আজ বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ, ২০২৪

Advertise

জাহানারা ইমাম: নির্মূল কমিটির আন্দোলনের ২৪ বছর

সাব্বির খান  

কোন দাবিতে যখন একটি স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলন সংগঠিত হয় এবং বিভিন্ন চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে সেই আন্দোলনটি যখন স্ববলে পেয়ে যায় একটি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ, তখন সন্দেহাতীত ভাবে ধরে নিতে হবে সেই ‘দাবি’-টিই মূলত একটি ‘সংগঠন’ এবং নিঃসন্দেহে একটি ‘গণ-সংগঠন’। সেই অর্থে “একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি” সুস্পষ্ট দাবি সম্বলিত একটি গণমানুষের সংগঠন। দীর্ঘ ২৪ বছর পূর্বে এই দাবিনামাটির রচয়িতা ছিলেন শহীদ জননী জাহানারা ইমাম, যার বর্তমান সাংগঠনিক রূপই হচ্ছে “একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি”। সেই অর্থে মৃত্যুশয্যা থেকে লেখা জননী জাহানারা ইমামের শেষ চিঠিটিকে ধরে নেয়া যেতে পারে সংগঠনটির দিকনির্দেশনামূলক একটি ঘোষণাপত্র, যার আলোকে এই দীর্ঘ ২৪টি বছরের পথ চলা এবং ভবিষ্যতেও চলবে।

শহীদ জননী সেই শেষ চিঠিতে লিখেছিলেন—

সহযোদ্ধা দেশবাসীগণ,
আপনারা গত তিন বছর ধরে একাত্তরের ঘাতক ও যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযমসহ স্বাধীনতাবিরোধী সকল অপশক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করে আসছেন। এই লড়াইয়ে আপনারা দেশবাসী অভূতপূর্ব ঐক্যবদ্ধতা ও সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছেন। আন্দোলনের শুরুতে আমি আপনাদের সঙ্গে ছিলাম। আমাদের অঙ্গীকার ছিল লক্ষ্য অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত কেউ রাজপথ ছেড়ে যাব না। মরণ ব্যাধি ক্যান্সার আমাকে শেষ কামড় দিয়েছে। আমি আমার অঙ্গিকার রেখেছি। রাজপথ ছেড়ে যাইনি। মৃত্যুর পথে বাধা দেবার ক্ষমতা কারো নেই। তাই আপনাদের কাছ থেকে বিদায় নিচ্ছি এবং অঙ্গীকার পালনের কথা আরেকবার আপনাদের মনে করিয়ে দিতে চাই। আপনারা আপনাদের অঙ্গীকার ও ওয়াদা পূরণ করবেন। আন্দোলনের শেষ পর্যায় পর্যন্ত ঐক্যবদ্ধ লড়াইয়ে থাকবেন। আমি না থাকলেও আপনারা আমার সন্তান-সন্ততিরা আপনাদের উত্তরসূরিরা সোনার বাংলায় থাকবেন।

এই আন্দোলনকে এখনো দুস্তর পথ পাড়ি দিতে হবে। দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, মুক্তিযোদ্ধা, ছাত্র ও যুব শক্তি, নারী সমাজসহ দেশের সর্বস্তরের মানুষ এই লড়াইয়ে আছে। তবু আমি জানি জনগণের মত বিশ্বস্ত আর কেউ নয়। জনগণই সকল শক্তির উৎস। তাই একাত্তরের ঘাতক ও যুদ্ধাপরাধীবিরোধী মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন ও ’৭১-এর ঘাতক দালাল নির্মূল সমন্বয় আন্দোলনের দায়িত্বভার আমি আপনাদের বাংলাদেশের জনগণের হাতে অর্পণ করলাম। জয় আমাদের হবেই।
-জাহানারা ইমাম

অসাধারণ ঐতিহাসিক একটি চিঠি, যার প্রতিটি শব্দের পেছনেই লুকিয়ে আছে দায়িত্ব, কর্তব্য, অঙ্গিকার, সাবধান বাণী, শত্রু-মিত্রের সংজ্ঞা এবং সর্বোপরি লক্ষ্যে পৌঁছানোর সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা। প্রতিটি আন্দোলনই শুরু হয় কোন না কোন দাবিকে কেন্দ্র করে। সময়ের আবর্তে ও দাবিতে তার কৌশলগত পরিবর্তন এবং পরিবর্ধনও হয়।

