প্রধান সম্পাদক : কবির য়াহমদ
সহকারী সম্পাদক : নন্দলাল গোপ
টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
Advertise
রেজা ঘটক | ৩০ ডিসেম্বর, ২০১৫
আগামী শুক্রবার শুরু হবে ইংরেজি নতুন বর্ষ ২০১৬। বৃহস্পতিবার শেষ হচ্ছে ২০১৫ সাল। ঘটনাবহুল ২০১৫ সাল কেমন গেল বাংলাদেশের? কেমন গেল বিশ্ববাসীর? আর কেমন গেল সাড়ে সাতশো কোটি মানুষের?
পেট্রোল বোমা, যাত্রীবাহী চলন্ত বাসে আগুন, সন্ত্রাস, খুন, হত্যা, ধর্ষণ, মুক্তিপণ, চোরাকারবারি, দুর্নীতি, লুটপাট, দখল ইত্যাদি নানান কিসিমের নেগেটিভ ইস্যু দিয়ে শুরু হয়েছিল বাংলাদেশের ২০১৫ সাল। বছরের শুরুতে বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া নিজের পার্টি অফিসে স্বেচ্ছায় অবরুদ্ধ হয়ে যে পেট্রোল বোমা সন্ত্রাসের পায়তারা করেছিলেন, সরকার ৩ জানুয়ারি বালুর ট্রাক দিয়ে অবরোধ করে খালেদা জিয়ার সেই খায়েসকে উসকে দিয়েছিল। যার উদ্দেশ্য ছিল ৫ জানুয়ারি সরকারের এক বছর পূর্তিকে বানচাল করা।
৫ জানুয়ারি বেগম জিয়া পুলিশের বাধার মুখে পার্টি অফিস থেকে বের হতে না পেরে অনির্দিষ্টকালের অবরোধের ডাক দেন। ১৯ জানুয়ারি খালেদা জিয়া অবরোধমুক্ত হলেও পার্টি কার্যালয় থেকে বের হননি। এমনকি ২০১৫ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি, ২৬ মার্চ ও ১৬ ডিসেম্বর ভাষা শহীদ বা একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে তিনি শহীদ মিনার বা জাতীয় স্মৃতি সৌধে যাননি। শেষ পর্যন্ত টানা তিন মাস কার্যালয়ে অবস্থানের পর ৫ এপ্রিল তিনি আদালতে আত্মসমর্পণ করে জামিন নিয়ে সেদিন বিকেলে বাসায় ফেরেন। মাঝখানে ৯২টি দিন বাংলাদেশের মানুষ ছিল চরম নিরাপত্তাহীনতায়।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটের গগণ বিদারী চিৎকার বেগম খালেদা জিয়ার কানে পৌঁছায়নি। আর রাষ্ট্রীয় কোনো আইন কানুন তার এই কুকর্মের বিচারেরও কোনো ধার ধারেনি। বছর শেষ হবার আগে তিনি চিকিৎসার নামে প্রায় দুই মাস লন্ডনে কাটিয়ে বাংলাদেশ বিরোধী নতুন ষড়যন্ত্র পাকাপোক্ত করে আবার দেশে ফিরে ২২ ডিসেম্বর মহান মুক্তিযুদ্ধে ত্রিশ লাখ শহীদদের সংখ্যা নিয়ে কটূক্তি করলেন। রাষ্ট্রপক্ষ এখনও বেগম জিয়াকে গ্রেফতার করেনি বা কোনো ধরনের মামলার উদ্যোগ নেয়নি। বাংলাদেশের নিরপরাধ সাধারণ মানুষকে পেট্রোল বোমায় মেরে যে রাজনীতি করা যায়, রাজনীতিতে সচলও থাকা যায়, এই বিষয়টি ২০১৫ সালে বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠা করলেন বেগম জিয়া।
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির ভোটারবিহীন নির্বাচনকে জায়েজ করতে সরকার বাহাদুরও বেগম জিয়ার এই সকল কুকর্মকে এক ধরনের স্বেচ্ছায় হজম করে জনগণের সঙ্গে সুস্পষ্টভাবে বিশ্বাসঘাতকতা করল। যার সঙ্গে সরকারি প্রণোদনায় আরও কিছু অপরাধও বাংলাদেশে জায়েজ হয়ে গেল। সংখ্যালঘুদের উপর হামলা, তাদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেওয়া, সম্পত্তি দখল, মন্দির ভাঙচুর, হিন্দু নারীদের ধর্ষণ, জোর করে তাদের ভারতে যেতে বাধ্য করা, সারাদেশে সরকারি দলের একক আধিপত্য বিস্তারে জোরজবরদস্তিমূলক কর্মকাণ্ড, খুন, গুম, ধর্ষণ, মুক্তিপণ, চোরাকারবারি, লুটপাট, সরকারি সম্পত্তি ভাগবাটোয়ারা, দুর্নীতি, দখল, হামলা এসবকে জায়েজ করতেই সরকারি দল বেগম জিয়ার পেট্রোল সন্ত্রাসকে এক ধরনের বৈধতা দিল ২০১৫ সালে। নইলে একটি ঘটনারও কেন বিচার হবে না?
