প্রধান সম্পাদক : কবির য়াহমদ
সহকারী সম্পাদক : নন্দলাল গোপ
টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
Advertise
চিররঞ্জন সরকার | ২৩ এপ্রিল, ২০১৬
ব্যাকরণে সহিষ্ণু (বিণ.) মানে সহনশীল, সহ্য করতে পারে এমন (কষ্টসহিষ্ণু); ধৈর্যশীল; ক্ষমাশীল। সহিষ্ণু থেকে এসেছে সহিষ্ণুতা। কিন্তু বর্তমানে আমাদের পরিবারে, সমাজে, রাষ্ট্রে কী আদৌ সহনশীলতা, সহ্য, ধৈর্য, ক্ষমা ইত্যাদি মূল্যবোধগুলো অবশিষ্ট আছে? কী রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে, কী সামাজিক-পারিবারিক পরিমণ্ডলে-সবখানে দেখছি অসহিষ্ণুতার দাপট। পৈশাচিকতা।
আমরা সবাই যেন একটা ‘আমি’র বৃত্তে আটকে গেছি, আমাদের মধ্যে সহানুভূতি, প্রেম, সহমর্মিতা, পারস্পরিক শ্রদ্ধা, মর্যাদা, মনুষ্যত্ব বোধ যেন হারিয়ে গেছে। আমি কি পাব, কি ভাবে আমার লাভের অংশ নিশ্চিত করতে পারব, আর আমার কি ক্ষতি হলো, শুধুই সেই বিষয়ে আমরা সচেতন! সবচেয়ে আশঙ্কার ব্যাপার হলো এই ‘আমির’ মধ্যে এখন আর আত্মীয়-পরিজন, এমন কি আমার সন্তানরাও যুক্ত নয়। তা না হলে শুধু ১০ টাকা বাবার পকেট থেকে না বলে নেবার কারণে ২ শিশু কন্যাকে বাবা কেমন করে চুলার আগুনে হাত পুড়িয়ে দেয়? এর কী ব্যাখ্যা দেবেন সমাজ তাত্ত্বিকেরা?
সমাজে অসহিষ্ণুতা ভীষণ ভাবে বেড়ে যাচ্ছে। পান থেকে চুন খসলেই সবাই কেমন তেড়েফুঁড়ে উঠছে। জীবন নিতে এমনকি দিকে পর্যন্ত কেউ কসুর করছে না। ধৈর্য-সহ্য-মান্যতা-পারস্পরিক শ্রদ্ধা-সম্প্রীতি-এগুলো তো রাজনীতি থেকে অনেক আগেই গেছে, এখন পরিবার থেকেও তা বিদায় নিতে বসেছে। এখন, তর্ক, আলোচনা খুব একটা হয় না। যা হয়-তা হচ্ছে রাগারাগি এবং মারামারি। ভাই ভাইকে মারছে। বন্ধু বন্ধুকে। এমনকি সন্তানের হাতে মা-বাবা কিংবা মা-বাবার হাতে সন্তান খুন হচ্ছে পর্যন্ত। আগে বড় রকমের স্বার্থের দ্বন্দ্ব হলে অনেক সময় হানাহানি-মারামারি হত। এখন একটু যদি মতের অমিল হয় তাহলেই যমের বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে। হুমকি, হত্যা, নির্যাতন ছাড়া গণমাধ্যমে কোনো খবর নেই।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক এ এফ এম রেজাউল করিম সিদ্দিকীকে শনিবার সকাল সাড়ে ৭টার দিকে রাজশাহীর শালবাগান এলাকার বটতলা মোড়ে নৃশংস ভাবে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। একটি মোটর সাইকেলে করে এসে দুই ব্যক্তি পেছন থেকে এসে তাকে কুপিয়ে পালিয়ে যায়। এর আগে কয়েকজন ব্লগারকে যেভাবে হত্যা করা হয়েছিলো; ঠিক সেভাবেই হত্যা করা হয় রেজাউল করিমকে।
ঠিক এর আগের হত্যাকাণ্ডগুলোর ব্যাপারে সরকারের যে ‘অবস্থান’ ও ‘নীতি’, এ ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হবে বলে মনে হয় না। হত্যাকারীদের খুঁজে বের করার ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের ক্ষমাহীন ব্যর্থতা, পাশাপাশি ভুক্তভোগী ব্যক্তির নামে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সরকারের কর্তাব্যক্তিদের কলঙ্ক আরোপের ঘেরাটোপে আটকে গেছে দেশে মুক্তবুদ্ধি ও প্রগতিশীল মানুষের খুনের ঘটনা! আমাদের বর্তমান সরকার তো প্রগতিমনা মানুষদের খুনের লাইসেন্স দিয়েই রেখেছে। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, কেউ ধর্মের বিরুদ্ধে যদি কিছু লিখে এবং সে খুন হয়, তাহলে সেই খুনের দায় সরকার নেবে না! অতঃপর যদি অধ্যাপক রেজাউলের জীবনপুঞ্জি ঘেঁটে বের করা হয় যে, তিনি একদিন ‘ব্যক্তিগত ডায়রীতে’ অথবা আড্ডায় ধর্মকে ‘কটাক্ষ’ করে একটি অক্ষর প্রয়োগ করেছিলেন!তাহলেই এই হত্যাকাণ্ডের বৈধতা প্রতিষ্ঠা হবে!
