আজ শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

Advertise

নূরীর মুক্তিযুদ্ধ থেকে জীবনযুদ্ধ

সাইফুর মিশু  

গ্রামে মিলিটারি ঢুকছিলো তাই প্রাণ বাঁচাতে একটি গাব গাছে উঠেন কিশোরী নুরজাহান। এর আগে শুধু শুনেছিলেন মিলিটারিদের কথা। সেবারই প্রথম স্বচক্ষে দেখলেন। ভয়ে গাছ থেকে পিছলে পড়ে যান পাশের লাউগাছের মাচার উপরে। নড়া চড়া না করে সেখানেই চুপচাপ উপুড় হয়ে থাকেন।

সেই মাচার নিচেই টেনে হিঁচড়ে নিয়ে আসা হয় হিন্দু ডাক্তারের স্ত্রী বেলা রাণীকে। নিজের প্রাণ বাঁচাতে নুরজাহান বেগম চোখের সামনে চুপচাপ দেখে যান বেলা রাণীকে নির্যাতনের দৃশ্য। ২৫ জন পর্যন্ত সেনা সদস্য তিনি গুনেছিলেন, যারা বেলা রাণীর উপর পাশবিকভাবে চালিয়েছে শারীরিক নির্যাতন।

বাড়ী থেকে ধরে আনার সময় বেলা রাণীর কোলে ছিল তার তিন দিন বয়সের প্রথম সন্তান। সেই বাচ্চাকে কোল থেকে কেড়ে নিয়ে মাটিতে ছুড়ে ফেলে বাড়ীর পিছনে লাউ গাছের মাচার কাছেই টেনে হিঁচড়ে নিয়ে আসে। টেনে কাপড় খুলে নেয় বেলা রাণীর। এরপর পাকিস্তানী সেনারা একে একে শুরু করে নির্যাতন। পঁচিশ জন পর্যন্ত তিনি গুনে, নির্যাতনের বীভৎসতা দেখেই জ্ঞান হারান উপর থেকে দেখা কিশোরী নূরজাহান বেগম।

জ্ঞান ফেরার পরে দেখেন আশ পাশের সব বাড়িঘরে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে। ততক্ষণে পাকিস্তানী পশুগুলো চলে গেছে সেই গ্রাম থেকে। এরপর তিনি নেমে আসলেন মাচার উপর থেকে। বেলা রাণীকে কোনমতে টেনে কিছুটা পরিষ্কার স্থানে নিয়ে আসেন। তিন দিন বয়সের শিশুটির কাছে যেয়ে দেখেন পিঁপড়া ঘিরে ধরেছে। পিঁপড়া ছাড়িয়ে শিশুকে মায়ের কোলে ফিরিয়ে আনেন। প্রায় মৃত বেলারাণী একটু জল খেতে চেয়েছিলো। কিশোরী নূরজাহান তাকে একটু জল এনে দেয়ার জন্য কিছুই খুঁজে না পেয়ে নিজের শাড়ির আঁচল ভিজিয়ে এনে তা চিপে জল দেন বেলা রানীর মুখে। এরপর একটি গাছের সাথে হেলান দিয়ে রেখে যান নিজ বাড়ীতে। যেয়ে দেখেন কিছুই নেই আর। সব পুড়িয়ে দিয়ে গেছে .....

এলাকার লোকজনের কাছ থেকে জেনে সাথে আরো দুইজনকে নিয়ে চলে যান মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্পে। বেলা রাণীর ননদ এবং অন্য একজনের সাথে পরামর্শ করেন নূরজাহান। রেডিওতে শুনতেন বঙ্গবন্ধুর যে ভাষণ বার বার প্রচারিত হতো স্বাধীন বাংলা বেতারে। "তোমাদের যার যা কিছু আছে, তা নিয়েই প্রস্তুত থাক..." জাতির জনকের এই কথাগুলো শুনে অনুপ্রাণিত হয় মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্পে যেয়ে যোগ দেয়ার ইচ্ছে প্রকাশ করেন তারা। ক্যাম্পের কমান্ডার নাম তাদের নাম, ঠিকানা জেনে ফিরিয়ে আনেন পরিবারের কাছে। নূরজাহানের বাবার কাছে জানতে চান, তিনি তার মেয়েকে মুক্তিবাহিনীতে যোগ দেয়ার অনুমতি দিবেন কিনা। বাবা তার একমাত্র কিশোরী মেয়েকে নিশ্চিত মৃত্যুর মুখে ঠেকে দিতে রাজী না হবার কারণে সেবার তাদের আর যোগ দেয়া হয় না যুদ্ধে।