সংবাদপত্রের উপর সরকারিভাবে এক ধরনের সেন্সর জারির মাধ্যমে এসব অপকর্ম অনেকটাই গুবলেট পাকাতে চেয়েছে সরকারি দল। পাশাপাশি আইসিটি আইনের ৫৭ ধারার আওতায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যক্তির অবাধ মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে কৌশলে রুদ্ধ করার কৌশল নিয়েছে সরকার। কারো ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লাগার নামে ব্যক্তির মতপ্রকাশের স্বাধীনতায় সুস্পষ্ট হস্তক্ষেপের মাধ্যমে সরকার বাংলাদেশে সংঘটিত নানান অনিয়মকে প্রকাশ করা থেকে বিরত থাকতে অনেকটাই বাধ্য করেছে।
চলতি বছর ধর্মীয় মৌলবাদীদের হাতে চার জন ব্লগার-লেখক ও একজন প্রকাশক নিহত হয়েছেন। আরেকজন প্রকাশক ও দুইজন ব্লগার-লেখক মৌলবাদীদের হামলায় মৃত্যুর বাড়ি থেকে ঘুরে এসেছেন। সরকারিভাবে ব্লগার-লেখক-প্রকাশকদের হত্যাকারী বা তাদের কোনো সহযোগীদের এখন পর্যন্ত গ্রেফতার করা সম্ভব হয়নি। বরং ব্লগার-লেখক-প্রকাশক হত্যায় সরকারের প্রচ্ছন্ন সমর্থন লক্ষ্য করা গেছে। তবে আশার কথা, বছর শেষের দিন অর্থাৎ ৩১ ডিসেম্বর ২০১৫ তারিখে, ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে মৌলবাদীদের হাতে নিহত ব্লগার রাজীব হায়দার শোভন হত্যা মামলার রায় হতে যাচ্ছে।
মধ্যপ্রাচ্যে ইসলামিক স্টেট বা আইএস-এর সন্ত্রাসী তৎপরতার কারণে চলতি বছর গোটা মধ্যপ্রাচ্য ছিল রক্তের খেলা। সিরিয়া থেকে লাখ লাখ উদ্বাস্তু নৌপথে জীবন বাঁচাতে নানা ঘটনার জন্ম দিয়েছে। লাখ লাখ উদ্বাস্তু'র ইউরোপমুখী যাত্রায় গোটা বিশ্ব মানবিকতা এক নতুন প্রশ্নের মুখে পড়েছিল চলতি বছর। শেষ পর্যন্ত জার্মান সেই মানবিক আবেদনে সাড়া দিয়ে সিরিয়ান শরণার্থীদের সেই অনিশ্চিত ঢলকে একটা সমর্থন দিয়েছে। ইউরোপের অন্যান্য দেশ সেই মানবিক আবেদনে সাড়া দিতে অনেকটাই বাধ্য হয়েছে। পাশাপাশি চলতি বছর ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিস, বোকো-হারাম, মালির রাজধানী বামাকোর হোটেলে, চীনের জিনজিয়াংয়ে একটি কয়লা খনিতে, লেবাননের বৈরুতে সহ নানান জায়গায় সন্ত্রাসী হামলায় অনেক নিরীহ মানুষ প্রাণ হারিয়েছে।
২০১৫ সালে সারা বিশ্বে সন্ত্রাসী হামলায় মোট কত লোক প্রাণ হারিয়েছে? এই তথ্য হয়তো নতুন বছরে জানা যাবে। কিন্তু সেই সংখ্যাটি মোটেও কয়েক লাখের কম নয়। বিশ্ব নেতারা সন্ত্রাস দমনে এখন নতুন নতুন কৌশল খুঁজতে প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন। গত শতাব্দীর নব্বই দশকে সোভিয়েত সমাজতন্ত্রের পতনের পর গোটা বিশ্বের একক মোড়ল হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দীর্ঘদিন তাদের মিত্রদের সঙ্গে নিয়ে খবরদারি করে আসছিল। সিরিয়ায় আসাদ সরকারকে সমর্থন দিয়ে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন, সিরিয়ায় আইএস