আজ শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪

Advertise

নিজামীর ফাঁসি এবং যুদ্ধাপরাধীদের বিচার

ফরিদ আহমেদ  

একাত্তর সালে ঢাকা শহরে গেরিলা আক্রমণ পরিচালনা করার জন্য তরুণদের একটা দল ছিলো। এর নাম ক্র্যাক প্লাটুন। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সবচেয়ে অভিজাত গেরিলা গ্রুপ এটি। গড়ে উঠেছিল দুই নম্বর সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার মেজর খালেদ মোশারফের নেতৃত্বে এবং সেক্টরের সেকেন্ড ইন কমান্ড মেজর এটিএম হায়দারের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে।

মুক্তিযুদ্ধের সময়ে ক্র্যাক প্লাটুন ঢাকা শহরে পাকিস্তান আর্মি নাভিশ্বাস তুলে দিয়েছিলো। হিট এন্ড রান পদ্ধতিতে আক্রমণ চালাতো এরা। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর জন্য মূর্তিমান ত্রাসে পরিণত হয়েছিলো এরা। স্বাধীনতাকামী বাঙালিদের কাছে পরিণত হয়েছিলো কিংবদন্তীতে।

যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে ঢাকা শহরে বিরাশিটা আক্রমণ পরিচালনা করেছিলো এরা। এলিফ্যান্ট রোড, যাত্রাবাড়ী, আশুগঞ্জ, সিদ্ধিরগঞ্জ, উলন পাওয়ার স্টেশন উড়িয়ে দেয় তারা। ঢাকা শহরের বেশ কিছু পেট্রোল পাম্পও বোমা মেরে ধ্বংস করে দেয়। হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে গ্রেনেড হামলা চালিয়ে সারা বিশ্বকে ঝাঁকুনি দিয়ে জানিয়ে দেয় যে তথাকথিত পূর্ব পাকিস্তানে সবকিছু ঠিকভাবে চলছে না। ফার্মগেটের চেক পয়েন্টেও স্টেনগান এবং গ্রেনেড নিয়ে অকুতোভয় ক্র্যাক প্লাটুন সদস্যরা মুখোমুখি হয়েছিল পাকিস্তান বাহিনীর। গুঁড়িয়ে দিয়েছিলো পাকিস্তান আর্মির অহমিকাকে। ক্র্যাক প্লাটুনের দুঃসাহসিকতা দেখে বাঙালিরা আশায় বুক বেঁধেছিল। এরকম দুরন্ত বিচ্ছু বাহিনী যাদের আছে, তাদের স্বাধীনতা প্রাপ্তিকে আটকাবে কোন শক্তি?

২৯শে আগস্ট রাতে এক যোগে অভিযান চালিয়ে এই বাহিনীর বেশ কিছু গেরিলা যোদ্ধাকে ঢাকা শহরের নানা জায়গা থেকে গ্রেফতার করে ফেলে পাকিস্তান আর্মি। এদের মধ্যে ছিলো বদি, রুমি, আজাদ, জুয়েল, সামাদ, মাসুদ সাদেকসহ ক্র্যাক প্লাটুনের অনেক গেরিলা।

ক্র্যাক প্লাটুনের সদস্য ছিলেন জহিরুদ্দিন জালাল। তাঁকে বিচ্ছু জালাল বলে ডাকা হতো। নিউ ইস্কাটনের এক বাসায় আর্মি এবং রাজাকারদের মিটিং হবার কথা ছিলো। ৩০শে আগস্ট তাঁর কমান্ডার সেই বাসাতে আক্রমণ করার জন্য রেকি করতে পাঠানো। দুর্ভাগ্য বিচ্ছু জালালের। আর্মির হাতে ধরা পড়ে যান তিনি। তাঁকে নিয়ে আসা হয় নাখালপাড়ার এক বাড়িতে নির্যাতনের উদ্দেশ্যে। এখানে এসে তিনি আগের রাতে গ্রেফতার হওয়া ক্র্যাক প্লাটুনের অনেক সদস্যকে দেখতে পান। অমানবিক নির্যাতন করে আটকে রাখা হয়েছে তাঁদের। বিচ্ছু জালালের ভাষ্য থেকেই দেখি কি হয়েছিল সেখানে,

“আর্মিরা জিপে চড়ে বাংলা মোটর মোড় দিয়ে ডানে সোজা তেজগাঁ এম,পি, হোস্টেল গলি দিয়ে কিছুটা সামনে গিয়ে হাতের ডানে একটি গলির ভিতর দেড় তলা একটি দালানে আমাকে ঢুকাল। পরে জেনেছি এই বাড়ীটি পশ্চিম নাখাল পাড়ার ১১২ নম্বর বাড়ী ছিল। সন্ধ্যা ৭টায় একটি বাসের শব্দ কানে ভেসে এলো। আর্মির জুতার খট খট শব্দে আমার রুমের সামনে কিছু আর্মি এলো। কিছুক্ষণের মধ্যেই আমার বন্দী রুমে আট দশ জন লোককে কুঁজো বাঁকা অবস্থায় ঢুকাল। তাদের দিকে চোখ ফেরাতেই আমি চমকে উঠলাম। আমি বোবার মত হয়ে গেলাম। দেখলাম ঐ ৮/১০ জন লোক সবাই মুক্তিযোদ্ধা, যাদের সাথে আমি মতিনগর ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ নিয়েছিলাম। তাদের মধ্যে বদি, জুয়েল, আজাদ, রুমি ভাইকে দেখতে পেলাম। পাশে আরেক জন ছিল যার নাম আলতাফ মাহমুদ যিনি একুশে ফেব্রুয়ারির গানের সুরকার। সবার চেহারা ছিল বীভৎস, ক্ষত-বিক্ষত। বদি ভাইকে দেখলাম তার দুহাতের আঙুল কেটে দিয়েছে এবং তার পুরো চেহারায় আঘাতের চিহ্ন ফুলে উঠেছে। কোন ভাবেই সে মাজা সোজা করতে পারছিল না। আজাদ ভাইয়েরও আঙুল কেটে নিয়েছিল এবং তার বাম কানে তখনও রক্ত জমে ছিল। দেখলাম বদি ভাইয়ের ডান চোখ কমলার মত ফুলে উঠেছে, চোখের মনি দেখা যাচ্ছিল না, তার বাম চোখ ক্ষত-বিক্ষত ফুলানো ছিল, তার আঙুলও কেটে ডান হাত বাঁকা করে দিয়েছিল। আলতাফ মাহমুদের ঠোট দুটো পুরো শশার মত ফুলানো ছিল। তারো ডান হাত বাঁকা করে দিয়েছিল। জুয়েল ভাইয়ের কাছে কথা বলার সময় দেখলাম তার দুহাতের আঙুল নেই। তারও বাম দিকের কানের নিচে রক্তের জমাট ছিল।“

