আজ শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪

Advertise

অস্ট্রেলিয়ার বুকে বাঙালির বর্ষবরণ

ফজলুল বারী  

বাংলা পঞ্জিকা-ইংরেজি ক্যালেন্ডার দেখে বাংলাদেশে-ভারতের পশ্চিমবঙ্গে বাংলা নববর্ষ উদযাপন হয়ে গেছে  ১৪ এপ্রিল। কিন্তু অস্ট্রেলিয়ায় এদিন ছিল কাজের দিন। সে কারণে এদেশের বাঙালিরা বাংলা নববর্ষ উদযাপন করবেন সাপ্তাহিক ছুটির দিনে আগামী শনিবার ১৬ এপ্রিল। যেমন ছুটির দিন দেখে গত শনিবার সিডনিতে একটি বৈশাখী মেলা হয়ে গেছে এখানকার টেম্পি পার্কে। আর ১৬ এপ্রিল যে বৈশাখী মেলাটি হবে সেটিকে বলা হয় বাঙালির দেশ বাংলাদেশের অথবা ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বাইরে পৃথিবীর বৃহত্তম বাঙালি উৎসব-সমাবেশ!



এর কারণ কী জানেন? দুনিয়ার বেশির ভাগ শহরে সভা-সমাবেশ হয় মিলনায়তনের ভেতরে। প্রচণ্ড শীত অথবা গরমের কারণে অনেক জায়গায় উন্মুক্ত স্থানে সভা-সমাবেশ করা যায় না। সংশ্লিষ্ট দেশ-কর্তৃপক্ষেরও অনুমতির বিষয় আছে। কিন্তু সিডনির এই বর্ষবরণের বৈশাখী মেলাটি হয় অলিম্পিক পার্কের মতো বিশাল ভেন্যুতে! এ উপলক্ষে শুধু সিডনি-ক্যানবেরা নয়, অস্ট্রেলিয়ার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে, এমনকি দুনিয়ার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বাঙালিরা আসেন সিডনিতে! এবং এই বাঙালি বলতে শুধু বাংলাদেশি বাঙালি না, ভারতীয় বাঙালিদেরও এটি সারা বছরের অপেক্ষার প্রাণের উৎসব। এ উৎসবে প্রায় সবাই বাহারি বৈশাখী রঙের জামা-কাপড়, শাড়ি-পাঞ্জাবি পরে আসেন! বিদেশিরা অবাক হয়ে বাঙালির প্রাণের উৎসব দেখেন! আরেকটি তথ্য, অলিম্পিক পার্কের মতো ব্যয়বহুল ভেন্যুতে বৈশাখী মেলায় কিন্তু কেউ ফ্রি ঢোকেন না। লাইনে দাঁড়িয়ে ১০ ডলারে টিকিট কেটে ঢোকেন বাংলাদেশ ও ভারতের কয়েক’শ বাঙালি। পার্কিং এর জন্যেও গুণতে হয় ১৫ ডলার। ভেন্যু থেকে এ দেশের পার্কিংগুলোও বেশ দূরে  দূরে। সেখানে গাড়ি রেখে বিদেশে অনভ্যস্ত শাড়িপরা মেয়েরা বাচ্চাদের কোলে-কাঁধে নিয়ে অথবা স্ট্রলার ঠেলতে ঠেলতে হেঁটে আসেন অলিম্পিক পার্কে! প্রাণের আবেগ-টানটি এখানে কত ব্যাপক বুঝতে পারেন?

এবং প্রতি বছরই সিডনির এই বৈশাখী মেলার স্থান-সংকুলান নিয়ে আক্ষেপ-প্রশ্ন উঠছে বলে এবারের মেলাটি হচ্ছে আরও বড় ভেন্যুতে! এবার প্রথমবারের মতো বৈশাখী মেলা হবে অলিম্পিক পার্কের এএনজেড স্টেডিয়ামে! এর ধারণ ক্ষমতা ৭৫ হাজার! গোটা অস্ট্রেলিয়া জুড়ে অত বাঙালি নেই। কিন্তু মেলা উপলক্ষে গোটা স্টেডিয়াম এলাকা জুড়ে যত বাহারি পণ্যের স্টল বসে, পান্তা-ইলিশ, পিঠেপুলি থেকে শুরু করে বই-শাড়ি-পাঞ্জাবি-লুঙ্গি-গামছা-ধুতি, বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের জার্সি থেকে শুরু করে অস্ট্রেলিয়ার নানা ব্যাংক, সেবা সংস্থা সহ নানান প্রতিষ্ঠানের স্টল-পসরা এখানে এক জায়গায় হয়, এবার ভেন্যুটি অনেক বড় হওয়াতে সবার চলাফেরা অনেক স্বচ্ছন্দের হবে আশা করা হচ্ছে। বাংলাদেশের নানা সব বাহারি খাবারের পাশাপাশি কলকাতারও নানান স্টল থাকে মেলায়। এবার এএনজেড স্টেডিয়ামের বাইরেও স্টলের ব্যবস্থা করা হয়েছে। কিন্তু মূল সাংস্কৃতিক আয়োজনের মঞ্চটি থাকবে স্টেডিয়ামের ভিতরে।

