প্রধান সম্পাদক : কবির য়াহমদ
সহকারী সম্পাদক : নন্দলাল গোপ
টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
Advertise
রেজা ঘটক | ০১ ফেব্রুয়ারী, ২০১৬
কোথায় যাচ্ছে বাংলাদেশ? বাহান্ন'র ভাষা আন্দোলনের দ্রোহ থেকে যে বাংলা একাডেমি সৃষ্টি হলো, সেই একাডেমি এবার হীরক জয়ন্তী পালন করবে, এটা আমাদের জাতীয় গৌরব। শহীদ মিনার, জাতীয় স্মৃতিসৌধ, বাংলা একাডেমি এই স্থাপনাগুলো বাংলাদেশের গর্ব, বাঙালির গর্ব।
ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতায় অমর একুশে বইমেলা এখন বাঙালির প্রাণের মেলা। সারা বছর আমাদের কবি, লেখক, প্রকাশক, বইপ্রেমী লাখ লাখ মানুষ ভাষার মাস ফেব্রুয়ারি ও অমর একুশে বইমেলার জন্য গভীর আগ্রহে অপেক্ষা করেন। বাংলা একাডেমিতে অনুষ্ঠিত অমর একুশে বইমেলায় না গেলে যেন আমাদের পেটের ভাত হজম হতে চায় না।
প্রতি বছর ১ লা ফেব্রুয়ারি সরকার প্রধান হিসাবে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী অমর একুশে বইমেলা'র শুভ উদ্বোধন করেন। তারপর পুরো ফেব্রুয়ারি মাসজুড়ে কবি, লেখক, প্রকাশক পাঠক ও বইপ্রেমীদের উচ্ছ্বাসে জমে ওঠে আমাদের প্রাণের বইমেলা। অমর একুশে বইমেলা এখন আমাদের ঐতিহ্যের অংশ।
কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে আমরা লক্ষ্য করছি, যে উদ্দেশ্য নিয়ে বাংলা একাডেমি সৃষ্টি হয়েছিল, যে একাডেমিকে আমরা বলি জাতির মননের প্রতীক, সেই একাডেমিতে কিছু ভূতের আছর লেগেছে। ২০০৪ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি অমর একুশে বইমেলা থেকে ফেরার পথে ডক্টর হুমায়ুন আজাদের উপর হামলা হয়েছে। ২০১৩ সালে আমাদের প্রাণের বইমেলায় আগুন দেওয়া হয়েছে। ২০১৫ সালে মৌলবাদীদের উস্কানিতে একাডেমি রোদেলা প্রকাশনীর স্টল বন্ধ করে দিয়েছে। আর মেলার শেষের দিকে ২৬ ফেব্রুয়ারি বিজ্ঞান লেখক অভিজিৎ রায় ও তাঁর স্ত্রী লেখক বন্যা আহমেদের উপর সন্ত্রাসীদের নৃশংস হামলা হয়েছে। সেই হামলায় অভিজিৎ রায় নিহত হয়েছেন। বন্যা আহমেদ মৃত্যুর ঘর থেকে ফিরে এসেছেন। একই ধারায় অভিজিৎ রায়ের বইয়ের দুই প্রকাশক জাগৃতি'র ফয়সল আরেফিন দীপন ও শুদ্ধস্বরের আহমেদুর রশীদ টুটুলের উপর তাঁদের প্রকাশনা কার্যালয়ে সন্ত্রাসীদের নৃশংস হামলা হয়েছে। সেই হামলায় ফয়সল আরেফিন দীপন নিহত হয়েছেন। অপর হামলায় শুদ্ধস্বরের অফিসে আহমেদুর রশীদ টুটুলের সঙ্গে দুইজন লেখক রণদীপম বসু ও তারেক রহিম গুরুতর আহত হয়েছেন। বন্যা আহমেদের মত এই তিনজনও মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে এসেছেন। সেই সব নৃশংস হামলার এখনো কোনো বিচার হয়নি। রাষ্ট্র অনেকটা নিরব ভূমিকায় রয়েছে।
লেখক ও প্রকাশকদের উপর মৌলবাদীদের জঘন্য নৃশংস হামলার পরেও বাংলা একাডেমি কোনো ধরনের উচ্চবাচ্য করেনি। শোক দেখায়নি, কাউকে সমবেদনা পর্যন্ত দেখায়নি। উল্টো এ বছর অমর একুশে বইমেলা শুরু হবার আগেই বাংলা একাডেমি'র মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান সাহেব প্রকাশকদের জন্য এক কঠোর সবক দিয়েছেন। উস্কানিমূলক কোনো লেখা যেন কোনো প্রকাশক না ছাপায়। যদি কেউ দায়িত্ব নিয়ে কারো উস্কানিমূলক লেখা ছাপায় তাহলে রোদেলা প্রকাশনীর মত ভাগ্য বরণ করতে হবে তাদের। এখন পর্যন্ত একাডেমি'র মহাপরিচালক সাহেবের এই বক্তব্যের কোনো আনুষ্ঠানিক প্রতিবাদ কোনো প্রকাশক বা প্রকাশনা সংঘ থেকে কেউ করেননি। বিচ্ছিন্নভাবে অনেকে সোশ্যাল মিডিয়ায় খান সাহেবের কথার জবাব দিয়েছেন। কিন্তু কোনো আনুষ্ঠানিক প্রতিবাদ এখন পর্যন্ত হয়নি। যা বাঙালি জাতির জন্য এই মুহূর্তে এক চরম লজ্জার বিষয়!
