আজ শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

Advertise

প্রধানমন্ত্রী কী মনোযোগ সরাতে চাইছেন!

মাসকাওয়াথ আহসান  

আমরা জানি মিডিয়াকে রাজনীতিবিদেরা দীর্ঘদিন ধরে ব্যবহার করে আসছেন বিশেষ বিশেষ পরিস্থিতিতে জনগণের মনোযোগ কোন একটি বড় সংকট থেকে সরিয়ে অন্য প্রসঙ্গ অবতারণার কাজে। ২১ শে ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশে একজন হিন্দু পুরোহিতকে হত্যা করা হয়। আরেকজন গুলিবিদ্ধ হন। এটা স্পষ্ট করে তোলে বাংলাদেশের বর্তমান আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির ভঙ্গুরতার দিকটি। যে একুশে ফেব্রুয়ারি এখন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে আদিবাসী ও নৃগোষ্ঠীগুলোর ভাষা-সংস্কৃতি রক্ষার প্রতীক হিসেবে বিশ্বজুড়ে সম্মানিত; যে সম্মান বাঙালি বুকের রক্ত দিয়ে অর্জন করেছে। সেই বাঙালি কিছু সেটলার পার্বত্য চট্টগ্রামে ২১শে ফেব্রুয়ারিতে কুপিয়েছে পাহাড়ের আদিবাসীদের। এই দুটো ঘটনা একুশের অর্জনকে ম্লান করে দিয়েছে; এবং এরকম ঘটনা নিয়মিতভাবেই ঘটে চলেছে “অসাম্প্রদায়িকতার শ্লোগান” সিঞ্চিত আওয়ামী লীগের শাসনামলে; এটা খুবই দুর্ভাগ্যজনক।

স্বাভাবিকভাবেই প্রত্যাশা ছিলো এই মুহূর্তে জাতির অভিভাবক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চিন্তার জগতে এই ঘটনা দুটো গভীর বেদনার রেখাপাত ঘটাবে। হয়তো ঘটিয়েছেও। কিন্তু আমাদের তা জানা হলো না। বরং আমরা লক্ষ্য করলাম প্রধানমন্ত্রী বিগত এক এগারো সরকারের আমলে ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহফুজ আনাম গোয়েন্দা সংস্থার দেয়ার তথ্য ছাপিয়ে সম্প্রতি ভুল স্বীকার করেও কেন পদত্যাগ করলেন না সেই প্রসঙ্গ টেনে আনলেন। আর প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্যের আগে কাকতালীয়ভাবে সরকারের কোরাস শিল্পী যে অনলাইন নিউজপেপার “মাহফুজ আনাম” ইস্যুটিকে টক অফ দ্য টাউন করে তুলেছিলো; তার পক্ষ থেকে মাহফুজ আনামকে সাংবাদিকতার নৈতিকতার নসিহত করে তাকে ক্ষমা করে দেয়ার একটি সস্তা নাটকের পান্ডুলিপিধর্মী অভিমত কলাম ছাপা হয়। অর্থাৎ ঘুরে ফিরে এখন মাহফুজ আনামকে নিয়ে ভাবতে হবে।

নিহত বা গুলিবিদ্ধ পুরোহিত, নির্যাতিত পাহাড়ের আদিবাসী; তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ যেন মাহফুজ আনাম প্রসঙ্গটি। এই যে প্রধানমন্ত্রী এবং উনার সরকারের ভ্রান্তিগুলো থেকে জনগণের মনোযোগ অন্যদিকে নিয়ে যাবার কাজটি নিয়মিত চালিয়ে যাওয়া অনলাইন নিউজপেপার; তাদের এই একুশে ফেব্রুয়ারি পরবর্তী অভিমতের সমবেত সংগীত; এটাকেই মিডিয়া চিন্তক নোয়াম চমস্কি বলেছেন, নেসেসারি ইলিউশান। অর্থাৎ রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে মূল সংকট থেকে জনগণের মনোযোগ ইচ্ছাকৃতভাবে ঘুরিয়ে দেয়া; এটাকে শাসকের ও শাসকাশ্রিত মিডিয়ার প্রয়োজনীয় ভ্রান্ত-অধ্যাস তৈরির খেলা হিসেবে চিহ্নিত করেছেন চমস্কি।

এইভাবে নানা সময়ে প্রধানমন্ত্রী এবং উনার মনপছন্দ মিডিয়া নেসেসারি ইলিউশান তৈরি করে লুকিয়ে রাখছে রাষ্ট্রব্যবস্থার আসল ক্ষতগুলো। আর যেহেতু ক্ষমতা বলয়ের অধিকাংশ মানুষই তাদের জীবন নির্বাহের জন্য রাজনীতি ব্যবসার ওপর খুবই নির্ভরশীল; তাদের মাঝেও কেউ দাঁড়িয়ে বলছে না, ক্ষত লুকিয়ে রাখলে ক্ষত সেরে যায়না; বরং ক্ষতটা আরো বড় হয়। গ্যাংরিনে আক্রান্ত হয়ে পড়ে পুরো রাষ্ট্রব্যবস্থা।