ও আসাদ বিরোধী জঙ্গি গোষ্ঠীর উপর সরাসরি হামলা করে চলতি বছর মার্কিন আধিপত্যকে নতুন চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছেন। যে কারণে পুতিনের কৌশলের কাছে এখন বড় মোড়লগণ একটু নড়েচড়ে বসেছেন। আইএস নিয়ে মার্কিন ও তাদের মিত্রদের ফাঁপা নাটককে পুতিন চোখে আঙুল দিয়ে বিশ্ববাসীকে দেখিয়ে দিয়েছেন, কারা সন্ত্রাস লালনপালন করে। কীভাবে করে? মধ্যপ্রাচ্যের তেল কারা কেনে? কীভাবে কেনে? আইএস জঙ্গি সন্ত্রাসীদের অর্থের উৎস, অস্ত্রের উৎস কারা?
খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ২০১৫ সালে বন্দুক হামলায় ১২ হাজারের বেশি মানুষ মারা গেছে এবং আহত হয়েছে প্রায় ২৫ হাজার। পলিটিফ্যাক্টের পরিচালিত এক জরিপে দেখা গেছে, ১৯৬৮ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত বন্দুক বা পিস্তলের গুলিতে যুক্তরাষ্ট্রে ১৪ লাখ মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে এখন কী পরিমাণ পিস্তল বা বন্দুক ব্যবহার করা হচ্ছে, তার সঠিক কোনো পরিসংখ্যান নেই। তবে ধারণা করা হয়, এই সংখ্যা প্রায় ৩০ কোটি। এই সংখ্যা যুক্তরাষ্ট্রের মোট জনসংখ্যার সমান। আর সিরিয়ায় ২০১১ সালের মার্চে গৃহযুদ্ধ শুরুর পর থেকে এ পর্যন্ত আড়াই লাখেরও বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। বাস্তুচ্যুত হয়েছে লাখ লাখ মানুষ।
বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলো মধ্যপ্রাচ্যে সন্ত্রাস লালনের এক তীর্থ ভূমি গড়ে তুলেছে। যার নেতৃত্বে রয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিগবাপ ইসরাইল। মধ্যপ্রাচ্যের আইএস বা ইসলামি স্টেট এখন ভারতীয় উপমহাদেশে আফগানিস্তান-পাকিস্তানের পর ভারত ও বাংলাদেশে তাদের নতুন ঘাঁটি করার ঘোষণা দিয়েছে চলতি বছর। ইতোমধ্যে বাংলাদেশে বিভিন্ন জায়গা থেকে গ্রেফতার হওয়া সন্ত্রাসীদের সঙ্গে আইএসের সুস্পষ্ট জড়িত থাকার খবর সরকারিভাবে অস্বীকার করা হলেও সন্ত্রাসীদের যেভাবে অর্থ ও অস্ত্রশস্ত্রে বিস্তার ঘটেছে, তা খুবই উদ্বেগের। চট্টগ্রামে গ্রেফতার হওয়া কথিত জেএমবি সদস্যদের কাছ থেকে মার্কিন নৌবাহিনী কর্তৃক ব্যবহৃত স্নাইপার এম-১১ রাইফেল পাওয়ার ঘটনা বাংলাদেশে সন্ত্রাস বিস্তারকে উদ্বেগ হিসেবেই চিহ্নিত করা যায়।
বাংলাদেশে যে কয়জন ব্লগারকে খুন করা হয়েছে, বিভিন্ন সময়ে সে সব খুনের দায় স্বীকার করেছে ইসলামিক স্টেট ভারতীয় শাখা। বাংলাদেশে কোনো আইএস-এর ঘাঁটি নেই সরকারি এই বক্তব্যের বিপরীতে সন্ত্রাসীদের বিভিন্ন আস্তানা যে আবিষ্কার হচ্ছে, এটাই নতুন উদ্বেগের কারণ। তাহলে কী ইরাক, আফগানিস্তান, সিরিয়া, লিবিয়া, পাকিস্তানের পর এবার সন্ত্রাসের নতুন ক্ষেত্র হিসাবে মোড়লদের লক্ষ্য বাংলাদেশ? আর তার সকল আয়োজন অনেকটা চূড়ান্ত করার পর্যায়ে রয়েছে বাংলাদেশ?