একাডেমি'র মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান সাহেবের খবরদারির সালতামামি করার আগে এবারের অমর একুশে বইমেলার জন্য আমার দুটি প্রস্তাব আছে। এবারের অমর একুশে বইমেলায় একাডেমি প্রাঙ্গণে লিটল ম্যাগাজিন চত্বরকে ‘লেখক অভিজিৎ রায় চত্বর’ ঘোষণা করা হোক। আর একুশে বইমেলার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের জাগৃতি প্রকাশনী'র চত্বরকে ‘ফয়সল আরেফিন দীপন চত্বর’ ঘোষণা করা হোক। এই দুটি চত্বর একুশে বইমেলার প্রথমদিন থেকেই করা হোক।
এবার আসি জনাব শামসুজ্জামান খান সাহেবের কারবারিতে। একুশে পদকপ্রাপ্ত শামসুজ্জামান খান সাহেবকে ২০০৯ সালে বাংলা একাডেমি'র মহাপরিচালক হিসাবে নিয়োগ দেওয়া হয়। তিন বছরের মেয়াদ শেষ হয় ২০১২ সালে। তখন তাঁকে আবার পুনঃনিয়োগ দেওয়া হয়। ২০১৫ সালে দ্বিতীয়বারের মেয়াদ শেষ হলে ১৫ জুলাই ২০১৫ সালে তাঁকে তৃতীয়বারের মত পুনঃনিয়োগ দেওয়া হয় একাডেমির মহাপরিচালক হিসাবে। এর আগে তিনি বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর ও বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি'রও মহাপরিচালক ছিলেন। বাংলাদেশের ইতিহাসে তিনি সম্ভবত প্রথম ব্যক্তি যিনি সরকারকে তৈলমর্দনে একজন যোগ্য চ্যাম্পিয়ন হবার গৌরব লাভ করেছেন। নইলে এক ব্যক্তি তিনটি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানে পাঁচবার কীভাবে মহাপরিচালকের দায়িত্ব পান? আমি তাঁর এই বিরল চ্যাম্পিয়নশিপকে গিনিজ ওয়ার্ল্ড বুক অব রেকর্ডে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য বিনীত অনুরোধ করছি!
