আজ বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ, ২০২৪

Advertise

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতিরোধে আইন প্রয়োজন

ড. শাখাওয়াৎ নয়ন  

কেউ যদি এখন পানি ঘোলা করার জন্য প্রশ্ন তোলে, ‘কারবালায়, বদরের যুদ্ধে এবং ওহুদের যুদ্ধে শহীদের সংখ্যা কত ছিল? সর্বজনবিদিত একটি উত্তর দেয়ার পরেও যদি সে বলে ‘এই সংখ্যা নিয়ে বিতর্ক আছে’; আপনি যদি বলেন, ‘বিতর্ক কিসের?’ সে বলবে ‘শহীদদের নাম-ঠিকানাসহ তালিকা দেখাতে হবে’ তাহলে আপনি কি করবেন? কারবালায়, বদরের যুদ্ধে এবং ওহুদের যুদ্ধে শহীদদের নাম-ঠিকানা কোথায় পাবেন? আপনি তাদের নাম-ঠিকানাসহ তালিকা দেখাতে পারবেন না; দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ইউরোপে ৫০ লাখ মানুষ নিহত হয়েছে (পাঁচ মিলিয়ন)। এটা ইতিহাস। এটাই সর্বজন জানে এবং মানে। কিন্তু এখন যদি কেউ সেই ৫০ লাখ মানুষের সংখ্যা নিয়ে সন্দেহ পোষণ করে? যদি বলে নাম-ধামসহ তালিকা দেখতে হবে, কেউ দিতে পারবে না। অনেকেই আবার বলা শুরু করছে,শহীদদের সঠিক সংখ্যাটি জানা দরকার; কম বেশি হলেও ক্ষতি নেই। তাদের উদ্দেশ্যে বলছি, দুনিয়ার ইতিহাস সম্পর্কে আর একটু পড়াশুনা করুন; তাহলেই জানতে পারবেন। একটা বিরাট গণযুদ্ধে হতাহতের সংখ্যা নাম-ধাম দিয়ে পৃথিবীর কোথাও নির্ধারণ করা হয় না, কিংবা নির্ধারণ করা যায় না।

বহুদিন থেকেই জামাতীরা মুক্তিযুদ্ধকে 'চুক্তিযুদ্ধ' বলে আসছে; আমাদের জাতীয় সঙ্গীতকে ব্যঙ্গ করে জামাতীরা গায় ‘আমার সোনার গামলা’; সাকা চৌধুরী এবং ডক্টর আফতাব বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত পরিবর্তনের কথা বলেছিল। স্বাধীনতার ঘোষণা নিয়ে বিএনপি মিথ্যা প্রচারণা করে আসছে সেই ১৯৯১ সাল থেকে; জামায়াত এবং বিএনপি এক সময় বলেছিল,’বাংলাদেশে কোনো যুদ্ধাপরাধী নেই, ছিলনা’।

গত ১৬ ডিসেম্বর চিটাগাঙে জামায়াত শিবির মিছিল করেছে 'স্বাধীনতা এনেছি, স্বাধীনতা রাখবো' বলে; বাংলাদেশের রেডিও টেলিভিশনে 'রাজাকার, আল-বদর' জাতীয় শব্দ এক সময় উচ্চারণ করা নিষিদ্ধ ছিল; ২৬ মার্চ, ১৪ ডিসেম্বর, ১৬ ডিসেম্বর এলে তারা বলতো কিছু ‘গাদ্দার’, পাকিস্তানী শব্দটি বাদ দিয়ে শুধু মাত্র ‘হানাদার বাহিনী’ উচ্চারণ করতো; ‘বঙ্গবন্ধু নাকি স্বাধীনতা চান নি’; এরকম নানা রকম মিথ্যাবচন, মাইক লাগিয়ে চিৎকার করে করে বাংলার মাটিতেই বলা হয়েছে, এখনো হচ্ছে।

