আজ বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল, ২০২৪

Advertise

আমাদের অবমূল্যায়ন করবেন না, প্রিয় প্রধানমন্ত্রী!

শারমিন শামস্  

হয়তো আমরা ফুঁসে উঠবো। হয়তো ভিতরে জমছে বাষ্প। হয়তো আমাদের অবচেতনের প্রস্তুতি শুরু হয়ে গেছে। হয়তো আমরা জানিই না, একদিন জ্বলে উঠবে কোটি কোটি মানুষ। আজ সকালে ঘুম ভেঙ্গেছে যে মর্মান্তিক ব্রেকিং নিউজে, তা দেখে হয়তো আজ সারাদিন আমি চলেছি স্বাভাবিক, কথা বলেছি অন্য দশদিনের মতই, হেসেছি, গল্পগুজব, পরনিন্দা, সব করেছি।

প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রিপরিষদ, আমলা, সচিব, কূটনীতিক সবাই অফিসে গিয়েছেন। কাজ করেছেন। রাস্তার মোড়ে মোড়ে ফ্লাইওভারের জন্য মাটি কেটেছে শ্রমিক, বিলবোর্ডে মডেল নায়িকা হেসেছেন প্রখর রোদে পুড়তে পুড়তেও। অর্থাৎ দুনিয়াদারি থেমে ছিল না কিচ্ছু।

শুধু বাড়ি থেকে ২০ গজ দূরে ফুটপাথে উপুড় হয়ে পড়েছিলেন একজন মানুষ, যিনি শিক্ষকতা করতেন, ছাত্রদের পড়াতেন শেক্সপীয়র, শেলী, কীটস। আর বাড়ি ফিরে বাজাতেন সেতার। ধুলোর ওপরে পড়েছিল যে মানুষটা, তার একটি ছেলে আর একটা মেয়ে। তারা দুজনেই পড়ছে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। ঐ শিক্ষক মানুষটাকে ঐভাবে ধুলোর ওপরে রেখেই আমরা যে যার কাজে ফিরে গিয়েছি। ব্রেকিং নিউজ দেখে হাই তুলেছি, কারণ সেটা ছিল খুব সকাল আর তখনও আমরা কেউ সকালের চা’টাও খাইনি।

আজ যারা কাজে ফিরে গেছি, পরচর্চায় মেতে গেছি, ফেসবুকে সেলফি আপ করেছি, তারা অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি হত্যায়, চাপাতিতে, ইসলামিক জঙ্গিবাদে, ধর্মচর্চার নামে রাজনীতিতে, ভোট কেনায়, খুনের বদলে ভোটের চুক্তিতে।

হয়তো আমাদের সবজি কিনতে হবে, বৌয়ের জন্য শাড়ি আর সন্তানের জন্য বাইসাইকেল। হয়তো বাজারে পেঁয়াজের দাম বেশি, হয়তো এ বছর খরায় পুড়ছে ফসলের ক্ষেত। হয়তো আমি ফিরে গেছি কাজে, নতুন সিনেমায়, নতুন আড্ডায়, গঞ্জিকা সেবনে। তাই আজ ভুলে গেছি রেজাউল করিম নামে একজন আজ চাপাতির কোপে খুন হয়ে গেছে। এবং এই ছোট্ট বদ্বীপে এই কোপ খেয়ে মরে যাওয়াটাই সবচেয়ে সস্তা ও স্বাভাবিক আজ।

তবু আজ সারাদিন মন ভাল নেই। সারাদিন একটি খুন হয়ে যাওয়া লাশের ছবির চেয়ে বেশি মানসপটে উড়েছে এমন সব দৃশ্যকল্প, যা আগামি দুই তিনদিনে টিভি পর্দায়, পত্রিকার পাতায়, সামাজিক গণমাধ্যমে এসে বারবার ভিড় করবে। ‘লোকটা নাস্তিক ছিল। লোকটা বড় বাড় বেড়েছিল। লোকটার পরকীয়া ছিল। লোকটা সেতারের ভিতরে অবৈধ অর্থ রেখেছিল। লোকটা ভালো ছিল না’। এদিকে, লোকটা তখনও পড়ে আছে ধূলায় আর তার তাজা রক্ত তখন শুকিয়ে ক্ষীণ ধারা হয়ে কোথায় মিশেছে, কে জানে!