অনেক ত্যাগ আর যত্নের বিনিময়ে বর্তমানে এক আজব দেশ বানিয়েছি। যেখানে খুন করারও বৈধতা আছে। শুধু কারও নামে আরোপ করতে হবে-লোকটা ধর্মকে ‘কটাক্ষ’ করে লেখা লিখেছিল। ব্যস, তাহলেই তাকে হত্যা বৈধ হয়ে যাবে। এই হত্যার দায় রাষ্ট্র নেবে না। কেউ নেবে না।
অধ্যাপক রেজাউল হত্যার ঘটনাটি না হয় বোঝা গেল, প্রগতিশীল মানুষ ছিলেন, বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। এসব কর্মকাণ্ড করতে গিয়ে কোন ‘কাঠমোল্লা’র অনুভূতিতে আঘাত দিয়ে কখন কী বলেছেন বা করেছেন, যে কারণে তাঁর জীবন নেওয়া ধর্মবিশ্বাসী বর্বরদের জন্য হয়তো ‘ফরজ’ হয়ে গেছে! কিন্তু বর্বর আক্রমণ তো তো মুক্তমনা মানুষদের উপরই হচ্ছে না। সাধারণ মানুষজনের উপরও হচ্ছে। এমনকি ক্ষমতাসীন দলের লোকজনও নিজেদের লোকদের হাতে খুন হচ্ছে। গেল সপ্তাহে গোপালগঞ্জে এক কলেজছাত্রীকে তার স্বামী পিটিয়ে হত্যা করেছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। নিহত কুয়াশা জামান মৌ (১৭) গোপালগঞ্জের সরকারি বঙ্গবন্ধু বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের এইচএসসি দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী ও কোটালীপাড়া উপজেলার মাঝবাড়ী গ্রামের ফারুকুজ্জামানের মেয়ে। ওদিকে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রার্থীর পক্ষ ত্যাগ করায় পিরোজপুর জেলার নেছারাবাদ উপজেলার পূর্ব জলাবাড়ি এলাকায় জসিম উদ্দিন হাওলাদার নামের একজন সুপারি ব্যবসায়ীকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। একই দিনে মাদারীপুরের মস্তফাপুর ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের দুই পক্ষের মধ্যে ইউপি নির্বাচন-পরবর্তী সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ জুয়েল মল্লিক (২৮) মারা গেছেন। জুয়েল মস্তফাপুর ইউনিয়নের নির্বাচিত চেয়ারম্যান কুদ্দুস মল্লিকের ভাতিজা।
প্রতিদিনের সংবাদপত্রের পাতা জুড়ে কেবল এমন খবর। হয় মারামারি-খুনোখুনি হচ্ছে, না হয় তো মেরে ফেলার, শেষ করে ফেলার হুমকি দেওয়া হচ্ছে। প্রত্যেকেই আততায়ী। একে অপরের খুনী। জল্লাদ বা হন্তারকের ভূমিকায় অবতীর্ণ যেন সবাই। কে, কাকে, কখন কোতল করবে-সেটা বুঝে উঠা কঠিন।
নানা কারণে আমাদের সমাজে ব্যক্তি বা পরিবার পর্যায়ে এক ধরনের অসহিষ্ণু মানসিকতা দিন দিনই বাড়ছে।এর সঙ্গে যোগ হয়েছে রাষ্ট্রীয় অসহিষ্ণুতা। ক্ষমতাসীনরা নানা কারসাজিতে এক ধরনের ব্যবস্থা চালু করেছে। যেখানে ‘যে আমার সঙ্গে নেই, সে আমার বিরুদ্ধে’ এমন একটা রীতি গড়ে উঠেছে। বলা ভালো, গড়ে তোলা হয়েছে। আর ‘যে আমার বিরুদ্ধে’ তাকে দমন-আক্রমণ করা বা উচিত শিক্ষা দেওয়াটাও রেওয়াজে পরিণত করে ফেলা হচ্ছে। যখন নিজেদের একচ্ছত্র আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়, তখন একটা সহজাত দম্ভ ও ঔদ্ধত্য এসে ভর করে। আর ক্ষমতার ঔদ্ধত্য আরও মারাত্মক!
