আজ মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল, ২০২৪

Advertise

আমার নারীবাদ, সিগারেটের আগুন কিংবা যুদ্ধের কৌশল

শারমিন শামস্  

নারীবাদী বলে গাল পাড়াটা সহজ। গাল তো খাই-ই। গাল পাড়ার লোক চারিদিকে ছটফটাচ্ছে। আবার অনেক সময় নারীবাদী সম্পর্কে তথাকথিত একটা ধারণার বাইরে আমাকে আবিষ্কার করে চিন্তিত হতেও দেখেছি অনেককে। ‘আরে এ তো দেখি বর বাচ্চা নিয়ে বেশ সুখেই দিন কাটাচ্ছে – এ নারীবাদী ক্যান?’

সুখের সংসারের সাথে নারীবাদের সংঘর্ষ কোথায় আমার জানা নেই। কিংবা, নারীবাদের সাথে বড় টিপ, এলোমেলো কাপড় আর সিগারেট খাওয়া কালো ঠোঁটের সাথে মাটির গহনা সংশ্লিষ্ট কেন, তাও আমি জানি না। জানার ইচ্ছেও হয় না। তবে এটা ঠিক, এ যাবৎকালে নারীবাদ কে ব্যবহার করে যারা একটা বিভ্রান্ত ধারণা ছড়িয়ে দিয়েছে নারীবাদকে নিয়েই, তাদের পাশাপাশি হেঁটে যাওয়ার রাস্তা তৈরি করতে বেগ পেতে হয়। তবে রাস্তা তৈরি হয় ঠিকই, তাদের নিয়েই। কারণ যার যার মত প্রকাশ ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের স্বাধীনতা, নিজস্ব মতবাদে জীবনযাপন ও ভালো থাকার অধিকারই নারীবাদেরই মূল কথা। তাই সবাইকে নিয়েই পথ চলাটা। কিন্তু ঐ যে সিগারেটের কালো ঠোঁট কিংবা বড় গলার ব্লাউজের সাথে বড় লাল টিপ কিংবা লিভ টুগেদার- এইভাবে নারীবাদকে ব্র্যান্ডিং করাটাই নারীবাদের সর্বনাশ।

শিশুকাল থেকে আজ পর্যন্ত আমি জেন্ডার সম্পর্কিত কারণে নানাভাবে বৈষম্যের শিকার হয়েছি, নির্যাতিত হয়েছি, প্রতারিত এবং বঞ্চিত হয়েছি। এসব বঞ্চনা কিংবা নির্যাতন, প্রতারণা আমি মানতে পারিনি, মানতে চাই না এবং আমি এর সমাধান চাই। ফলে এর জন্য আমি লড়াই করি। এই লড়াইয়ের দর্শন নারীবাদের দর্শন হতে পারে। কিন্তু সবকিছু ছাপিয়ে আমার কাছে আমার লড়াইটাই মুখ্য। আমি দর্শন নিয়ে পড়ে থাকতে ইচ্ছুক নই। আমি কর্মে বিশ্বাস করি বলেই আমার লড়াই মাঠে ময়দানে। আমি যা পারি, আমার যা ক্ষমতা তাই দিয়েই এই বৈষম্য আর প্রতারণার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে যেতে চাই।

জীবনে সবচেয়ে বেশি বঞ্চনা তো হয় কর্মক্ষেত্রে; হয়েছি। পদে পদে বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে, বেশি বেড়ো না, ঝড়ে পড়ে যাবে। কিন্তু আমি বাড়তে চেয়েছি এবং এখনও চাই। কারণ পাশে যে পুরুষ সহকর্মীটির বেড়ে যাওয়া, সেটা প্রশংসা পায়। তাকে ঝড়ে পড়ার অভিশাপ কেউ দেয় না। এই পরিস্থিতিতে আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি, নিজের কাজ আর মেধাটাকেই হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করার। সেই হ্যাপাও কম না। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আমার লড়াই এই হাতিয়ার হাতে নিয়েই। এবং রণাঙ্গনে বারবার রক্তাক্ত হবার পরও বিজয় ধরা দিয়েছে, পরাজিত হই নাই। এটা আমার রণকৌশল।

এখন কেউ যদি সমাজের ফালতু নিয়মগুলোকে বুড়ো আঙুল দেখাতে চায়, অপমান করতে চায়, সেটা করে দেখাবার প্রয়োজনে সিগারেট খায় কিংবা লিভ টুগেদার করে, এটা তার রণকৌশল এবং এটাও একটা কৌশল, আমি সেটাকেও শ্রদ্ধা জানাই। আমি এভাবে পারিনি, কিন্তু সে পারছে। তবে সবসময়ই মনে করি, এ সবকিছুর বাইরেই প্রত্যেকটি অধিকার সচেতন মেয়ের নিজেকে কর্মক্ষেত্রে এবং পরিবারে এবং সর্বোপরি সমাজে যোগ্য ও দক্ষ হিসেবে প্রমাণ করে নিজের জায়গাটি আদায় করে নেয়াই শ্রেষ্ঠ কৌশল। এর জন্য ক্ষয় হয় অনেক, ক্ষত হয় হাজারে-হাজারে, রক্ত ঝরে অবিরল। কিন্তু যে বিজয় আসে তা টেকসই, গতিশীল এবং সম্মানজনক।

