আজ বৃহস্পতিবার, ১২ ডিসেম্বর, ২০২৪

Advertise

ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত পাওয়া একটা ফ্যাশন

অধ্যাপক ডা. শেখ মো. নাজমুল হাসান  

ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত পাবার বিষয়টিকে শোরগোল করে প্রচার করা হচ্ছে হাল আমলের একটা ধর্মীয় ফ্যাশন। এই ফ্যাশনের ডিজাইনার হচ্ছে মুসলমানদের ধর্মের অনুসারী উগ্রবাদী গোষ্ঠীসমূহ। বাংলাদেশের জন্য কাজটা করছে স্রেফ জামায়াত-শিবির। নানা নামে, নানা ঢংয়ে ওরাই এ কাজ করছে বলে আমার যৌক্তিক ধারণা। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীও জামায়াত-বিএনপিকে এ জন্য দায়ী করে স্পষ্ট বক্তব্য দিয়েছেন। নেপথ্য ফ্যাশন ডিজাইনার জামায়াত-শিবির হলে কী হবে, এই ডিজাইনকে তারা ভালমতো রপ্ত করাতে পেরেছে এ দেশের ইসলামধর্ম-প্রবণ সাধারণ মানুষকে।

বুঝে হোক আর না বুঝেই হোক মানুষ ধর্ম রক্ষার নামে হৈ চৈ করছে যা প্রত্যক্ষভাবে জামায়াত-শিবির-বিএনপির এজেন্ডা বাস্তবায়নে প্রত্যক্ষ ভূমিকা পালন করছে। আর করছে বলেই খুন খারাবি মহাসমারোহে চলছে। সাধারণ মানুষের মধ্যে এমন আস্থা তৈরি করতে না পারলে এ কাজটি এভাবে চলতে পারতো না। সুতরাং আপনার সরল ধর্ম অনুভূতিকে খুব সূক্ষ্মভাবে কাজে লাগিয়ে যে অপকর্ম তারা করছে সে ব্যাপারে আপনার ভূমিকা আছে বৈকি।

এই দেশের আপামর ধর্মপ্রবণ জনগণের সম্পর্কে আমার ধারণা খুব একটা সুবিধাজনক নয়। কারণ, ধর্মকে রক্ষার নামে আমাদের দেশের মানুষজনকে খুব সহজেই নানান স্বাদের টোপ গিলিয়ে বিভ্রান্ত করা যায়। রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিল করার জন্য সেই কাজটিই করছে মুসলমান ধর্মের অনুসারী উগ্রবাদী গোষ্ঠীসমূহ। ধর্ম রক্ষার নামে এটা আওয়ামী নিধন প্রক্রিয়ার বাস্তবায়ন ছাড়া আর কিছু না।

ধর্মানুভূতিতে আঘাত পাবার বিষয়টিকে যত্রতত্র ব্যবহার করার মানে হচ্ছে, দুনিয়ার অসৎ চিন্তাকে ধারণ করে নিজেকে ধর্মপ্রাণ হিসেবে প্রমাণ করা। এটা এ ক্ষেত্রে একটা যুতসই ও কার্যকরী পন্থা। এটা মানুষের কাছ থেকে সস্তা বাহবা পাওয়ার জন্য বিনা চালানের ধর্মানুভূতির বিনিয়োগ।

বাস্তবতার দিকে তাকালে সহজেই বোঝা যায় যে, এই দেশের মানুষ সবাই-ই প্রায় ধর্মান্ধ এবং ধর্মপ্রবণ, কিন্তু তারা ধর্মপ্রাণ না। যে দেশের মানুষ সততাকে মনে-প্রাণে ধারণ করে সেই দেশের অবস্থা কখনওই এতটা জঘন্য হয় না। যে কয়জন মানুষ নিয়মিত নামাজ পড়েন শুধুমাত্র সেই কয়জন মানুষও যদি প্রকৃত ভাল মানুষ হতো তবে দেশের বাকী সকল মানুষ খুব খারাপ হলেও দেশের এই অবস্থা হবার কথা না।