এখানেই বিচ্ছু জালাল এই সব অত্যাচারের নেপথ্য ব্যক্তিদের দেখতে পান। ক্র্যাক প্লাটুনের সদস্যদের এরকম পৈশাচিক নির্যাতন, এমন ছিন্ন-ভিন্ন অবস্থার পিছনে দুইজন ব্যক্তি ছিলো। এরা জন্মসূত্রে বাঙালি, কিন্তু মানসিকতায় পাকিস্তানি। আলবদর বাহিনী গঠন করে বাঙালিদের স্বাধীনতার স্পৃহাকে ধ্বংস করে দিতে চেয়েছিল তারা। এরা হচ্ছে মতিউর রহমান নিজামী এবং আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদ। বিচ্ছু জালাল এ বিষয়ে আরো বলেন:

“ক্যাপ্টেন কাইয়ুমের সাথে মতিউর রহমান নিজামী ও মুজাহিদ সহ ৩/৪ জন লোক অস্ত্র হাতে আমার রুমের সামনে দিয়ে ক্যাপ্টেন কাইয়ুমের রুমে গেল। জুয়েল ভাই মতিউর রহমান নিজামী ও আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদকে দেখিয়ে বললো এরাই এবং আরো কয়েকজন তাদেরকে এইভাবে টর্চার করেছে। আরো বললো যে কোন সময় মুজাহিদ, নিজামী তাদের মেরে ফেলতে পারে। ক্যাপ্টেন কাইয়ুমের কাছে তখন দুজন সৈনিক এসে কিছু কথা বলতে চাচ্ছিল। ক্যাপ্টেন কাইয়ুম আমাকে রুম থেকে বের করে নিয়ে আসার জন্য হাবিলদার গুলকে পাঠাল। হাবিলদার গুল আমাকে নিয়ে ক্যাপ্টেন কাইয়ুমের সামনে দাড় করাতেই সাদা কাগজে নাম লিখে দস্তখত নিলো এবং মাদারচোৎ বাইনচোৎ বলে গালি দিয়ে সত্য কথা বলার জন্য চাপ দিতে থাকল। তখন নিজামী তার কোমরে রাখা ফাইভ স্টার পিস্তল হাতে নিয়ে মাদারচোৎ গালি দিয়ে জিজ্ঞাসা করল ভিতরে থাকা বন্দীদের সাথে কি কথা বলেছিস, তুই কিভাবে ওদের জিনিস, কতদিন যাবৎ ওদের সাথে পরিচয় জানতে চেয়ে পিস্তল দিয়ে আমার দুহাতের কব্জির উপর জোরে একের পর এক আঘাত করতে থাকল। পিস্তলের আঘাতে আমার দুহাতের আঙ্গুল চামড়া ছিঁড়ে রক্ত বের হতে থাকল। তারপরও আমি মুখ না খুল্লে আমাকে হুমকি দিল বাসা থেকে আমার মাকে, বোনকে তুলে আনবে। তখনই পাশে দাড়িয়ে থাকা আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ ওই সময় মইনউদ্দিন নামে একজনকে ডাকলে অস্ত্র হাতে সে ঘরে ঢুকল। মুজাহিদ তখন মইন উদ্দিনের হাত থেকে স্টেনগান টেনে নিয়ে আমাকে মাদারচোৎ গালি দিয়ে আমার মাথার পিছনে বাট দিয়ে আঘাত করল। সাথে সাথে ফিনকি দিয়ে মাথা রক্ত ঝরছিল। তারপর প্রচণ্ড জোরে লাথি মেরে আমাকে ফ্লোরে ফেলে দিয়ে মারতে থাকল। আমাকে মাটি থেকে নিজামী, মুজাহিদ দুজনে গর্দান টেনে তুলে বন্দীদের রুমে নিয়ে গেল। মুজাহিদ বন্দীদের হাল দেখিয়ে আমাকে বলল যে- সত্য কথা না বললে তোকেও এই হাল করব। মুজাহিদ জিজ্ঞাসা করছিল ২৫ আগস্ট ধানমন্ডি আর্মিদের বিরুদ্ধে যে অপারেশন করেছিল সেই অপারেশনে তোর সাথে কে কে ছিল এবং তোদের হাতে কি কি অস্ত্র ছিল। আমি কথার জবাব না দিলে আবার আমাকে লাথি, গুঁতা মেরে ফ্লোরে ফেলে দেয়। তখন মুজাহিদ রুম থেকে বের হয়ে ক্যাপ্টেন কাইয়ুমের রুমে গিয়ে নিজামী ও মুজাহিদ দুজনেই বলতে থাকে ১৯৭১ সালের ৫ সেপ্টেম্বর প্রেসিডেন্ট যে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেছে সেই সাধারণ ক্ষমার আগেই ২/৩ দিনের মধ্যেই ঐ হারামজাদা, গাদ্দার বদি, রুমি, জুয়েল, আজাদ, আলতাফদের সাথে এই পিচ্চিকেও (আমাকে) গুলি করে লাশ গুম করে দিতে হবে।“

