আজ শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪

Advertise

এমপিও ভুক্ত শিক্ষকদের বাদ দিয়েই পে-স্কেল এবং গাঁধার ঘোলা জল পান

অসীম চক্রবর্তী  

৮ম জাতীয় বেতন কাঠামোর গেজেট প্রকাশ করা হয়েছে। টাইমস্কেল ও সিলেকশন গ্রেড বাদ দেওয়া হয়েছে। এবারের এই বেতন কাঠামোতে সর্বোচ্চ বেতন নির্ধারণ করা হয়েছে পঁচাত্তর হাজার এবং সর্বনিম্ন আট হাজার দুইশ বাহান্ন।

অনেক পরীক্ষা নিরীক্ষা করে এই গেজেট প্রকাশ করতে একটু বেশি সময় ব্যয় হয়েছে।  ১৫ হাজার কোটি টাকা অতিরিক্ত ব্যয় করা  এবারের বেতন কাঠামোতে সরকারি চাকরিজীবীরা খুশি হবেন বলে আশা প্রকাশ করেন অর্থমন্ত্রী
নতুন এই বেতন কাঠামোর চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গেজেট আকারে প্রকাশ পায় গত পনের ডিসেম্বর বাংলাদেশের সময় সন্ধ্যায়।  গেজেটে বলা হয় সরকারী কর্মকর্তা কর্মচারীরা ২০১৫ সালের জুলাই মাস থেকে বকেয়া সহ বর্ধিত বেতনের সুফল ভোগ করা শুরু করবেন আগামী বছরের এক তারিখ থেকে। দেশের ১৬ লক্ষ সরকারী কর্মকর্তা কর্মচারী এবং পাঁচ লক্ষ এমপিও ভুক্ত (বেসরকারি কলেজ, বিদ্যালয় এবং মাদ্রাসা) শিক্ষক সহ মোট একুশ লক্ষ পরিবার উদগ্রীব হয়ে তাকিয়ে ছিলো অনলাইন এবং অফলাইনের পত্রিকার পাতায়।  

সরকারী সিদ্ধান্ত অনুযায়ী যাতে বাংলাদেশের একুশ লক্ষ পরিবার একসাথে নতুন বেতন কাঠামোর সুসংবাদে উৎসবের আমেজে বিজয় দিবস উদযাপন করতে পারে তাই জন্যই চূড়ান্ত গেজেট ১৫ই ডিসেম্বর প্রকাশ করা হয়।  যাহা নিঃসন্দেহে একটি প্রশংসনীয় উদ্যাগ ছিলো।  কিন্তু বিধি এবারও বাম।  ভ্যাট আন্দোলন সহ আগের অনেক ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটিয়ে  এবারও অজানা কারণে জল ঘোলাই হলো এবং হয়ত সরকারকে ঘোলা জলই পান করতে হবে।  আর এই জল ঘোলার কারণ পাঁচ লক্ষ এমপিও ভুক্ত শিক্ষকদের নতুন বেতন কাঠামো নিয়ে কুহেলিকা ময় পরিস্থিতি।  

এবার একটু দেখে নেই এই জল ঘোলা হওয়ার নেপথ্যের কারণ কি।  গত সেপ্টেম্বর মাসে অর্থমন্ত্রনালয় থেকে ঘোষণা দেওয়া হলো  সরকার এমপিও ভুক্ত শিক্ষকদের বেতন বৃদ্ধির বিষয়ে একটি কমিটি তৈরি করেছে এবং এই কমিটির প্রতিবেদনের সাপেক্ষে শীঘ্রই  ১৬ লক্ষ সরকারী চাকুরীজীবীদের সাথে বাকি ৫লক্ষ শিক্ষকদের বিষয়ে এক সাথে গেজেট প্রকাশ করবে।  

কিন্তু  অদৃশ্য এক কারণে ঘোষিত বেতন বৃদ্ধির গেজেটে এখনো স্থান পায়নি ৫লক্ষ এমপিও ভুক্ত কলেজ, মাদ্রাসা এবং বেসরকারি হাইস্কুল শিক্ষকেরা। পর্যালোচনার নাম করে বিমাতা সুলভ আচরণ করা হয়েছে এই পাঁচ লক্ষ পরিবারের সাথে।  নয় নাম্বারের সেকশনে এমপিও ভুক্তদের বেতন কাঠামো ঘোষণা করলেও ১৬ লক্ষ সরকারী চাকুরীজীবীদের সাথে তারা আগামী মাস থেকে নতুন স্কেলে বেতন পাচ্ছেন না।  গত চার  মাস ধরে  পর্যালোচনা করেও এখনো  এর কোনো  সুহারা করতে পারেনি অর্থমন্ত্রনালয়।  