আমার লড়াইয়ের মাঠে আমি একা। কারণ প্রত্যেকেই তাই। জীবনযুদ্ধ একাই করার নিয়ম।  সাংবাদিকতার শুরুতে একটি ভালো বিট পাওয়ার জন্য যে লড়াই, তা শেষ হয়েছিল যোগ্যতা প্রমাণ করে প্রত্যাশিত বিটটি পাওয়ার মধ্যদিয়ে।  কিন্তু প্রতিটা মুহূর্তে নানা যন্ত্রণা আর নোংরামির ভিতর দিয়ে যেতে হয়েছে।  চোখের সামনে কত অন্যায় আর অন্যায্য আচরণ হতে দেখেছি। বিষাদে ছেয়ে গেছে মন। তবু মেনে নিই নাই। প্রতিবাদ করেছি। তারপর কাজ করেছি, পরিশ্রম করেছি। নিজের যেটুকু সম্পদ, তাই নিয়েই আমার লড়াই। এখনও চলছে।

নিজের ভালোলাগার জগতে নিজের কাজটুকু স্বাধীনভাবে করার ইচ্ছে নিয়ে যখন চাকরি ছেড়ে শুরু করেছি প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণের কাজ, ভেবেছি এবার বোধহয় লড়াইয়ের ধকল কমে এলো! আমার এই ভাবনা জেনে বিধাতা বোধহয় অট্টহাসিই দিলেন। নানাভাবে হেনস্তা করলো খুব বিশ্বাস করেছিলাম যাদের, তারাই। কিন্তু আমি যে কত বড় বড় পোড় খাওয়া মেয়ে, সে তো তাদের জানা নেই। আমি তো সেই জন, যে যুদ্ধের ময়দানে তলোয়ারের আঘাত পাবার পরও আহত দেহ নিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে আবারো যুদ্ধ ঘোষণা করি নিরন্তর।

আমি তো থামি না। আর ঐ যে যেটুকু মেধা আছে, যেটুকু শক্তি আছে, আর আছে নিজেকে ক্রমাগত আরো যোগ্য আর দক্ষ করার প্রয়াস, প্রতিবাদের সাহস আর প্রতিকূলতার মুখোমুখি হবার ইস্পাত কঠিন ইচ্ছে- সেটুকু নিয়েই আমি ঘুরে দাঁড়াই। যারা মেয়ে জেনে আমাকে দুর্বল ভাবে, অপরিণত ভাবে, অযোগ্য ভাবে, যারা মনে করে আমাকে বেশ শায়েস্তা করবে এইবার, তারা ভুল করে। আমার জায়গায় একটা ছেলে থাকলে এই কাজগুলো করার সাহস তাদের হত না। কিন্তু আমি জানি, আমার লড়াই, আমার ঘুরে দাঁড়ানো পথ সহজ করবে আরেকটি মেয়ের। অন্য কোন মেয়েকে একইভাবে হেনস্তা করার নোংরা ইচ্ছে তারা দমন করতে চাইবে। কারণ, আমি তাদের বুঝিয়ে দিয়েছি, নারীত্ব দুর্বলতা নয়, নারী মানেই ক্ষমতাহীন নয়।

জীবন পাল্টায়। সময় পাল্টায়। বছর দশেক আগে একটি জিনস শার্ট পরা, রাতে বিরাতে কাজ কিংবা আড্ডা,  সে যাই হোক, সেরে ঘরে ফেরাটাই হয়তো ছিল অনেক বড় ইস্যু। আজ বয়স যখন ত্রিশ পেরিয়ে, যখন কর্মক্ষেত্রে আমি দাঁড়িয়ে আছি একটি অবস্থানে, যখন আমি আরো পরিণত আমার চিন্তায় আর মননে, তখন ইস্যুগুলোও পরিণত হচ্ছে।

আমি নিজেকে ছাড়িয়ে আরো বড় পরিসরে আরো দশজন নারীকে নিয়ে ভাবি। তাদের পাশে দাঁড়াই, যা পারি করি। আমি চাই নারীত্ব হয়ে উঠুক শক্তির প্রতীক, ক্ষমতার অপর নাম। আর এই সত্য সবার আগে পৌঁছাক নারীর কানে।

কোন থিওরি নিয়ে বসে থেকে অর্জন হয় না অধিকার। অর্জন আসে কাজে। কাজটাই আসল। আর লাগে সাহস, প্রতিবাদের সঠিক ভাষা এবং ব্যক্তিত্ব; আর কিচ্ছু লাগে না।

শারমিন শামস্, লেখক, স্বল্পদৈর্ঘ্য ও প্রামাণ্য চলচ্চিত্র নির্মাতা।

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪২ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬৩ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩১ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯০ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৬ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