প্রধান সম্পাদক : কবির য়াহমদ
সহকারী সম্পাদক : নন্দলাল গোপ
টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
Advertise
মাসকাওয়াথ আহসান | ১১ এপ্রিল, ২০১৬
সরকারের বিরুদ্ধে আলোচনা-সমালোচনা জারী থাকাই স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার একমাত্র পথ। এটা নীতি নির্ধারকদের মাঝে চিন্তা-ভাবনায় সমসাময়িকেরা জানেন। যারা জানেন না তাদের এটা জানা জরুরী যে বাংলাদেশ ৪৫ বছর বয়েসী এক প্রাপ্তবয়স্ক রাষ্ট্র। এই রাষ্ট্রের অপ্রাপ্ত বয়স্কের মত দ্বায়িত্বজ্ঞানহীন আচরণের সুযোগ নেই।
শিক্ষা ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে আলোর অলক্ষ্যে বাংলাদেশে এখন একটি শিক্ষিত-সচেতন প্রজন্ম তৈরি হয়েছে যারা নিজ যোগ্যতায় একটি নিরাপস জীবন-যাপনে সক্ষম। আবার মিডিয়া ও তথ্য-প্রযুক্তির কল্যাণে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা বঞ্চিত প্রজন্মটিও স্বশিক্ষিত ও সচেতন হয়েছে যথেষ্ট। কাজেই অতীতের যে কোন সময়ের চেয়ে আজ ও আগামীতে সরকারের ভুল পদক্ষেপের সমালোচনা বেশী হবে। বুদ্ধিবৃত্তিক ক্ষেত্রে ধামাধরা আপস-উন্মুখ মানুষের সংখ্যা সহজাতভাবেই কমবে।
কাজেই সরকারকে বাংলাদেশের বিকাশমান বুদ্ধিবৃত্তিক সমাজকে পাশ কাটিয়ে যাবার কোন সুযোগ নেই। পুরো দক্ষিণ এশিয়ায় যেভাবেই হোক একটি অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র হিসেবে একমাত্র ভারত টিকে থাকতে সক্ষম ও বাধ্য হয়েছে একটি নিরাপস বুদ্ধিবৃত্তিক সমাজের সক্রিয়তার কারণে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও ঘটনাটা একই ঘটবে। বাংলাদেশ সরকার নিশ্চয়ই জানে পাকিস্তানে বুদ্ধিবৃত্তিক সমাজের দুর্বলতার কারণে আজ তা বিশ্ব-সন্ত্রাসবাদের সূতিকাগার; মানবাধিকার লঙ্ঘনের নরভোজী রাক্ষস রাষ্ট্র হিসেবে নিমজ্জিত প্রায় এক পোড়ো জনপদ। সুতরাং পাকিস্তান মডেলে জনমানুষকে জিম্মি করে শাসন-শোষণ চালিয়ে যাবার কামনা যদি বাংলাদেশের নীতি নির্ধারকদের কারো থেকে থাকে; তারা একাত্তরের মানবতা বিরোধী অপরাধীদের মতই গন্তব্য বরণ করবে এটা নিশ্চিত করে বলা যায়।
বাংলাদেশের মানুষ কল্পনাও করতে পারেনি ২০০১-০৬ বিএনপি-জামায়াত দুঃশাসন থেকে মুক্তি পাবে কিংবা একাত্তরের ঘাতকদের কখনো বিচার হবে। কিন্তু সেটা জনমানুষই ঘটিয়েছে ওয়ান-ইলেভেন সরকারকে সমর্থন দিয়ে। আবার আওয়ামী লীগের মহাজোটকে ভোট দিয়ে। আওয়ামী লীগের নির্বাচনী অঙ্গীকারে একাত্তরের ঘাতকদের বিচার, সংবিধান ৭২ সালের মৌলিক অঙ্গীকারে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া এবং দুর্নীতি দমনের কথা ছিলো। আওয়ামী কেবল একটি অঙ্গীকার পূরণ করেছে। কিন্তু সবধর্ম ও মতের মানুষের জন্য সাম্যভিত্তিক সুষম সমাজ গড়ার সেই বাকী দুটি অঙ্গীকার বিস্মৃত হয়েছে আওয়ামী লীগ।
সন্ত্রাসবাদ বিরোধী অভিযানে বাংলাদেশের যে সেনা কর্মকর্তারা সফল হয়েছিলেন; পিলখানা ষড়যন্ত্রে তাদের হত্যাকাণ্ডটি আজ বাংলাদেশে আল-কায়েদা-আইএস-এর শাখা খুলে মানুষ হত্যার কৃতিত্ব দাবীর সাহস যুগিয়েছে। ১৯৭১-এর শহীদ বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড যেভাবে বাংলাদেশে বুদ্ধিবৃত্তিক শূন্যতা তৈরি করেছিলো; পিলখানা হত্যাকাণ্ডটি তেমনি বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা বুদ্ধিবৃত্তির ক্ষেত্রে একটা বড় ধরণের শূন্যতা তৈরি করেছে। একের পর এক লেখক হত্যার পরও এই সন্ত্রাসবাদের মাকড়সা সুড়ঙ্গের কূল-কিনারা করতে না পারা পিলখানায় নিহত সেইসব মেধাবী ও সাহসী দেশপ্রেমিক সেনা কর্মকর্তার অভাব স্পষ্ট করে তোলে; যারা জামায়াতুল মুজাহেদীন বাংলাদেশ সন্ত্রাসীগ্রুপের দুই শীর্ষ সন্ত্রাসীকে গ্রেফতার করে বাংলাদেশকে রক্ষা করেছিলেন।