বাংলাদেশ কেন সন্ত্রাসীদের লক্ষ্য হবে? এই প্রশ্নের সহজ জবাব হল, বাংলাদেশের ভৌগলিক অবস্থান এবং বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সম্পদ থাকা, বাংলাদেশে সন্ত্রাস বিস্তারের সকল উপাদান বর্তমান থাকা, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা থাকা, বিচারহীনতা ইত্যাদি। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে চীন ও ভারতীয় প্রভাবকে দমানের ক্ষেত্রে বড় শক্তিগুলোর জন্য বঙ্গোপসাগরে খুবই কার্যকরী পয়েন্টে বাংলাদেশের ভৌগলিক অবস্থান। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, চীন ও ভারত এই চার পরাশক্তির জন্য বাংলাদেশের অবস্থান খুবই স্পর্শকাতর। আর পাকিস্তানের বাংলাদেশ বিরোধী তৎপরতা তো রয়েছেই। বঙ্গোপসাগর ও দক্ষিণ মহাসাগরে একক আধিপত্য বিস্তারের জন্য বাংলাদেশে এই পরাশক্তিদের যে কারো একটা সামরিক ঘাঁটি খুব সুস্পষ্টভাবেই বিবেচনাধীন। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতিতে এই চার পরাশক্তিকে কীভাবে মোকাবেলা করা হবে, সেই কৌশল ঠিক করার এখনই উপযুক্ত সময়। নইলে যে কোনো ভুলে বড় ধরনের মাশুল দিতে হবে বাংলাদেশকে।
বাইরের এসব পরাশক্তি ছাড়াও ক্ষমতা ধরে রাখা এবং ক্ষমতায় যাওয়া নিয়ে আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো গোটা বাংলাদেশকে কার্যত দুইভাগে ভাগ করেছে নীতি ও আদর্শগত অবস্থান থেকে। কোনো পক্ষই বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব প্রশ্নে এক টেবিলে আসার সুস্পষ্ট লক্ষণ নেই, যা এই চার পরাশক্তিকে বাংলাদেশ নীতিতে এক ধরনের সুযোগ করে দিচ্ছে। পাশাপাশি সেই সুযোগে বংশবিস্তার করছে সন্ত্রাসী গোষ্ঠী। আমাদের কোনো সুস্পষ্ট শিক্ষা নীতি নেই। কোনো সুস্পষ্ট স্বাস্থ্য নীতি নেই, নেই কোনো জনসংখ্যা নীতি। জনগণের সেবার নামে এক ধরনের মাস্তানিতন্ত্রই কেবল বিস্তার ঘটেছে। সুস্পষ্টভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতার যে মূল সুর ছিল, সেই মূল সুর থেকে আমাদের শাসক ও শাসন করায় আগ্রহী গোষ্ঠীগুলো দূরতম স্থানে অবস্থান করছে। ফলে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পৃথিবীর মানচিত্রে যে দেশটির আবির্ভাব, সেই বাংলাদেশকে এখন রাজনৈতিক কলহের বলিতে সার্বভৌমত্ব টেকানোর প্রশ্নে নতুন সংশয় তৈরি হয়েছে স্বাধীনতার ৪৪ বছর পর এসে। রাষ্ট্রের কোথাও সাধারণ মানুষের জীবনের কোনো নিরাপত্তা নেই। আইনের কোনো সঠিক প্রয়োগ নেই। আইন যে সবার জন্য সমান, এই কথাটি কাগজে কলমের এক ব্যারামে পরিণত হয়েছে। বাস্তবে আইনের কোনো বাস্তবায়ন নাই। জনগণের দিনদিন মধ্যে হতাশা বাড়ছে। ধনী-গরিব ব্যবধান ক্রমশ বাড়ছে। রাষ্ট্রীয় নীতিতে জনগণের কল্যাণের কথা থাকলেও বাস্তবে দলীয় লোকজনের কল্যাণ ছাড়া জনগণের দুর্ভোগের কোনো সীমা নেই।
