমে ফোন করে জানালেন যে তখন ঢাকায় অবস্থানরত ইয়াহিয়া খান তিনদিন ধরে কোন খাবার পাননি কারণ বাবুর্চিরাও অসহযোগ করছেন তখন, তারা রান্না করেননি।

এই তথ্যচিত্রটির অসাধারণ গুণ বোধহয় এখানে যে, যাকে দিয়ে যে বক্তব্যটি তুলে আনা হয়েছে, তিনিই সেই বিষয়ে মন্তব্য ও ব্যাখ্যা করার সবচেয়ে উপযুক্ত ব্যক্তি। ৩রা মার্চের স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন, ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণ, ৭ মার্চ বালুচের কসাই হিসাবে খ্যাত টিক্কা খানের এবং১৫ মার্চ ইয়াহিয়ার ঢাকায় আগমন, সংবিধান না থাকলে কীভাবে মার্শাল ল’ তুলে ফেলা সম্ভব প্রশ্ন তুলে প্রবেশনাল সংবিধান তৈরির জন্য কালক্ষেপণ এই বিষয়গুলো তুলে ধরা হয়েছে কামাল হোসেনের বক্তব্যে। আবার পাকিস্তান সরকারের যুদ্ধ প্রস্তুতির বিষয়টি চমৎকারভাবে তুলে ধরা হয়েছে মেজর জেনারেল (অব:) শফিউল্লাহ’র বক্তব্যে।

ভুট্টো আসার সাথে সাথে কীভাবে ঢাকায় অবস্থানরত অন্যরা চলে গেলেন আর কোয়েটা থেকে ৯ম ডিভিশন এবং খারিয়া থেকে ১৬ ডিভিশন পূর্ব পাকিস্তানে পাঠানো হলো, কীভাবে বেঙ্গল রেজিমেন্টের বাঙালি-পশ্চিম সেনা অনুপাত রাতারাতি ৫০-৫০ থেকে মার্চের মাঝামাঝি নাগাদ ৪:১ এবং পরে ৬:১-এ চলে এলো এই বর্ণনাগুলো এসেছে এই পর্বে। আবার এই সময়ে সংঘটিত চট্টগ্রামের পাহাড়তলি, খুলনার খালিশপুর, সৈয়দপুর ও শান্তাহারে বিহারী-বাঙালি দাঙ্গা, বিক্ষিপ্ত সংঘর্ষের বর্ণনাও বাদ পড়েনি। প্রখ্যাত উর্দু লেখক মুশতাক আহমেদ বর্ণনা করেছেন কীভাবে পাকিস্তান বিহারীদের ব্যবহার করেছে রাজনৈতিক দাঙ্গা-হাঙ্গামায় ব্যবহার করার জন্য, কীভাবে তাদের অনগ্রসর করে রাখা হয়েছে। ইতিমধ্যে পাকিস্তানী জাহাজ সোয়াত এসে ভিড়েছে চট্টগ্রাম বন্দরে। বাঙালি শ্রমিকেরা অস্বীকৃতি জানিয়েছেন অস্ত্র খালাস করতে। সেই সময়কার বর্ণনা উঠে এসেছে চট্টগ্রামে অবস্থানরত ব্রিগেডিয়ার (অব:) মজুমদারের কথায়। টিক্কা খান, জানজুয়া এরা খুব জোর দিতে লাগলেন অস্ত্র খালাসের জন্য, আমরা জানলাম জেনারেল মিট্টা ছিলেন আরেক কাঠি সরস। তিনি বললেন, ‘সমস্ত নদী রক্তে লাল হয়ে গেলেও অস্ত্র খালাস করতে হবে।’

অপারেশন সার্চলাইট

সাধারণভাবে আমরা জানি পাকিস্তানী আর্মি ঘুমন্ত ঢাকার উপরে কামান চালিয়ে দিলো, যার পূর্বাপর পাওয়া যায় না। তথ্যচিত্রটির এই পর্ব শুরু হয়েছে মেজর (অব:) কামরুল হাসান ভূঁইয়ার দেয়া চমকপ্রদ কিছু তথ্য দিয়ে। ১৯ মার্চ সিদ্ধান্ত হয়েছে, ক্রাকডাউন হবে। জেনারেল খাদিম হোসেন রাজা লিখলেন নীল কাগজে পেন্সিল দি “Operation Search Light”। ২০ মার্চ খাদিম হোসেন রাজা বসলেন চিফ অব স্টাফ জেনারেল হামিদের সাথে। হামিদ অনুমোদন দিলে অনুমোদন পাওয়া গেলো ইয়াহিয়ার কাছ থেকেও একই দিনে আর পাকিস্তানী জেনারেলরা বিভিন্ন ক্যান্টনমেন্টে ঘুরে যুদ্ধ পরিকল্পনা ছড়িয়ে দিতে লাগলেন। ২৪ মার্চ খাদিম হোসেন রাজা এবং জেনারেল মিট্টা জেনারেল আনসারীকে নিয়ে গেলেন ব্রিগেডিয়ার মজুমদারের। কীভাবে তারপর প্রেসিডেন্ট সব সিনিয়র অফিসারদের সাথে কথা বলবেন বলে ব্রিগেডিয়ার মজুমদারকে চট্টগ্রাম থেকে সরিয়ে ঢাকা নিয়ে এলেন এবং সেখানে রেখে আসা হলো ব্রিগেডিয়ার আনসারীকে যে আনসারী সরাসরি চলে গেলেন চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দরে এবং সেখানে বাধাদানকারী ইপিআর সৈন্যদের গুলি করার মাধ্যমে ২৪ মার্চ ‘পয়েন্ট-অব-নো রিটার্ন’-এ চলে যাওযার যে বর্ণনা দিয়েছেন মেজর (অব:) রফিকুল ইসলাম এই ধরণের প্রামাণ্য ইতিহাসের বর্ণনা দুর্লভ।