বিচ্ছু জালাল এঁদের উপর অত্যাচারের আরো বিশদ বিবরণও দিয়েছেন। তাঁর ভাষ্য অনুযায়ী, “মুক্তিযোদ্ধা বদির দুই আঙ্গুল কেটে দিয়েছে, ডান হাত ভেঙ্গে দিয়েছে এবং মেরুদণ্ড বাট দিয়ে পিটিয়ে কুঁজো করে দিয়েছে। মুক্তিযোদ্ধা আজাদের ও একই অবস্থা। মুক্তিযোদ্ধা রুমির চেহারা বিধ্বস্ত, তাকে চেনাই যাচ্ছিল না, তারও আঙ্গুল কেটে দিয়েছিল এবং পা ভেঙ্গে দিয়েছিল। সুরকার আলতাফ মাহমুদের হাতের কবজি কোপানো ছিল, আঙ্গুল গুলো কাটা ছিল, ওনার ঠোঁট দুটো শশার মত ফুলা ছিল। মুখমণ্ডলে রক্ত জমাট হয়ে ফুলে উঠেছিল। ওনারও মেরুদণ্ড বাট দিয়ে পিটিয়ে ভেঙ্গে দিয়েছিল। মুক্তিযোদ্ধা জুয়েল ভাইয়ের দুই আঙ্গুল কেটে দিয়েছিল। তার বাম কান দিয়ে রক্ত ঝরছিল। তারও মেরুদণ্ড ভেঙ্গে দিয়েছিল।”

নিজামী এবং মুজাহিদ নামের এই দুই শীর্ষ আলবদর সত্যি সত্যিই নির্যাতনের পর হত্যা করে আমাদের এলিট গেরিলা ফোর্সের সবচেয়ে চৌকস একদল তরুণ গেরিলাকে। তারপর তাদের লাশ গুম করে দেয়। আমরা অকালে হারাই আমাদের সেরা সন্তানদের।

একদল দু:সাহসী দেশপ্রেমিক তরুণ, গ্রীক পৌরাণিক দেবতা প্রমিথিউসের মতো আমাদের জন্য আগুন ছিনিয়ে আনতে গিয়ে নিজেরাই হারিয়ে যায় অন্তহীন এক অন্ধকারের মাঝে।

২.

২০শে অগাস্ট, ১৯৭১।
মশরুর বিমান ঘাটি, পাকিস্তান।

সকাল প্রায় এগারোটা। টি-৩৩ বিমান নিয়ে আকাশে উড়বার কথা পাইলট অফিসার রশিদ মিনহাজের। মিনহাজের বিমানের সাংকেতিক নাম ব্লু-বার্ড ১৬৬। পাইলট অফিসার মিনহাজ যথারীতি কন্ট্রোল টাওয়ারের কাছে অনুমতি চাইলো। ব্লু-বার্ডকে নিয়ে আকাশে উড়তে চায় সে।। কন্ট্রোল টাওয়ারও কোনো গড়িমসি না করেই স্ট্যান্ডার্ড ক্লিয়ারেন্স দিয়ে দিলো ব্লু বার্ডকে।

ব্লু বার্ডকে নিয়ে ২৭ নম্বর রানওয়েতে ঢোকার জন্য প্রস্তুত হলো মিনহাজ। ৪ নং ট্যাক্সি ট্রাক ধরে এগিয়ে সে। সামনেই একটা টিলা। এটি কিছুটা আড়াল করে রেখেছে ট্যাক্সি ট্রাককে কন্ট্রোল টাওয়ার থেকে। ওখানেই একটা গাড়িতে বসে ওৎ পেতে ছিলেন ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মতিউর রহমান। রশিদ মিনহাজের প্লেনকে এগিয়ে আসতে দেখে তীব্র গতিতে নিজের গাড়ি চালিয়ে তিনি ছুটে গেলেন ৪ নম্বর ট্যাক্সি ট্রাকের দিকে। মিনহাজকে বিমান থামানোর জন্য সংকেত দিলেন তিনি। এই ফ্লাইটের সেফটি অফিসার তিনি। কন্ট্রোল টাওয়ারের আকাশে উড়ার অনুমতি থাকার পরেও সেফটি অফিসারের সংকেত পেলে বিমান থামানো অনেকটা বাধ্যতামূলক। মতিউর ভাব করলেন যেনো জরুরি কিছু বলার আছে তাঁর মিনহাজকে। মতিউর রহমানের হাবভাব দেখে বিমান থামায় মিনহাজ। তারপর কথা শোনার জন্য বিমানের ক্যানোপি খোলে সে। এই সুযোগে মিনহাজকে জরুরী কিছু বলতে চাচ্ছেন এমন একটা ভাব নিয়ে অত্যন্ত দ্রুতগতিতে বিমানের ককপিটে উঠে পড়েন তিনি। তারপর শক্তি প্রয়োগ এবং ক্লোরোফর্মের সাহায্যে কাবু করে ফেলেন মিনহাজকে। এর আগেই অবশ্য তিনি গাড়িটাকে এমনভাবে ট্যাক্সি ট্রাকের উপর রেখেছেন যাতে করে অন্য কোনো টি-৩৩ তাঁকে ধাওয়া করতে না পারে।

ট্যাক্সি ট্রাকের মাঝপথে বিমান থামতে দেখে বিস্মিত হয় কন্ট্রোল টাওয়ার। নাক গলায় তারা। জানতে চায় কোনো অসুবিধা আছে কি না বিমানে। ব্লু বার্ড থেকে কোনো উত্তর আসে না। এর পরিবর্তে অত্যন্ত দ্রুত গতিতে ব্লু বার্ড এগিয়ে যায় রানওয়ের দিকে। ঠিক একটু আগেই একটা বিমান নেমেছে রানওয়েতে। ফলে, রানওয়ে তখন খালি। এই সুবর্ণ সুযোগে ব্লু বার্ডকে নিয়ে শা করে আকাশে উঠে যান মতিউর রহমান।