এখন প্রকাশ্যে অবিশ্বাসীদের হত্যার ঘোষণা দিয়ে হেফাজতের কট্টরপন্থী নেতা যে রাষ্ট্রে হেলিকপ্টারে চড়ে প্রমোদ-ভ্রমণ করে বেড়ায় সেখানে আইনের শাসন নেই; বলাই বাহুল্য। মহাজোটের মন্ত্রী হাসানুল হক ইনু যখন কথা বলেন, গণতন্ত্র এতো ঠুনকো নয়; কয়েকজন ব্লগারের মৃত্যু গণতন্ত্রের জন্য কোন ব্যাপার নয় এমন সুরে; তখন তিনি এইসব অপরাধকাণ্ডের এপোলজিস্ট হয়ে যান।
একই ভুল আওয়ামী লীগের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীও করেছেন। একজন নাগরিকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব; তা সে যে ধর্মের বা মতামতের মানুষই হোক না কেনো; এটা তো কমনসেন্স। লেখালেখির ক্ষেত্রে কোন লেখক রাষ্ট্রের কথিত আচরণবিধি ভঙ্গ করলে; প্রচলিত আইনে তার বিচার হতে পারে। হেফাজতের সন্ত্রাসী নেতাকে কেউ বিচার ও শাস্তির কর্তৃত্ব দেয়নি। মন্ত্রীদেরও কেউ দায়িত্ব দেয়নি লেখকদের ভুল বিচারের মাধ্যমে হত্যার পরোক্ষ যৌক্তিকতা বয়ানের। এ বিচারের এখতিয়ার কেবল আদালতের।
আওয়ামী লীগের অঙ্গসংগঠন ওলামা লীগ যখন পহেলা বৈশাখের উৎসবকে হারাম বলে ফতোয়া দেয়; তখন আওয়ামী লীগ সাম্প্রদায়িক রাজনীতির অংশীদার হয়ে যায়। এই যে ধর্মীয় অনুভূতিতে বাতাস দিয়ে ক্ষমতার ফানুস ওড়ানোর আত্মঘাতী প্রবণতা এ হচ্ছে আওয়ামী লীগের মৌলিক আদর্শ থেকে ছিটকে গিয়ে আত্মপরিচয় হারানো। কেন এই মোল্লা তোষণ। ২০০৮ সালের পর ক্ষমতায় থাকতে আওয়ামী লীগকে তেমন কোন নির্বাচন লড়তে হয়নি; সে অর্থে কোন ভোট ব্যাংকের প্রয়োজন পড়েনি। তবু কেন এই মরণনেশা।
অতিরিক্ত মোল্লা ও দুর্নীতি তোষণের ফলে শিশু ও নারীর জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে বাংলাদেশ রাষ্ট্র। ভিন্নমতকে দমনের জন্য যেরকম পুলিশী রাষ্ট্র ও দমবন্ধ ভীতিপ্রদ সমাজ তৈরি করা হচ্ছে; তা-ও যে অকল্যাণ বয়ে আনবে তা সহজেই অনুমেয়। আওয়ামী লীগের এই শাসনকালে অন্যধর্মের মানুষ ও আদিবাসীদের ওপর হত্যা-নির্যাতন-লুণ্ঠন-উচ্ছেদের যে খড়গ নেমে এসেছে; তা আওয়ামী লীগের জন্য কালচিহ্ন হয়ে রইলো।
এই যে উন্নয়নের সাফল্যের সূচকগুলো আওয়ামী লীগের টেকস্যাভি লোকেরা বিভিন্ন জায়গায় ল্যাপটপে ফেরি করে দেখিয়ে বেড়ান; তারা কী কখনো ভেবে দেখেছেন; এই রিজার্ভ বাড়া; জিডিপি গ্রোথ বাড়া, মাথাপিছু উপার্জন বাড়া এসবই জনমানুষের সাফল্য। আওয়ামী লীগ বরং ব্যর্থ হয়েছে জনগণের অর্থের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে। যে পরিমাণ টাকা লুণ্ঠন ও পাচার হয়েছে তা হিসাব করে দেখলে আওয়ামী লীগের গভীরভাবে অনুতপ্ত হওয়া উচিত। অযথা সমালোচকদের ওপর ক্ষিপ্ত না হয়ে টাকা চোরগুলোকে দ্রুত গ্রেফতার করে বিচারের মুখোমুখি করা জরুরী।
আওয়ামী লীগকে বুঝতে হবে জনগণ যেমন ফুলের মালা দিয়ে জনপ্রতিনিধিকে বরণ করতে জানে; অন্যায় করলে বা অন্যায়কে প্রশ্রয় দিলে তাকে ছুঁড়ে ফেলেও দিতে পারে এক লহমায়।
মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।
আপনার মন্তব্য