একাত্তরে মহান স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হয়েছিল ২৫ মার্চ রাতে, যখন পাক-হানাদার বাহিনী ঝাঁপিয়ে পড়েছিল বাংলার নিরীহ-নিরস্ত্র মানুষের উপর। একটি অঘোষিত যুদ্ধ শুরু হলেও তা মোকাবেলা করার প্রচ্ছন্ন একটি দিক-নির্দেশনাও দেয়া ছিল আগে থেকেই। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণকে সে অর্থে সন্দেহাতীতভাবে ধরে নেয়া যেতে পারে স্বাধীনতা যুদ্ধের সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা। এ ভাষণ আজো বাঙ্গালী জাতীর হৃদয়ে হয়ে আছে সকল প্রেরণার উৎস হিসেবে। শহীদ জননী জাহানারা ইমামের ‘শেষ চিঠি’টিও বাঙ্গালী জাতীর প্রতি ঠিক তেমনি একটি দিকনির্দেশনামূলক বার্তা— যার আলোকে আজ দীর্ঘ ২৪টি বছর ধরে চলে এসেছে একটি সুসংগঠিত আন্দোলন।

শহীদ জননীর জীবদ্দশায় সব সময়ই তিনি রাজপথে থেকে দাবি আদায়ের উপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন, যা তাঁর শেষ চিঠিতেও স্পষ্ট। তিনি লিখেছেন, “...আমি আমার অঙ্গিকার রেখেছি। রাজপথ ছেড়ে যাইনি।” অর্থাৎ রাজপথ না ছাড়ার জন্য তিনি সবার প্রতিও আহবান জানিয়েছিলেন এবং রাজপথকেই তিনি দাবি আদায়ের সূতিকাগার হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন। চিঠিতে তিনি আরো লিখেছিলেন, “...দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, মুক্তিযোদ্ধা, ছাত্র ও যুব শক্তি, নারী সমাজসহ দেশের সর্বস্তরের মানুষ এই লড়াইয়ে আছে। তবু আমি জানি জনগণের মত বিশ্বস্ত আর কেউ নয়। জনগণই সকল শক্তির উৎস।“ অর্থাৎ তিনি এই আন্দোলনটিকে কোন নির্দিষ্ট গোষ্ঠীনির্ভর আন্দোলন হিসেবে দেখতে চাননি।

১৯৭৫ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ শাসন করেন সামরিক সমাজের প্রতিনিধিদ্বয় জেনারেল জিয়াউর রহমান ও জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। তাদের উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশে সামরিক সংস্কৃতির তথা আমলাতন্ত্রের প্রসার ঘটানো— যা আমাদের দেশের জনগণের মানসিকতা ও সংস্কৃতির সাথে সাংঘর্ষিক এবং সম্পূর্ণ বিপরিতধর্মী। এই জেনারেলদ্বয় দেশের শিল্প-সংস্কৃতি থেকে অর্থনীতি, সমাজ থেকে রাজনীতি— সর্বক্ষেত্রে বপন করেছে সামরিকায়নের বীজ। বদলে দিয়েছে একটা জাতির চেতনার মূল সংস্কৃতিকে। ভেঙ্গে দিয়েছে মুক্তিযুদ্ধের মূল ভাব এবং তার স্বপ্নকে। সোজা ভাষায় যাকে বলে “জাতির মেরুদণ্ডে কুঠারাঘাত” তারা করেছে। জেনারেলদ্বয় তাদের এই হীনকার্য সম্পাদনে সাত সাতবার কুঠারাঘাত করেছে স্বাধীন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের চেতনাসম্বলিত সংবিধানে। কেটেছেটে বাদ দিয়েছে বাঙ্গালী জাতির চেতনার মূল স্তম্ভ “সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা”-কে। মুসলমানিত্বের লেবাস পরিয়েছে রাষ্ট্রের গায়ে, যা একাত্তরের মূল চেতনার সম্পূর্ণ পরিপন্থী। গণতন্ত্রায়নের চর্চা নিমিত্তে খাল কেটে কুমির এনেছে; পুনর্বাসিত করেছে রাজাকার ও আলবদরদের। তৈরি করেছে এক নতুন ‘সিভিল সমাজ’। শহীদ জননী জাহানারা ইমামের ভাষায় যাদের শুধু “মূর্খ-অর্বাচীন, ধূর্ত-শয়তান” হিসেবেই চিহ্নিত করা যায়। যাদের দৌরাত্ত্বে আর বাচলামীতে গভীর রাতের ঘুমই শুধু নষ্ট হচ্ছে না, সেই সাথে শান্তিপ্রিয় বাঙ্গালীদের প্রতিদিন হতে হচ্ছে নিত্য নতুন পদ্ধতিতে প্রতারিত।