চলতি বছর একাত্তরের মানবতা বিরোধী তিনজন যুদ্ধাপরাধীর দণ্ড কার্যকর করা হয়েছে। কিন্তু একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের যে দীর্ঘসূত্রিতা তা অনেকটা রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের আড়ালে রাষ্ট্রের অন্যান্য সমস্যাকে আড়াল করার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহারের কৌশলে শেষ পর্যন্ত এই বিচার আর কতদিন চলবে, তা নিয়েও সুস্পষ্ট সংশয় রয়েছে। কারণ যে কোনো ঘটনায় ক্ষমতার পালাবদল ঘটলে মানবতা বিরোধী যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কতদূর এগোবে তা এখনও প্রশ্নের মুখে। দেশের সার্বিক দুর্নীতি দমনে সরকারের কোনো সুস্পষ্ট দায় নেই বলে প্রতীয়মান বরং দুর্নীতি আরো মদদ পাচ্ছে সরকারি বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের ধরন ও প্রয়োগে। রাষ্ট্রের কোনো প্রতিষ্ঠানকে শক্তিশালী করার সুনির্দিষ্ট কোনো কৌশল দেখা যায় না। লুটপাট, চুরিচামারি, বিদেশে অর্থ-সম্পদ পাচার, বিদেশে সেকেন্ড হোমের স্বপ্নে বিভোর যেন গোটা রাষ্ট্রের ক্ষমতাবান মানুষগুলো। বাংলাদেশ যেন তাদের আয় রোজগারের একটা সেক্টর। বাংলাদেশের প্রতি এদের যেন কারো দায় নেই।
চলতি বছর ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের ছিটমহল সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধান হলেও সীমান্তে বিএসএফ কর্তৃক বাংলাদেশের নিরীহ মানুষ হত্যা বন্ধ হয়নি। ভারতমুখী পররাষ্ট্রনীতি'র কারণে সরকারি তরফে জোরালো প্রতিবাদও সুস্পষ্ট নয়। সীমান্তে এসব হত্যার কোনো বিচার হয়না। কেবল পতাকা বৈঠকে এক ধরনের আনুষ্ঠানিকতাকে ৪৪ বছর ধরে হজম করছে বাংলাদেশ। কিন্তু একটি হত্যারও বিচার হয়নি। চলতি বছরে ফেলানি হত্যার বিচার শুরু হলেও সেই বিচারে শেষ পর্যন্ত ভারত কী রায় দেয় সেদিকে তাকিয়ে আছে বাংলাদেশ। পার্বত্য চট্টগ্রামে নতুন করে চলতি বছরে সংখ্যালঘু নৃ-গোষ্ঠীর উপর বিজয় দিবসেও হামলার ঘটনা ঘটেছে। নতুন করে পাহাড়ে উত্তপ্ততা ছড়িয়েছে, যা নতুন বছরে আরো বৃদ্ধি পেতে পারে। ১৯৯৭ সালে পার্বত্য শান্তি চুক্তি স্বাক্ষর হলেও বিগত ১৮ বছরে তা বাস্তবায়ন করা হয়নি।
যে নির্বাচন কমিশনের ব্যর্থতা দিয়ে বিএনপি ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন বর্জন করেছিল, সেই কমিশনের অধীনে বছর শেষে বিএনপি স্থানীয় নির্বাচন (পৌর নির্বাচনে) করছে। স্থানীয় নির্বাচনে এবার দলীয় প্রতীক বরাদ্দের কারণে কার্যত স্থানীয় নির্বাচন এখন দলীয় কর্তার ইচ্ছায় কর্মের পর্যায়ে চলে গেল। নির্বাচনের ডামাডোলের ফলাফল নিয়েই নতুন বছরে নতুন করে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার রোডম্যাপ এখন প্রস্তুত। বিএনপি পৌর নির্বাচনে হারলে নতুন বছরে নতুন করে আবার রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা তৈরি করার একটা মোক্ষম অস্ত্র এখন খালেদা জিয়ার হাতে। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে ত্রিশ লাখ শহীদ আর সাড়ে চার লাখ মা বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে যে স্বাধীনতা আমরা পেয়েছি, তার চেয়ে গত ৪৪ বছরে কেবল রাজনৈতিক সহিংসতায় বাংলাদেশে ত্রিশ লাখেরও বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। আজ পর্যন্ত যার একটিরও কোনো বিচার হয়নি এদেশে। এক বিচারহীনতা নিয়ে বড় হচ্ছে বাংলাদেশ। নতুন বছরে যে রাজনৈতিক সহিংসতা ঘটবে, তার লক্ষণ এখনই সুস্পষ্ট। আর সেসব সহিংসতার যে বিচার হবে না, তাও আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর নেতানেত্রীরা এখনও জানেন। তাই নতুন করেই তারা আবার হত্যা, খুন, হামলা, দখল, লুটপাটের ছক করেন তারা নির্দ্বিধায়।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, নতুন বছরে বাংলাদেশকে ঘরের শত্রুর পাশাপাশি বাইরের শত্রুদের মোকাবেলা করতে হবে। যুদ্ধের দামামা বাজছে যেন। এখন হুঁইসেলের অপেক্ষায় সন্ত্রাসীরা তৈরি। নতুন বছরেও বাংলাদেশে আরো অনেক রক্ত ঝরবে। কিন্তু একটা সুনির্দিষ্ট বিচার ব্যবস্থা যতক্ষণ না স্থায়ী হচ্ছে, ততক্ষণ এই নির্বিঘ্ন রাজনৈতিক সহিংসতা চলবে, আর এর দায় ভোগ করবে নিরীহ সাধারণ জনগোষ্ঠী। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, এক ভয়াবহ আগামী'র জন্য বাংলাদেশ কার্যত অপেক্ষা করছে। তারপরেও আশার কথা চলতি বছর আমরা নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতুর কাজ শুরু করেছি। আমাদের কৃষকরা এখনো রাজনীতির বাইরে আছেন। নতুবা আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের স্বার্থে যেভাবে শ্রমিকদের ব্যবহার করে দলীয় স্বেচ্ছাসেবক বানিয়েছে, কৃষকদের সেভাবে ব্যবহার শুরু হলেই সব শেষ হবে।
চলতি বছর বাংলাদেশ ক্রিকেট সবগুলো একদিনের আন্তর্জাতিক সিরিজে জয় পেয়েছে। শক্তিশালী পাকিস্তান, ভারত ও দক্ষিণ আফ্রিকাকে পরাজিত করেছে। বাংলাদেশের জাতীয় ফুটবল দলের মেয়েরা নেপালকে হারিয়ে এএফসি অনূর্ধ্ব-১৪ গার্লস আঞ্চলিক প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। চলতি বছর বাংলাদেশ পৃথিবীর সর্বোচ্চ সাতটি পর্বত চূড়া জয় করেছে। কেবল রাজনৈতিক সহিংসতা না হলে বাংলাদেশ বিশ্বে অনেক কিছু জয় করার ক্ষমতা রাখে। বাংলার দামাল ছেলেমেয়েরা যুদ্ধ জয় করতে জানে। আমাদের রাজনৈতিক সদিচ্ছাগুলো সহায় হলে নতুন বছরে আমাদের জন্য নতুন নতুন আরো অনেক জয়ই অপেক্ষা করছে।
রাজনৈতিক সহিংসতামুক্ত কয়েকটি বছর কেবল আমরা চাই। এতো নেগেটিভ ইফেক্ট থাকা সত্ত্বেও কেবল রাজনৈতিক সহিংসতা মুক্ত থাকলে একদিন বিশ্ব জয় করবে বাংলাদেশ। অবাক তাকিয়ে দেখবে বিশ্ববাসী। আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে শুধু বিনীত অনুরোধ, আপনারা আলোচনার টেবিলে সব সমস্যার সমাধান করেন। বাংলাদেশকে গড়ায় মনোযোগ দেন। বাংলাদেশ বাঁচলে আপনাদের রাজনীতিও বাঁচবে।
আপনাদের সুমতি হোক। নতুন বছরে এই শুভকামনা রইল।
মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।
আপনার মন্তব্য