অবিচলিত কণ্ঠে তিনি কন্ট্রোল টাওয়ারে খবর পাঠালেন। ব্লু বার্ড ছিনতাই হয়ে গিয়েছে। কন্ট্রোল টাওয়ার তখনো হতভম্ব, হতচকিত। বললো, ‘নিশ্চিত করে জানাও।’

বেতার সেটে মতিউর রহমানের পরিষ্কার কণ্ঠ ভেসে এলো, ‘নিশ্চিত।’

রাডারে যাতে ধরা না পড়ে সে কারণে খুব নিচু দিয়ে, একেবারে মাটির গা ঘেঁষে ব্লু বার্ডকে উড়িয়ে নিয়ে যেতে থাকেন মতিউর রহমান। পিছনে ফেলে আসা স্ত্রী এবং দুই শিশু কন্যা নয়, তাঁর দু’চোখে ভাসছে সামনে পড়ে থাকা স্বপ্নের স্বাধীন দেশ। এই বিমান নিয়ে পৌঁছে যাবেন তিনি ভারতে। তারপর এটা দিয়ে আকাশপথে যুদ্ধ হবে পাকিস্তান বিমানবাহিনীর সাথে।

কন্ট্রোল টাওয়ারে তখন হুলস্থূল পড়ে গেছে। অল্পক্ষণের মধ্যেই দু’টো এফ-৮৬ জঙ্গি বিমান উঠে পড়ে আকাশে। আশে পাশের সব বিমান ঘাটির রাডারগুলো সচল হয়ে ওঠে। চিরুনি তালাশ শুরু হয়ে যায়।

এর মধ্যে বিমানের মাঝে শুরু হয় আরেক নাটক। হঠাৎ করেই জ্ঞান ফিরে পায় মিনহাজ। একটু ধাতস্থ হতেই টের পেয়ে যায় মতিউর রহমানের উপরে। দুই দেশের দুই বীর যোদ্ধা নিজ নিজ দেশের জন্য আকাশে শুরু করে আকাশযুদ্ধের এক অসামান্য ক্লাসিক লড়াই। একজন এটিকে ছিনতাই করে নিয়ে যেতে চান তাঁর দেশের মুক্তিযুদ্ধে ব্যবহার করার জন্য। অন্যজন তার দেশের বিমানকে রক্ষার করার জন্য মরিয়া হয়ে উঠে। এ যেনো হেক্টর আর একিলিসের মরণপণ লড়াই। সেই লড়াইয়ে জিতেছিলো একিলিস। কিন্তু, এই বাস্তব লড়াইয়ে জয় হয় না কারো, পরাজয়ও ঘটে না কারো। অসমসাহসী দুই বীরের দাপাদাপি সইতে পারে না ব্লু বার্ড। দুজনকে নিয়েই ধ্বংস হয়ে যায় সে।

সারাদিন অনেক চেষ্টা করেও ব্লু বার্ডের হদিস পাওয়া যায় না। বিকালের দিকে খবর পাওয়া গেল যে, থাট্টার অদূরে ব্লু বার্ডের বিধ্বস্ত শরীর পড়ে আছে। এর দুই বৈমানিকই নিহত।

মতিউর রহমানকে মশরুর বিমান ঘাটির চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের জন্য নির্ধারিত স্থানে কবর দেওয়া হয়। গাদ্দার বলে তাঁর জানাজা পড়ানো হয় না। কোনো রকম ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা ছাড়াই দেশের জন্য জীবন দেওয়া, বাংলাদেশের এক অকুতোভয় শ্রেষ্ঠ বীর পড়ে থাকে অনাদরে আর অবহেলায়, ভিন্ন এক দেশের মাটিতে ভিনজাতীয়দের ঘৃণার পাত্র হয়ে।

এতো গেলো ভিনদেশি মানুষদের কথা। এরা লিপ্ত ছিলো আমাদের সাথে এক অন্যায় যুদ্ধে। এদের প্রতিক্রিয়া কী হবে সেটা বুঝতে কোনো অসুবিধা হয় না। কিন্তু, আমাদের সুমহান দেশরক্ষক রাজাকাররা, যারা আমাদেরই মাটির সন্তান। মাটির সন্তান, কিন্তু মাটি বা মানুষের প্রতি ছিলো না কোনো মায়া-মমতা, ভালবাসা। এর বিপরীতে প্রবল আক্রোশ অনুভব করতো স্বজাতির বিরুদ্ধেই। বিজাতীয় প্রভুদের মনোরঞ্জনের জন্য নিজের দেশের মানুষের রক্তে হোলি খেলতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করে নি তারা। তাদের প্রতিক্রিয়া কেমন ছিলো? এর জন্য অবশ্য খুব বেশি অনুমান করতে হয় না।

বাঙালি মতিউর রহমান নয়, বরং পাকিস্তানি মিনহাজের বীরত্বে গর্ববোধ করেছে তারা। ৩০ শে আগস্ট দৈনিক সংগ্রাম ‘আমরা গর্বিত’ নামে সম্পাদকীয় ছাপে। সেই সম্পাদকীয়তে লেখা হয়ঃ

“পাকিস্তান বিমান বাহিনীর পাইলট অফিসার রশীদ মিনহাজ জাতীর জন্য নিজের জীবন কোরবানী দিয়ে দেশপ্রেম ও দায়িত্ববোধের এক অত্যুজ্জ্বল নিদর্শন আমাদের সামনে রেখে গেলেন। পাকিস্তান সরকার সাহসিকতার জন্য পাকিস্তানের সর্বোচ্চ খেতাবে নিশানে হায়দার দিয়ে মরহুম মিনহাজকে সম্মানিত করছে। মরহুম মিনহাজের বীরত্ব ও আত্মত্যাগের কাহিনী যখন আমরা শুনেছি তখন আমাদের বুক গর্বে আনন্দে ভরে উঠেছে।”

