আজ শনিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০২৪

Advertise

‘দ্যাশ স্বাধীন হয়ে কি লাভ হইলো কিংবা কি পাইলাম’ প্রশ্ন এবং প্রশ্নকর্তাদের ব্যবচ্ছেদ

আজম খান  

বাংলাদেশে সবচাইতে বহুল উচ্চারিত বাক্যগুলোর একটা হচ্ছে, দ্যাশটা স্বাধীন হয়ে কি লাভ হইলো কিংবা দেশটা স্বাধীন হয়ে কি পাইলাম? এই কি লাভ হইলো, আর কি পাইলাম প্রশ্নকর্তারা আরো কিছু বাক্য উচ্চারণ করেন। প্রসঙ্গের মূলে যাওয়ার আগে সেসবের অবতারণা সঙ্গত কারণে নীচে করা হলো-

ইশ, পাকিস্তান নামের মুসলমান দেশটা কেন যে ভাইঙ্গা গেলো। উত্তেজনার সময়ে মানুষ কত কিছু কইরা ফালায়। বুঝলাম, অনেক মানুষ মারছে পশ্চিম পাকিস্তানীরা। তাই বইলা মুসলমান দেশটা এইভাবে ভাইঙ্গা ফেলতে হইবো? একসাথে থাকলে আজকে কি সীমান্তে বিএসএফ এইভাবে হত্যাকাণ্ড ঘটাতে পারে? ভারত পারমানবিক বোমার ভয়ে আমাদের মুসলমানদের কাছে সকাল-বিকাল আইসা কদমবুচি করতো।

আরে ভাই, সারাক্ষণ পাকিস্তানীরা আমাদের সাথে একাত্তরে এইটা করছে, ঐটা করছে করেন ক্যান? আমেরিকানরা কি ব্রিটিশদের থেকে স্বাধীন হয় নাই? সৌদি আরব স্বাধীন হয় নাই তুরস্কের কাছ থেকে? তারা তো একে অপরকে ঘেন্না করে না। আপনেরা এত ঘেন্না নিয়ে বাঁচেন ক্যামনে, ভাই?

বুঝলাম, জামাত একাত্তরে খারাপ কাজ করছে। কিন্তু এখন যারা জামাত করে তারা তো আর একাত্তরে ছিল না। তাদের আদর্শ, চিন্তাধারা ভুল হইলে নিষিদ্ধ না করে রাজনৈতিকভাবে মোকাবেলা করুন।

আরে, শেখ সাব তো সবাইরে মাপ কইরা দিছিলেন। এতদিন পরে এই যুদ্ধাপরাধ বিচার আসলে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা। ইসলামের কথা বলে যেসব নেতা তাদের ফাঁসি দিয়ে এই দেশের ইসলামি আন্দোলনকে শেষ করে দেয়ার চক্রান্ত।

কাদের মোল্লা, নিজামী, কামারুজ্জামান, গোলাম আযম, সাঈদী হুজুরেরা যদি এতই দোষ করে থাকে তাইলে এত বছর পার হইলো কেউ বিচার করলো না ক্যান?

বিচার-ফিচার কিছু না। আওয়ামী লীগেও তো কত কত রাজাকার আছে। কই তাদের তো কাউরে ধরে না। আসলে এইটা দেশের বড় বড় যত আলেম আছে সবাইরে ফাঁসি দিয়া বাংলাদেশের মাটি হতে ইসলামকে উৎখাত করার ষড়যন্ত্র।

জামাতের সাথে জোট করার কারণে বিএনপিকে এত গাইলান কেন? বিএনপিতেও তো অনেক মুক্তিযোদ্ধা আছে।

আমরা বাঙালি হমু কেন? আমরা মুসলমান। বাঙালি হইলো হিন্দুয়ানী জাত।

পহেলা বৈশাখ, একুশে ফেব্রুয়ারি, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস পালন করা হারাম। নাভি দেখায়া শাড়ি পরে বেহায়া মেয়েরা সব নির্লজ্জ হয়ে উলঙ্গ হয়ে ঘুরে, কপালে সিঁদুরের মত কইরা টিপ দেয়।