আমরা সারাদিন খুব স্বাভাবিক ছিলাম। আমরা প্রকাশ করিনি, আমাদের কষ্ট হচ্ছে। কারণ ঐ সেতার তো আমিও বড় ভালোবাসি। সেতারবাদক ভালোবাসি। অবচেতনে আমাদের রুদ্ধ আবেগ কবরের মত বাঁশচাপা মাটিচাপা....।

এই গ্রীষ্মের রুদ্ধশ্বাস জীবনে আমরা কি অপেক্ষা করছি কিছুর? কী সেটা? আমরা কি চাইছি জেগে উঠতে? আমরা কি চাইছি চিৎকার করতে? আমার বাবার মত ঐ লোকটা, ঐ শিক্ষক মানুষটা, আমি খুব করে চাইছি ছুটে যাই, কিন্তু আমি স্তব্ধ আর স্থির হয়ে গেছি। ঠিক যেন ঝড়ের পূর্বমুহূর্তের মত। ঠিক যেন ভূমিকম্পের আগে তীব্র গুমোটের মত।

প্রিয় প্রধানমন্ত্রী, আর কোনদিন বিচার হবে না এইসব হত্যার। চাপাতির কোপে পড়ে যাবে আরো শত শত ধড়, শিক্ষকের , সাংবাদিকের, সাহিত্যিকের। জ্বি, আমরা জানি। আমরা সব জানি। আপনার কাছে আর কোন বিচার দাবি করিনা আমরা। কারণ বিচার আপনি করবেন না। তবে আমাদের স্তব্ধতা এক অশনি সংকেতের মত বুকের ভেতরে ধাক্কা মারছে শুধু। আমাদের নিরুপায় ক্ষোভ আর ক্রুদ্ধ কান্নার দমক মস্তিষ্কের কোষে কোষে জমছে স্তরে স্তরে। কিন্তু আপনি ভুলে গেছেন, তিলে তিলে জমে ওঠা কান্না আর দুর্দমনীয় ক্রুদ্ধ আবেগ আর তেজ আমাদের অপ্রতিরোধ্য করে তোলে কখনো কখনো- আমরা হলাম সেই জাতি, সেই তরুণের দল।

আপনি ভুলে গেছেন আমাদের, কিংবা ভুল বুঝছেন আমাদের। কিংবা অবমূল্যায়ন করছেন আমাদের আবেগকে। আমরা হলাম প্রাইমারি স্কুল আর মাধ্যমিকের বোর্ড পরীক্ষায় অংশ নেয়া একটি প্রজন্ম, যারা এখনো রবীন্দ্রনাথ শুনি, তারস্বরে গাই বিটলস, চিৎকার করে পড়ি নজরুল, শূন্য পকেটে ঘুরে স্বপ্ন দেখি সিনেমা বানানোর। কিংবা সারাদিন গতর খেটে ফলাই ফসল, চাকা ঘুরাই কলের, রিক্সা ঠেলি, গার্মেন্টসে শ্রম বেচি ভোর থেকে রাত। আর এসবের ভিতরেও আমাদের আবেগ দগদগে, তাজা আর উন্মাদ।

আমরা না থাকলে ৫২ হত না, ৬৯ হত না, ৭১ আসতো না। আমাদের অবমূল্যায়ন করবেন না। আমাদের আবেগকে বারবার আহত করবেন না। আজ সারাদিন স্তব্ধ হয়ে আছি। তার মানে এই নয়, আমি ধূলায় পড়ে থাকা রক্তাক্ত আমার পিতার মত ঐ শিক্ষক হত্যার বিচার না নিয়েই ফিরে যাব!

শারমিন শামস্, লেখক, স্বল্পদৈর্ঘ্য ও প্রামাণ্য চলচ্চিত্র নির্মাতা।

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪১ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬৩ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩১ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯০ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৬ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