প্রধান সম্পাদক : কবির য়াহমদ
সহকারী সম্পাদক : নন্দলাল গোপ
টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
Advertise
চিররঞ্জন সরকার | ০৬ মে, ২০১৬
বিদেশি শক্তিগুলোর প্রতি ইঙ্গিত করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, অনেকে চেষ্টা করবে, জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাস আছে দেখিয়ে দেশ নিয়ে খেলতে। আমি বেঁচে থাকতে এই দেশ নিয়ে কাউকে খেলতে দেব না। দশম সংসদের দশম অধিবেশনের সমাপনী ভাষণে একথা বলেন তিনি। এ সময় তিনি সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে দেশবাসীকে আরও সজাগ থাকার আহ্বান জানান। সন্ত্রাস দমনে সরকারের কঠোর অবস্থানের কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংসদে বলেছেন, ‘আমাদের এই মাটিতে জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসের স্থান নেই। সন্ত্রাস দমনে যথেষ্ট কঠোর পদক্ষেপ হাতে নিয়েছি।’
প্রধানমন্ত্রীর এই সাহসী উচ্চারণ নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। তবে কথায় নয়, কাজে প্রমাণ দিতে হবে। বাংলাদেশে জঙ্গিরা যেন কাউকে, খুন করতে না পারে, কোনো রকম অপতৎপরতা চালাতে না পারে সেটা নিশ্চিত করতে হবে। তা না হলে বিদেশি শক্তি খেলার চেষ্টা করবেই। একথা ঠিক বাংলাদেশকে নিয়ে জাতীয়-আন্তর্জাতিক নানা স্বার্থবাদী গোষ্ঠীর নানা খেলা, ষড়যন্ত্র সেই উনিশ শ একাত্তর সাল থেকেই অব্যাহত রয়েছে। বর্তমান সরকারের আমলে তা আরও বেড়েছে। এরই অংশ হিসেবে ‘বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক জঙ্গিগোষ্ঠীর অস্তিত্ব রয়েছে’ এটি আগে তারা ‘স্ট্যাবলিস্ট’ করতে চায়। তারা চায় এই ইস্যুতে বাংলাদেশে এসে তারা তাদের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে। কৌশলের অংশ হিসেবে আরও আছে সরকারের দুর্বলতাগুলো চিহ্নিত করা।
সম্প্রতি কলাবাগানে জোড়া খুনের ইস্যুটি সামনে এনে পশ্চিমা দেশগুলো নতুন করে আবারও সরব হয়ে উঠেছে। ইউএসআইডি’র কর্মকর্তা জুলহাজ মান্নান ও তার বন্ধু মাহবুব রাব্বি তনয় খুনের ঘটনায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি ফোন করেন এবং তিনিও আইএস প্রসঙ্গে কথা বলেছেন। এর পরই দক্ষিণ, দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিশা দেশাই বিসওয়ালের অনেকটা হঠাৎ করেই বাংলাদেশে সফর করেন এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করে বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক জঙ্গি আছে বলে জানান। যদিও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তা অস্বীকার করেছেন। তার মতে, দেশে কোনও আইএস বা আল কায়েদার অস্তিত্ব নেই। সাম্প্রতিক নাশকতাগুলোর জন্য দেশীয় জঙ্গিরাই দায়ী।
নানা কারণে বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক ভালো যাচ্ছে না। বাংলাদেশকে একটা উচিত শিক্ষা দেওয়ার মওকা তারা অনেক দিন ধরেই খুঁজছে। দেশটি বাংলাদেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখা পোশাক খাতের প্রতি তীক্ষ্ণ নজর রেখেছে। এ খাতে দুর্বলতা খুঁজে বের করার চেষ্টা করছে। জিএসপি সুবিধা বন্ধ করে দেওয়া ছিল তাদের একটি ষড়যন্ত্রের অংশ। এই সুবিধা পেতে তাদের দাবি অনেকাংশে পূরণ করা হলেও অজানা কারণে জিএসপি সুবিধা এখনও বন্ধ করে রেখেছে। কাজেই বাংলাদেশে মার্কিন নীতিনির্ধারকদের ভূমিকা অনেকটাই স্পষ্ট।