রশীদ মিনহাজ যে একজন বীর, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু এই রাজাকার সাহেবদের রশীদ মিনহাজের বীরত্বে গর্ব হয়, কিন্তু একজন বাঙালি বীর যে তাঁর দেশের মুক্তির জন্য একটা আস্ত যুদ্ধ বিমান ছিনতাই করে লড়াইয়ে নামতে চায়, তাকে নিয়ে কোনো গর্ববোধ করে না।

গর্ববোধ তো অনেক দূরের কথা, তাঁকে বিশ্বাসঘাতক বলতেও বিন্দুমাত্র বাধে না তাদের। ১লা সেপ্টেম্বর একটা লেখা ছাপা হয় দৈনিক সংগ্রামে। এর শিরোনাম ছিলো ‘শহীদ মিনহাজের জীবনের শেষ কয়েকটি মুহুর্ত’। এই লেখায় বলা হয়ঃ

“আমাকে হাইজ্যাক করা হচ্ছে – এই ছিল তার শেষ কথা যা টেপ রেকর্ডে ধরা পড়েছে। এই কণ্ঠস্বর ছিল পরিষ্কার ও জোরালো এবং কথাটি তিন বার উচ্চারণ করা হয়েছে। প্রথমবার ছিল অনুমান করার মত। ঠিক যখন বিশ্বাসঘাতক ফ্লাইট লেঃ মতিউর রহমান তাকে ক্লোরফর্ম দিয়ে কাবু করার চেষ্টা করেছিল। এই উচ্চারণ শুনে মনে হয় তিনি নিজের নিয়ন্ত্রণ ফিরে পাওয়ার চেষ্টা করছেন। কিন্তু যখন তার কাছে দিবালোকের মত পরিষ্কার হয়ে গেল যে, তার ইন্সট্রাক্টর বিমানটিকে ভারতে নিয়ে যাবেই তখন তিনি শেষ বারের মত প্রাণপন চেষ্টা করে বিমানটিকে দুর্ঘটনাকবলিত করেন। এইভাবে তিনি দেশ ও নিজ কর্তব্যের প্রতি চুড়ান্ত আত্মত্যাগ করে গেলেন।”

শুধু সংগ্রামই নয়, ইসলামি ছাত্র সংঘের প্রধান মতিউর রহমান নিজামীও মিনহাজের জন্য শোকার্ত হয়ে ওঠে। মিনহাজ তার কাছে মহান দেশ্রেমিক আর অন্যদিকে মতিউর রহমান ভারতের হানাদার এজেন্ট। মিনহাজের বাবার কাছে শোকবার্তা পাঠায় নিজামী। দৈনিক সংগ্রাম সেপ্টেম্বরের চার তারিখে পত্রিকায় এটি তুলে আনে। শিরোনাম ছিলো, “মিনহাজের পিতার নিকট ছাত্রসংঘ প্রধানের তারবার্তা”। সেখানে বলা হয়ঃ

“পাকিস্তান ইসলামী ছাত্রসংঘের সভাপতি জনাব মতিউর রহমান নিজামী শহীদ রশীদ মিনহাজের পিতার নিকট এক তারবার্তা প্রেরণ করেছেন।

পাকিস্তানী ছাত্র সমাজ তার পুত্রের মহান আত্মত্যাগে গর্বিত। ভারতীয় হানাদার ও এজেন্টদের মোকাবেলায় মহা্ন মিনহাজের গৌরবজ্জ্বল ভূমিকা অক্ষুণ্ণ রাখতে তারা বদ্ধ পরিকর।”

৩.

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান বাহিনী, এর সহযোগী সংগঠন রাজাকার, আল-বদর, আল-শামস এর সহযোগিতায় সারা বাংলাদেশে হত্যা, ধর্ষণ, মানবতার বিরুদ্ধে অন্যান্য অপরাধ এবং গণহত্যার মতো অপরাধ সংগঠিত করেছে। নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধে প্রায় তিরিশ লক্ষ মানুষ প্রাণ হারিয়েছে, আড়াই লক্ষ নারী সম্ভ্রম হারিয়েছে, এবং এক কোটির উপরে মানুষ দেশ ছেড়ে ভারতে শরনার্থীর জীবন বেছে নিতে বাধ্য হয়েছে। ২৫শে মার্চ রাতে পাকিস্তান আর্মির ‘অপারেশন সার্চলাইটের’ পর থেকে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয় এবং ১৬ই ডিসেম্বরে পাকিস্তান আর্মির সদস্যরা যারা বাংলাদেশে ছিল, তাদের আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে এই যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে। বাংলাদেশের প্রায় সব লোকই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ছিল। সামান্য কিছু বাঙালি, বিহারি এবং ধর্ম-ভিত্তিক রাজনৈতিক দলের সদস্যরা এর বিপক্ষে ছিল, এবং এরাই পাকিস্তান আর্মির সাথে সহযোগিতা করে বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে বিঘ্নিত করতে চেয়েছিল। এরাই হত্যা, ধর্ষণ, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ এবং গণহত্যাতে পাকিস্তান বাহিনীর সহযোগী হিসাবে কাজ করেছে। মুক্তিযুদ্ধের শেষের দিকে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যখন আসন্ন, তখন পাকিস্তান আর্মির নিষ্ঠুরতার মাত্রা বেড়ে যায়। এরা তাদের সহযোগী সংগঠন রাজাকার, আল-বদর, আল-শামসদের নিয়ে স্বাধীনতার পক্ষের শতশত বুদ্ধিজীবীকে ধরপাকড় শুরু করে। ধরে নিয়ে গিয়ে নির্যাতন করে তাঁদের নির্মমভাবে হত্যা করে। স্বাধীন হলেও বাংলাদেশ যাতে বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে পঙ্গু হয়ে যায়, সেটাই ছিল বুদ্ধিজীবী হত্যার মূল কারণ।