১৯৯০ এর পর জোটভিত্তিকভাবে হলেও পালা করে মূলত দেশের প্রধান দুটি দল রাষ্ট্রক্ষমতায় এসেছে এবং এই দুটি দলই মূলত স্বৈরতান্ত্রিক এরশাদ সরকারের পতন ঘটিয়েছিল। অথচ এই দল দুটিই ঘুরেফিরে সেই সামরিক সরকারগুলোর সৃষ্ট বিভিন্ন সেক্টরের ‘সিভিল সমাজ’ দ্বারা চালিত এবং নিয়ন্ত্রিত হয়ে এসেছে সব সময়। দল দু’টোর ক্ষমতায় যাওয়ার প্রক্রিয়ায়ও বেশির ভাগ সময় এই সিভিল সমাজ মূল ভূমিকা রেখেছে। যে কারণে গণতন্ত্রের তকমায় আঁটা হলেও মূলত: সরকারগুলো স্বৈরতান্ত্রিক রাজনৈতিক সংস্কৃতি থেকে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই বেরিয়ে আসতে পারেনি। অন্তত তাদের ক্ষমতায় থাকাকালীন ক্রিয়াকলাপ পর্যালোচনায় তা-ই দেখা যায়। যে কারণে রাজপথের আন্দোলনও বাধাগ্রস্ত হয়েছে বারবার এবং একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির আন্দোলনকে এগিয়ে যেতেও বাধাগ্রস্ত করেছে বার বার। অর্থাৎ স্বৈরশাসক গোষ্ঠীর সৃষ্ট বিভিন্ন সেক্টরের সিভিল সমাজ বিভিন্ন সময়ে এই আন্দোলনে থাকলেও শহীদ জননী তাঁদের উপর ভরসা হয়ত করতে পারেননি। তাই তিনি আশ্রয়স্থল হিসেবে বেছে নেয়ার কথা বলেছিলেন ‘জনগণ’-কে। দীর্ঘ ২২ বছরের আন্দোলনে আমরাও দেখেছি এই আন্দোলনে যুক্ত বিভিন্ন সহকর্মীদের, কিভাবে তাঁরা ভোল পাল্টিয়েছেন, কিভাবে আন্দোলনকে স্তব্ধ করে দিতে কূটকৌশলী হয়েছেন, কিভাবে অসহযোগীতা করেছেন বার বার। শেষমেশ গণদাবির সূতিকাগার সেই জনগণই এগিয়ে এসেছে, কাঁধে তুলে নিয়েছে এই আন্দোলনের দায়ভারকে। বিভিন্ন ভাবে বাধাগ্রস্ত এই আন্দোলনকে এগিয়ে নিতে তাই বিভিন্ন সময় কৌশলগত পরিবর্তনও আনতে বাধ্য হয়েছে সংগঠনটিকে। এক্ষেত্রে নিঃসন্দেহে প্রজ্ঞার পরিচয় দিয়েছেন সংগঠনটির নেতৃবৃন্দ।