আমরা সবাই জানি বাংলা একাডেমি পুরস্কার বাংলা সাহিত্যের সবচেয়ে বড় রাষ্ট্রীয় সম্মান। একাডেমি'র মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান দীর্ঘদিন বাংলা একাডেমিতে খবরদারি করার কারণে সেই বাংলা একাডেমি পুরস্কারকে উনি বিতর্কিত করেছেন। ২০১৪ সালের ভ্রমণ সাহিত্যে বাংলা একাডেমি পুরস্কার দেওয়া হয় সম্পূর্ণ অপরিচিত জনৈক প্রবাসী মাহফুজুর রহমানকে। যিনি পেশায় একজন ব্যাংকার, বসবাস করেন সুদূর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। তারচেয়ে বড় পরিচয় তিনি তাঁর বন্ধু। যিনি জীবনে একটিমাত্র ভ্রমণকাহিনী লিখেছেন। ‘নওগাঁ থেকে নিউ ইয়র্ক’ বইয়ের জন্য তাঁকে ভ্রমণ সাহিত্যে বাংলা একাডেমি পুরস্কার দেওয়া হয়, যার পেছনের সকল কলকাঠি নেড়েছেন এই খান সাহেব।
বাংলা একাডেমি পুরস্কারের জন্য লেখক মনোনীত করার একটি সুনির্দিষ্ট নিয়ম রয়েছে। নিয়ম হচ্ছে, পরিষদের ২৫ সদস্যের বেশি সংখ্যকের সম্মতি অর্জনের মাধ্যমে একটি তালিকা তৈরি করা হয়। সেই তালিকা দেওয়া হয় বাংলা একাডেমি পুরস্কারের জন্য গঠিত ১০ জনের কমিটিকে। সেই কমিটির কাউন্সিলররা চূড়ান্ত করেন পুরস্কারপ্রাপ্তদের নাম। তাঁরা চূড়ান্ত করে সুপারিশের জন্য কার্যনির্বাহী কমিটির কাছে নামগুলো পাঠাবেন। কিন্তু একাডেমি'র মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খানের একক দৌরাত্ম্য বাস্তবে তা হয়নি। অনেক সদস্য স্বাক্ষর দেয়ার আগে পর্যন্ত জানতেন না কাকে পুরস্কার দেয়া হচ্ছে। আবার তালিকার সবার নাম নিয়েও পরিষদের সবার মধ্যে ঐকমত্য ছিল না।
আরেকটি ব্যাপার হলো, যে কমিটি পুরস্কারপ্রাপ্তদের তালিকা তৈরি করবে, সেই কমিটির সদস্য জামিল চৌধুরীও পুরস্কারের জন্য নির্বাচিত হয়েছেন। পুরস্কারের জন্য গঠিত কমিটির এক সদস্যকে ওই কমিটিই নির্বাচিত করায় বিতর্ক আরও ডালপালা মেলেছে। ধীরে ধীরে খান সাহেবের কীর্তিকলাপ বাইরে চাউর হয়েছে। বাংলা একাডেমির উপ-পরিচালক মুর্শিদুদ্দীন আহমদ অবশ্য এই বিতর্ক প্রত্যাখ্যান করে বলেছেন, তিনি ছিলেন কমিটিতে। কিন্তু যেহেতু তাঁর নাম সুপারিশে এসেছে, তাই তাঁকে মূল্যায়নের কাজ থেকে দূরে রাখা হয়। এজন্য কমিটির সুপারিশে তাঁর স্বাক্ষর নেই।
এতো গেল খোদ বাংলা একাডেমি পুরস্কারের ভেতরে খান সাহেবের নানান কিসিমের কেরামতি'র খবর। খান সাহেব শুধু বাংলাদেশে নয় সুদূর বৃটেনেও একক প্রচেষ্টায় একটি পুরস্কার চালু করেছেন। গত তিন বছর ধরে বৃটেনে বইমেলা হচ্ছে। যার প্রধান উদ্যোক্তা বাংলা একডেমির মহাপরিচালক জনাব শামসুজ্জামান খান। আর এদের সঙ্গে আছে ব্রিটেনের একটি সাংস্কৃতিক জোট। খান সাহেবের আইডিয়া হলো, বাটি চালান দিয়ে প্রবাসী সাহিত্যিকদের আগে খুঁজে বের করা হোক। তারপর তাঁদের পুরস্কৃত করা হবে। সেই উপলক্ষে বাংলা একাডেমি'র ফান্ড থেকে চালু করা হয়েছে ‘প্রবাসী লেখক’ পুরস্কার। পুরস্কারের মান নগদ পঞ্চাশ হাজার টাকা, একটি ক্রেস্ট ও একটি সম্মাননা সনদ। সবচেয়ে মজার ঘটনা হলো, তাঁর একক কীর্তিতে এই পুরস্কার পেলেন লন্ডন প্রবাসী সালেহা চৌধুরী। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের পাঠদানের পাঠ চুকিয়ে (এক বছরের ছুটি নিয়ে) স্বামী তোফাজ্জল হোসেন চৌধুরীর লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের কথিত একটি স্কলারশিপের অজুহাত তুলে সালেহা চৌধুরী ১৯৭২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে দেশ ছাড়েন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এক বছরের ছুটি নিয়ে তিনি স্বামীর সঙ্গে লন্ডন গেলেও আর ফিরে আসেননি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরপর পাঁচ বছর ওঁনাকে চিঠি দিয়েছেন কাজে যোগ দেওয়ার জন্য। পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সালেহা চৌধুরীকে বাংলা বিভাগ থেকে বহিষ্কার করে।
সালেহা চৌধুরী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকাকালীন দুটি বই প্রকাশ করেছেন। ১৯৬৭ সালে গল্পের বই ‘যখন নিঃসঙ্গ’ এবং ১৯৭০ সালে একটি প্রবন্ধ সংকলন ‘সাহিত্য প্রসঙ্গ’। তারপর লন্ডনে ঘরসংসার, চাকরি, ছেলেমেয়ে মানুষ করার পেছনে সময় দিতে গিয়ে উনি লেখালেখি ছেড়ে দেন। পরবর্তী সময় খান সাহেবদের প্রেরণায় দীর্ঘ ২০ বছর পর উনি আবার কলম হাতে তুলে নিলেন। ওঁনার বড় ভাইয়ের প্রকাশনা থেকে বের হলো গল্পের বই 'উষ্ণতর প্রপাতে'। তারপর খান সাহেবের মেয়েকে লন্ডনের বাসায় থাকার জায়গা দেওয়ার বিনিময়ে পেয়ে গেলেন সুযোগ্য ‘প্রবাসী লেখক’ পুরস্কার।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর কিছু বুদ্ধিজীবীর দেশ ছাড়ার ইতিহাস আমরা জানি। একাত্তরের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় যারা পাকিস্তানপন্থী হিসেবে চিহ্নিত, তারা সকলেই কোনো না কোনো ছলাকলা কৌশল দেখিয়ে তখন দেশ ছেড়েছিলেন। সৈয়দ শামসুল হক যেমন জেনারেল টিক্কা খানের ছাড়পত্র নিয়ে লন্ডন গিয়েছিলেন। কারণ তাঁর স্ত্রী আনোয়ারা সৈয়দ হক ছিলেন টিক্কা খানের ক্যান্টনমেন্টের ডাক্তার। যে কারণে খান সাহেব প্রবর্তিত ‘প্রবাসী লেখক’ পুরস্কারপ্রাপ্ত লেখক সালেহা চৌধুরী'র দেশ ছাড়ার পেছনের ইতিহাস এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের চাকরি স্বেচ্ছায় ছাড়ার পেছনের ইতিহাস খতিয়ে দেখার জন্য নতুন প্রজন্মের প্রতি আমি আহবান জানাই। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি একটু খোঁজ নিলেই সেই নাড়ির খবর এবং অন্তরালের আরো অনেক গরম খবর বের হয়ে আসবে।
একাডেমি'র মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান লন্ডনের 'প্রবাসী লেখক' পুরস্কারের এই কেলেঙ্কারি আড়াল করার জন্য এই পুরস্কারটির নামই বদল করে ফেলেছেন। এখন ওটির নাম রাখা হয়েছে ‘ওয়ালীউল্লাহ সাহিত্য’ পুরস্কার। বাংলা সাহিত্যের বিখ্যাত কথাসাহিত্যিক সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ'র নামে এখন এই পুরস্কার চালু আছে। তিনি বাটি চালান দিয়ে নিজের পছন্দের যাকে খুঁজে পাবেন, প্রবাসীদের ভেতর থেকে সেই সৌভাগ্যবানকেই দেওয়া হবে ‘ওয়ালীউল্লাহ সাহিত্য’ পুরস্কার। খান সাহেব বাংলা একাডেমি'র দীর্ঘ ঐতিহ্য ভেঙ্গে নিজের পছন্দমত খুঁজে খুঁজে তাহলে কাদের পুরস্কার দিচ্ছেন? বাংলাদেশ কী সেই খবর রাখে? বঙ্গবন্ধু কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কী সেই খবর রাখেন? আমরা সবাই জানি খান সাহেব মাননীয় প্রধানমন্ত্রী'র অত্যন্ত প্রিয়ভাজনেষু।
