আজ মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল, ২০২৪

Advertise

বিতার্কিক বাঙালি ও বঙ্গবন্ধুর সাত মার্চের ভাষণ

আরিফ রহমান  

বাঙালি বিতার্কিক জাতি, বাঙালি বিতর্ক করতে ভালোবাসে তাদের প্রতিটা অর্জন নিয়ে, নিজের মা-বোনের লাশের সংখ্যা নিয়ে, স্বাধীনতা ঘোষণা নিয়ে, বাঙালি বিতর্ক করে জাতীয় সংগীত নিয়ে, বিতর্ক করে পতাকার মাপ নিয়ে, বিতর্ক করে রাষ্ট্রের চার মূলনীতি নিয়ে। আজকের দিন নিয়ে যেমন বিতর্ক হয় "৭-ই মার্চ মুজিব স্বাধীনতা ঘোষণা করলেন না ক্যান..." এই নিয়ে।

এহেন বিতর্কের মধ্যে থেকে একজন অনুসন্ধানী মানুষ কিভাবে বুঝতে পারবে সত্য আর মিথ্যার পার্থক্য?

সাতই মার্চের ভাষণ নিয়ে তো অনেকের অনেক কথা অনেক ইতিহাসই শুনলেন। আজ আপনাদের শোনাবো দুইজন পাকিস্তানী জেনারেলের কণ্ঠে সাতই মার্চের ভাষণের বয়ান। বিরোধী শিবিরের তথ্য যেহেতু- ধোঁয়া খানিকটা কাটলেও কাটতে পারে।

একাত্তরের মার্চে আমাদের দেশের প্রধান সামরিক প্রশাসক ছিলেন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল খাদিম হোসেন রাজা। এই লোকটাই টিক্কা খানের সাথে এক টেবিলে বসে পৃথিবীর ঘৃণ্যতম গণহত্যা অপারেশন সার্চলাইটের পরিকল্পনা করে। নিজের লেখা 'এ স্ট্রেঞ্জার ইন মাই ওউন কান্ট্রি' বইতে গর্ব ভরে বলেছে "অপারেশন সার্চলাইট"-এই নামকরণ করেছে সে নিজে। তার বইতে সাতই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের কথা উঠে এসেছে গুরুত্ব নিয়ে।

এছাড়া কিঞ্চিত আলোচনা করা যায় জেনারেল রাও ফরমান আলীর বই- 'হাউ পাকিস্তান গট ডিভাইডেড' নিয়ে। এই রাও ফরমান আলী মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানের সামরিক প্রশাসক ছিলেন। পদমর্যাদায় জেনারেল নিয়াজীর সমান। নিয়াজি পরিচালনা করতো যুদ্ধ আর ফরমান চালাতো প্রশাসনিক কাজ। রাজাকার, আল-বদর, আল-সামস এর মত বেসামরিক সৈনিকদের পরিচালনা করতো। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভাবে বলতে গেলে ফরমান ছিলো বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের প্রমাণিত নায়ক। স্বাধীনতার পর তার অফিস থেকে একটা ডাইরিতে পাওয়া যায় বুদ্ধিজীবীদের নামের তালিকা, যেসব বুদ্ধিজীবীদের একজনকেও স্বাধীন বাংলায় আর দেখি নাই আমরা।


খাদিম হোসেন রাজা কিংবা রাও ফরমান আলীর মত পাকি জারজদের মুখে সাতই মার্চের তাৎপর্য যখন শুনবেন তখন আর কষ্ট করে বাঁশেরকেল্লার দেশী জারজদের কাছ থেকে ইতিহাস শোনার প্রয়োজন পড়বে না।

ব্রিগেডিয়ার জেনারেল খাদিম হোসেন রাজা লিখেছে-

"আগে থেকেই গুঞ্জন চলছিলো সাতই মার্চ কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে। বঙ্গবন্ধু হয়ত স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে দিতে পারে। তার প্রস্তুতি হিসেবে ক্যান্টনমেন্ট ছিলো সর্বোচ্চ সতর্কতায়।"