এখন উদোর পিণ্ডি বুদোর ঘাড়ে দেবার মতো করে ধার্মিক হয়েও অধার্মিক হবার সে ব্যর্থতার দায় চাপানো হচ্ছে প্রগতিশীল মানুষদের উপরে। তারা তো কাউকেই বাদ দিচ্ছে না- নাস্তিক-ব্লগার নাম দিয়ে শুরু; এখন তো দেখছি লেখক, শিক্ষক, পীর, খাদেম, প্রকাশক, সাদা চামড়া, কালো চামড়া, পাদ্রী, সন্ন্যাসী, দেশি-বিদেশি কেউ-ই বাদ নাই। চাপাতি উঠছে সবারই গলায়।

ধর্মপ্রাণ সাজা আর প্রকৃত ধর্মপ্রাণতাকে ধারণ করা এক কথা নয়। প্রকৃত ধর্মপ্রাণ ব্যক্তি খুন-মারামারিকে সমর্থন করার কথা না। সুতরাং ধর্মের নামে কিছু একটা শুনলেই যারা ধর্ম গেল ধর্ম গেল বলে শোরগোল তোলেন তারা সঠিক কাজটি করেন না। নিজের অজান্তেই ভুল করেন। সাধারণ মানুষ মনে করতে পারেন যে তিনি তার চেতনা থেকেই ধর্মের বিষয়ে কটাক্ষের ব্যাপারে প্রতিবাদ করছেন। কিন্তু তারা বুঝতেও পারেন না যে, এটা সাজানো, খুবই সূক্ষ্মভাবে ঢুকিয়ে দেওয়া একটা প্রতিক্রিয়ার প্রকাশ।

ধর্মান্ধতা প্রতিষ্ঠা করে অন্ধকার সমাজকে টিকিয়ে রাখাই ওদের উদ্দেশ্য। ধর্ম কী এতো সহজে যাবার জিনিস যে কিছু একটা হলেই তা চলে যাবে! কেউ যদি এরকম মনে করেন, তবে এটা একদিন এমনিতেই চলে যাবে, খুন-খারাবি করে এটাকে টিকিয়ে রাখা যাবে না। ধর্ম টিকাতে হলে নিজের চরিত্র ও চর্চা ভাল করেন, নিজেকে আদর্শ ও অনুকরণীয় করে গড়ে তোলেন। এটা যদি করতে পারেন তবে অন্য আর কিছু করার দরকার পড়বে না। গুলি-চাপাতি, কামান-বন্দুকের শক্তির চেয়েও ওই আদর্শ অনেক বেশি শক্তিশালী ও কার্যকর, স্থায়ীও বটে।

ধর্ম গেল, ধর্ম গেল বলে যারা খামোখাই মাঠ গরম করে ধর্মপ্রাণতা দেখাতে ব্যস্ত- নীতি, চর্চায়, আদর্শে, মননে এ সব মানুষেরা খুবই অনাদর্শিক। ধর্ম খালি ওদের গলাবাজিতে, কাজে-কর্মে নয়। দেশের কয়টা মসজিদ সৎ টাকায় প্রতিষ্ঠিত, নিষ্কণ্টক জমিতে এবং শুধুমাত্র নামাজের উদ্দেশ্যে তৈরি? নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে খোঁজ নিয়ে দেখুন, শর্ষের মধ্যে ভূত কেমনে বসবাস করছে তা সহজেই বুঝতে পারবেন।