মুক্তিযুদ্ধের সময়ে মতিউর রহমান নিজামী নিখিল পাকিস্তান ইসলামী ছাত্র সংঘের প্রেসিডেন্ট ছিল। জামায়াতে ইসলামী এবং ইসলামী ছাত্র সংঘ, এই দুই সংগঠনই বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিপক্ষে ছিল।

২০১০ সালে করা এক মামলার ভিত্তিতে আইসিটি এক্টের আওতায় প্রতিষ্ঠিত তদন্ত কমিটি মতিউর রহমানের বিরুদ্ধে তদন্ত কাজ পরিচালনা করে এবং একটা তদন্ত রিপোর্ট এবং সেই সাথে দলিলপত্রাদি আইসিটি কর্তৃক নিয়োজিত আইনজীবীদের কাছে  হস্তান্তর করে। এই রিপোর্ট এবং দলিলের ভিত্তিতে আইনজীবীরা মতিউর রহমান নিজামীর বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিকভাবে অভিযোগ দাখিল করে। এই অভিযোগের মধ্যে ছিল, মুক্তিযুদ্ধের পুরোটা সময়েই আসামী মতিউর রহমান নিজামী পাকিস্তান বাহিনী এবং এর সহযোগী সংগঠনগুলোকে তার নিজের জেলা পাবনাসহ, ঢাকা এবং অন্যান্য অঞ্চলে মানবতার বিরুদ্ধে নানা ধরনের অপরাধ এবং গণহত্যা সংগঠিত করতে সহায়তা করেছে। সে যেহেতু ইসলামী ছাত্র সংঘের সভাপতি ছিল, পদাধিকার বলে আল-বদর বাহিনীরও অলিখিত শীর্ষ নেতা ছিল সে। কারণ, এই আল-বদর বাহিনী গড়ে উঠেছিল মুলত ইসলামী ছাত্র সংঘের কর্মীদের দিয়েই।

মহিউদ্দীন চৌধুরী নামের এক লোক ১৯৭১ সালে নোয়াখালী জেলার শান্তি কমিটির নেতা ছিল। ১৯৭২ সালের মে মাসে সে বাংলাদেশ ছেড়ে পাকিস্তানে  চলে যায়। ১৯৯৮ সালে ‘সানসেট এর মিডডে’ নামে একটা বই লেখে মহিউদ্দীন চৌধুরী। এটি প্রকাশিত হয় করাচি থেকে। এই বইতে মহিউদ্দীন চৌধুরী উল্লেখ করেছে যে, “ইসলামী ছাত্র সংঘের সদস্যদের নিয়ে আল-বদর বাহিনী গড়া হয়েছিল, জামায়াতে ইসলামী, মুসলিম লীগ এবং নেজামে ইসলামী এই সমস্ত দলের লোকদের নিয়ে আল-শামস এবং উর্দুভাষী বিহারীদের নিয়ে গড়ে উঠেছিল আল-মুজাহিদ।”

মতিউর রহমান নিজামী যে আল-বদর বাহিনীর প্রধান ছিল, সেটা তার নিজের লেখা থেকেও জানা যায়। ১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বর মাসের ১৪ তারিখে দৈনিক সংগ্রামে বদর দিবস হিসাবে তার একটা প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। সেই প্রবন্ধটির শিরোনাম ছিল ‘বদর দিবসঃ পাকিস্তান ও আলবদর’। এই প্রবন্ধে মতিউর রহমান নিজামী লিখেছে,

“হিন্দু বাহিনীর সংখ্যাশক্তি আমাদের তুলনায় পাঁচগুণ বেশী। তাছাড়া আধুনিক সমরাস্ত্রেও তারা পাকিস্তানের চেয়ে অধিক সুসজ্জিত। দুর্ভাগ্যবশতঃ পাকিস্তানের কিছু মুনাফিক তাদের পক্ষ অবলম্বন করে ভেতর থেকে আমাদেরকে দুর্বল করতে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত আছে। তাদের মুকাবেলা করেই তাদের সকল ষড়যন্ত্র বানচাল করেই পাকিস্তানের আদর্শ ও অস্তিত্ব রক্ষা করতে হবে। ….. আমাদের পরম সৌভাগ্য বলিতে হবে পাক সেনা বাহিনীর সহযোগিতায় এদেশের ইসলাম প্রিয় তরুণ সমাজ বদর যুদ্ধের স্মৃতিকে সামনে রেখে আল বদর বাহিনী গঠন করেছে। বদর যুদ্ধে মুসলিম যোদ্ধাদের সংখ্যা ছিল ৩১৩জন। এ স্মৃতিকে অবলম্বন করে তারাও ৩১৩জন যুবকের সমন্বয়ে এক একটি ইউনিট গঠনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।”

২০১১ সালের নভেম্বর মাসে আইনজীবীরা আনুষ্ঠানিক অভিযোগনামা আইসিটির নিকট পেশ করে। আইসিটি দুই পক্ষের আইনজীবীদের শুনানী শেষে মতিউর রহমান নিজামীর বিরুদ্ধে ১৬টা অভিযোগ দাঁড় করায়। এগুলো সব কাঠগড়ায় দাঁড়ানো নিজামীকে পড়ে শোনানো হয়। নিজামী অবশ্য তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগসমূহ মিথ্যা বলে ঘোষণা করে এবং নিজেকে নির্দোষ দাবী করে।

বিবাদীপক্ষের আইনজীবীরা ২৬জন সাক্ষীকে হাজির করে। সেই সাথে অসংখ্য প্রামাণিক দলিল হাজির করে। অন্যদিকে আসামী পক্ষের আইনজীবীরা তিনজন সাক্ষীকে হাজির করে। তাঁরাও কিছু দলিলপত্র ট্রাইবুনালে পেশ করে।