এর সপ্তাহখানেক পরে মারা যান নূরজাহানের বাবা। অভিভাবকহীন নূরজাহান আবারো তার অপর দুই সঙ্গীকে নিয়ে যান মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্পে। এবার তাদের দলে নিয়ে নেন স্থানীয় কমান্ডার। অন্যদের সাথে ভারতে না পাঠিয়ে তাদের প্রশিক্ষণ দেয়া হয় বাঁশের লাঠি দিয়ে। মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে একটি বহুল উচ্চারিত শ্লোগান ছিলো, "বাঁশের লাঠি তৈয়ার করো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো।" প্রশিক্ষণ শেষে প্রতিটি গ্রুপে একজন করে নারী মুক্তিযোদ্ধাদের সংযুক্ত করা হয়। নূরজাহানের উপর দায়িত্ব অর্পিত হয়, পাকিস্তানী বাহিনীর ক্যাম্পের খোঁজ খবর এনে মুক্তিবাহিনীর কাছে পৌঁছানো। বরিশালের জয়শ্রীতে ক্যাম্প করে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী। সেই ক্যাম্পে নূরজাহানের খালুকে বাবুর্চির কাজ নিয়ে সেট করা হয় ক্যাম্পের যাবতীয় খোঁজ খবর পাবার জন্য।

কিশোরী নূরজাহান তার খালুর মাধ্যমে বিস্তারিত খোঁজ নিয়ে জানান মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্পে। অপারেশনের প্রস্তুতি নিতে থাকে মুক্তিযোদ্ধারা। ইতিমধ্যে একদিন মটর বোটে উঠার সময় দেখতে পান ঐ নৌকা থেকে নামছে কয়েকজন পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর সদস্য। এসময় এক পাকিস্তানী সৈন্য নূরজাহানকে ডাক দেয়। অল্প বয়সী নুরজাহান ভয় পেয়ে দৌড় দেন। পিছনে দৌড়ায় পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর ঐ সদস্যরা। এক পর্যায়ে পিছন থেকে গুলি চালায় তারা। একটি বুলেট এসে বিঁধে নূরজাহানের ডান উরুতে। রক্তাক্ত পা নিয়ে তবুও দৌড়ান নূরজাহান। এমন সময় এক বিয়ে বাড়ী দেখে প্রাণ বাঁচাতে চেষ্টা করেন তিনি। সে বাড়ীর লোকজন তাকে আশ্রয় দেয় না, নিজেদের নিরাপত্তার জন্য। রাইফেলের বাট দিয়ে পিছন থেকে মাথায় আঘাত করে পাকিস্তানী সেনারা। হাত-পা বেঁধে গাড়িতে তোলার পরে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন তিনি। এরপর ২৪ ঘণ্টা বুক পর্যন্ত পানিতে দাঁড় করিয়ে রাখে। রক্ত ঝরতে ঝরতে এক পর্যায়ে জমাট বেঁধে যায় বুলেটবিদ্ধ উরুতে। বেয়োনেট দিয়ে খুঁচিয়ে অত্যাচার করা হয় মুক্তিবাহিনীদের সম্পর্কে খবর বের করার জন্য। ছুড়ি দিয়ে পোঁচ দেয়, কামড়ে কামড়ে ক্ষত বিক্ষত করে সারা শরীর। তারপর একটি কক্ষে এনে রাখা হয় নূরজাহানকে। সেই কক্ষে দেখতে পান আরো ২৪/২৫ জন নারী যারা সকলেই ছিলো বিবস্ত্র অবস্থায়। তখনো তার উরুতে সেই বুলেট। প্রতি রাতে সেই কক্ষ থেকে কয়েকজনকে নিয়ে যাওয়া হতো, সারারাত নির্যাতন চালিয়ে সকালে আবার এনে রেখে যাওয়া হতো তাদের। নির্যাতনের ভয়াবহতা ছিলো এতটাই যে অনেকে পাগল হয়ে গিয়েছিলো, অনেকেই মারা যান সেই কক্ষে। পৈশাচিক এই নির্যাতন থেকে রেহায় পাবার জন্য তারা প্রতিদিন নিজেদের মৃত্যু কামনা করতো। নিজের হাত/পা কামড়ে কামড়ে ক্ষত করে চেষ্টা করতো আত্মহত্যার। খাবার জন্য তাদের দিকে ছুড়ে দেয়া হতো শুকনো রুটি আর পানি চাইলে উপর থেকে মগ দিয়ে ঢালা হতো নোংরা পানি। পায়ে বুলেটবিদ্ধ ১৪ বছর বয়সী নূরজাহানও রেহায় পাননি বর্বর পাকিস্তানী সেনাসদস্যদের সেই অমানুষিক নির্যাতন থেকে। বরিশালের গৌরনদী কলেজের সেই ক্যাম্প থেকে প্রাণ নিয়ে ফিরেছিলেন নূরজাহান এবং তার সাথের কয়েকজন, মুক্তিবাহিনীরা সে ক্যাম্প দখল করে নেয়ার পর।