এরপর এই অংশে তোফায়েল আহমেদ, কামাল হোসেন, ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলামের বক্তব্যে যেমন তুলে আনা হয়েছে বঙ্গবন্ধু, তাজউদ্দিনের অবস্থান ২৫ মার্চের কালরাতে। তেমনি সাধারণ পুলিশদের সাক্ষাৎকারে উঠে এসেছে রাজারবাগ পুলিশ লাইনে আক্রমণ এবং থ্রিনটথ্রি এবং মার্ক-ফোর দিয়ে তাদের প্রতিরোধের কথা। ওইরাতে তাদের মধ্য থেকে ১০০-১৫০ জন মারা যান আর ধরা পড়েন ১৫০জন।

ইকবাল হল, যা বর্তমানে সার্জেন্ট জহুরুল হক হল নামে পরিচিত, আর জগন্নাথ হলের হত্যাকাণ্ডের বর্ণনা দিয়েছেন ওই সময় পার করে আসা ছাত্ররা। সুরেশ চন্দ্র দাশ, অজয় দাশগুপ্ত, মৃণাল বোস, সত্যরঞ্জন। শহীদ বুদ্ধিজীবীদের হত্যাকাণ্ডের বিষয়টি এসেছে মেঘনা গুহঠাকুরতার স্মৃতিচারণায়। মধুসূদন দে’র পুত্র অরুণ কুমার দে বর্ণনা করেছেন তার পরিবারের ট্রাজেডি। তবে এই অংশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন মনে হয় শাঁখারী বাজারে প্রথম যে পরিবারে আক্রমণ চালানো হয়, সেই পরিবারের অমল সূর আর তার মা-র সাক্ষাৎকার। ২৫-২৬-২৭ তিনদিন ধরে তাদের পরিবারে আক্রমণ চালানো হয়। ২৭ তারিখ তিনি দেখেন আঙ্গিনায় পড়ে থাকা তার বাবা-ভাইয়ের লাশ ঠোকরাচ্ছে কাক। শাঁখারি বাজারের নাম হয়েছিলো তখন টিক্কাখান রোড আর পুড়িয়ে দেয়া হয়েছিলো টঙ্গী থেকে নারায়ণগঞ্জ পর্যন্ত বস্তি এলাকা ধরে নিয়ে যে এইখানেই সবচেয়ে বেশী মানুষের বসবাস যারা মিছিল করে।

প্রাথমিক প্রতিরোধ

২৫ মার্চ রাতের ঘটনা ছড়িয়ে পড়লে চট্টগ্রাম, যশোর, পাবনা, রংপুর, কুষ্টিয়া, ময়মনসিংহ- এ প্রতিরোধ শুরু হয়। থ্রিনটথ্রি, পাখি মারার একনলা বন্দুক, পয়েন্ট ২২ বোর, এয়ারগান, ঢাল-সড়কি, তীর-ধনুক, কাস্তে ছিলো প্রতিরোধ যুদ্ধের অস্ত্র। যশোর ক্যান্টনমেন্ট থেকে ক্যাপ্টেন হাফিজের নেতৃত্বে এবং রংপুর ক্যান্টনমেন্ট থেকে লেফটেন্যান্ট আনোয়ারের নেতৃত্বে সৈন্যরা পালিয়ে যান এবং মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। ইপিআর-এর চুয়াডাঙ্গা-মেহেরপুর থেকে মেজর আবু ওসমান বিদ্রোহ করে দখল করেন কুষ্টিয়া শহর। তাঁর মতে, প্রকৃত জনযুদ্ধ শুরু হয় কুষ্টিয়া থেকে। যে বালুচ রেজিমেন্ট ২৫ মার্চ রাতে চট্টগ্রামে ১২০০ সৈন্যকে হত্যা করেছিলো সেখানে ক্যাপ্টেন রফিকের নেতৃত্বে এবং পাবনায় ক্যাপ্টেন নুরুল কাদের খানের নেতৃত্বে যেসব যুদ্ধ গড়ে ওঠে আছে সেসব বর্ণনা। বর্ণনা আছে কুমিরার যুদ্ধে সুবিদ আলী ভূঁইয়ার নেতৃত্বাধীন ৮ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈন্যদের যুদ্ধ। তবে এইসব যুদ্ধের ইতিহাস আমরা কমবেশি জানি। কিন্তু যে যুদ্ধের কথা ইতিহাসে আর কেউ তুলে আনেননি এ পর্যন্ত, তা হলো, পার্বত্য চট্টগ্রামে আদিবাসী জনগণের যুদ্ধসম্পৃক্তির ইতিহাস।

রণবিজয় কিশোর ত্রিপুরার সাক্ষাৎকার একটি বিশেষ সংযোজন। তিনি জানান পার্বত্য চট্টগ্রামের যুদ্ধ সম্পর্কে। মারমা এবং ত্রিপুরা জনগোষ্ঠী স্বাধীনতার পক্ষে কাজ করেছে।

বেলাল মোহাম্মদের সাক্ষাৎকারে মেজর জিয়াউর রহমানকে কীভাবে অনুরোধ করা হয় স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রটি পাঠ করতে এবং তিনি কীভাবে বঙ্গবন্ধুর নামে এই ঘোষণাপত্রটি পাঠ করেন ২৭ মার্চ, বিষয়টি স্পষ্ট হয়েছে।

উঠে এসেছে ৪ঠা এপ্রিল সিলেটের তেলিয়াপাড়া চা বাগানে বাঙালি মিলিটারি অফিসারদের সভায় মেজর জেনারেল ওসমানীসহ সভার সমন্বিত সিদ্ধান্তে নিজস্ব সরকার গঠনের ব্যাপারটি। এই প্রসঙ্গটি তুলে ধরেন মেজর জেনারেল শফিউল্লাহ।