ট্রাইবুনাল এই ষোলটা অভিযোগের মধ্যে তিনটা, অভিযোগ ২, ৬ এবং ১৬-তে তাকে দোষী সাব্যস্ত করে ফাঁসির দণ্ডাদেশ দেয়। পরে সুপ্রীম কোর্টের আপিলেট ডিভিশনেও এই সাজা বহাল থাকে।

যে তিন অভিযোগে নিজামীর ফাঁসির আদেশ হয়েছিল, সেগুলো দেখি আমরা।

অভিযোগ ২: একাত্তরের ১০ মে বেলা ১১টার দিকে  সাঁথিয়া উপজেলার বাউশগাড়ি গ্রামের লোকদের রূপসী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে একটি সভায় আসার জন্য আহবান জানায় মতিউর রহমান নিজামী। স্থানীয় শান্তি কমিটির সদস্য ও রাজাকারদের উপস্থিতিতে ওই সভায় নিজামী এই বলে বক্তব্য রাখে যে, অচিরেই পাকিস্তানি সেনারা শান্তি রক্ষার জন্য এখানে আসবে।

১৮ইমে একদল রাজাকার এবং নিজামীর এক সহযোগী আসাদকে সাথে নিয়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনী এসে হাজির হয়। তারা বাউশগাড়ি, রূপসী এবং ডেমরা গ্রামকে ঘিরে ফেলে। প্রায় সাড়ে চারশো মানুষকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয় এই তিন গ্রাম থেকে। সবাইকেই গুলি করে মেরে ফেলা হয়। এদের হত্যা করার পর পাকিস্তান আর্মি এবং রাজাকাররা ৩০-৪০জন নারীকে ধর্ষণ করে। এর পরিণতিতে এই নারীরা লোকলজ্জায় দেশ ছেড়ে ভারতে পালিয়ে যায়।

অভিযোগ ৬: ১৯৭১ সালের নভেম্বর মাসের ২৭ তারিখে মুক্তিযোদ্ধাদের খোঁজার অজুহাতে ধূলাউড়া গ্রামের ডাক্তার আবদুল আওয়াল এবং তাঁর প্রতিবেশীদের বাড়িতে হামলা চালায় নিজামী এবং তার দোসর রাজাকাররা। অসংখ্য নারী-পুরুষ এবং শিশুকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয় ধুলাউড়া স্কুলের মাঠে। সেখানে গুলি করে নির্বিচারে তাদের হত্যা করা হয়।

অভিযোগ ১৬: মুক্তিযুদ্ধের শেষ পর্যায়ে, পরাজয় নিশ্চিত জেনে মতিউর রহমান নিজামী এবং তার সংগঠন ইসলামী ছাত্র সংঘ এবং আল-বদর বাহিনী বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবী এবং পেশাজীবীদের উপর গেস্টাপো ধরনের হামলা শুরু করে। বুদ্ধিজীবীদের তালিকা তৈরি করে তাঁদের বাড়িতে হামলা চালায় তারা, চোখ বেঁধে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়, নিয়ে গিয়ে নির্মমভাবে নির্যাতন করা হয় অত্যন্ত নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হয়। তাঁদের মৃতদেহ গণকবরে ঠাই হয় বা কখনো কখনো উন্মুক্ত স্থানেও ফেলে দেওয়া হয় সেগুলো। এই হামলা চালানো হয়েছিল মূলত ১৪ই ডিসেম্বর এবং এর এক দুইদিন আগের ও পরের  দিন।

৪.

বর্তমানে বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধী এবং মানবতাবিরোধীদের বিচার হচ্ছে। যদিও এই অপরাধসমূহের ঘটনাকাল এখন থেকে পয়তাল্লিশ বছর আগে। ঘটেছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়ে। নানা কারণে এই বিচার বিলম্বিত হয়েছে। এই দীর্ঘ সময়ের অনেকখানি জায়গা জুড়েই স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি রাষ্ট্র ক্ষমতায় থাকতে পারে নি। ফলে, এদের কোনো বিচার হয় নি। শুধু যে, বিচার হয় নি বা বিলম্বিত হয়েছে, তাই নয়। এই সুযোগে এরা সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয়ভাবে নিজেদের পূনর্বাসিত করেছে, আর্থিকভাবে পুষ্ট হয়েছে, গা থেকে রাজাকারের গন্ধ মুছে ফেলার চেষ্টা করেছে। এদের কেউ কেউ বিভিন্ন সময়ে জনপ্রতিনিধি হয়েছে, মন্ত্রী হয়েছে, এমনকি রাষ্ট্রের শীর্ষপদও দখল করেছে। এরকম লোকজনকে যুদ্ধ ঘটনার এতো বছর পরে এসে তাদের কৃতকর্মের জন্য যথাযথ শাস্তি দেওয়াটা অত্যন্ত দুরূহ কাজ।

দুরূহ, কিন্তু অসম্ভব নয়। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের যে সরকার বর্তমানে রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসীন আছে, তারা তাদের নির্বাচনের প্রতিশ্রুতি হিসাবে এই সব রাজাকা্রদের, বিশেষ করে শীর্ষ রাজাকাররা, যারা একাত্তরে গণহত্যা, নির্বিচারে হত্যা, ধর্ষণ, হিন্দু ধর্মালম্বী এবং স্বাধীনতার পক্ষের মানুষদের উপর নৃশংস অত্যাচার করেছিল্‌ তাদের বিচার করা শুরু করে। এই বিচারে ইতোমধ্যেই কাদের মোল্লা, মোঃ কামরুজ্জামান, সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী এবং আলী আহসান মুজাহিদ এবং অতি সম্প্রতি মতিউর রহমান নিজামীর ফাঁসি হয়েছে। জেলদণ্ড হয়েছে গোলাম আযম এবং দেলোয়ার হোসেন সাঈদীর। আরো কয়েকজনের রায় প্রকাশের অপেক্ষায় রয়েছে।