খাদিম পরিষ্কারভাবে বলেছে-

"চারটি ব্যাটিলিয়ান প্রস্তুত ছিলো, তিনটি কামানের মুখ করা ছিলো সমাবেশ স্থলের দিকে। যদি সমাবেশ থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা আসে তাহলে ঢাকাকে মাটির সাথে মিশিয়ে দেয়া হবে মুহূর্তে... আমার দেশের অখণ্ডতা রক্ষা করার জন্য সবকিছু করতে রাজি আমি।"

জয় বাংলার পরে জয় পাকিস্তান বলার সমস্যা কিংবা মুজিব কেন সাতই মার্চ সরাসরি স্বাধীনতার ঘোষণা দিলেন না টাইপের বিভ্রান্তিতে যারা আছেন তাদের অধিকাংশই সোজা বাংলায় স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি এছাড়া মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কম জানা কিন্তু বেশী বলা কিছু মানুষের মুখে এমন কথা শোনা যায়। সাতই মার্চের ভাষণটা কতটা ডিপ্লোম্যাটিক ছিলো সেটা বুঝতে হলে আপনাকে সেই সময়ের সিচুয়েশান খুব ভালো করে বুঝতে হবে।

একটু লক্ষ্য করলেই দেখবেন সেদিন যদি বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ডাক দিয়ে দিতেন তাহলে তিনি হতেন একজন বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতা। পাকি সরকার তাকে একহাত দেখে নেয়ার সুযোগ পেতো, বিচ্ছিন্নতাবাদী বিদ্রোহের ধোঁয়া তুলে সমূলে নির্মূল করা হতো মুক্তিকামীদের। একবার লক্ষ্য করুন এখনও পৃথিবীর বহুদেশ স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করছে। আফ্রিকার খমুজ, ভারত কিংবা পাকিস্তানের কাশ্মীর অংশ, পাকিস্তানের বেলুচিস্তান, রাশিয়ার বেশ কয়েকটা অংশ স্বাধীনতা জন্য সংগ্রাম করছে। পৃথিবীর বেশিরভাগ মিডিয়াই এইসব আন্দোলনকে অভ্যন্তরীণ ইস্যু বিবেচনা করে কম গুরুত্ব দিয়ে আসছে অনেক ক্ষেত্রে গুরুত্বই দিচ্ছে না। সাতই মার্চ যদি মুজিব স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে দিতেন মুহূর্তেই পাকি সেনাবাহিনী সবাইকে মাটিতে মিশিয়ে দিতো আর সারা পৃথিবী কাছে বার্তা পৌঁছতো "বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতার ব্যর্থ অভ্যুত্থানের চেষ্টা"।


২৫ মার্চের আক্রমণে বিশ্ব দেখলো রাতের অন্ধকারে বর্বর একটা সেনাবাহিনী কিভাবে নিরস্ত্র মানুষের উপর ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে। আর তখনই ছিলো স্বাধীনতা ঘোষণার সবচেয়ে উপযুক্ত সময়। পৃথিবীর কাছে আমাদের বার্তা পরিষ্কার, আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি আলোচনা করার। যখন তারা বন্য পশুর মত আমাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়লো তখন প্রতিরোধ ছাড়া আমাদের কাছে আর কোন রাস্তা খোলা ছিলো না।

শেখ সাহেবের- "এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতা সংগ্রাম" কথাটার মাঝেই স্বাধীনতার ঘোষণা লুকানো ছিলো, তবে সেটা পড়তে পেরেছিলো শুধু বাঙালিরাই। সাতই মার্চ আমাদের জন্য স্বাধীনতার বার্তাই বয়ে এনেছিলো, আর সেই সাথে মুজিবের দূরদর্শিতা লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবন বাঁচিয়েছিলো সেদিন। বলা হয়ে থাকে সেদিন সমাবেশ স্থলে সাত আট লাখ মানুষ সমবেত হয়েছিলো।

