প্রধান সম্পাদক : কবির য়াহমদ
সহকারী সম্পাদক : নন্দলাল গোপ
টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
Advertise
জুয়েল রাজ | ০৪ মার্চ, ২০১৬
২ মার্চ আমাদের পতাকা দিবস। ১৯৭১ সালের এই দিনে সর্বপ্রথম বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়েছিল। এ বছরের ২ মার্চ বাংলাদেশ যখন মিরপুর স্টেডিয়ামে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে এশিয়া কাপের সেমিফাইনালরূপী ম্যাচ খেলছিল অনুভূতিটা তাই অন্যরকম ছিল।
বিদেশ বিভূঁইয়ে যাবতীয় ব্যস্ততা ভুলে সবাই যেন বুদ ছিল ক্রিকেটে। পরিচিত একজন বাজির দানে ধরে দিলেন ১০০০ পাউন্ড কোন কারণ ছাড়াই। শুধুমাত্র বাংলাদেশ জিতবে এই প্রত্যাশায়। ভদ্রলোক যেমন ক্রিকেট বোদ্ধা না তেমনি বাজিগরও না। সহকর্মী একজনের স্ত্রী হাজার মাইল দূর থেকে ফোন দিয়েছিলেন একরকম ধমক দিয়েই ভদ্রলোক ফোনটা কেটে দিলেন খেলার পরে কথা হবে,এই বলে।
টেলিভিশনে দেখলাম মিরপুরের স্টেডিয়ামে তিল ধারণের জায়গা ছিলনা। একটা সময় সাকিবকে হারিয়ে বাংলাদেশ যখন বেশ চাপের মুখে, গ্যালারী জুড়ে প্রার্থনারত মানুষের মুখ, বারবার কেন জানি কণ্ঠরোধ হয়ে আসছিল। মাঝে মাঝেই এক ঝলক দেখছিলাম পরিচিত কিছু মুখ, সাথে দেশের বিভিন্ন মাধ্যমের তারকাদের। মনে হয়নি হাজার মাইল দূরে বসে খেলা দেখছি।
শেষ বলে মাহমুদউল্লাহর চার রানে যে বিজয় উল্লাস, তা ছোঁয়ে গেছে পৃথিবীর সকল বাঙালিকে। স্টেডিয়ামের দর্শক গ্যালারির কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রধানমন্ত্রীর এই ক্রিকেট প্রেম সর্বজনবিদিত। বাংলাদেশের খেলা হলেই মাঠে উপস্থিত থাকার চেষ্টা করেন তিনি।
ভারতের আনন্দবাজার লিখেছে, ‘‘এই উপমহাদেশের সবচেয়ে ক্রিকেটপ্রেমী প্রধানমন্ত্রী’’ তাঁর উপস্থিতি বাংলাদেশ টিমকেও অনুপ্রেরণা যোগায় বলেই সবার বিশ্বাস। আজকের (২ মার্চ) খেলার বিজয়ে প্রধানমন্ত্রীর আনন্দ অশ্রুটুকু আবেগতাড়িত করেছ আমাদেরকেও।
আমার এক বন্ধুর ফেইসবুক ওয়ালে ছবিটা দেখে লিখেছিলাম এই আবেগের কারণেই আপনাকে ভালোবাসি। যার সূত্রধরে আসলে এই লেখার সূচনা। প্রধানমন্ত্রীর আবেগের কাছে বারবার হার মানে বাংলাদেশ, সেটা ক্রিকেট থেকে শুরু করে পুরাণ ঢাকায় অগ্নিকাণ্ডে নিহত পরিবারের মেয়েদের নিজের মেয়ের মতো আগলে রাখা। পেট্রোল বোমায় আহত নিহতদের খোঁজ খবর নেয়া।
সম্প্রতি বাহুবলে চার শিশু হত্যাকাণ্ডে পরিবারের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়া। এই জাতীয় শত শত ঘটনার উদাহরণ আছে। একজন প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বের বাইরে এসে সাধারণ মানুষের প্রতি তাঁর মমত্বের কারণেই তাকে অসাধারণ মনে হয়।
সবচেয়ে বড় যে বিষয়টি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ক্ষেত্রে ইস্পাত কঠিন ব্যক্তিত্বের যে প্রমাণ শেখ হাসিনা দিয়েছেন, শুধুমাত্র এই একটি কারণেই বাংলাদেশ যতদিন থাকবে শ্রদ্ধার সাথে তাঁর নামটি ও উচ্চারিত হবে।