এর আগে আমরা দেখেছি, মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে কালুরঘাট স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে বঙ্গবন্ধু'র পক্ষে ২৭ মার্চ ১৯৭১ সালে মেজর জিয়া স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেছিলেন। পরবর্তী সময়ে তিনি স্বাধীনতা যুদ্ধে জেড ফোর্সের নেতৃত্ব দেন। বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করার পর মেজর জিয়ার আসল চেহারা বাঙালির কাছে উন্মোচিত হয়েছে। মেজর জিয়া সৃষ্ট রাজনৈতিক দল 'বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল' বা বিএনপি পাকিস্তানের এজেন্ট জামায়াতে ইসলামী'র সঙ্গী হয়ে এখন মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের ৩০ লাখ শহীদকে নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টির পায়তারা করছে। যা আসলে পাকিস্তানের এজেন্ডা।
আমরা দেখেছি, মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের উপ-অধিনায়ক একে খন্দকার সাহেবের কীর্তি। তাঁর লেখা 'একাত্তর: ভেতরে বাইরে' পড়লে যে কেউ বুঝতে পারবে পাকিস্তান কোথায় কীভাবে তাদের নিজেদের লোক সেট করে রেখেছিল! খোদ সোহারাওয়ার্দী উদ্যানে পাকিস্তানের আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে একে খন্দকার সাহেব আসলে কোন পক্ষের প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন, সেটি এখন জাতির সামনে সবচেয়ে বড় প্রশ্ন! আরেক খন্দকার কুমিল্লার মোশতাক আহমেদ সাহেবের নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পরেও আমরা পাকিস্তানপন্থীদের এখনো পুরোপুরি চিহ্নিত করতে পারিনি। এখনো বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের অনেক বড় বড় পদ, পদবিতে এসব পাকিস্তানপন্থী লোকেরা ঘাপটি মেরে বসে আছে। যাদের কেউ কেউ চিহ্নিত, কেউ কেউ একেবারে বর্ণচোরা।
অমর একুশে বইমেলায় উস্কানিমূলক বই প্রকাশ করা যাবে না বলে খান সাহেব আমাদের কীসের ইঙ্গিত দিচ্ছেন? খোদ বাংলা একাডেমি সৃষ্টি হয়েছে 'রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই' উস্কানিতে। নইলে জিন্নাহ সাহেব উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার জন্য তাঁর পরিষদ খাজা নাজিমুদ্দিন গংরাসহ একপায়ে খাঁড়া ছিলেন। বাংলার দামাল ছেলেরা রফিক, শফিক, বরকত, জব্বার, সালামরা বুকের তাজা রক্ত দিয়ে আমার মায়ের ভাষাকে সেদিন বাঁচিয়েছিলেন। বাংলা একাডেমি একটি সুস্পষ্ট উস্কানির ফসল। সেই উস্কানি বাঙালি জাতির গর্বের, বাঙালির গৌরবের। বাংলা একাডেমি এখন বাংলাদেশের একটি ঐতিহ্যের নাম। বাঙালি জাতির মননের প্রতীক।
অমর একুশের বইমেলায় কোন বইটি উস্কানিমূলক নয়? অমর একুশে বইমেলায় যত রাজনীতি বিষয়ক বই প্রকাশ পায়, তার কোনটি উস্কানিমূলক নয়? যত ধর্মীয় বই প্রকাশ পায়, তার কোনটি উস্কানিমূলক নয়? যত বিজ্ঞানের বই প্রকাশ পায়, তার কোনটি উস্কানিমূলক নয়? যত কবিতার বই, গল্পের বই, উপন্যাস প্রকাশ পায়, তার কোনটি উস্কানিমূলক নয়? বইয়ে কোনো রকমের উস্কানি না থাকলে সেই বই কোনো পাঠককে আকৃষ্ট করে কীভাবে? খান সাহেব উস্কানি বলতে আসলে কী বোঝাতে চেয়েছেন? বরং অমর একুশে বইমেলা শুরু হবার আগেই বাংলা একাডেমি'র মহাপরিচালক হিসাবে উনি কবি, লেখক, প্রকাশক এবং বইপ্রেমী পাঠকদের উদ্দেশ্য করে একটি সুস্পষ্ট উস্কানি দিয়েছেন।