রাও ফরমান লিখেছে-

"আমরা যখন সাতই মার্চ ঢাকায় নামছিলাম, মুজিব তখন প্রায় সাত লাখ মানুষের বিশাল সমাবেশে ভাষণ দিচ্ছিলেন। বিমানটি নিচু দিয়ে উড়ে যাওয়ার সময় আমরা সবাই এক জনসমুদ্র দেখলাম। আমি টিক্কার দিকে ঘুরে বললাম, পরিস্থিতি পশ্চিম পাকিস্তানের মত সহজ নয়।"

একটু পরেই ফরমান লিখেছে-

"এইচ কিউ সি এম এল সতর্ক ছিল, হয়তো একতরফা স্বাধীনতার ঘোষণা আসতে পারে। মুজিব খুবই চতুরতার সাথে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন নি... সাতই মার্চের পর থেকে সরকারের সকল সংস্থাই কার্যত মুজিবের নির্দেশে পরিচালিত হয়েছে। কেন্দ্রীয় সরকার যে সম্পূর্ণ অসহায় সেটা পরিষ্কার হয়ে পড়েছিলো। তথাপি এই পরিস্থিতি মোকাবেলায় কোন রাজনৈতিক পদক্ষেপ রাওয়ালপিন্ডি নেয় নি।"

একটু পরে একই গ্রন্থে ফরমান যা লিখেছে তা খুবই ইন্টারেস্টিং-

"সাতই মার্চের ফলে ইডেন বিল্ডিং এর পরিবর্তে প্রাদেশিক সচিবালয়ের কাজ কর্ম চলছিলো শেখ মুজিবের ধানমন্ডির বাসভবনে। রেডিও-টেলিভিশন-টেলিফোন-টেলিগ্রাফ ও রেলওয়ে সহ সকল সরকারি বিভাগই তাঁর কমান্ডে চলছিলো। এমনকি আশ্চর্যজনকভাবে গোয়েন্দারাও তাঁর সমর্থনে ছিলো। পুলিশের পুরোভাগ নিয়ে প্রকাশ্যে একটা ছায়া সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়ে গিয়েছিলো...... সত্যি বলতে পরিস্থিতি এমন হয়ে পড়েছিলো যখন প্রদেশের সমস্ত জনগণের মনোভাবই ছিল (আমাদের) অমান্য করার।"

সার কথা হচ্ছে- আমার মতে পঁচিশে মার্চ না আসলেও এদেশ ঠিকই স্বাধীন হতো। কিন্তু সাতই মার্চ না এলে এই দেশ কখনোই স্বাধীন হতো না এটা বলে দেয়া যায় পরিষ্কার কণ্ঠে। হাজার বিভ্রান্তির ভিড়ে শুধুমাত্র সাতই মার্চের ভাষণের কারণে বঙ্গবন্ধুর পরবর্তী সমস্ত ভুল-ভ্রান্তিকে ক্ষমা করে দেয়া যায়। সেই ভাষণ ছিলো তাঁর "লাইফ টাইম বেষ্ট পারফরম্যান্স"। পৃথিবী শ্রেষ্ঠ ভাষণ বললেও ভুল বলা হবে না।

নিঃসন্দেহে সাতই মার্চ পৃথিবীর নাট্যমঞ্চে মঞ্চস্থ হয়েছিলো- শতাব্দীর সেরা নাটকের প্রথম অঙ্কটি।

রক্ত আর মাংসের সত্যিকারে নাটক;
যেই নাটকে দুঃখ ছিলো, ট্রাজেডি ছিলো, ছিলো অনেক রক্ত।
যেই নাটকের শেষ অঙ্কে আমরা আমাদের জন্য একটা দেশ পেয়েছিলাম।
নাটকটা শেষ করেছিলো লক্ষ মানুষ,
কিন্তু শুরুটা করেছিলো একজন "শেখ মুজিব"।

আরিফ রহমান, লেখক, অনলাইন এক্টিভিষ্ট

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪১ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬৩ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩০ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯০ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৬ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