আজকে বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধীদের যে বিচার হচ্ছে, এর ভিত্তিটা গড়ে দিয়েছিলেন এক অসমসাহসিক নারী জাহানারা ইমাম। একটা সময়ে, প্রায় সবাই যখন একাত্তরের কথা ভুলতে বসেছে, বাংলাদেশের সমাজে যুদ্ধাপরাধীরা যখন শক্ত ভিত গেড়ে বসেছে, মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের মানুষেরা যখন কোণঠাসা, ঠিক সেই সময়ে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য বাংলাদেশে সবচেয়ে বড় আন্দোলনটা গড়ে তুলেছিলেন তিনি। ভিয়েতনামে মার্কিন আগ্রাসনের বিচারের লক্ষ্যে ১৯৬৬ সালে বার্ট্রান্ড রাসেলে একটি বেসরকারি ট্রাইব্যুনাল গঠন করেছিলেন। সেই ট্রাইব্যুনালে ভিয়েতনাম যুদ্ধ এবং উত্তর ভিয়েতনামে গুপ্তহত্যার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জনসনের সরকারকে দায়ী করা হয়। এরই আদলে জাহানার ইমাম ১৯৯২ সালের ২৬শে মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে গড়ে তোলেন গণ আদালত। সেখানে প্রতীকী বিচারকার্য সমাধা হয় গোলাম আযমসহ কুখ্যাত বেশ কিছু রাজাকারের। এই গণআদালতের রায় বাস্তবায়নের জন্য সারা দেশব্যাপী এক বিশাল আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন তিনি।

পচাত্তরের পরে আমাদের ইতিহাসকে বিকৃত করার, আমাদের গৌরবোজ্জল উত্তরাধিকারকে কালিমালিপ্ত করার, ইতিহাসের সাহসী মানুষদের বিস্মৃতির আঁধারে ঠেলে দেবার, খলনায়কদের নায়ক বানানোর সব প্রচেষ্টাই চালু হয়ে যায়। একসময় যারা বাংলাদেশের জন্মে প্রবল বিরোধিতা করেছে, নিদারুণ নিষ্ঠুরতা প্রদর্শন করেছে একে আঁতুরঘরেই হত্যা করতে,  একাত্তরের সেইসব যুদ্ধাপরাধীরা তখন সমাজে সুপ্রতিষ্ঠিত। তাদের বিরুদ্ধে কথা বলার মতো কোনো কণ্ঠ তখন বাংলাদেশে ছিল না। অদম্য সাহস নিয়ে মহিয়সী এই মহিলা এগিয়ে আসেন যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুলতে। সেই সময় তিনি মরণব্যাধী ক্যান্সারে আক্রান্ত। মৃত্যুকে সঙ্গী করে আন্দোলন পরিচালনা করেছেন তিনি। বিএনপি-জামাত এবং ফ্রিডম পার্টি লোকদের অকথ্য গালিগালাজ খেয়েছেন তিনি। বিএনপি সরকারের লেলিয়ে দেয়া পুলিশের লাঠিপেটা খেয়ে হাসপাতালের ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটেও থেকেছেন। তারপরেও তাঁকে ঠেকানো যায় নি। নির্মূল কমিটির জেলা বা থানা পর্যায়ের আয়োজিত যে কোন জনসভাতেই অংশ নিতেন তিনি। ফলে আন্দোলন হয়ে উঠেছিল দুরন্ত-দুর্বার।

গণ আদালত গঠন করার অপরাধে তাঁকে সহ চব্বিশজনকে রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলায় ফেলে দেয় বিএনপি সরকার। রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপবাদ মাথায় নিয়েই মারা যান তিনি। আজব আমাদের এই দেশ! অথচ এই ভদ্রমহিলা মানব ইতিহাসের বিরল এক মা। একাত্তরে বাংলাদেশের যাতে জন্ম হয়, সেই কারণে নিজ হাতে তাঁর সন্তানকে রণসাজে সাজিয়ে দিয়ে, ভারতের পথে নামিয়ে দিয়ে এসেছিলেন তিনি। যুদ্ধে যাওয়া তাঁর সেই তরুণ ছেলে রুমি বাঁচে নি। আরো অসংখ্য গেরিলা যোদ্ধার সাথে তাকেও ধরে নিয়ে গিয়ে হত্যা করা করেছিল পাকিস্তান মিলিটারি। শুধু যে ছেলে হারিয়েছিলেন তিনি, তাই নয়। তাঁর স্বামীও মারা গিয়েছিল এই যুদ্ধের প্রত্যক্ষ স্পর্শে। আর সেই দেশে তিনি রাষ্ট্রদোহী হিসাবে স্বীকৃতি পেয়েছিলেন! অদ্ভুত ব্যাপার!!

কুখ্যাত রাজাকার এবং আল-বদররা, যারা আমাদের এই দেশটাকে নরককুণ্ডে পরিণত করেছিল, পরিণত করেছিল মৃত্যুর হিম ছোঁয়ানো এক শ্মশানভূমিতে, তাদের বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনাল এবং আদালতের এই রায়গুলো একেকটি ইতিহাস। এই রায়গুলোতে রক্তের অক্ষরে লেখা আছে তাদের সকল কুকীর্তির কথা। এগুলো জানা দরকার আপামর জনগণের, আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্মের। একদল রক্ত পিপাসু দস্যু কীভাবে আমাদের পূর্ব পুরুষদের রক্ত ঝরিয়েছে বিনা কারণে, সেটা জানলে এদের ঘৃণা করতে সুবিধা হবে তাদের। সেই সাথে তারা এটাও জানবে যে, এই দেশটা কারো দয়ার দানে আসে নি। একে কিনতে হয়েছে অনেক রক্তের দামে, অনেক প্রাণের বিনিময়ে, অনেক নারীর সম্ভ্রম হারানোর মূল্যে।  

ফরিদ আহমেদ, কানাডা প্রবাসী লেখক

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪২ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬৩ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩১ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯০ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৬ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