গৌরনদী কলেজের পাকিস্তানী ক্যাম্পে পৈশাচিক নির্যাতন থেকে শুধুমাত্র প্রাণটুকু নিয়ে ফেরেন কিশোরী নুরি। মুক্তিযোদ্ধারা ক্যাম্প দখল করে নেয়ার পরে একটি ঘর থেকে উদ্ধার করেন নুরজাহান এবং তার সঙ্গীদের। তাদের কারোই গায়ে ছিলো না এক টুকরো কাপড়ও। মুক্তিযোদ্ধারা নিজেদের গায়ের শার্ট, গামছা, লুঙ্গি দিয়ে তাদের কোনভাবে সম্ভ্রমটুকু ঢাকার ব্যবস্থা করেন। এ অবস্থায় বাড়িতেও ফিরতে পারছিলেন না নুরজাহান। গ্রামের পাশে একটি জঙ্গলে বসে থাকেন রাত হবার অপেক্ষায়। রাতে বাড়ি ফিরেন তার মায়ের কাছে।

- মারে... মা, ওমা।
- তুই আইছোস, তুই কেডা? তুই মরস নাই?
- না মা, অনেক তো চেষ্টা করছিলাম, পারি নাইতো মা।
- এই রাতের অন্ধকারেই অনেক দূরে চলে যা।
- কই যামু মা? আমাদের কয়ডা টাকা দেও। আমি ভাইয়ের কাছে খুলনা যামু।
- টাকা কইত্তে দিমু? তোর লাইগা তো সব পুইরা দিয়া গেছে। তোর বাপেরেও মাইরা ফালাইলো, তোর লাইগাতো সবই গেল আমাগো।

বাড়ির পাশের একটি আমগাছ বিক্রি করে চল্লিশ টাকা মা তুলে দেন নুরজাহানের হাতে। গাছ বিক্রয় হওয়া পর্যন্ত তাকে সারাদিন বসে থাকতে হয় জঙ্গলের মধ্যে। আশ পাশের মহিলারা খবর পেয়ে এসে কটূক্তি করে, 

"কি শখ! মাইয়া লোক, মাগী মানুষ হইয়া মুক্তি বাহিনীতে গেছে। মিলিটারি ধইরা নিয়া গেছে, কেমনে মুখ দেহায়, বাইচ্চা রইছে? আমরা হইলে লগে লগে ফাঁস দিয়া মইরা যাইতাম।"