আর একথাও অস্বীকার করা যাবে না যে, বিএনপি-জামায়াত রাজনীতিতে পরাস্ত হয়ে এখন পুরোদমে বিদেশিদের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে লবিস্ট নিয়োগসহ নানা অপতৎপরতার খবর প্রায়ই সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হচ্ছে। পশ্চিমা শক্তির চক্রান্তের সঙ্গে দেশীয় অপশক্তির যোগসাজশের বিষয়টি এখন সর্বজনবিদিত। এ ব্যাপারে শুধু অঙ্গীকার নয়, দৃঢ় ও দৃশ্যমান কাজ দিয়ে সব ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্ন করতে হবে।
বাংলাদেশ জন্মলগ্ন থেকেই জাতীয়-আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রকারীদের টার্গেটে পরিণত। সাম্প্রতিক বিভিন্ন হামলা ও খুনের ঘটনার মধ্য দিয়ে এই ষড়যন্ত্রের জাল যেন নতুন করে পোক্ত হয়েছে। এমনিতেই এদেশে ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের অবস্থা এখনও দুর্বিষহ বলে বিভিন্ন গবেষণায় প্রকাশ পাচ্ছে৷ তার উপর রয়েছে বিভিন্ন নামের জঙ্গি গোষ্ঠীর নীরব তৎপরতা। সরকার কিছুতেই টার্গেট-কিলিং ঠেকাতে পারছে না।একের পর এক খুনের ঘটনা এবং বিভিন্ন সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর এই খুনের দায় স্বীকারের মাধ্যমে ‘আন্তর্জাতিক সন্ত্রাস সৃষ্টিকারী দেশ’ হিসেবে সন্দেহের তালিকায় বাংলাদেশের নাম যুক্ত করার একটা আন্তর্জাতিক পাঁয়তারা চলছে। এ পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ সমূহ বিপদের মধ্যে আছে।
বিষয়টি হেলাফেলার নয় মোটেই। ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলোর পেছনের লবকুশদের যেমন খুঁজে বের করতে হবে। পাশাপাশি নতুন করে যেন কোনো নাশকতা না ঘটে এ ব্যাপারে সর্বোচ্চ সতর্ক থাকতে হবে। জঙ্গি ঝুঁকির দেশ এমন একটা ট্যাগ লাগানোর জন্য কিন্তু অনেকেই মুখিয়ে আছে। কাজটা মোটেও দুরূহ নয়।
শুধু ভাবমূর্তি নয়, বাংলাদেশের অর্থনীতিও ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে।দেশের উন্নয়ন ও আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তির ক্ষেত্রে নিরাপত্তা ও সুশাসন অন্যতম প্রধান শর্ত হিসেবে বিবেচিত। দুঃখজনক হলেও সত্য, এতদবিষয়ে আমাদের অর্জন সুখকর নয়। এখানে নাগরিকদের আতঙ্কগ্রস্ত হওয়ার যথেষ্ট উপাদান রয়েছে।
আমাদের দেশের নিরাপত্তা নিয়ে বড় গলায় কথা বলার মতো অবস্থা নেই। গত বছর ফেব্রুয়ারিতে বইমেলা থেকে ফেরার সময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ শত শত মানুষের উপস্থিতিতে যেভাবে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত মার্কিন নাগরিক অভিজিৎ রায়কে হত্যা করা হয়, তা ছিল বিদেশিদের কাছে একটি বড় সতর্ক বার্তা। এর পর আরও দুই বিদেশি নাগরিক হত্যা, একের পর এক ব্লগার হত্যা বা বিভিন্ন টার্গেটেড কিলিং, তাঁদের সেই উদ্বেগ আরো বাড়িয়ে দেয়।
অন্যদিকে অভিজিৎ রায়ের হত্যাকারীদের ধরার ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দীর্ঘদিনেও তেমন কোনো সাফল্য দেখাতে পারেনি। অন্যান্য টার্গেটেড কিলিংয়ের ক্ষেত্রেও পুলিশের অদক্ষতা চোখে পড়ার মতো। ফলে বাংলাদেশের পুলিশের সক্ষমতা নিয়েও বিদেশিদের মধ্যে প্রশ্ন রয়েছে, আস্থার অভাব রয়েছে।