কিন্তু প্রধানমন্ত্রী কি এই খবরটুকু রাখেন? তাঁর আনন্দ অশ্রু যেমন দেশের মানুষকে আপ্লুত করে তোলে। তাদের চোখের কোণেও চিকচিক করে সেই অশ্রুকণা। তেমনি তার নীরবতায় ও কতো চোখ অশ্রু ঝরিয়ে পাথর হয়ে যায়। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে গণহারে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উপর যে নির্যাতন চলছে পাহাড় থেকে সমতল হিন্দু থেকে বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান কিংবা আদিবাসী কেউই বাদ যাচ্ছেনা। আমি ব্যক্তিগত ভাবে ধর্ম বিশ্বাসী না। কিন্তু জন্মগত ভাবে পারিবারিক কারণে আমি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ভুক্ত। তাই পরিচিত মানুষগুলোর দুর্দশার কথা যখন শুনি নিজেকে বড় অসহায় লাগে। নাস্তিক বলে পরিচয় দিলেও দিন শেষে আমাকে পারিবারিক ধর্মীয় পরিচয়ে গণ্য করা হয়। আমি ছাড়লে ও মানুষ আমাকে ছাড়ে না।
সবচেয়ে অবাক করার মত যে বিষয়টি সেটি হচ্ছে নির্যাতিত এই সব মানুষের বিশ্বাসটুকু এতোই শক্তিশালী অবাক না হয়ে পারিনা। তাদের বিশ্বাস সারাদেশে এই যে প্রতিদিন সংখ্যালঘুদের উপর নির্যাতন নিপীড়ন হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী এই বিষয়টি জানেন না। ছোট ছোট বিভিন্ন বিষয়ে তিনি যেভাবে হস্তক্ষেপ করে সমাধান করে দেন। কিন্তু ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের নির্যাতনের ঘটনা জানলে নীরব থাকার কথা না। কারণ তিনি বঙ্গবন্ধু কন্যা। অনেক কিছুই তিনি আবেগ দিয়ে বিচার করেন। এই মতামত শোনার পরে আর কিছু কি বলার থাকে!
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বাবরী মসজিদ ভাঙার সময়কাল থেকে শুরু করে ২০০১ সালের নির্বাচনে বিজয় লাভের পর বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের উপর জামায়াত বিএনপি জোটের সেই নির্যাতন উৎসব থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত একটা দিনের জন্য ও কি থেমেছে? থামেনি। আর থামবেও যে তার কোন সম্ভাবনা নাই বললেই চলে।
সংখ্যালঘুদের সম্পত্তি দখল চলছে তো চলছেই। যার সাথে আপনার আত্মীয়স্বজনের নাম ও জড়িয়ে যাচ্ছে। তবু শেষ ভরসা হিসাবে আপনাকেই বিবেচনা করে সবাই। বাংলাদেশের ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা বিশ্বাস করে আপনি যদি সংসদে দাঁড়িয়ে একদিন বলেন আজকের পর থেকে দেশে কোন সংখ্যালঘু পরিবারের উপর কোন ধরণের নিপীড়ন, নির্যাতন বরদাস্ত করা হবে না। একটি নির্যাতন বা জবর দখলের বিচার যদি দ্রুততম সময়ে বাস্তবায়িত হয় বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতনের ঘটনা ঘটাতে কেউ সাহস পাবেনা। শুধুমাত্র এই বিশ্বাসটুকু সম্বল করে ধর্মীয় সংখ্যালঘু মানুষগুলো মুখ বুজে মার খাচ্ছে। পূর্বপুরুষের মাটি কামড়ে পড়ে আছে। জাতির জনকের কন্যা, অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির ধারক-বাহক হিসাবে একটি মানুষকে এরা শ্রদ্ধার স্থানে রেখেছে,তিনি শেখ হাসিনা।