পাবলিক সেক্টরের চাকুরেরা সবাই ধর্মবিশ্বাসী- বুকে হাত দিয়ে বলেন সুযোগ থাকার পরেও তাদের কয়জন ঘুষ খায় না। যারা ঘুষ দেয় তারাও ধর্মবিশ্বাসী। ধর্ম তো মানেন- ঘুষ ছাড়তে পারবেন? পারবেন না, যদি পারতেন তবে ধরতেনই না। ধর্ম আগেও বিশ্বাস করতেন, এখনও করেন। বিশ্বাস করতে করতেই ঘুষ খাওয়া শুরু করছেন এবং চালিয়ে যাচ্ছেন, যাবেনও বটে। ধর্মটা কিন্তু ঠিকই কপচাচ্ছেন এবং যারা একটাও খারাপ কাজ করে না শুধু ধর্মাচার থেকে বিরত তাদেরকে ধর্মের পথে অর্থাৎ আপনার অসৎ পথে আসার আহ্বান জানিয়ে নিজেকে সুপিরিয়র হিসেবে দেখছেন। নিকুচি করি আপনার ঐরকম ধর্ম চর্চার। একজন নাস্তিকের মধ্যে যে সততাটুকু আছে, মানবিকতাটুকু আছে তারসাথে তুলনা করে দেখুন বিশ্বাসী হিসেবে আপনার অবস্থান কোথায়? আপনি ধর্ম মানেন আর আরেকজন মানেন না- শুধু এইটুকুর জন্য নিজেকে মহৎ এবং উপরের মানুষ না ভেবে, আপনি তার চেয়ে কতোটা ভাল মানুষ, ভাল কাজ করেন, মানবিক কাজ করেন সেটার তুলনা করেন। বিবেক বলে যদি কিছু থাকে তবে দেখবেন আপনি এত নিচে পড়েছেন যে ক্রেন দিয়ে টেনেও আপনাকে তার সমান করা সম্ভব নয়।

সারা দুনিয়ায় নাস্তিকেরা সচেতনভাবে একটা বুনো চারাগাছকেও মারে না, চাপাতি চালানো তো দূরের কথা। আপনি অনেক নিচেয়, নাস্তিককে বাঁচিয়ে রাখলে নিজে ছোট হয়ে যাবেন, সেটাই কী হত্যার কারণ? নিজেদের নড়বড়ে নৈতিক অবস্থান প্রকাশের ভয়েই ধর্মীয় শোরগোলকারীরা ভীত, ধর্ম গেল বলে তাদের কোন চিন্তা নেই, কারণ ধর্ম ওদের নিজেদের কারণেই যাচ্ছে, নাস্তিকদের কারণে নয়। বরং ওদের অনৈতিকতাই নাস্তিক তৈরিতে উৎসাহ যুগিয়েছে এবং যুগিয়ে চলেছে।

আমি ধর্ম নিয়ে কিছু লিখি না। ধর্মকে কটাক্ষ করে যারা লেখালেখি করেন তাদেরকে বরং উল্টো সমালোচনা করি। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে ধর্মের নামে অসৎ মানুষদের বাড়াবাড়িটা খুব বেশি হয়ে যাচ্ছে। বদ মানুষের ধর্মভঙ দেখতে অসহ্য লাগে। কে বেশি ধর্মের ক্ষতি করছে, নাস্তিক নাকি বিশ্বাসী-অসৎ সেটা বিবেচনার দরকার আছে।

মানবিকতার দৃষ্টিতে ধর্মীয় আর বিধর্মীয় বিষয়টি বিবেচ্য নয়, মানুষ হিসেবে ভাল আর মন্দ বিষয়টা বিবেচ্য। ধর্ম মানলাম, ধর্মের লোকায়ত চর্চাটা দেখালাম আর দুনিয়ার সকল অপকর্ম করে বেড়ালাম- এটা কোন ভাল কাজ নয়। এর চেয়ে বরং ধর্মাচার না করে মানবহিতৈষী কর্মকাণ্ড করাটা বেশি গ্রহণযোগ্য।

ধর্মাচার করার চেয়ে মানবহিতৈষী কর্মকাণ্ডই বেশি জরুরি এবং সেটাই কাঙ্ক্ষিত।

অধ্যাপক ডা. শেখ মো. নাজমুল হাসান, লেখক, গবেষক ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অধ্যাপক ডা. শেখ মো. নাজমুল হাসান ২৭ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৮ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৫ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬৪ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১১০ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪৪ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩২ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪৩ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯৩ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ২৫ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ শাখাওয়াত লিটন শাবলু শাহাবউদ্দিন