এই উস্কানির সোজাসাপটা মানে দাঁড়ায় একুশের বইমেলায় যেন নতুন কোনো আইডিয়া, নতুন কোনো আবিষ্কার, নতুন কোনো স্বপ্ন নিয়ে কেউ বইপ্রকাশ না করেন! এই উস্কানির মানে হলো সিলেবাসের বাইরে যেন কোনো প্রকাশক বই না ছাপেন। এই সিলেবাস মানে মৌলবাদীদের তথাকথিত আবদারের অজুহাত। এই সিলেবাসের মানে হলো মৌলবাদীরা যেভাবে খান সাহেবকে নসিহত করেছেন, সেই নসিহতের তর্জমা। এই উস্কানি অনুবাদ করলে তার মানে দাঁড়ায়, খান সাহেব মৌলবাদীদের পক্ষে সুস্পষ্টভাবে ওকালতি করছেন। এই উস্কানির মানে হলো অমর একুশের বইমেলাকে বিতর্কিত করা। এই উস্কানির শানেনজুল হলো পাকিস্তানীদের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করা।
মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশ স্বাধীন হলেও এখনো বাংলাদেশে সুস্পষ্টভাবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষে এবং পাকিস্তানের পক্ষে দুটি গ্রুপ সক্রিয়। কোন লোকটি যে কার পক্ষে কখন কাজ করছে, সেই সুনির্দিষ্ট তথ্যের এখনো অভাব রয়েছে। কেবল খন্দকার সাহেবদের মত কারবারি ধরা পড়ার পর সবাই স্বীকার করেন, ওরা আসলে পাকিস্তানের দালাল। ধরা না পরার আগে ঘাপটি মারা সেইসব লোক চিহ্নিত করার সময় এখন নতুন প্রজন্মের হাতে।
একুশের বইমেলা নিয়ে খান সাহেব যে উক্তি উচ্চারণ করেছেন, তা ওনার বাংলা একাডেমি'র মহাপরিচালক হিসাবে বলার কথা নয়। বরং তরুণ প্রজন্মের উদ্দেশ্যে আরো নতুন নতুন জাগরণ সৃষ্টিমূলক লেখা আহবান করার কথা ওঁনার।
বাংলাদেশ এখন সুস্পষ্টভাবে একটি কঠিন ক্রান্তিকাল পাড়ি দিচ্ছে। ৪৪ বছর পর দেশে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হচ্ছে। পরাজিত একাত্তরের শত্রুরা এখনো সারা বাংলাদেশে মরণপণ চেষ্টা করছে কামড় দিতে। সেই মুহূর্তে বাংলা একাডেমি'র মহাপরিচালক হিসেবে খান সাহেব যেখানে তরুণ প্রজন্মের কাছে আরো জাগরণমূলক নতুন নতুন উস্কানি-উদ্দীপনা-স্বপ্ন জাগানো লেখা আহবান করার কথা, সেখানে উনি প্রকাশকদের হুশিয়ারি দিয়েছেন কেউ যেন উস্কানিমূলক লেখা না ছাপেন! তাহলে খান সাহেব আসলে কাদের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে চান?
বাংলা একাডেমি বাঙালি জাতির মননের প্রতীক। সেই প্রতিষ্ঠানের প্রধান হিসাবে এমন একজন ভীরু, দলকানা, কারবারিপটু, বাংলা একাডেমি পুরস্কারকে বিতর্কিত করা লোককে কিছুতেই আমরা দেখতে চাই না।
বাংলা একাডেমি আমাদের সবার অস্তিত্বের ঠিকানা। আমাদের সেই প্রাণের ঠিকানায় এমন একজন বিতর্কিত লোক কীভাবে টানা তিনবার কোন যোগ্যতায় মহাপরিচালকের পদে আসীন থাকেন? অমর একুশে বইমেলার এই ফেব্রুয়ারি মাসেই শামসুজ্জামান খানকে বাংলা একাডেমি থেকে সম্মানের সাথে সরিয়ে নেওয়া হোক। নইলে স্বাধীনতার মাস মার্চে শামসুজ্জামান খানের পদত্যাগের প্রশ্নে নতুন প্রজন্ম আন্দোলনে যাবে। সোজা কথা বাংলা একাডেমি'র মহাপরিচালকের পদ থেকে জনাব শামসুজ্জামান খানের স্বেচ্ছায় পদত্যাগ চাই।
মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।
আপনার মন্তব্য