বর্তমানে এমপিও ভুক্ত শিক্ষকরা প্রতিমাসে  বাড়িভাড়া বাবদ ৩০০ টাকা এবং চিকিৎসা ভাতা বাবদ ৫০০ টাকা পেয়ে থাকেন।  বাস্তবের সাথে যার কোনো মিল নেই।  দুর্মূল্যের বাজারে ৩০০ টাকা দিয়ে যেখানে একটা সেন্ডু গেঞ্জিও পাওয়া যায়না সেই বাজারে ৩০০ টাকা দিয়ে যদি একজন শিক্ষককে তার দুই বাচ্চা এবং স্ত্রী নিয়ে বাসা ভাড়া করে  থাকতে বলে হয় তবে পাগলের প্রলাপ ছাড়া কিছুই নয়।  


তো যা বলছিলাম প্রাথমিক পর্যায়ে অর্থমন্ত্রী  সিদ্ধান্ত নিলেন  সকল এমপিও ভুক্ত প্রতিষ্ঠানের তহবিল অধিগ্রহণ করা হবে এবং অধিগ্রহণ করা হয়ে গেলে এবং তবে এক্ষেত্রে একটি পর্যালোচনা করা হবে। পর্যালোচনা হবে মূলত কোন কোন প্রতিষ্ঠান সরকারের নিয়মনীতি অনুসরণ করছে। তবে নতুন পে-স্কেল বাস্তবায়নের বিষয়টি দেখবে অর্থ মন্ত্রণালয় এবং তার পরেই  শিক্ষকদের নতুন বেতন কাঠামোয় অন্তর্ভুক্ত করবেন।  যেখানে বাড়ি ভাড়া ভাতা বাড়িয়ে বেসিকের  ৪০% করা হবে এবং উপযুক্ত চিকিৎসা ভাতার ও বন্দোবস্ত করবেন। কিন্তু এই বিষয়ে  গত ছয়মাসে অর্থমন্ত্রনালয়ের   কোনো পদক্ষেপ নজরে আসেনি।  কিন্তু এখন নতুন বেতন কাঠামোর আংশিক প্রকাশ করে পর্যালোচনার নামে কেনইবা এমপিও ভুক্ত শিক্ষকদের  ঝুলিয়ে রেখেছেন অথবা জল ঘোলা করছেন সেটা আসলেই বোধগম্য নয়।

আমরা মুখে মুখে বলি শিক্ষক সমাজের সম্মানিত ব্যক্তি, মানুষ গড়ার কারিগর ইত্যাদি।  কিন্তু একজন শিক্ষকের সন্তান হিসাবে খুব কাছে থেকে দেখেছি বাংলাদেশের প্রাথমিক এবং মাধ্যমিক শিক্ষকদের জীবন সংগ্রাম কতো কঠিন এবং কতোটা ভয়াবহ।  শিক্ষকদের এই কঠিন জীবন যাত্রা চলে আসছে অনেক দিন আগে থেকেই।  এবং তার পরেও কিছু মানুষ হাসি মুখে এই পেশাকে বেছে নেয় সমাজে শিক্ষার আলো ছড়ানোর জন্যে।  

আজকের এই ২০১৫ সালে একজন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক ঈদ বোনাস পান বেতনের ২৫% যা সর্বসাকুল্যে গড়ে ২২শ থেকে ২৫শ।  এবার আসুন একটি পাটি গাণিতিক সমাধান করি।  যদি একজন  শিক্ষকের পরিবারে দুটি সন্তান স্ত্রী এবং বৃদ্ধ পিতামাতা থাকেন তবে এই ২২শ টাকায় কি খুবই নগণ্য ভাবেও ঈদ সংক্রান্ত  ব্যয় সংকুলান সম্ভব ? একজন গণিতের ছাত্র  হিসাবে আমার এই পাটিগণিতের সমাধান জানা নেই।  