গত বছর থেকে লক্ষ্য করছি, বিএনপি’র ত্যাগী নেতা (দেশ) তারেক রহমান লন্ডনে বসে ইতিহাস বিকৃতির প্রকল্প পরিচালনা করছেন। কিছু দিন আগে বিএনপির কতিপয় নেতারা হঠাৎ করেই মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বেশ কিছু বিবৃতি দিয়েছেন (হান্নান শাহ,খালেদা জিয়া);কিন্তু কুকুরের লেজ কি সোজা জিনিস? খালেদা জিয়া এবার নিজ মুখে বললেন, মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ শহীদের সংখ্যা নিয়ে বিতর্ক আছে। ১৬ ডিসেম্বর ফরহাদ মজহারের ফেইসবুক স্ট্যাটাস দেখে আমার একটু সন্দেহ হয়েছিল; ভাবতেছিলাম ‘আবার কিছু একটা আসিতেছে’। হ্যাঁ, একটু বিলম্বে হলেও চলে এসেছে। বাঙ্গালী জাতির সবচেয়ে মহত্তম অর্জন মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীনতা; দক্ষিণ এশিয়ায় একমাত্র জাতিরাষ্ট্র বাংলাদেশ; পাঞ্জাবীরা যা পারে নাই, শিখরা যা পারে নাই; বাঙ্গালীরা তা পেরেছে। বাংলাদেশের হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ সন্তান মুক্তিযুদ্ধে শহীদ সন্তানেরা, সেই শহীদদেরকে নিয়ে অপরাজনীতি করার চেষ্টা করা হচ্ছে; মুক্তিযুদ্ধকে বিতর্কিত করার অপচেষ্টা অনেক দিন ধরেই চলছে; কিন্তু তাদের এই খায়েশ কোনো দিন সফল হবে না। এই সাধারণ বুদ্ধিটুকু যাদের নেই; তারা এসেছে রাজনীতি করতে(!)।

হঠাৎ করে বেগম খালেদা জিয়ার বাংলাদেশের ৩০ লাখ শহীদের সঠিক সংখ্যা নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টির প্রয়োজন পড়লো কেন? খালেদা জিয়ার কথার সাথে পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিবৃতির খানিকটা মিল আছে কি না দেখা যাক; পাকিস্তান বলেছে, ১৯৭১ সালে তারা বাংলাদেশে কোনো যুদ্ধাপরাধ করেনি; গণহত্যা করেনি; বাংলাদেশে বিএনপি-জামায়াত দাবি করে, বাংলাদেশে কোনো যুদ্ধাপরাধী নেই, তারা যুদ্ধাপরাধ করেনি। দেখুন কথার কত মিল (!); খালেদা জিয়া কার জন্য, কাদের স্বার্থে এসব বলছেন? এটা কি আরো পরিষ্কার করে বলতে হবে? ৩০ লাখ শহীদদের সংখ্যা নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি করাটা কি পাকিস্তানের পক্ষে সাফাই গাওয়ার সামিল নয়?

বিএনপি-জামায়াতের আসল উদ্দেশ্য হচ্ছে, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে বিতর্কিত করা। পাকিস্তানের উদ্দেশ্য তাই। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের মধ্যে মিথ্যা ঢুকিয়ে বিকৃত ইতিহাস উৎপাদন ও উন্নয়ন করা। জিয়াউর রহমানও এক সময় বাংলাদেশ থেকে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস মুছে ফেলার চেষ্টা করেছিলেন; তিনি সোহরাওয়ারদী উদ্যান থেকে স্বাধীনতার সকল স্মৃতি চিহ্ন মুছে দিয়ে সেখানে শিশু পার্ক নির্মাণ করেছিলেন, বনজ গাছ-পালা লাগিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু লাভ হয় নাই। ইতিহাস মোছা যায় না, এটাও ইতিহাসের শিক্ষা। সেই শিক্ষা খালেদা জিয়ার হয় নাই; মুক্তিযুদ্ধকে বিতর্কিত করতে পারলে লাভ হবে জামায়াতীদের, বিএনপি'র কোনো লাভ হবে না; এই সহজ হিসেবটি খালেদা জিয়া কিংবা তার পুত্র তারেক কেউই বুঝতে পারছে না? তা কি করে হয়? নাকি ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা অন্য কিছু? জামায়াতকে নিষিদ্ধ করা হলে জামায়াতের সকল রাজনৈতিক এজেন্ডা বিএনপি গ্রহণ করবে? লক্ষণ কিন্তু সেরকমই মনে হচ্ছে। ইতোমধ্যেই, বিএনপি জামায়াতের ভাষায় কথা বলছে; তাই ২০১৩ সালের ১২ ফেব্রুয়ারির পর থেকে বহুল প্রচারিত অনলাইন ভিত্তিক স্যাটায়ার ম্যাগাজিন ‘মতিকন্ঠ’, ‘মগবাজারডটকম’ খালেদা জিয়াকে ‘বৃহত্তর জামায়াত ইসলামীর বিএনপি শাখার মহিলা আমীর’ হিসেবে সম্বোধন করছে।