ব্লগার যারা খুন হয়েছে তাঁরা সবাই মুক্তিযুদ্ধের চেতনা লালন করতেন। অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখতেন। মানুষকে মানুষ হিসাবে ভালবাসার কথাই বলতেন। বাংলাদেশকে ভালবাসতেন। মাতৃভূমির দুর্দিনে এরাই হতো আজাদ, বদি, রুমি, জুয়েল কিংবা বিচ্ছু জালাল। বাংলাদেশের চিন্তার বিকাশে এ ব্লগাররা কলম ধরেছিল, কি-বোর্ড ধরেছিল।
রাজীব, জগৎজ্যোতি, অভিজিৎ, অনন্ত , বাবু নিলয় থেকে দীপন। কণ্ঠগুলো বন্ধ আজ। আর যাদের কণ্ঠে এখনো রক্ত বহমান তাঁরা আজ নিষ্প্রাণ। রুদ্ধ তাঁদের কণ্ঠ। ম্রিয়মাণ, নিষ্প্রাণ, ভীত। ওপরের নামগুলো এখন শুধুই নাম। তাঁদের নিয়ে গলা খুলে প্রতিবাদেও আজ কণ্ঠ সরে না। কোমলমতি ছেলেমেয়েগুলো মাতৃভূমি ছেড়ে পাড়ি জমিয়েছে বিদেশে বিভূঁইয়ে। আমরা যারা চাইলে ও দেশে ফেরার সাহস পাচ্ছি না।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর বিজয় অশ্রু যেমন আবেগে আপ্লুত করে। তেমনি দেশের জন্য বুক পোড়ে প্রতিনিয়ত। পরিবার পরিজনের চোখে ও বেদনার অশ্রুপাত হয়। প্রতিনিয়ত চোখের সামনে থাকা মানুষগুলো চাপাতির কোপের পর প্রথমে হয় লাশ কিংবা ডেডবডি পরম শ্রদ্ধায় যাকে গতকালও ডেকেছি দাদা অথবা ভাই নয়তো নাম ধরে। কিছুদিন কলরব হয়, সচিত্র কালো ব্যানার ওঠে প্রতিবাদ কিংবা স্মরণসভার হেডটেবিলের পেছনে। বা ভুলে যাবার তারও কিছুদিন পর একটু বর্ষপূর্তি, একটু পরিবারের সদস্যদের স্মরণ। ভয়ে ভয়ে গা-বাঁচিয়ে, অলক্ষ্যে খুব কাছের মানুষদেরও অপস্রিয়মাণ সরে যাওয়া।
কিন্তু পরিবারগুলো কি ভুলেছে তার প্রিয়জনের শূন্যতা? যে মানুষটি প্রতিটি দিন পাশে থাকতো, যার জীবন্ত শরীরটি উঠে যাবার পরও তপ্ততা অনুভূত হতো প্রিয়জনের অনুভবে- সে রেখে যাওয়া প্রিয়জন এত সহজে ভুলেছে কি প্রিয়তম মানুষটিকে হারানোর শোক? শুকোয় কি তাদের চোখ? নুনা জলে কোল ভরে থাকে অহর্নিশি।
যে হারায় একমাত্র সে-ই জানে কতটা অসহনীয় প্রিয়জন হারানোর বেদনা। বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চের ভাষণে বলেছিলেন, আমরা যখন মরতে শিখেছি তখন কেউ আমাদের দাবাতে পারবেনা। মুক্তচিন্তার এই তরুণরা ও মরতে শিখে গেছে দাবায়ে রাখা যাবেনা।
একবার জোর গলায় বলুন সংখ্যালঘু , সংখ্যাগুরু, আস্তিক , নাস্তিক নিয়েই আমার বাংলাদেশ। ভিন্ন মত প্রকাশের দায়ে আমার কোন ছেলেমেয়ে দেশ ছেড়ে পালাবে না। চোখের জল নিয়ে কোন সন্তানের লাশের পাশে দাঁড়াবে না কেউ।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনার আবেগের কাছে আবারো হারতে চায় বাংলাদেশ!
মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।
আপনার মন্তব্য