স্বাধীনতাবিরোধী শক্তিটি বাংলাদেশের সামাজিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক সেক্টরগুলোতে আমূল পরিবর্তন ঘটাতে বদ্ধপরিকর ছিল একাত্তরের পর থেকেই। কাজটি আরো বেশী তরান্বিত হয়েছে পঁচাত্তরের পর থেকে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে সপরিবারে হত্যার মাধ্যমে। সেই থেকে নব্বইয়ের আগ পর্যন্ত দেশটি শাসন করা হয়েছে মূলত সেনানিবাস থেকে, যাদের প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ সহযোগী হিসেবে কাজ করেছে স্বাধীনতাবিরোধী ফ্যাসিষ্ট মৌলবাদী চক্রটি। সময়ের আবর্তে বাংলাদেশে তৈরি হয়েছে একটি নতুন প্রজন্ম। সেই সাথে দেশের সংস্কৃতি এবং সামাজিক মূল্যবোধের জায়গাটিকে। এই সহজ উপলব্ধি থেকে স্বাধীনতাবিরোধী শক্তিটি একাত্তর পরবর্তী প্রজন্মকে সরাসরি টার্গেট করে পরিচালনা করেছে তাদের বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড। একটা দেশের ইতিহাস পরিবর্তন করা থেকে শুরু হয় তাদের এই হীন-কর্মযজ্ঞ। একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি শহীদ জননী জাহানারা ইমামের মৃত্যুর পর পরই এই সত্যটি উপলব্ধি করেছিল যে, মৌলবাদী এই চক্রটিকে প্রতিহত করার জায়গাটি মূলত এই নতুন প্রজন্মকে তৈরি করার মধ্যেই। আশির দশকের বিশ্বব্যাপী ‘শীতল যুদ্ধের’ মত সেই থেকে মৌলবাদের বিরুদ্ধে সরাসরি এক অদৃশ্য যুদ্ধ ঘোষণা করেছিল নির্মূল কমিটি। সম্পূর্ণ স্রোতের বিপরীতে থেকেও এই চ্যালেঞ্জ থেকে এক চুল পরিমাণও পিছপা হয়নি সংগঠনটি, যা আজো চলমান।

১৯৯৫ সাল থেকে শুরু হয় একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির আন্দোলনকে একটা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়ার ধারাবাহিক কার্যক্রম। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিকে মুখ্য রেখে একই সাথে শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে পুনরুদ্ধার করার কাজ। সেই সাথে জঙ্গিবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে লড়াই। অর্থাৎ একই সাথে বিভিন্ন ফ্রন্টের এই যুদ্ধে স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি জামায়াত ইসলামকে চ্যালেঞ্জ করা হয়েছে প্রতি পদে পদে। নির্মূল কমিটির এই যুদ্ধটি মূলত একাত্তরের মত পাকিস্তানী জান্তার বিরুদ্ধে বাঙ্গালীদের অসম যুদ্ধের মতই ছিল। আর যাই হোক, জামায়াত ইসলামের অর্থনৈতিক শক্তিকে চ্যালেঞ্জ করার মত কোন অবস্থানই নির্মূল কমিটির কোনদিনই ছিল না। কিন্তু একাত্তরের চেতনাই যার সম্বল, তাঁর আর কি লাগে! দিনের পর দিন, বছরের পর বছর যুদ্ধে একের পর এক পর্যুদস্ত করেছে মৌলবাদী শক্তিকে। যুদ্ধের কৌশলগত দিক চিন্তা করে নির্মূল কমিটি ‘মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি সংরক্ষণ কেন্দ্র ট্রাস্ট’ এবং ‘সাম্প্রদায়িকতা ও মৌলবাদবিরোধী দক্ষিণ এশীয় গণসম্মিলন’ নামে দুটি সহযোগী সংগঠন গড়ে তোলে। দুটি সংগঠনেরই প্রধান সমন্বয়কারী হিসেবে নির্মূল কমিটির বর্তমান সাধারণ সম্পাদক কাজী মুকুলের অক্লান্ত চেষ্টায় সারা দেশে প্রায় ৮০টির অধিক “মুক্তিযুদ্ধের শহীদ স্মৃতি পাঠাগার” স্থাপন করেন। নতুন প্রজন্মের মধ্যে জঙ্গিবাদ ও মৌলবাদবিরোধী মনোভাব গড়ে তোলা সহ তারুণ্যের মনে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা প্রতিষ্ঠাই এই পাঠাগারের মূল উদ্দেশ্য। গত জোট সরকার ক্ষমতায় থাকাকালীন সময়ে প্রায় ২০টি পাঠাগারের উপর হামলা চালানো হয়েছিল। পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধ মেলাও প্রথম শুরু করেছিল নির্মূল কমিটিই।