গণহত্যা দিকে দিকে

এই পর্বে দেশের সব প্রান্তে যে গণহত্যা চালানো হয় তার এক নির্বাচিত অংশের দলিল পেয়ে যাই। পরিষ্কারভাবে উঠে আসে এই গণহত্যার লক্ষ ছিলো আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মী, হিন্দু জনগোষ্ঠী, ছাত্র-যুবক। বিশেষ করে হিন্দুদের উপর জাতিগত নিধন চালানো হয়। আর হত্যাকাজে সাহায্য করেছে স্থানীয় বিহারীরা, জামাত-ই-ইসলামী এবং মুসলিম লীগ। ইতিহাসের কাছে দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে দেশের বিভিন্ন বিহারী প্রধান এলাকায় ক্রুদ্ধ বাঙালিদের হাতে বিহারী নারী-পুরুষদের হত্যার প্রসঙ্গটিও বাদ পড়েনি।

ভারতের সঙ্গে যোগাযোগ

মুক্তিযুদ্ধে ভারতের সাহায্য বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি অস্বস্তিকর প্রসঙ্গই যেনো। বিশেষ করে ১৯৭৫ সালের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পরে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত যেসব শক্তি ক্ষমতায় এসেছে সামরিক বা বেসামরিক লেবাসে, তারা যেহেতু মুক্তিযুদ্ধ প্রসঙ্গটিকেই ধামাচাপা দিতে চেয়েছে, এবং যেহেতু সাম্প্রদায়িক ভারতবিদ্বেষী রাজনীতিই ছিলো তাদের রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষের প্রধান সোপান, তাই ভারতের সাহায্য প্রসঙ্গটি এসেছে কেবলমাত্র এক কোটি শরণার্থীদের আশ্রয় দেবার প্রসঙ্গে, তাও কালেভদ্রে। এই তথ্যচিত্রটি প্রথম আলো ফেলেছে বস্তুনিষ্ঠভাবে। ইতিহাসের এক অনালোচিত অধ্যায়কে নির্মাণ করার জন্য পরিচালক যথেষ্ট খেটেছেন। ব্যারিস্টার আমীরুল ইসলামের সাক্ষাৎকার থেকে জানা যায় তাজউদ্দিন আহমেদ ভারত যান আমীরুল ইসলামকে নিয়ে, ইন্দিরা গান্ধীর সাথে দেখা করেন। সাহায্য করেছিলো ভারতের বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্স।

চুয়াডাঙ্গার আওয়ামী লীগ নেতা ড. আসাবুল হকের নেতৃত্বে তখন বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্বপক্ষে গড়ে ওঠে নানা তৎপরতা। তৌফিক-ই-এলাহি চৌধুরী এবং তার সহযোগী যারা এই কাজে সরাসরি যুক্ত ছিলেন তাঁদের বক্তব্যে সরাসরি তুলে আনা হয়েছে এইসব তৎপরতার ইতিবৃত্ত। যেমন তৌফিক-ই-এলাহি চৌধুরী খোলা চিঠি লিখেছিলেন ভারতীয় জনগণকে, অস্ত্র চেয়ে। কয়েকদিন পরে উত্তর এসেছিলো, ‘দেখা করো’। তারা দেখা করেছিলেন কর্নেল চক্রবর্ত্তীর সাথে। এখানে খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি সাক্ষাৎকার পাই আমরা গোলক মজুমদারের। তিনি তখন বিএসএফ-এর আইজি। তিনি প্রথম এইসব ছোট ছোট ছেলেদের অপরিণত চেহারা, পোশাক এবং ব্যবহারে খুবই অবাক হন কিন্তু পরিচয় করিয়ে দেন রুস্তমজীর সাথে। রুস্তমজী কথা বলেন ইন্দিরা গান্ধীর সাথে। ইন্দিরা গান্ধী বলেলেন তাদের দিল্লী পাঠাতে।

দিল্লীতে ইন্দিরা গান্ধীর সাথে তাজউদ্দিন এবং ব্যারিস্টার আমীরুল ইসলামের আলোচনার মূল পয়েন্টগুলো ছিলো:
১। এই যুদ্ধ আমাদের। আমাদেরই স্বাধীন করতে হবে। ভারতীয় বাহিনী দেশের ভেতরে যাক, চাই না। ২। আমরা চাই সাহায্য, গ্রুপিং, ট্রেনিং, রি-গ্রুপিং, অস্ত্র ও অন্যান্য সাহায্য। ৩। এক থেকে দেড় কোটি শরণার্থীর দায় নেয়া। ৪। বৈদেশিক প্রচার বিষয়ে সাহায্য। ৫। একটি প্রচার মাধ্যম চালানোর ব্যবস্থা করা, যার নাম হবে বাংলাদেশ বেতার। এই পয়েন্টগুলোতে ভারতের সাথে একটি পরিপূর্ণ সমঝোতা হয় এবং সে অনুযায়ী কাজ শুরু হয়।

মুজিব নগর সরকার

১০ এপ্রিল প্রবাসী সরকার গঠিত হয়। কিন্তু শপথ-গ্রহণ অনুষ্ঠান যেহেতু দেশের মধ্যেই হতে হবে তাই ১৭ এপ্রিল মেহেরপুরের বৈদ্যনাথ তলায় শপথ-গ্রহণ অনুষ্ঠান ধার্য করা হয়। এখানেও গোলক মজুমদারের তথ্য খুব কৌতূহলোদ্দীপক। কীভাবে তারা সকল বিধায়কদের জড়ো করেছিলেন এই শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে, এসেছিলেন তারা ৪০টি অ্যাম্বাসাডার গাড়িতে। এই অনুষ্ঠানে ঘোষণাপত্রের খসড়া তৈরি করেছিলেন ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলাম, পাঠ করেছিলেন অধ্যাপক ইউসুফ আলী আর স্থানটির নামকরণ করা হয় মুজিবনগর। যে ১২জন গার্ড অব অনার দিয়েছিলেন, তাদের মুখেই ধারণ করা হয়েছে সেই অনুষ্ঠানে তাদের অংশগ্রহণের প্রস্তুতির কথা। এই অনুষ্ঠানে তাজউদ্দিন মন্তব্য করেছিলেন, ‘এক আম্রকাননে স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হয়েছিলো, আরেকটি আম্রকাননে স্বাধীনতার সূর্য উঠলো।’