পাকিস্তানী ক্যাম্পে বন্দি থাকা অবস্থায় এক নারী সহযোদ্ধা বলেছিলেন, "নূরজাহান, কখনো এইসবে নিজেকে ছোট ভাববে না, আমরাতো ইচ্ছেকৃতভাবে এখানে আসিনি। দেশের জন্য আমরা জীবন দিয়েছি। কেউ বন্দুক দিয়ে যুদ্ধ করেছে, আমরা ইজ্জত দিয়ে যুদ্ধ করেছি। আমরা কোন অন্যায় করিনি। মরার কথা কখনো মুখে আনবে না।" সেই কথাগুলো নতুন করে শক্তি দেয় কিশোরী নূরীকে, সাহস যোগায় বেঁচে থাকার জন্য। নূরজাহান ঐ চল্লিশ টাকা নিয়ে রওনা দেন খুলনায় তার ভাইয়ের কাছে যাবার লক্ষ্যে।
ভাইয়ের কাছে পৌঁছালে ভাইও তাকে ফিরিয়ে দেয় মান-সম্মানের ভয়ে। উপায় না দেখে নূরজাহান যায় খুলনায় বসবাসরত তার ফুফাতো ভাইয়ের। কিশোরী নূরজাহানকে তার বাবা বিয়ে দিয়ে যান মৃত্যুর আগে। ফুফাতো ভাইয়ের কাছে যেয়ে তাকে অনুরোধ করেন তার স্বামীকে যদি খুঁজে পাওয়া যায় আর সে যদি তাকে গ্রহণ করে তবে তিনি তার সাথেই থাকতে চান। তার স্বামীও গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানায়। এরপর তার ফুফাতো ভাই, আরেকটি বিয়ে ঠিক করেন। সেই বিয়েও হয় না, পাকিস্তানী ক্যাম্পে নির্যাতিত হবার কারণে। নূরজাহান পালিয়ে চলে আসেন ঢাকায় বঙ্গবন্ধুর সাথে দেখা করার লক্ষ্যে। ধানমন্ডি লেকের পারে এক মুক্তিযোদ্ধার বাড়িতে মিথ্যা পরিচয় দিয়ে কাজ নেন পেটে ভাতে। মুক্তিযোদ্ধা জানতেন তার আসল পরিচয়, নিষেধ করে দেন তার স্ত্রীকে জানাতে।

ঐ মুক্তিযোদ্ধার ছোট শিশুকে কোলে নিয়ে প্রতিদিন বঙ্গবন্ধুর বাড়ির সামনে হাঁটতেন, উদ্দেশ্য বঙ্গবন্ধুর সাথে দেখা করে খুলে বলবেন নিজের অবস্থা। কোনভাবেই গতি হয় না তার। বাড়ির গার্ডদের অনুরোধ করেন। কোন ভাবেই কেউ ব্যবস্থা করতে পারে না। একদিন দেখেন বঙ্গবন্ধুর বাড়ীর থেকে বের হচ্ছে এক সেনা কর্মকর্তার গাড়ি। গাড়ির সামনে দাঁড়ালে নেমে আসেন সেই সেনা কর্মকর্তা। পা জড়িয়ে ধরে মিনতি জানান তিনি একবার অন্তত বঙ্গবন্ধুর সাথে দেখা করতে চান। উক্ত সেনা কর্মকর্তা অনুমতি নিয়ে নূরজাহানকে নিয়ে যান বঙ্গবন্ধুর কাছে।

বঙ্গবন্ধু সব শোনেন চুপচাপ। নুরজাহান বেগমকে একটি কাগজ দেন গেইট পাশ, যাতে করে পরবর্তীতে তিনি আসলে ভিতরে ঢুকতে দেয়া হয়। সেদিন নূরজাহানকে এক সপ্তাহ পরে আবার আসতে বলেন, এবং ঐদিন তার একটি ব্যবস্থা করে দিবেন তাও আশ্বাস দেন। কিন্তু না, নূরজাহানের ভাগ্য খোলে না আর। ঐ সপ্তাহেই বাড়িতে থাকা বঙ্গবন্ধুর পরিবারের বাকী সদস্যদের সহ নির্মমভাবে হত্যা করা হয় জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। রাতে গোলাগুলির আওয়াজ শুনে ভোরে দৌড়ে ছুটে যান বঙ্গবন্ধুর বাড়ির দিকে। দেখতে পান সেনাবাহিনীর সদস্যারা ঘিরে রেখেছে পুরো বাড়ি। মৃতদেহগুলো চটিতে মুড়িয়ে ছুড়ে ছুড়ে তোলা হচ্ছে ট্রাকে।