কি? ব্লগার মরছে? নাস্তিক মরছে? শাবাস, মর্দে মুজাহিদের দল। নাস্তিকরা হচ্ছে জাহান্নামের কীট। শাহজালাল, শাহপরান, বারো আউলিয়ার দেশে গৌড় গোবিন্দের প্রেতাত্মাদের আনাগোনা সহ্য করা হবে না।

কি? মসজিদে বোমা হামলা করছে? পুলিশ মারছে? নামাজরত অবস্থায় মুসল্লি মারা গেছে? ইহুদী-নাসারাদের ষড়যন্ত্র সব এইগুলান। ইসলামকে হেয় করাই এর উদ্দেশ্য।

এই "দ্যাশটা স্বাধীন হয়ে কি লাভ হইলো কিংবা কি পাইলাম" প্রশ্ন কর্তারা আসলেই দেশ স্বাধীন হওয়াতে কি পেয়েছেন তা আমি জানি না। তবে তারা দেশকে কি দিয়েছেন সেটা আমি জানি। আসুন দেখে নেই তারা এখন পর্যন্ত স্বাধীন দেশকে কি কি দিয়েছেন-

আসলে এক হাতে তালি বাজে না। গণ্ডগোলের বছরে ভারত এবং এই দেশের হিন্দুদের তালে পইড়া আমরাও কিছুটা বাড়াবাড়ি করছি। নাইলে কেউ হুদাই এতগুলা মানুষ মারে নাকি। আরে ভাই, পাকিস্তানিরা মুসলমান, আমরাও মুসলমান।

অমুক বনাম পাকিস্তানের ম্যাচ দেখতে স্টেডিয়ামে এসেছি কেন? গালে পাকিস্তানের পতাকা এঁকেছি কেন? কারণ পাকিস্তান একটি মুসলমানদের দেশ। একজন মুসলমান হিসেবে ঈমানী কর্তব্য পাকিস্তানকে সমর্থন করা।

ইশ, পাকিস্তান নামের মুসলমান দেশটা কেন যে ভাইঙ্গা গেলো। উত্তেজনার সময়ে মানুষ কত কিছু কইরা ফালায়। ভাইয়ে-ভাইয়ে ঝগড়া হয় না? ভাই-ভাই আলাদা হয় না? তাই বইলা কি ভাই ভাইরে ঘৃণা করবে? দূরে সরায়ে দিবে?

বুঝলাম অনেক মানুষ মারছে পশ্চিম পাকিস্তানীরা। তাই বইলা মুসলমান দেশটা এইভাবে ভাইঙ্গা ফেলতে হইবো? একসাথে থাকলে আজকে কি সীমান্তে বিএসএফ এইভাবে হত্যাকাণ্ড ঘটাতে পারে? পারমানবিক বোমার ভয়ে সকাল-বিকাল কদমবুচি করতো।

"ধর্মনিরপেক্ষতা" আবার কি? এইগুলান যারা বলে তারা নাস্তিক-কাফের-মুরতাদ। মুসলমানের দেশে শরিয়তি আইন চাই।

দ্যাশে ইসলাম নাই বলেই কোন উন্নতি হইলো না। সকল ইমানদার ভাইয়েরা বাদ জুমা বায়তুল মোকাররমের সামনে থেকে মিছিলে যোগ দিন। দ্যাশকে উন্নয়নের চূড়ায় নেয়ার লড়াইয়ে লক্ষ ইসলামপ্রিয় জনতা বজ্র হুংকার দিয়ে স্লোগান দিব- আমরা হবো তালেবান, বাংলা হবে আফগান।

১৯৭১ এ কী হইছে সেইসব ভুইলা গিয়ে আমাদের সামনে বাড়তে হবে। কী এক মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধ, একাত্তর, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, ভাঙ্গা রেকর্ড বাজাইতেছেন।