মৃত্যু-উপত্যকা

সবচেয়ে বেশী নির্মিত দৃশ্য পাই আমরা এই অংশে। রাজশাহীর সারদার থানাপাড়া গ্রামের উপর দিয়ে ১৯৭১ সালের ১৩ এপ্রিল হেঁটে গিয়েছিলো পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ৫৭ ব্রিগেড। কথা বলবে বলে গ্রামবাসীকে জড়ো করে ১২০০ লোককে নির্বিচারে ব্রাশ ফায়ার করেছিলো আর পেট্রোলের টিন ছড়িয়ে আগুন দিয়ে দিয়েছিলো। বেঁচে যাওয়া ড. জিন্নাতুল আলম বর্ণনা করেন সেই কাহিনী। । সারদার থানাপাড়া গ্রামটি এখন বিধবাদের গ্রাম নামে পরিচিত। পরিচালক আশ্চর্য দক্ষতায় এরপর একে একে তুলে আনেন ডুমুরিয়ার চুকনগর গণহত্যা, কিশোরগঞ্জের বড়ইতলা গণহত্যা, সৈয়দপুরের গোলারহাট গণহত্যা, বরিশালের আটঘরিয়া কুড়িয়ানার গণহত্যা, মৌলবী বাজারের চা-বাগান গণহত্যা, যশোরের মাদ্রাসা গণহত্যা, জয়পুরহাটের পাগলা দেওয়ান গণহত্যা। এসব গণহত্যার কথা বর্ণনা করেন যারা হারিয়েছেন তাদের স্বজন, কিংবা নিজেই গেছেন সেইসব অভিজ্ঞতার ভেতর থেকে। এইসব গণহত্যার পর মৃতদেহ ফেলে রাখা হতো নদীর পাড়ে, পথের পাশে, কারো সৎকার হতো না। কুকুরের-শেয়ালের খাদ্য হয়েছে এইসব মানুষের দেহ। ‘শুধুমাত্র নিজের পছন্দের দল ও ব্যক্তিকে ভোট দেবার জন্য এতবড় মূল্য আর কোন জনগোষ্ঠীকে দিতে হয়নি’ বলে এই পর্ব শেষ করেন ধারা-বর্ণনাকারী।

মুক্তিবাহিনী-প্রবাসী সরকার

এই দুই পর্বে আমরা মুক্তিবাহিনীর প্রশিক্ষণ এবং অপারেশন দেখি। আর কোলকাতার ৮নং থিয়েটার রোড যা এখন শেক্সপিয়ার সরণী নামে পরিচিত সেখানে প্রবাসী সরকারের কাজ এবং বিদেশের বিভিন্ন স্থানে কর্মরত বাঙালি কূটনৈতিকদের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের স্বরূপটি জানতে পারি মহিউদ্দিন আহমেদ, এইচ.টি. ইমাম, শিহাবউদ্দিন- এই তিন কূটনীতিকের বরাতে। ১৮ এপ্রিল ভারতে বাংলাদেশের ডেপুটি হাই কমিশনার হোসেন আলী তুলেছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা। জানতে থাকি নিউ ইয়র্কে এ এইচ মাহমুদ আলী, শাহ এমএস কিবরিয়া, আবুল মাল আব্দুল মহিত, মোয়াজ্জেম হোসেন এবং এস এ করিমের তৎপরতার কথা।

তাহাদের কথা

দুই লাখের বেশী সংখ্যক নারীকে ১৯৭১ সালে ধর্ষণ করা হয়েছিলো, এই তথ্যকে যখন নানা মোড়কে অস্বীকার করার প্রয়াস চলছে, যখন শর্মিলা বোস প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের উইড্রো-উইলসন সেন্টারের ফান্ডে ১৯৭১ সালে কোন ধর্ষণের ঘটনা ঘটেনি বলে ‘গবেষণা’ বই প্রকাশ করছেন, যখন বাংলাদেশের এক পরিচালক কোটি কোটি টাকা খরচ করে নির্মিত চলচ্চিত্রে ‘আমি কি এই প্রথম ধর্ষিত হয়েছি?’ মর্মে প্রশ্ন তুলে পাকিস্তানী সৈন্যদের নির্বিচার ধর্ষণকে মোলায়েম করতে চাইছেন, তখন এই তথ্যচিত্রটি ইতিহাসের নিষ্ঠুরতা পাকিস্তান বাহিনীর ধর্ষণ উৎসবকে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মনস্তাত্ত্বিক আক্রোশের আলোকে যেমন উপস্থাপন করেছেন তেমনি নির্যাতিত ক্ষেত্রবিশেষে পরিত্যক্ত এসব নারীকে বিস্মৃতি থেকে তুলে এনেছে ইতিহাসের অনিবার্য অংশ হিসাবে। ব্রিগেডিয়ার এআর সিদ্দিকী এএসপিআর নিয়াজীকে ধর্ষণের ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করলে নিয়াজী গর্বের সাথে উত্তর দিয়েছিলেন,  “I ask my soldiers what was your last night’s harvest?”[আমরা ফুটেজে দেখতে থাকি] ... “My soldiers will live here, they will fight here, they will die here and for sex they will go to Jhilam?”