দেশের সকল নারী মুক্তিযোদ্ধারা যখন একটু একটু করে পুনর্বাসিত হচ্ছিলো, প্রায় ধ্বংসপ্রাপ্ত দেশটি ধীরে ধীরে ঘুরে দাঁড়াবে ঠিক তখনই শুধুমাত্র দুই কন্যা ব্যতীত বঙ্গবন্ধুকে তার পরিবারের অন্য সকল সদস্যকে নির্মমভাবে হত্যা করে সেনাবাহিনীর কুচক্রী ক্ষমতালোভী মহল। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পরে তার জীবনের সকল আশা হারিয়ে ফেলেন নূরজাহানসহ আরো অনেক নারী মুক্তিযোদ্ধারা, যারা দেশের জন্য নিজের সবকিছু হারিয়েছেন। সমাজে প্রাপ্য সম্মানটুকুতো দূরের কথা বরং পেয়েছেন নানা রকম বঞ্চনা, অবহেলা এবং দুর্ব্যবহার।

বঙ্গবন্ধুসহ তার পরিবারের সদস্যদের লাশগুলোকে কি পরিমাণ অবহেলায় ট্রাকে তোলা হয়েছিলো তার প্রমাণ পাওয়া যায় প্রত্যক্ষদর্শী মুক্তিযোদ্ধা নূরজাহানের বক্তব্য থেকে। তা দেখে ঘরে ফিরে স্থির থাকতে পারেননি তিনি। এই জীবনে তার আর কোন আশাই অবশিষ্ট থাকলো না। আর কেউ রইলো না যার সহযোগিতায় নতুন একটি জীবনের স্বপ্ন দেখতে পারেন তিনি। যে বাড়িতে কাজ করতেন তিনি সে বাড়িতে খুঁজে পান এক বোতল পিঁপড়া মারার বিষ। সেই বিষ খেয়ে নেন। সেই বাড়ীর মহিলা তাকে সন্দেহ করে তার স্বামীর সাথে নূরজাহানের অবৈধ সম্পর্ক আছে, নিয়ে যায় হাসপাতালে। চিকিৎসকরা তার পাকস্থলী পরিষ্কার করে তার কাছে জানতে চান কেন তিনি বিষ খেয়েছিলেন।

"শেখ মুজিবকে এভাবে মাইরা ফাইলাইছে আমি সহ্য করতে পারি নাই, তাই বিষ খাইছি।"

জবাব শুনে কর্তব্যরত এক নারী চিকিৎসক নূরজাহানের কাছে তার বিস্তারিত জানতে চান। তিনি সব খুলে বলার পরে তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে সেই নারী চিকিৎসক বলেন,

"তুমি আমাদের দেশের জন্য যা করেছ, তাতো আমরাও করতে পারিনি। আজ থেকে তুমি আমার কাছে আমার মেয়ের মতই থাকবে।"

দুইদিন পরে হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়ে তিনি চলে যান মিরপুর কাজিপাড়া। ঐ এলাকা তখনও গ্রাম ছিলো। সেখানে এক বাড়িতে কাজ নেন তিনি। সেখানে এক বয়স্ক মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীসহ তাদের দোসররা তার পরিবারের সবাইকে মেরে ফেলে। সেই শোক সইতে পারেননি তিনি। মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন। মাঝে মাঝে দৌড় দিতেন চিৎকার করতে করতে, "ধর ধর, ফায়ার কর, ফায়ার কর।" অন্য সময় ভাল থাকতেন। তিনি নূরজাহানকে বিয়ে করতে চান। রাজী হন নূরজাহান। যে বাড়িতে কাজ করতেন তিনি সে বাড়ির লোকজনকে রাজি করিয়ে বিয়ে করেন দুইজন।

