আজ শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

Advertise

ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম করার বিরুদ্ধে ছিল আ.লীগ, বিএনপি এমনকি জামায়াতও

ইয়ামেন এম হক  

১৯৮৮ সালের ৭ই জুন। মিলিটারি স্বৈরশাসক লে: জে: হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের শাসনামল। তৎকালীন সংসদে পাশ করা হলো বাংলাদেশের সংবিধানের অষ্টম সংশোধনী বিল। এই সংশোধনী দিয়ে ইসলামকে বাংলাদেশের রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়। ইসলাম এখনও বাংলাদেশের রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে বহাল আছে। কিছুদিন আগে এই অষ্টম সংশোধনীকে চ্যালেঞ্জ করে দায়ের করা একটা রিটের আবেদন খারিজ করে দিয়েছে আদালত।

এখন যেই সংবিধানে 'ধর্মনিরপেক্ষতা'কে দেশের চার মূল স্তম্ভের একটা বলে দাবী করা হয় সেখানে রাষ্ট্রধর্মেরও উপস্থিতি ঠিক কতোটা যৌক্তিক এ নিয়ে বিশাল আলোচনা করা যেতে পারে এবং ইতিমধ্যে অনেক জায়গায় হয়েছে। আমার লক্ষ্য সেটা না। আমার এই লেখার উদ্দেশ্য হলো ১৯৮৮ সালে এই সংশোধনী পাশ হবার পর রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া কি হয়েছিল পরের দিনগুলোতে, আর এই সাম্প্রতিক রিট আদালতে যাওয়ার আগে কি প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছিল, সেটা তুলে ধরা। কন্সিস্টেন্সির জন্য নীচের সব স্ক্রিনশটগুলো দৈনিক ইত্তেফাক থেকেই নেয়া।

প্রথমেই দেখা যাক ৮ই জুনের প্রথম পৃষ্ঠার শিরোনাম কি ছিল:



এখন দেখা যাক তৎকালীন বিরোধী দলীয় রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিক্রিয়া কি ছিল:




দেখা যাচ্ছে বিরোধী দলগুলোর সিংহভাগ এই সংশোধনী বিল পাশের বিষয়ে চরম বিরূপ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে। বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া দাবী করেন এই বিল পাশ 'ধর্মের নামে জাতিকে বিভক্ত করার চেষ্টা', অন্যদিকে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী এবং তৎকালীন আরেক বিরোধী দলীয় নেত্রী আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনাও দাবী করেন 'সংবিধানের সংশোধনী জনগণ মানিবে না'। আওয়ামী লীগ, বিএনপি এবং অন্যান্য দল রাস্তায় মিছিল করে, এবং যানবাহন ভাংচুর/অগ্নিসংযোগের ঘটনাও ঘটে। বুঝা যাচ্ছে যে এই সংশোধনী বিল দেশের সব বৃহত্তম রাজনৈতিক দলগুলোই প্রত্যাখ্যান করেছিল।

পরের দিন, মানে ৯ই জুনের ইত্তেফাকের দিকে চোখ বোলানো যাক। প্রথমেই, তৎকালীন স্বৈরাচারী রাষ্ট্রপতি এরশাদের এ ব্যাপারে মন্তব্য, যা তিনি করেছিলেন আটরশীর বিশ্ব জাকের মঞ্জিলে গিয়ে, আটরশীর পীর এবং তার মুরিদদের সাথে সাক্ষাৎকারে:




সাম্প্রতিক রাজনৈতিক নেতারা যেভাবে হেফাজতে ইসলামীর শফি হুজুরের পাশে ঘুরঘুর করে তার সাথে কোন মিল খুঁজে পাওয়া যায় কি? যাই হোক, একই দিন, বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর বিরূপ প্রতিক্রিয়া জারি ছিল:




এবং একই খবরের বাকি অংশ সেদিনের কাগজের দ্বিতীয় পাতায়:




প্রথমেই চোখে পড়ে অষ্টম সংশোধনী বাতিল এবং সরকারের অপসারণ দাবী করে ৮ দল (বিএনপি-নেতৃত্বাধীন জোট), ৭ দল (আওয়ামী লীগ-নেতৃত্বাধীন জোট) এবং ৫ দল পৃথক পৃথকভাবে পরবর্তী রোববার অর্ধদিবস হরতাল ডেকেছিল। সেই সাথে সম্পূরক খবরে দেখা যায় যে প্রতিবাদে গাড়ি ভাংচুর/অগ্নিসংযোগ অব্যাহত ছিল। তবে সবচেয়ে মজার বিষয় ছিল যুদ্ধাপরাধী এবং মৌলবাদী রাজনৈতিক দল জামায়াতে ইসলামীও কিন্তু এই সংশোধনীর তীব্র বিরোধিতা করেছিল। একই খবর থেকে উদ্ধৃত:

 

"জামাতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় মজলিশে শুরার তিনদিন ব্যাপী বৈঠক গতকাল শুরু হইয়াছে। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ভারপ্রাপ্ত সভাপতি আব্বাস আলী খান বলেন, সরকার তার নিজ রাজনৈতিক প্রয়োজনে ৮ম সংশোধনী বিল পাশ করিয়াছে। সরকার তাহাদের গণবিরোধী কার্যকলাপ ঢাকা দেওয়ার জন্য ইসলামের নাম ব্যবহার করিতেছেন। কোরান সুন্নাহর আইন ও সৎ লোকের শাসন কায়েম না হওয়া পর্যন্ত জনগণের দাবী পূরণ হইবে না"