সেই মনোভঙ্গির ফলাফল কতটা ভয়াবহ ছিলো তা ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণীর সাহসী উচ্চারণে যেমন উঠে এসেছে, তেমনি অত্যন্ত সাহসের সাথে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন কুষ্টিয়া, সিলেট, সিরাজগঞ্জ, বগুড়ার নির্যাতিত নারীরা। যশোরের ক্যান্টনমেন্টে, রূপসার গুদামে দল-ধর্ষণের শিকার প্রিয়ভাষিণী কমান্ডার গুলজারিন, কর্নেল আবদুল্লাহ, কর্নেল খাট্টাক, কর্নেল জায়ার, মেজর বানরি, কর্নেল আবেদ, লেফটেন্যান্ট সুলতান, মেজর বেলায়েত শাহ-র নাম অকপটে উচ্চারণ করেন আর বেদনার সাথে মনে করেন ২৩/২৪ বছরের কোন নারীর আর্তনাদ, যিনি একই কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে ছিলেন অথচ যাকে তিনি কখনো দেখেননি, “ওরে আমার হাবিব রে...তুই কনে?’’

প্রথম পর্ব শেষে দ্বিতীয় পর্ব শুরু হয় বাধ্যতামূলক ধর্মান্তরকরণের মত নাজুক এক এপিসোড নিয়ে।প্রায় চৌদ্দটি এপিসোড নিয়ে এই অধ্যায়।

বাধ্যতামূলক ধর্মান্তরকরণ

মুক্তিযুদ্ধে হত্যা-ধর্ষণই যে শেষ কথা ছিলো, এমন নয়। তাদের দ্বিজাতি তত্ত্ব এদেশকে হিন্দু-শূন্য করার ব্রত নিয়েছিলো। তাই হিন্দুদের জোর করে ইসলাম ধর্ম গ্রহণে বাধ্য করা ছিলো নিপীড়নের আরেক রূপ। এমনই এক পরিবার ময়মনসিংহের যতীন সরকার পরিবার। বিশিষ্ট লেখক, গবেষক এবং চিন্তাবিদ যতীন সরকার এবং তার স্ত্রী কনক সরকারের বক্তব্যে এই রূপটি ধরা পড়ে। যতীন সরকার বেদনার সাথে উল্লেখ করেন যারা তাদের পড়শি, যাদের সাথে আন্দোলন-সংগ্রাম করছেন, তারা পর্যন্ত প্রশ্ন করেছেন দেশ স্বাধীন হলে যতীন সরকারের কী লাভ, তিনি কেনো এতো উত্তেজিত? তিনি বেদনার সাথে বলেন, তখনো আসলে সাংস্কৃতিকভাবে ভেদবুদ্ধি লোপাট হয়নি আর তার স্ত্রী বর্ণনা করেন কোন প্রেক্ষাপটে তাদের ধর্মান্তরিত হতে হয়। তাঁরা অত্যন্ত কৌতুকপূর্ণ ভঙ্গিতে এই অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেন বটে, তবে সেই বর্ণনার মধ্যেই সে’সময়কার ধর্মীয় নির্যাতনের রূপটি ভয়াবহভাবে ধরা পড়ে।

নির্যাতনের নানা আলেখ্য

পাকিস্তানী বাহিনীর নানা নির্যাতনের সাথে এই প্রজন্মের সামান্যই পরিচয় আছে। নির্যাতনের রূপ কত ভয়াবহ হতে পারে তার সাক্ষ্য নিয়ে এখনো অনেকে বেঁচে আছেন। ঠাকুর গাঁ-র শফিক আলম চৌধুরী দিয়েছেন তেমনই এক বর্ণনা। ঠাকুর গাঁ-এ মুক্তিযুদ্ধের সংগ্রাম পরিষদ তৈরি হলে তিনি সেখানে যোগ দেন। রাজাকাররা তাকে ধরে নিয়ে যায় পাকিস্তানী সেনা ক্যাম্পে। সেনাক্যাম্পে কয়েকটি বাঘ রাখা হয়েছিলো। চারটি বাচ্চা আর তিনটি বড় চিতা। সেই রুমে রাখা হয় শফিক আলম চৌধুরীকে। এই বাঘগুলো ছিলো খুবই হিংস্র, যে কেউ পরিদর্শনে এলেই তাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ত কিন্তু কোন এক অজ্ঞাত কারণে বাঘগুলো তার কোন ক্ষতি করেনি। তবে প্রতিদিনই পাকিস্তানী মেজর পরিদর্শনে এসে জনাব শফিককে বলতেন বাঘকে ডাকার জন্য। হিংস্র বাঘের খাঁচার মধ্যে রেখে তারা মজা দেখতেন।

বাংলার মাটি, দুর্জয় ঘাঁটি

মুক্তিযুদ্ধে ১১টি সেক্টর গঠিত হয় মেজর পদমর্যাদার অফিসারদের নিয়ে। এছাড়াও জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে ‘জেড’ ফোর্স, মেজর জেনারেল শফিউল্লার নেতৃত্বে এস ফোর্স এবং খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অপারেশন এবং ভারতীয় সেনাবাহিনীর ইস্টার্ন কমান্ডার জেনারেল অরোরা-র নেতৃত্বে ‘অপারেশন সরকার’ তৈরি হয় এবং বিভিন্ন ট্রেনিং-এর বিবরণ রয়েছে এই পর্বে যার মধ্যে কেবল সেনাবাহিনী নয় বরং সাধারণ মানুষের যুদ্ধে টেনিং নেবার বিষয়টিও উঠে এসেছে। ফেনী-বিলোনিয়া এবং সালদা নদীর যুদ্ধে বাংলার মুক্তিযোদ্ধাদের বিজয় যেমন আলোচিত হয়েছে, তেমনি এসেছে ন্যাপ-কমিউনিস্ট পার্টির যৌথ বাহিনীর গঠন ও কাজ এবং টাঙ্গাইলের কাদেরিয়া বাহিনী- ফরিদপুরের হেমায়েত বাহিনী-মানিকগঞ্জের হালিম চৌধুরী বাহিনী এবং সিলেটের কমান্ডেন্ট মানিক চৌধুরী বাহিনীর কার্যক্রম।