প্রধানমন্ত্রীকে খুব সম্ভব উনার মিডিয়া নীতিতে কিছু পরিবর্তন আনতে হবে। কারণ নোয়াম চমস্কি যে নেসেসারি ইলিউশান এবং ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে মিডিয়ার খেলার কথা উল্লেখ করেছেন; মিডিয়া বুম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কল্যাণে বাংলাদেশের জনমানুষ বিষয়টি খুব ভালোভাবে ধরে ফেলেছে। বিশেষ করে বিগত বিএনপি-জামাত আমলের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ কালের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীরা যখন “বিচ্ছিন্ন ঘটনা” ও “মিডিয়ার সৃষ্টি” বলে কট্টরপন্থার রাহুগ্রাসকে একই ভাষায় উড়িয়ে দিয়ে আসছেন; জনগণ এখন ভালোই বোঝে খোঁড়া অজুহাত বিষয়টা কী এবং কতপ্রকার।

আর আসল ঘটনা থেকে জনমনোযোগ অন্যদিকে সরানোর এই খেলাটি বহু ব্যবহারে জীর্ণ। এতে আর খুব বেশী কাজ হবে বলে মনে হয়না। বরং সত্যকে সহজভাবে নিয়ে সত্যের মুখোমুখি হতে পারাটাই কাজের কথা। এখন শতচেষ্টা করেও মাহফুজ আনাম ইস্যুটিকে টক অফ দ্য টাউন বানানো কঠিন হবে; কারণ পুরোহিতের মৃত্যু ও আদিবাসীদের কোপানোই সভ্য সমাজের দুশ্চিন্তার বিষয়। এরকম ঘটনার বিরুদ্ধে গণপ্রতিরোধ গড়ে তুলতে না পারলে; অন্যধর্মের মানুষ হত্যা ও উচ্ছেদে পাকিস্তানের বর্বরতা-রেখাটি অতি দ্রুতই স্পর্শ করবে বাংলাদেশ। এতে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধে শহীদ ৩০ লাখ মানুষের আত্মা অপমানিত বোধ করবে। মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্নগুলো অধরা থেকে যাবে। কারণ কেবল ব্যবসা সফল বাংলাদেশ নয়; পরমতসহিষ্ণুতার এক সুষম ব-দ্বীপ বিনির্মাণ ছিলো মুক্তিযুদ্ধের মূল লক্ষ্য।

পুরোহিত হত্যা ও আদিবাসী কোপানো থেকে জনগণের মনোযোগ মাহফুজ আনামে ফেরাতে প্রধানমন্ত্রী মাহফুজ আনামকে পদত্যাগের দাবী জানিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী নিশ্চয়ই জানেন, দেশে দেশে একটি নৌযান ডুবে মানুষের মৃত্যু হলে নৌমন্ত্রী পদত্যাগ করেন। দালান ধসে মানুষের মৃত্যু ঘটায় প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগের দৃষ্টান্তও রয়েছে। বাংলাদেশে অসংখ্য নৌযান ডুবে অযুত মানুষের মৃত্যুতে কেউ পদত্যাগ করেন নি। রানাপ্লাজার দালান ধসে এগারোশো’র বেশী সেলাই কর্মীর মৃত্যুর পর কাউকে পদত্যাগ করতে দেখিনি। পদত্যাগের সংস্কৃতি চর্চার মত নৈতিক ঋজুতা বাংলাদেশে কে কবে দেখিয়েছেন আমার মনে পড়ে না।

প্রধানমন্ত্রী মাহফুজ আনামের সাংবাদিকতা নৈতিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন; সেটা খুবই সঙ্গত। কিন্তু অন্যের দিকে আমরা যখন একটি আঙ্গুল তুলি; তখন নিজের হাতের চারটি আঙ্গুল নিজের দিকেই নির্দেশিত হয়। আজকের এই যে পুরোহিত হত্যা; আদিবাসী নির্যাতন; অন্যধর্মের মানুষ উচ্ছেদ; এর পেছনে স্বৈরশাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের “ইসলাম”-কে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ঘোষণার মারণ-সিদ্ধান্তটিই দায়ী। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে এই স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক আন্দোলনে অসংখ্য তরুণ শহীদ হয়েছে। কিন্তু ক্ষমতামুখী রাজনীতির অনৈতিক চর্চার কারণে সেই স্বৈরশাসক এখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ দূত। এই নির্মম স্ববিরোধিতাকে প্রধানমন্ত্রী কোন নেসেসারি ইলিউশান দিয়ে ঢাকবেন।

এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে নিহত তরুণদের পিতা-মাতারা কিংবা আওয়ামী লীগে আস্থা রেখে প্রতিনিয়ত উচ্ছেদ হয়ে যাওয়া অন্যধর্মের মানুষ প্রধানমন্ত্রীর নৈতিকতাকে কীভাবে দেখছেন; বা ইতিহাস শেখ হাসিনার রাজনৈতিক নৈতিকতাকে কীভাবে মূল্যায়ন করবে সে নিয়ে নিশ্চয়ই শ্রদ্ধেয় প্রধানমন্ত্রী আত্মজিজ্ঞাসার মুখোমুখি হবেন।

তবে এই মুহূর্তে যেটি জরুরী তা হলো সংকটের অগ্রাধিকার বিবেচনা, বাছাই ও সমাধান। মাহফুজ আনাম দিয়ে নেসেসারি ইলিউশান তৈরির তামাদি কৌশল জনমনে কোন হ্যালিউসিনেশান তৈরি করতে ব্যর্থ হবে বলাই বাহুল্য।

মাসকাওয়াথ আহসান, সাংবাদিক, সাংবাদিকতা শিক্ষক

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪১ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬২ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩০ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯০ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৫ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