বিয়ের পরে তাদের সংসারে জন্ম নেয় এক পুত্র সন্তান। নিয়তির কি নির্মম পরিহাস, তাদের সেই পুত্রটিও হয় প্রতিবন্ধী। পুত্রের বয়স যখন তিনমাস তখন মারা যান তার স্বামী। আবারো সেই নিঃসঙ্গ অসহায় জীবন। এক ডাক্তারের ঘরে কাজ নেন নুরজাহান। সেই ডাক্তার তাকে ধাত্রীর কাজ শেখান। তখন থেকে ধাত্রীর কাজ করেই জীবন নির্বাহ করেন জীবনযুদ্ধে লড়ে যাওয়া এই নারী, যার মত লাখো নারীর ত্যাগের বিনিময়ে আজকের বাংলাদেশ। আঠারো মাস বয়সী ছেলেকে নিয়ে নূরজাহান একবার গিয়েছিলেন নিজ গ্রামে। নিজ গ্রামের লোকজন টিটকারি দিতো, এলাকার বাচ্চাদের লেলিয়ে দিতো তার পিছনে, হাত তালি দিয়ে নানা রকম ব্যঙ্গাত্মক ভাষা এবং অঙ্গভঙ্গি করতো। টিকতে পারেননি নিজ গ্রামেও। এরপর খবর পেয়ে অনেক কষ্টে তার যুদ্ধকালীন এক কমান্ডার নুরুর সাথে সাক্ষাৎ করেন নূরজাহান। তার আরেক কমান্ডার নিজামকে দেশ স্বাধীন হবার চার মাস পরে গুলি করে হত্যা করে দুষ্কৃতিকারীরা।

সেদিন নুরু কমান্ডার নুরজাহানকে একটি সার্টিফিকেট দেন। তা নিয়ে তিনি ফিরে আসেন ঢাকায়। এর মধ্যে বরিশাল থেকে রেডিওতে একটি সাক্ষাৎকার প্রচারিত হয় নূরজাহানের। কিন্তু জিলা কমান্ডার থেকে শুরু করে মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয় পর্যন্ত তিনি গিয়েছেন একটু স্বীকৃতি এবং সম্মানের আশায়। পাশাপাশি চেয়েছিলেন মুক্তিযোদ্ধাদের সরকার প্রদত্ত সুবিধা পেলে এই বয়সে কিছুটা নিশ্চিন্তে কাটাতে পারেন দিনগুলো। নাহ, তার আর্থিক অবস্থা ভাল নয়, তাই তিনি পদে পদে আটকে গেছেন। যেখানেই যান দেখেন টাকা নিয়ে কাজ হয়, টাকা ছাড়া কেউ কাজ করে না। জাতির এই শ্রেষ্ঠ সন্তান মুক্তিযোদ্ধাদের যাদের নিয়ে আমরা গর্ব করার কথা, যাদের ত্যাগের বিনিময়ে আজকের এই স্বাধীন মাটি, যাদের কারণে আজকের এই দেশ তাদেরকেও ঘুষ দিতে হয় নিজের প্রাপ্য সম্মান পেতে।

নুরজাহান ঘুরেছেন দ্বারে দ্বারে, কেউ তার দিকে ফিরে তাকায় নি, সরকারী অফিস থেকে শুরু করে মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে কাজ করা নানা সংগঠনের দরজায় কড়া নেড়েও কোন জবাব পাননি। নাম উঠেনি সরকারী কোন তালিকায়, তিনি পান না কোন সরকারী ভাতা, তার ক্ষোভের আরো নানান কথা শুনে নিতে পারবেন নিজ কানে।

কৃতজ্ঞতা: শামশুজ্জোহা আজাদ পলাশ ভাই, আরাফ কাশেমী ও ফাতেমা জোহরা।

সাইফুর মিশু, মুক্তিযোদ্ধার সন্তান

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪১ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬২ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩০ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯০ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৫ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