রাজাকার

পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে সাহায্য করার জন্য ১৯৭১ সালে রাজাকার অর্ডিন্যান্স জারির মাধ্যমে দেশে প্রায় এক লক্ষ রাজাকার তৈরি করা হয়। খুলনা শহরের আনসার ক্যাম্প যা ভূতের বাড়ি নামে পরিচিত সেখানে মওলানা ইউসুফের ট্রেনিং-এর মাধ্যমে তাদের যাত্রা শুরু। মূল কাজ ছিলো মুক্তিবাহিনী, হিন্দু এবং আওয়ামী লীগের লোকদের এবং তাদের বাড়িঘর চিনিয়ে দেয়া, মেয়েদের তুলে নিতে সাহায্য করা এবং লুটপাট, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ এবং জমিজমা কেড়ে নেয়া। জামাত-ই-ইসলাম, মুসলিম লীগ-এর অঙ্গসংগঠন হিসাবে গড়ে ওঠা রাজাকার বাহিনীর পাশাপাশি গড়ে উঠেছিলো আল বদর এবং আল শামস বাহিনী যাদের কাজ ছিলো তালিকা করে শিল্পী-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করা। ফুটেজ, নতুন ধারণ করা দৃশ্য এবং ফাদার রেগানের স্মৃতি চারণায় এদের কার্যক্রম তুলে ধরা হয়েছে। গোলাম আযম স্বাক্ষরিত পাকিস্তান রক্ষা সাহায্য তহবিলের একটি রসিদ বই ছাপা আছে।

আর্টিস্ট

এই অংশের শুরুতে এদেশের শিল্পী-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবীদের সংঘবদ্ধ স্থিরচিত্রের মাধ্যমে তাদের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ প্রসঙ্গে অবস্থানটি স্পষ্ট করে দেয়া হয়েছে। এরপর কামাল লোহানী, সৈয়দ হাসান ইমাম, আলী যাকের-এর সাক্ষাতকার থেকে আমরা দেখতে থাকি ৫৭/৮ বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডে গড়ে ওঠা স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্ত্র থেকে কীভাবে অনুষ্ঠান পরিচালিত হতো, কারা কী দায়িত্বে ছিলেন। এমআর আক্তার মুকুলের চরমপত্র থেকে কিংবা দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়-এর সংবাদ পাঠ ও সংবাদ পরিক্রমা থেকে উদ্ধৃতি সেই সময়কার আবহে নিয়ে ফেলে আমাদের। ফুটবলার সালাউদ্দিন বর্ণনায় আমরা পাই কীভাবে দুই বাংলার ফুটবল খেলোয়াড়রা মাঠে নেমেছিলেন সেদিন আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে সাহায্য করার জন্য। আর ওয়াহিদুল হকের প্রাজ্ঞ উচ্চারণে পরিচালক ধরে রাখেন পশ্চিমবঙ্গেও শিল্পী-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা। বাংলাদেশ মুক্তিসংগ্রামী শিল্পী সংস্থায় আমরা যুক্ত হতে দেখি একের পর এক কিংবদন্তীর নাম - দীপেন বন্দ্যোপাধ্যায়, মৈত্রেয়ী দেবী, সুচিত্রা মিত্র, শ্যামল মিত্র, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়-এন নাম। আর শেষ হয় এই অংশটি রবিশংকরের উদ্যোগে নিউইয়র্কের মেডিসন স্কয়ারে রবিশংরের উদ্যোগে কনসার্ট বাংলাদেশের ফুটেজ দিয়ে। এই অনুষ্ঠানে জর্জ হ্যারিসন ছাড়াও গেয়েছিলেন বব ডিলান, এরিক ক্লাপটন, বিলি প্রেসটন, লিওন রাসেল রিংগো স্টারের মত শিল্পীরা।

মুক্তিযোদ্ধারা

এই এপিসোডে প্রথমে কয়েকটি ফোকাস গ্রুপ আলোচনার মাধ্যমে দর্শকদের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়া হয় গেরিলা যুদ্ধে অংশ নেয়া মুক্তিযোদ্ধাদের। এই সময় ঢাকায় বেশ কয়েকটি গেরিলা গ্রুপ গড়ে উঠেছিলো। তাদের মধ্যে একটির নাম ছিলো লাইট গ্রুপ। তারা ঢাকার জয়পাড়া বাজার, কাচারিঘাট বান্দুরা বাজার, পালংগঞ্জ বাজারে অপারেশন করেছেন। গেরিলা কমান্ডার মাহবুব আলমের কথায় আম্বরখানা যুদ্ধের কথা যেমন সামনে এসে দাঁড়ায় তেমনি মেজর খালেদ মোশাররফ এবং মেজর হায়দারের নেতৃত্বে ‘ক্র্যাক প্লাটুন’-এর বর্ণনা দেন হাবিবুল আলম। নারী মুক্তিযোদ্ধাদের সীমিত অংশগ্রহণের কিছু উল্লেখও এই তথ্যচিত্রে পাই আমরা। কিছু ফুটেজ রয়েছে ত্রিপুরার বিশ্রামগঞ্জ হাসপাতালে কর্মরত নারীকর্মীদের, সাক্ষাৎকার রয়েছে তারামন বিবি বীরপ্রতীকের।

নৌ-কমান্ডো

আকাশবাণীকে ব্যবহার করে নৌকমান্ডোদের আক্রমণের সিগন্যাল বিষয়ে চমকপ্রদ তথ্য রয়েছে এই পর্যায়ে। যেমন, আকাশবাণীতে পঙ্কজ মল্লিকের গলায় ‘আমি তোমায় যত শুনিয়েছিলেম গান’ বাজালে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে আক্রমণ চালানোর প্রস্তুতি নিতে হতো কিংবা সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের ‘আমার পুতুল আজ প্রথম যাবে শ্বশুরবাড়ি‘ গানটি বাজালে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আক্রমণ চালানো হত। আর এই সংকেত ধরে একযোগে আক্রমণ চালিয়ে ১৫ আগস্ট চট্টগ্রামে ৯টি এবং মংলা পোর্টে ৬টি জাহাজ ডুবিয়ে দিয়ে দুই পোর্টের চ্যানেলকেই তারা প্রায় অচল করে দিয়েছিলেন। আর সেই সময়কে বর্ণনা করেছেন নৌকমান্ডোর সদস্যরাই। বর্ণনা করেছেন সাব-কমান্ডার মেজর (অব:) জিয়াউদ্দিন।