বর্তমানে সারা বাংলাদেশে নির্মূল কমিটির শাখার সংখ্যা ২৫০র অধিক। দেশের বাইরে আছে ১২টি। অর্থাৎ বাংলাদেশের সিভিল সোসাইটির যেকোনো সংগঠনের মধ্যে নির্মূল কমিটিই সর্ববৃহৎ। এছাড়াও নির্মূল কমিটি যদিও কোন রাজনৈতিক দল নয়, তবুও এর বৃহত্তরতা বিবেচনায় নিলে বাংলাদেশের প্রথম চারটি বড় দলের পরেই এর অবস্থান। সুতরাং এই পরিসংখ্যান থেকেও বোঝা যায়, স্বাধীনতাবিরোধীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে এর অগ্রযাত্রা। রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক প্রতিকূলতার পরেও সংগঠনের পরিসর বৃদ্ধির পাশাপাশি নিয়মিত সারাদেশে নিয়মিত সভা-সেমিনার করাই ছিল নির্মূল কমিটির মূল কাজ। একটা বিপথগ্রস্ত প্রজন্মকে সঠিক ট্র্যাকে ফিরিয়ে আনা নিঃসন্দেহে অন্য যেকোনো কাজের চেয়ে কঠিন ছিল। কিন্তু নির্মূল কমিটি নির্দ্বিধায় এর প্রশংসার দাবি করতেই পারে যে, এই প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছে, যদিও কাজ এখনো অনেক বাকি। আমরা এর প্রতিচ্ছবি দেখেছি শাহবাগের প্রজন্ম চত্বরে যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসীর দাবিতে তারুণ্যের আন্দোলন থেকেও। এছাড়াও এই সংগঠনের বর্তমান নির্বাহী সভাপতি সাংবাদিক, লেখক এবং চলচ্চিত্রনির্মাতা শাহরিয়ার কবিরসহ সংগঠনের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ নিরলসভাবে দেশের বিভিন্ন জেলা সহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছুটে বেরিয়েছেন যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের পক্ষে সমর্থন আদায়ের লক্ষ্যে। শাহরিয়ার কবির বাংলাদেশের সংখ্যালঘু নির্যাতনের উপর প্রামাণ্য চিত্র ‘আমাদের বাঁচতে দাও’ ছাড়াও জঙ্গিমৌলবাদের ভয়ংকর বিস্তারের উপরে নির্মাণ করেছেন ‘যুদ্ধাপরাধ ’৭১’, ‘পোট্রেট অব জিহাদ’, ‘জিহাদ উইদাউট বর্ডার’, ‘দ্য আল্টিমেট জিহাদ’, ‘দুঃসময়ের বন্ধু’ ইত্যাদি প্রামাণ্যচিত্রগুলো, যা দেশে এবং বিদেশে বাংলাদেশের মৌলবাদের স্বরূপ তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছে এবং বিশ্ববাসীও জেনেছে বাংলাদেশ মূলত কোনদিকে যাচ্ছে।  নিরলস ভাবে কলম সৈনিকের ভূমিকায় শাহরিয়ার কবির এবং অধ্যাপক মুনতাসির মামুন নিঃসন্দেহে ইতিহাসের একটা জায়গা দখল করে নিয়েছেন। ১৯৯৫ সাল থেকে জাহানারা ইমাম স্মারক বক্তৃতার আয়োজন করছে। এ বক্তৃতা দিয়েছেন বাংলাদেশের বরেণ্য বুদ্ধিজীবীগণ। এছাড়াও মুক্তিযুদ্ধ, সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে কাজের অবদান রাখার জন্য ১৯৯৫ সাল থেকে প্রতি বছর একটি প্রতিষ্ঠান এবং একজন ব্যক্তিকে দেয়া হচ্ছে ‘জাহানারা ইমাম স্মৃতি পদক।’