এবার আসি পেনশন বিষয়ে।  কোথাও পড়েছিলাম   অর্থমন্ত্রনালয় থেকে বলা হয়েছে আমাদের সম্মানিত অবসর প্রাপ্ত শিক্ষকেরা তাদের পেনশনের টাকা কোনো ঝামেলা ছাড়াই পেয়ে যাবেন। চেক নাকি অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষকদের পেছনে ঘুরে বেড়াবে।  কিন্তু বাস্তব চিত্র একেবারেই ভিন্ন।  সারা জীবন শিক্ষকতার মতো মহৎ পেশায় নিয়োজিত থাকা এই সব শিক্ষকদের পেনশনের চেকের জন্য ধরনা দিতে দিতে প্রতি মাসে ক্ষয় হয়ে যায় চপ্পলের তলা। মাসের পর মাস বছরের পর বছর যায়।  বৃদ্ধ অবসর প্রাপ্ত অনেক শিক্ষক অবসরের পাঁচ বছর পরে মারা গেছেন কিন্তু পেনশনের চেক এসে পৌঁছায়নি একাউন্টে।  এটাই কি তবে একজন মানুষ গড়ার কারিগরের পুরস্কার?


একজন ক্ষুদ্র মানুষ হিসাবে আমি বুঝতে পারিনা এমপিও ভুক্ত ৫লক্ষ শিক্ষককে অন্ধকারে রেখে নতুন বেতন কাঠামো ঘোষণা করে আমাদের অর্থমন্ত্রনালয় এবং মাননীয় অর্থমন্ত্রী কতটুকু আনন্দ উদযাপন করতে পেরেছেন ? যদিও আনন্দ উদযাপন করে থাকেন তবে সেটা পৈশাচিক  অমানবিক, এবং অবিবেচক সিদ্ধান্ত হয়েছে বলেই মনে করি।

বিগত দিনে আমরা দেখেছি বেসরকারি শিক্ষকদের এমপিও নিয়ে হাজার জটিলতা।  ব্যক্তিগত ভাবে অনেক শিক্ষককে দেখেছি পাঁচ ছয় বছর অবৈতনিক শিক্ষকতা করে তার পরে এমপিও ভুক্ত হয়েছেন।  কিন্তু এই সরকারের আমলে নতুন শিক্ষকদের এমপিও ভুক্তি মূলক সমস্যার সমাধান হয়েছে যা অবশ্যই প্রসংশনীয়।  

তবে এই মুহূর্তে যে বিষয়টা প্রকট আকার ধারণ করেছে তা হলো ইদানীং মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ ছাড়া কোনো সমস্যার সমাধান হচ্ছে না।  যা মন্ত্রীপরিষদ এবং জড়িত উচ্চ কর্মকর্তা দের জন্য লজ্জাকর  বলেই মনে করি।  

এইতো কিছুদিন আগেই  বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভ্যাট আন্দোলন থেকে শুরু করে সাংবাদিক প্রবীর সর্দারের গ্রেফতার সহ নানা ধরনের ঘোলা করা জল কেনো প্রধানমন্ত্রীকে পরিষ্কার করতে হবে ? কেনো দায়িত্বশীলদের অর্বাচীন সিদ্ধান্ত দেশের মানুষদের আন্দোলনের দিকে ধাবিত করে।  দেশের প্রধানমন্ত্রী হচ্ছেন দেশের অভিভাবক।  উনার কর্মপরিধি ব্যাপক। হাজারো গুরুত্বপূর্ণ কর্মভারের মধ্যে এই সব ছোটখাটো বিষয়ে কেনো উনাকেই সিদ্ধান্ত দিতে হবে এটা আমার ক্ষুদ্র মস্তিষ্কে ধরে না।  

তবে পরিশেষে যে কথা বলবো তা হলো এই দেশে শিক্ষকরাই হচ্ছে আমাদের আগামী গড়ার কারিগর।  এদের হাত ধরেই তৈরি হবে আগামীর বঙ্গবন্ধু কিংবা শেখ হাসিনা। এদের হাত ধরেই তৈরি হবে আগামী নেতৃত্ব। মানসিক ভাবে অতৃপ্তিতে  থাকা একজন মানুষ কিভাবে সৃষ্টি করবে নৈতিক এবং আদর্শবান আগামী ? পাঁচ লক্ষ শিক্ষককে বঞ্চিত করে, অর্থনৈতিক এবং মানসিক অতৃপ্তিতে রেখে শিক্ষার  উন্নয়ন কখনই সম্ভব নয়। এমপিও ভুক্ত শিক্ষকদের বেতন কাঠামো সংক্রান্ত ধোঁয়াশার জাল উন্মোচন করে এর পাঁচ লক্ষ পরিবারকেও নতুন বেতন কাঠামোর আনন্দ উদযাপনে সামিল করুন।


অসীম চক্রবর্তী, যুক্তরাজ্য প্রবাসী লেখক

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪১ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬৩ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩১ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯০ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৬ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