বিদেশী সমর্থন

স্থির ছবি এবং আর্কইভাল ফুটেজের অসাধারণ ব্যবহারের মাধ্যমে অত্যন্ত জোরালোভাবে তুলে ধরা হয়েছে কারা ছিলেন এই যুদ্ধে বাংলাদেশের পক্ষ সমর্থনকারী আর কারা ছিলেন বিরুদ্ধাচারণকারী। প্রথম বিদেশী সমর্থন ছিলো সোভিয়েত প্রেসিডেন্ট পদগোনির। এরপর বৃটিশ পার্লামেন্ট সদস্য জন স্টোনহাউস, পিটার শোর, ফ্রান্সের বুদ্ধিজীবী আঁদ্রে মারলো, ইন্দিরা গান্ধী, এডওয়ার্ড কেনেডির ফুটেজ এবং বক্তব্য বিশেষ করে আঁদ্রে মারলোর উত্তেজিত বক্তব্য বাংলাদেশের পক্ষে এবং বৃটিশ মিডিয়াকে দেয়া ইন্দিরা গান্ধীর তীব্র-তীক্ষ-যথাযথ বক্তব্য অনন্য সংযোজন এই পর্বের। এরপর পাকিস্তানে আটকে পড়া বাঙ্গালী, বাংলার বিমান-বাহিনী, ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ, বুদ্ধিজীবী হত্যা, চূড়ান্ত বিজয় এবং সবশেষে বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন এই ধারাক্রমে এসে শেষ হয় এই আলেখ্য।

অসাধারণ ১৯৭১

এই প্রামাণ্যচিত্রটি বাংলাদেশ রাষ্ট্রটির জন্মের এমন এক মহাকাব্যিক দলিল যে চলচ্চিত্র নির্মাণের অন্যান্য দিকগুলোর আলোচনা খুব অপাংক্তেয় মনে হয়। তবে সহজ কথায় বলতে গেলে, এটি ধ্রুপদী প্রামাণ্যচিত্র কাঠামোতে নির্মিত। মূলত ঐতিহাসিক দলিলপত্র এই তথ্যচিত্রের পাটাতনটি নির্মাণ করেছে। তবে গবেষণাটি শুধু যে প্রামাণ্য দলিলের উপর নির্মিত হয়েছে মোটেই এমন নয় বরং গবেষণা করা হয়েছে যেসব দৃশ্য পরবর্তীতে নির্মাণ করা হয়েছে তার বাস্তবায়নের ক্ষেত্রেও। ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্বদের নির্বাচন করা, তাদের সাক্ষাৎকার, সাধারণ মানুষের যুদ্ধ-অভিজ্ঞতাকে তার সাথে যুক্ত করা, তাদের নিয়ে নতুন দৃশ্যায়ন এবং আর্কাইভাল ফুটেজ, স্থিরচিত্র, সাক্ষাৎকার এবং বর্তমান নির্দেশকারী দৃশ্যের সমস্বত্ত্ব এবং সমান্তরাল ব্যবহার খুব সহজ বিষয় নয়। সাত বছর গবেষণার পরিশ্রমটি খুব সহজেই বোঝা যায়।

ধ্রুপদী নির্মাণশৈলীতেই তিনি অতীতকে প্রধানত সাদা-কালো [ব্যতিক্রমও রয়েছে যেমন ইন্দিরা গান্ধী, আঁদ্রে মারলো-র ফুটেজ] আর বর্তমানকে রঙিন করে উপস্থাপন করেছেন। ফলে ইতিহাস আর বর্তমানের পার্থক্য করা যেমন সহজেই সম্ভব, একই সাথে সম্পাদনা এমনভাবে করা হয়েছে যে ইতিহাস আর বর্তমান জেনারেশন পার্থক্য না হয়ে ধারাবাহিকতা হয়ে উঠেছে। পরিচালক আগাগোড়া ইতিহাসের কাছে দায়বদ্ধ থেকেছেন, কিন্তু তাই বলে ইতিহাসের অন্তর্গত মানুষকে ভুলে যাননি। বরং সমান দায়বদ্ধতার সাথেই অতীতকে যুক্ত করেছেন বর্তমান যাপিত জীবনের সাথে। ফলে ইতিহাসের কচকচানি না হয়ে বর্তমান সময়ের জন্য, আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের সাথে মুক্তিযুদ্ধের অনিবার্য সম্পর্ককে স্পষ্ট করে তুলতে পেরেছেন।

তিনি এমনকিছু বিষয়ের অবতারণা এখানে রেখেছেন যা সচরাচর ইতিহাস পাঠে কমই দেখা যায়। প্রান্তিক মানুষের মুক্তিযুদ্ধকে তুলে ধরা। উদাহরণ হিসাবে বিশেষভাবে বলা যায়, তাহাদের কথা বা শরণার্থী এপিসোড দুটির কথা। যুদ্ধের সর্বাত্মক প্রভাবটি যে প্রান্তিক মানুষদের মধ্যেও নিঃস্বত্বদের উপরই সবচেয়ে বেশী ন্যস্ত হয়েছিলো ১৯৭১ সালে, তা বোঝা যায় নারী এবং হিন্দু জনগোষ্ঠীর উপর আক্রমণের মাত্রাটা দেখে। তিনি এই সত্যের কাছে দায়বদ্ধ থেকেছেন, সে বিষয়টি খুবই পরিষ্কার। এমনকি বিহারীদের উপর ক্রুদ্ধ বাঙ্গালীদের চড়াও হওয়ার ব্যাপারটিও তিনি এড়িয়ে যাননি।