৩০ লাখ তো আসলে মরে নাই। মরছে ৩ লাখ। শেখ মুজিব ৩ লাখ বলতে গিয়া ভুলে ৩০ লাখ বইলা ফেলছিল। আর যেই ৩ লাখ মারা গেছে তারা সব হিন্দু। মুসলমান হয়া পাকিস্তান সেনাবাহিনী মুসলমান মারবো কোন দুঃখে।

মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বইলা আসলে কিছু নাই। ঐটা বাংলাদেশকে "সিকিম" বানানোর লক্ষ্যে ভারতের ষড়যন্ত্র। সিকিম মানে বুঝছেন তো? মানে তাঁবেদার রাষ্ট্র আর কি। গোলাম বানায়ে রাখতে চায়।

একাত্তরে যেসব বুদ্ধিজীবী মারা গেছেন তারা আসলে নির্বোধ ছিলেন।

একাত্তরে যেসব বুদ্ধিজীবী মারা গেছেন তারা পাকিস্তান সরকার থেকে বেতন নিতেন। দেশ স্বাধীন হইবো বলে বিশ্বাস করেন নাই। তাই পালায়ে যান নাই। ঘরে থাইকা খুন হয়ে গেলেন।

এই "দ্যাশ স্বাধীন হয়ে কি পাইলাম কিংবা কি লাভ হইলো" প্রশ্ন করা মানুষেরা এই মুহূর্তে আমাদের দেশে প্রচুর। উনারা স্বাধীনতার সুফল পাওয়া, না পাওয়া, বঞ্চনার হিসেব কষেন কিন্তু যাদের জীবনের বিনিময়ে, আত্মত্যাগের বিনিময়ে এই স্বাধীনতা এসেছে তাদের সংখ্যা নিয়ে সন্দেহ পোষণ করে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর অপরাধকে খাটো করে দেখাতে চান। শহীদ বুদ্ধিজীবীদের অসম্মান করে তারা পরম আনন্দ নিয়ে "নির্বোধ" বলেন। আরো বলে থাকেন, শহীদ বুদ্ধিজীবীরা নাকি বাংলাদেশ স্বাধীন হবে তা চান নাই। মুক্তিযুদ্ধকে অনায়াসে, অবলীলায় ভারতের পাকিস্তানকে দুই টুকরো করার প্রয়াস মনে করেন।

একটা মানুষের কাছে তার জীবনের চাইতে মূল্যবান আর কিছু হতে পারে না। জননী-জায়া-পুত্র-কন্যার সাথে বেঁচে থাকার আনন্দ উপেক্ষা করা যে কোন সময়ের বিচারে পৃথিবীর সবচাইতে কঠিনতম কাজ। আমাদের বুদ্ধিজীবীরা, ৩০ লাখ মানুষ খুন হয়ে নিজ পিতামাতা'কে সন্তান হারা করে, স্ত্রী'কে বিধবা করে, সন্তানদের এতিম করেও প্রমাণ করতে পারেন নাই তারা খুন হয়েছেন। হাসিমুখে নিশ্চিত মৃত্যুর দিকে এগিয়ে গিয়েও প্রমাণ করতে পারেন নাই তারা এই দেশের স্বাধীনতা অর্জনের জন্য নিজেদের জীবনকে দান করেছেন। এতটাই দুর্ভাগা সেইসব মানুষেরা।

সুপ্রিয় পাঠক, এখন আপনারাই বলুন যারা বলে থাকে "দ্যাশ স্বাধীন হয়ে কি পাইলাম কিংবা কি লাভ হইলো" তারা কি আসলেই এই দেশ থেকে কিছু পাওয়ার অধিকার রাখে? উচিৎ?

আজম খান, ব্লগার, অনলাইন এক্টিভিস্ট ও সংগঠক। ইমেইল: [email protected]

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪২ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬৩ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩১ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯০ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৬ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