বাংলাদেশে একের পর এক মানুষ খুন হচ্ছে। এই খুনগুলো জঙ্গিদের নামেই হচ্ছে। দেশি-বিদেশি যেই হোক, তাদের নিরাপত্তা নিয়ে, নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে যে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, তা এড়িয়ে যাওয়ার উপায় নেই। এ মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি জরুরি হলো, দেশি-বিদেশি সকল নাগরিকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা ও আইন-শৃঙ্খলার উন্নয়ন সাধন করা। যদি খুন-হত্যা বন্ধ করা যায়, জঙ্গি তৎপরতা পুরোপুরি উচ্ছেদ করা যায়, তবেই সম্ভব বিদেশিদের মুখ বন্ধ করা। বাংলাদেশকে নিয়ে দেশি-বিদেশি স্বার্থবাদীদের অপতৎপরতা রুখে দেওয়া। তা নাহলে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক মহলের ষড়যন্ত্র সিদ্ধ হতে বাধ্য।
এ ব্যাপারে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের উপর দায় না চাপিয়ে প্রকৃত অপরাধীদের খুঁজে বের করার ব্যাপারে মনোযোগী হওয়া উচিত। মনে রাখতে হবে এ মুহূর্তে বাংলাদেশ জাতীয়-আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রকারীদের জালে আটকা পড়ে আছে। এর থেকে উদ্ধার পাওয়া সহজ ব্যাপার নয়। কে করছে, সেটা বড় কথা নয়, বাংলাদেশে একের পর এক হামলা হচ্ছে এবং এর শিকার হচ্ছেন একটি বিশেষ গোষ্ঠী, যারা একটু ভিন্ন পরিচয়ে সমাজে পরিচিত। সবার আগে দরকার হামলার সঙ্গে জড়িতদের খুঁজে বের করা, তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা। হামলাকারীরা অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে ধারাবাহিক হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে চলছে, অথচ সরকার কিছুই করতে পারছে না! এ পরিস্থিতিতে শুধু বিদেশিরা কেন, যে কেউ সুযোগ নিতে পারে!
মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি নিশা দেশাই বিসওয়াল বলেছেন, সাম্প্রতিক বিভিন্ন হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করে বার্তা দিয়েছে জঙ্গি সংগঠন আল কায়েদা এবং আইএস। আমরা গুরুত্বের সঙ্গে বিষয়গুলো বিবেচনায় রাখছি। আন্তর্জাতিক এসব জঙ্গি সংগঠন বাংলাদেশের জঙ্গিদের সঙ্গে হয় সম্পর্ক স্থাপনের অথবা তাদের আদর্শে অনুপ্রাণিত করার চেষ্টা করছে। ফলে তাদের এসব দাবি সম্পর্কে সন্দেহের অবকাশ নেই।
নিশা দেশাইয়ের এই মন্তব্যের পেছনে মতলব থাকতে পারে, কিন্তু তার কথাগুলোকে অবশ্যই গুরুত্ব দিয়ে ভাবতে হবে। বর্তমানে কোনো দেশকে বেকায়দায় ফেলতে চাইলে তার নামে রটিয়ে দিতে হবে যে দেশটিতে প্রচণ্ড সন্ত্রাস, সুতরাং জীবনের নিরাপত্তা নেই। আর পশ্চিমা বিশ্ব যে আমাদের নামেও এমন কলঙ্ক-তিলক এঁটে দেওয়ার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত নেই-সেটা নিশ্চিত করে কে বলবে?
আমরা আসলেই বিপদে আছি। এ পরিস্থিতিতে নিরাপত্তা ব্যবস্থা উন্নত, জোরদার ও নির্ভরযোগ্য করে তোলার পাশাপাশি আস্থার সংকট নিরসনে জাতীয় ঐকমত্যের কোনো বিকল্প নেই। পৃথিবীর অন্যতম জনবহুল সম্ভাবনাময় রাষ্ট্র বাংলাদেশে যদি সন্ত্রাসকে পরাস্ত করে দেশি-বিদেশি সব নাগরিকের জন্য একটি নিরাপদ পরিবেশ গড়ে তোলা না যায়, তাহলে অন্যান্য রাষ্ট্রের সঙ্গে যেমন প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়বে তেমনই আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ভূলুণ্ঠিত হবে দেশের গরিমা।কাজেই জাতীয় স্বার্থেই একাট্টা হয়ে সন্ত্রাসবাদ ও জঙ্গিবাদের মোকাবিলা করতে হবে। শুধু সংসদে দেওয়া বক্তৃতায় নয়, বাস্তব কাজের মাধ্যমেই মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে তা প্রমাণ করতে হবে।
মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।
আপনার মন্তব্য