এ গেলো আজ থেকে সাতাশ বছর আগের কথা। এখন অষ্টম সংশোধনী বাতিলের জন্য রিটের আবেদন নিয়ে আদালত রায় দেয়ার কিছুদিন আগের প্রতিক্রিয়া দেখা যাক। প্রথমেই এ বছর ২২শে মার্চ এ, হেফাজতে ইসলামীর হুমকি:



এর ছয় দিন পর, ২৮শে মার্চ, সেই জামায়াতে ইসলামী, যারা সাতাশ বছর আগে ৮ম সংশোধনীকে 'রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত' আখ্যা করে প্রত্যাখ্যান করেছিল, তাদের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করলো। নিশ্চয় তারা আগের অবস্থানেই অটল ছিল? ইয়ে, মানে:



বাহ, দেখা যাচ্ছে সাতাশ বছরে 'গণবিরোধী কার্যকলাপ ঢাকা দেয়ার জন্য ইসলামের নাম ব্যবহার করার প্রয়াস' দেশের 'সুশাসন এবং শান্তি বজায় রাখার চাবিকাঠিতে' পরিণত হয়ে গেছে! শুধু তাই না, এই অষ্টম সংশোধনী রক্ষা করার জন্য এখন জামায়াতে ইসলামী হরতাল ডাকতেও প্রস্তুত, এবং এটা বাতিল করার রিট এখন হয়ে গেছে 'কতিপয় রাষ্ট্র ও ধর্মবিদ্বেষী ব্যক্তিকে খুশি করার ঘৃণ্য চক্রান্ত'।

বলাই বাহুল্য, অষ্টম সংশোধনী বাতিল করা নিয়ে কোন রাজনৈতিক দল থেকে দাবী উঠেনি। বিএনপি চুপ থাকবে সেটা জানা কথা, কারণ তারা এখন জামায়াতে ইসলামীর একটা অঙ্গসংগঠন ছাড়া আর কিছু না। কিন্তু যেই আওয়ামী লীগ এক সময় এটা বাতিল করার জন্য বিক্ষোভ করেছিল, তারা এখন ক্ষমতাসীন দল হয়েও এই বিষয়ে তাদের পক্ষ থেকে সরাসরি কিছু ওভাবে বলা হয়নি। ধরে নেয়া হয় যেতে পারে যে সরকার বিচারবিভাগের স্বাধীনভাবে কাজ করার অধিকারের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে এ বিষয়ে কোন বক্তব্য রাখেনি। কিন্তু সরকার দলের অনেক নেতাদের হেফাজতে ইসলামের শফি হুজুরের সাথে সখ্যতা, আওয়ামী লীগেরই অনেক নেতাকর্মীদের সংখ্যালঘুদের উপর অত্যাচার করা, বিভিন্ন সময়ে ব্লগার/প্রকাশক হত্যা অথবা তাদের উপর আক্রমণ ও ৫৭ ধারার আওতায় লেখক/প্রকাশকদের গ্রেফতার/হয়রানির পর বিভিন্ন নেতাদের বক্তব্য, কিছুদিন আগে শিক্ষামন্ত্রীর নতুন পাঠ্যসূচিতে নৈতিক শিক্ষার ভিত্তি হবে ইসলাম, এহেন বক্তব্য, এসব দেখে মনে হয় দেশে একমাত্র যেই দলটিকে অসাম্প্রদায়িক এবং ধর্মনিরপেক্ষতার প্রতিনিধি বলে ভাবতাম, তারাও সেই নীতি থেকে ধীরে ধীরে সরে আসছে। আমার মতে আওয়ামী লীগ সরকারের কাছে আমাদের অনেক কিছুর জন্য কৃতজ্ঞ হবার কারণ আছে। কিন্তু যত দিন যাচ্ছে, এই একটা বিষয়ে তাদের বিফলতা এবং দায়বদ্ধতা অন্য কোন দলের থেকে আর কম থাকছে না।


সাতাশ বছর আগে যখন অষ্টম সংশোধনী বিল পাশ করা হয়েছিল, তখন দেশের সিংহভাগ রাজনৈতিক দলগুলোই তার প্রতিবাদে রাজপথে নেমে পড়েছিল, বিক্ষোভে ফেটে পড়েছিল। বর্তমানে এই সংশোধনী বাতিলের আবেদনে করা রিট যৌক্তিক/অযৌক্তিক, যাই হোক, সেসব রাজনৈতিক দলের কোনটারই কোন উচ্চবাচ্য নাই দেখে এটা নিশ্চিত করে বলা যায়: ধর্মের কথাই বলেন আর অসাম্প্রদায়িকতার কথাই বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য দিনশেষে এসবই এক একটা ইস্যু ছাড়া আর কিছু না।

যেসব ইস্যু পুঁজি করে ক্ষমতায় যাওয়ার চেষ্টা করা যায়, অথবা ক্ষমতায় থাকলে গদি আঁকড়ে ধরে রাখার খোরাক হিসেবে ব্যবহার করা যায়।



খবরের কাগজের আর্কাইভের জন্য কৃতজ্ঞতায়: ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইস স্ট্র্যাটেজি ফোরাম (ICSF), সেন্টার ফর বাংলাদেশ জেনোসাইড রিসার্চ (CBGR), ওমর শেহাব।

লেখাটি সচলায়তন ব্লগে প্রকাশিত

ইয়ামেন এম হক, প্রকৌশলী, ব্লগার

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪১ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬২ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩০ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯০ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৫ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