২০০১ সালে ঢাকায় দুদিন ব্যাপী এক আন্তর্জাতিক সম্মেলনের আয়োজন করা হয়েছিল ‘সাউথ এশিয়ান পিপলস ইউনিয়ন এগেইনস্ট ফান্ডামেন্টালিজম এন্ড কম্যুনালিজম’ শিরোনামে। দেশের শীর্ষস্থানীয় মানবাধিকার নেতৃবৃন্দ ছাড়াও বিদেশের বেশ কিছু মানবাধিকার বিষয়ের বিশেষজ্ঞ এতে যোগ দিয়েছিলেন। ২০১০ সালে ঢাকায় আয়োজন করেছিল দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক সম্মেলন ‘পিস, জাস্টিস এন্ড সেক্যুলার হিউম্যানিজম’ এবং এই সম্মেলনেও যোগ দিয়েছিলেন জার্মানি, সুইডেন, ভারত, নেপাল, পাকিস্তান, কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র, নেদারল্যান্ড, রাশিয়া এবং যুক্তরাজ্য থেকে স্ব স্ব দেশের আইন প্রণেতা সহ বিভিন্ন মানবাধিকার বিষয়ক বিশেষজ্ঞগণ। এছাড়াও নির্মূল কমিটির বিদেশের শাখাগুলো নিয়মিত বিভিন্ন ইস্যুর উপর আয়োজন করছে সভা-সেমিনার। ২০১০ সালে বাংলাদেশে গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের আইন এবং কার্যধারার উপর প্রশিক্ষণমূলক সেমিনারের আয়োজন করা হয়েছে অসংখ্য। দেশের বাইরেও জামায়াত ইসলামের বিভিন্ন প্রোপাগান্ডামূলক অপপ্রচারের জবাব দেয়ার জন্যও আয়োজন করা হয়েছে সেমিনার। ঢাকা থেকে নির্মূল কমিটির বিশেষজ্ঞ পর্যায়ের বিভিন্ন নেতৃস্থানীয় যাঁরা আছেন তাঁরাও যোগ দিয়েছেন এই ধরনের আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সেমিনারে। এছাড়াও প্রতি বছর নির্মূল কমিটির উদ্যোগে সংবিধান, যুদ্ধাপরাধের ফ্যাক্ট, বীরাঙ্গনা, সমসাময়িক ঘটনা নিয়ে লেখা বিভিন্ন কলামের সংকলন, মুক্তিযুদ্ধ ইত্যাদি বিষয়গুলোর উপর প্রকাশ করছে বিভিন্ন প্রকাশনা এবং তা ছড়িয়ে দিচ্ছে সারা দেশে।

নির্মূল কমিটির জন্মলগ্ন থেকে অদ্যাবধি যারা ছিলেন, তাঁদের অনেকেই আজ পরলোকগত। তাঁদের মধ্যে অধ্যাপক কবীর চৌধুরী, বিচারপতি কেএম সোবহান, কবি শামসুর রাহমান সহ আরো অনেক অগ্রজদের কথা স্মরণ করা যায়। সবার মহিমান্বিত স্বার্থহীন অক্লান্ত পরিশ্রমের ফসল আজকের এই বাংলাদেশে গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত। এই আদালতের বিরুদ্ধে বিরামহীন চক্রান্ত সহ হীন এমন কোন কাজ নাই যা স্বাধীনতাবিরোধী চক্রটি করছে না। কিন্তু নির্মূল কমিটির নেতৃত্ব এবং তাঁদের অক্লান্ত পরিশ্রমে সব চক্রান্তই একের পর এক মোকাবেলা করা হচ্ছে এবং আগামীতেও হবে। একজন যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসি হয়েছে এবং বেশ কিছু রায় দেয়া হয়েছে যা আপিল বিভাগে চূড়ান্ত রায়ের অপেক্ষায় আছে। স্বভাবতই আমরা আশা করব, যত দ্রুত সম্ভব এই রায় কার্যকর করতে। এছাড়াও যুদ্ধাপরাধী দল হিসেবে বাংলাদেশ জামায়াত ইসলামকে সাংবিধানিকভাবে নিষিদ্ধ ঘোষণা করতে হবে। তা না হলে দেশ থেকে কোনদিনও জঙ্গিবাদের মূলোৎপাটন করা সম্ভব হবে না। পরিশেষে এটা বলব যে, একাত্তরে বাংলাদেশ যে ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে স্বাধীন হয়েছিল, সেই ধর্মনিরপেক্ষ, সেক্যুলার ডেমোক্র্যাটিক সংবিধানে ফিরে গিয়ে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সত্যিকারের সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠা করা হোক। জন্মলগ্ন থেকে এটা একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির দাবি এবং এ দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন অব্যাহত থাকবে।

সাব্বির খান, রাজনৈতিক বিশ্লেষক, কলাম লেখক ও সাংবাদিক। ইমেইল : [email protected]

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪১ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬২ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ১৯ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩০ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৮৯ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৫ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