নতুন দৃশ্য নির্মাণের সময় মুডকে স্থাপনের যে এক বিশেষ যত্ন ছিলো সেটি অনুভব করা যায়। যেমন মুক্তিযোদ্ধারা এপিসোডে যখন গেরিলা যোদ্ধাদের ফোকাস দল সাক্ষাৎকার নেয়া হচ্ছিলো, তখন তাদের ভেতরকার বন্ধুত্বকে খুব অনায়াসেই বোঝানো সম্ভব হয়েছে। সহজ কথাকে তিনি সহজেই বলতে চেয়েছেন। ১৯৭১ এমন এক সহজ সত্য, মনে হয় উপস্থাপন অন্য কিছু হলেই বরং অস্বাভাবিক লাগতো।

তবে এই প্রামাণ্যচিত্রটির মূল শক্তির জায়গা হলো ইতিহাসের সাথে পরিচালকের অনায়াস বোঝাপড়া, ফলে কোথাও হোঁচট খেতে হয় না বরং অজানা তথ্যগুলো সামনে এলেও সহজেই আত্মস্থ করা যায়। তিনি শুধু উস্কে দিয়েছেন। এই ইতিহাস যাদের হাতে একদিন নির্মিত হয়েছিলো, তাদের মধ্যে যাঁরা এখনো বেঁচে আছেন তাদের স্মৃতিকে যেমন উস্কে দিয়েছেন, তারা স্মৃতি রোমন্থন করেছেন তেমনি উস্কে দিতে চেয়েছেন অনুসন্ধিৎসু মনকে, যারা মুক্তিযুদ্ধের সময় জন্ম গ্রহণ করেনি বা করলেও তাদের বোঝার বয়স হয়নি। অর্থাৎ এই প্রামাণ্যচিত্রে ইতিহাসের অংশীদার মানুষদের একটু উস্কে দিয়ে স্মৃতির ঝাঁপি খুলে দিতে সাহায্য করেছেন যা গল্পের মতো সেই সময়কে ভুলে থাকা মানুষদের কিংবা সেই সময় সম্পর্কে যাদের বাস্তব অভিজ্ঞতা নেই তাদের ভেতর পূর্ব-প্রজন্মের সবচেয়ে গৌরবের অথচ সবচেয়ে বেদনার সময়টিকে তুলে ধরতে পেরেছেন।

যদিও এই চলচ্চিত্রটি নিয়ে সমালোচনায় আমার আগ্রহ কম, তবে দু’একটি জায়গায় একটু নজর দেয়া গেলে বোধহয় ভালোই হতো। যেমন শুরু থেকে অর্থাৎ প্রথম পর্ব থেকেই প্রত্যেকটি এপিসোড টানটান, সবল, গতিময়, তবে পাকিস্তানে আটকে পড়া বাঙালী পর্বটি থেকে এই গতিতে যেনো একটু ভাটা পড়েছে। মনে হয় কোথাও বুঝি একটু মনোযোগ বিচ্যুতি ঘটেছে। এবং এই অমনোযোগ বুঝি বহাল থাকে শেষ পর্যন্ত। কিছু কিছু এপিসোডের নাম ইংরেজিতে দেয়া হয়েছে অথচ বাংলায় দেয়া হয়নি, যেমন Artist । বিষয়টি ইচ্ছাকৃত না হলে পাল্টে দিলে ভালো হয়। দু’একটি জায়গায় ভাষান্তরের ক্ষেত্রে একটু বুঝি অন্যমনস্কতা দেখা যায়, যা অনায়াসে শুধরে ফেলা সম্ভব। রেপ্রিজেন্টেশন তত্ত্ব অনুযায়ী, কোন টেক্সটে যা আছে তা যেমন প্রকাশ করে, যা অনুপস্থিত তাও অনেককিছু প্রকাশ করতে পারে। সেদিকে একটু খেয়াল রাখতে পারলে ভালো হতো আরো হয়তো। মুক্তিযুদ্ধে নারীদের বহুমাত্রিক অবদানটি উপস্থাপিত হয়নি। ধারা বর্ণনাকারীর গলা ভালো, উচ্চারণেও তেমন অসুবিধা নেই কিন্তু আগাগোড়া পাঠটি কেমন যেনো আনন্দিত কণ্ঠে করেছেন মনে হয়। গোটা চলচ্চিত্রের যে গভীরতা, সেটির প্রতি আরেকটু যত্নবান হলে ভালো হতো।

যুদ্ধ চলচ্চিত্রের, বিশেষ করে যুদ্ধ প্রামাণ্যচিত্রের একটি মুশকিল হলো প্রপাগান্ডামূলক চরিত্র থাকে। পরিচালক বোধহয় সেই বিষয়ে যথেষ্ট সজাগ ছিলেন। তাই প্রপাগান্ডামূলক স্বরটি কখনোই খুব উচ্চকিত হয়ে ওঠেনি বরং ১৯৭৫ সালের পটপরিবর্তনের পরে নানাভাবে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস যেভাবে বিকৃত করা হয়েছে বা ভুলে যাওয়ার বা ভুলিয়ে দেবার চেষ্টা করা হয়েছে, তার বিপরীতে ‘যেনো ভুলে না যাই’ স্বরটি প্রতিষ্ঠিত করতে পারাই হচ্ছে এই প্রামাণ্যচিত্রটির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অর্জন। প্রত্যেকটি এপিসোডের মধ্যেই একটি সম্পূর্ণ প্রামাণ্যচিত্র হয়ে উঠবার সম্ভাবনা রয়েছে। মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে সামগ্রিক বিস্মৃতির বিরুদ্ধে এই প্রামাণ্যচিত্রটি একটি দলিল- স্মৃতির এবং আত্ম-পরিচয়ের কাছে ফিরে আসার এবং প্রয়োজনে নির্মাণ করার। এই মহাকাব্যিক দলিলটি আমাদের প্রিয় সংগ্রহ হয়ে উঠুক।

ড. কাবেরী গায়েন, অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪১ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬২ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩০ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯০ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৫ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