৪৪ বছর পরে খালেদা জিয়া এখন জামাতীদের পুরোপুরি মুখপাত্র (ভারপ্রাপ্ত নয়) হয়ে ৩০ লাখ শহীদদের সংখ্যা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন;এ রকম প্রশ্ন তাদের পক্ষেই করা সম্ভব, মুক্তিযুদ্ধে যাদের কোনো আপনজন শহীদ হয় নাই। মুক্তিযুদ্ধকালীন খালেদা জিয়ার অবস্থান সম্পর্কে কম বেশী আমরা সবাই জানি। জিয়াউর রহমান ঢাকা সেনানিবাস থেকে খালেদা জিয়াকে উদ্ধার করে নিয়ে যাবার জন্য মেজর হাফিজকে পাঠিয়েছিলেন; কিন্তু খালেদা জিয়া যান নি। কেন গেলেন না? এসব নিয়েও অনেকের মধ্যে বিতর্ক আছে। একজন সুন্দরী বাঙালি নারী মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানী সেনা অফিসারদের কাছেই থাকতে চাইলেন কেন? তিনি সুযোগ পেয়েও স্বামীর কাছে গেলেন না কেন? এই প্রশ্নের নানা রকম উত্তর এখন বাংলার মানুষের মুখে মুখে উচ্চারিত হচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধে মহান শহীদদের সংখ্যা নিয়ে খালেদা জিয়া যে বিতর্ক তৈরির অপচেষ্টা করেছেন, তাতে খুব একটা সুবিধা করতে পারবেন না। কারণ তার ছেলে অনেক চেষ্টা করেছে, সুবিধা করতে পারেনি। দু’দিনের মধ্যেই ইস্যুটা হারিয়ে যাবে।বরং খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত জীবনের নানা রকম ঘটনা নিয়ে মানুষের মধ্যে মুখরোচক গল্প-গুজব রটবে। যারা তাকে ইতিহাস বিকৃতির জন্য এসব কুবুদ্ধি-কুপরামর্শ দিচ্ছে, তারা কার এজেন্ট? একটু ভালো করে খোঁজ নেয়া উচিৎ।

পাদটীকা: বাংলাদেশে কি এমন একজন আইনজীবীও নেই, যিনি মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতিরোধ, স্মৃতিস্তম্ভ ও দলিল প্রমাণাদি রক্ষায় হাইকোর্টে একটি রিট পিটিশন করতে পারেন? কিংবা বাংলাদেশের হাইকোর্ট কি স্বপ্রণোদিত হয়ে খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে সুয়োমটো রুলনিশি জারী করতে পারে না? সরকারের কাছে আবেদন জানাচ্ছি, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতিরোধে কঠোর আইন প্রণয়ন করুন। প্রয়োজনে সংবিধানে নতুন ধারা সংযোজন করুন। সরকার পরিবর্তনের সাথে সাথে যাতে গণমাধ্যমে, কোমলমতি ছেলে-মেয়েদের পাঠ্য বইয়ে আর মিথ্যা, বানোয়াট, বিকৃত ইতিহাস স্থান না পায়।

ড. শাখাওয়াৎ নয়ন, কথাসাহিত্যিক; একাডেমিক, ইউনিভার্সিটি অফ নিউ সাউথ ওয়েলস, অস্ট্রেলিয়া। ইমেইল: [email protected]

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪১ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬২ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ১৯ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩০ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৮৯ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৫ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