অথচ আমরা সারা জীবন বইপুস্তকে পড়েছি-পরমত সহিষ্ণুতার কথা। ধর্মেও আমরা সহিষ্ণুতার পক্ষে সাফাই দেখতে পাই। কিন্তু বাস্তবে দেখি তার উল্টোটা। আজ অসহিষ্ণুতা সম্পর্কে আমরা বোধহয় বড় বেশি সহিষ্ণু হয়ে পড়েছি! যা আমাদের সামাজিক মূল্যবোধ, শান্তি-স্থিতির জন্য এক হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
অসহিষ্ণুতার ফল ভালো না হলেও যুগে যুগে ক্ষমতাদম্ভীরা ঠিকই তাদের ‘দাপট’ দেখিয়েছেন। চেক সাহিত্যিক মিলান কুন্ডেরা কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য ছিলেন। কিন্তু ১৯৬৮ সালে তৎকালীন চেকোস্লোভাকিয়ার উপর রুশ আগ্রাসনের বিরোধিতা করায় ১৯৭০ সালে কমিউনিস্ট পার্টি তাকে বহিষ্কার করে। চাকরি থেকেও বরখাস্ত করা হয় তাকে। সমস্ত রাষ্ট্রীয় গ্রন্থাগারে কুন্ডেরা-র বই নিষিদ্ধ করে দেওয়া হয়। এর আগে ১৯৫০ সালে দলবিরোধী মতপ্রকাশের জন্য তাকে বহিষ্কার করা হলেও ১৯৫৬ সালে তাকে আবার দলে ফিরিয়ে আনা হয়েছিল। ‘৭০-এর বহিষ্কারের পর তিনি প্যারিসে চলে আসেন। এবং পরবর্তীকালে ফরাসি নাগরিকত্ব গ্রহণ করেন। মিলান কুন্ডেরা একটি ছোট্ট দৃষ্টান্ত। দস্তয়ভস্কি থেকে শুরু করে অস্কার ওয়াইল্ড, আরও অতীতে পৌঁছলে সক্রেটিসের বিষ পান, ঐতিহাসিক জবানবন্দি-এ সবই অন্ধ ক্ষমতার প্রদর্শন আর মতপ্রকাশের অধিকারের উপর চাবুকের আঘাত। ট্রটস্কি থেকে ডক্টর জিভাগো, এ এক লম্বা তালিকা।
তাহলে প্রশ্ন, এই যে অসহিষ্ণু মনোভাব, এর থেকে পরিত্রাণ কীভাবে সম্ভব? সমালোচনাপ্রিয় বাঙালি তো সমালোচনা বা তর্ক করবেই। সেই তর্কের বিরোধ থেকে সমন্বয়সাধন করাটাই তো লক্ষ্য। কিন্তু আমরা যদি ‘আমিই শ্রেষ্ঠ’, ‘আমার চেয়ে সাচ্চা কেউ নেই’, ‘আমার সমালোচনা করা মানেই আমার সর্বনাশ চাওয়া’-এই মানসিকতাকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরি, তাহলে কথোপকথন বা সমন্বয়সাধন কী করে সম্ভব?
ভিন্নমতকে শ্রদ্ধা জানাতে না শিখলে সমাজ থেকে অহিষ্ণুতা কখনও দূর করা যাবে না। এটা প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে নবীনতর নাগরিককেও বুঝতে হবে। বোঝাতে হবে। এই মানসিকতা বৃদ্ধির জন্য প্রচার চালাতে হবে। এ ক্ষেত্রে শাসক দলের দায় ও দায়িত্ব অনেক বেশি।
কৌটিল্য বলেছিলেন, প্রজার সুখেই রাজার সুখ। তাদের কল্যাণেই রাজার কল্যাণ। যেটি রাজাকে খুশি করে সেটিকেই রাষ্ট্রহিতকর, শুভ এবং মঙ্গল হিসাবে গ্রহণ করবেন না, বদলে যা তার প্রজাদের খুশি করবে, সেটিতেই তিনি খুশি হবেন ও উপকৃত বলে মনে করবেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যখন ক্ষমতার আসনে বসেন তখন তিনি বাংলাদেশের সব নাগরিকের প্রধানমন্ত্রী। তিনি কেবল আওয়ামী লীগের প্রধানমন্ত্রী নন। তিনি দেশের সব ধর্মের, সব মতের মানুষের প্রধানমন্ত্রী।সবাইকে রক্ষা করাই তাঁর রাজধর্ম।
যে কোনো ষড়যন্ত্র-মৌলবাদ-সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে লড়াই করাটাও শাসকের দায়িত্ব। আর সমালোচনা, ভিন্নমত, প্রতিবাদ বিক্ষোভ গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার অঙ্গ। বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য-এটাই প্রকৃতির বিধান। সমাজের বৈশিষ্ট্যও তাই। এই বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য গড়তে গেলে শুধু সংখ্যার স্টিমরোলার চালালে হয় না। ভিন্ন স্বরের অস্তিত্বকে অস্বীকার করা মানেই ভিন্ন ভিন্ন পরিচিতির সংঘাতকে সামনে টেনে আনা। আর সত্তার সংঘাতই হিংসা। অমর্ত্য সেন এই কথাটি তাঁর বহু লেখায় বলেছেন। তাই প্রয়োজন সহিষ্ণুতা। রাজনৈতিক সহিষ্ণুতা, সামাজিক সহিষ্ণুতা। ব্যক্তি ও পারিবারিক সহিষ্ণুতা।সেই সঙ্গে চাই খুনের বিচার, প্রতিকার। কারণ যাই হোক না, কোনো সভ্য রাষ্ট্রে মানুষকে খুন করার অধিকার কারও থাকতে পারে না।
মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।
আপনার মন্তব্য