আরেকটা মজার কথা বলি। দুনিয়ার নানান ভাষাভাষী-সংস্কৃতির মানুষজনের দেশ অস্ট্রেলিয়ার আর কোন জাতি-ভাষার মানুষের এতো বড় সমাবেশ কিন্তু এখানে সচরাচর হয়না। সে কারণে অস্ট্রেলিয়ার রাজনীতিকরা কিন্তু পারতপক্ষে এর দাওয়াত এড়াননা! এক জায়গায় এতো ভোটার! এবারের মেলায় সে কারণে অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী-বিরোধীদলের নেতা, নিউসাউথ ওয়েলস রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী সহ গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের যোগ দেবার সম্ভাবনা আছে। গুরুত্বপূর্ণ সবাইকে পৌঁছে দেয়া হয়েছে মেলার দাওয়াত। প্রধানমন্ত্রী-বিরোধীদলের নেতা থেকে শুরু করে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা দেশটিতে বসবাসরত বাঙালিদের বাংলা নববর্ষের শুভেচ্ছা জানিয়ে বানী দিয়েছেন।  এসবের কাড়নে প্রশান্তপাড়ের দেশ অস্ট্রেলিয়ার বাঙালিদের গৌরবের আরেক নাম হয়ে গেছে সিডনির অলিম্পিক পার্কের এই বৈশাখী মেলা। এটি এরমাঝে সেতুবন্ধন তৈরি করেছে অস্ট্রেলিয়ার মূলধারার সঙ্গে বাঙালির। এর সংস্কৃতির।

কিন্তু এই মেলা একদিন আজকের মতো বড় ছিলোনা। বাঙালিও একদিন এতবেশি ছিলোনা এদেশে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় এখানে বাংলাদেশের বাঙালি ছিলেন মাত্র পাঁচজন! দিনে দিনে এখানে বাঙালির সংখ্যা যেমন বেড়েছে, এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে বৈশাখী মেলার পরিসরও। দুই দশক আগে ১৯৯৩ সালে সিডনির বারউড গার্লস স্কুল মাঠে সূচনা হয়েছিল এ মেলার। বাংলা সালটি ছিল ১৪০০ সাল। প্রথম মেলাতে দর্শক হয়েছিল মাত্র ২০০ জন। একটানা তের বছর সেখানে মেলার আয়োজন করা হয়। কিন্তু দিনে দিনে সেখানে স্থান-সংকুলানের সমস্যা বাড়ায় মেলাটি ২০০৬ সালের দিকে স্থানান্তর করা হয় সিডনি অলিম্পিক পার্কে। এখন প্রতি বছর মেলায় আসেন প্রায় পঁচিশ হাজার বাঙালি। অস্ট্রেলিয়ার বিভিন্ন শহর ছাড়াও প্রতিবেশি নিউজিল্যান্ড থেকে অনেক বাঙালি আসেন। দুনিয়ার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বাঙালিরা অস্ট্রেলিয়া আসার আগে জেনে নেন সিডনির বৈশাখী মেলার দিন-তারিখ। টিকেট কাটেন সেভাবেই।

মেলার আয়োজক বঙ্গবন্ধু কাউন্সিল অস্ট্রেলিয়ার সভাপতি শেখ শামীমুল হক জানিয়েছেন, মেলা প্রেমিক বাঙালিদের ভোগান্তি এড়াতে এবার অনলাইনেও প্রবেশ ও পার্কিং টিকেট কাটার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। স্থানীয় বাঙালিদের ব্যান্ড, শিল্পী-কলাকুশলীদের পাশাপাশি প্রতিবছরের মতো এবারও দাওয়াত করা করে আনা হয়েছে বাংলা গানের একজন স্বনামখ্যাত শিল্পীকে। তবে ফ্যাশন শো সহ নানাকিছুর নেতৃত্বে থাকবেন অস্ট্রেলিয়াবাসী বাঙালি প্রিয় প্রজন্ম।  উল্লেখ্য অলিম্পিক পার্কের সব আয়োজন পরিচালনা করে ভেন্যু সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন ইভেন্ট ম্যানেজম্যান্ট কোম্পানি। স্টল সজ্জা, লাইটিং-সাউন্ড, মঞ্চ পরিচালনা, ভেন্যুতে প্রবেশ-পার্কিং, টিকেট বিক্রি, নিরাপত্তা সহ সবকিছুই এএনজেড স্টেডিয়াম অনুমোদিত ইভেন্ট ম্যানেজম্যান্ট কোম্পানির মাধ্যমে করাতে হয়। গত কয়েক বছর ধরে এই বৈশাখী মেলা শেষ হয় বর্ণাঢ্য আতশবাজির মাধ্যমে! প্রতিবছর ইংরেজি নববর্ষের উদযাপনে সিডনির অপেরা হাউসকে ঘিরে আতশবাজির উজ্জ্বল ছবিটি সবার আগে পৃথিবীব্যাপী বর্ষবরণের প্রথম ছবি হয়। মিলিয়ন ডলার ব্যয় হয় সেই আতশবাজিতে। সেই একই শহর সিডনিতে বাঙালির বর্ষবরণ পর্বও শেষ হয় উজ্জ্বল আতশবাজিতে! অলিম্পিক পার্কের আশেপাশের কয়েক বর্গ কিলোমিটার এলাকার লোকজন জানেন এখানে বর্ষবরণ হচ্ছে বাঙালির! ভাবা যায়! এসবই কিন্তু এখন অস্ট্রেলিয়াবাসী বাঙালিদের সত্যি বাস্তব। বিশ্ববাসী বাঙালিরা ভাগীদার এই গৌরবের।

ফজলুল বারী, প্রবাসী সাংবাদিক

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪১ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬৩ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩১ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯০ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৬ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