প্রধান সম্পাদক : কবির য়াহমদ
সহকারী সম্পাদক : নন্দলাল গোপ
টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
Advertise
জুয়েল রাজ | ১৬ মে, ২০১৬
কান ধরে উঠবস আমরা সবাই কম বেশি করেছি, বাংলাদেশে স্কুলে বা বাড়িতে অভিভাবকগণ এই কাজটা করিয়েছেন কম বেশি। এতে কেউ মরে যায় নি। তবে শিশু মনেও অপমান লাগে যখন অন্য অন্য ভাই বোনেরা হাসাহাসি করতো।
শ্যামল কান্তি ভক্ত ৫১ বছর বয়সে নিজের বিদ্যালয়ে ছাত্রছাত্রী সমেত হাজার হাজার মানুষের সামনে সেই অপমানটা মাথা পেতে নিয়েছেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হওয়া ভিডিওটি অনেকেই দেখেছেন, বাংলাদেশের কোন টেলিভিশন সংবাদ ও প্রকাশ করেছে।
নারায়ণগঞ্জের পিয়ার সাত্তার লতিফ হাইস্কুলের বারান্দায় দাঁড়িয়ে কানে ধরে উঠবস করছেন ওই স্কুলেরই প্রধান শিক্ষক শ্যামল কান্তি ভক্ত। চারপাশে কিছু অমানুষের দল দাঁড়িয়ে একটি নাটকের মঞ্চায়ন দেখছে। কেউ আবার মোবাইল দিয়ে সেই চিত্র ধারণ করছে। আমি সেই ভিডিওটি শেয়ার দিয়েছিলাম। অনেকে আমাকে ভিডিওটি সরিয়ে ফেলতে বলেছিলেন, শ্যামলকান্তি ভক্তকে যেন আর অপমানিত না করি। আমি শ্যামল কান্তি ভক্তকে অপমান করতে ভিডিওটি শেয়ার করিনি। পাশে দাঁড়ানো কিছু দুপেয়ে জানোয়ারের চেহারা চিনতে চেয়েছি মাত্র। টানা তেইশ বছর ধরে শিক্ষকতা করে আসা ৫১ বছর বয়েসী মানুষটি একটি মানুষও কি জন্ম দিতে পারেন নি? একটা মানুষ ও প্রতিবাদ করতে দাঁড়ায়নি, তাঁর কোন ছাত্র কি সেদিন ছিলনা সেখানে? একজন সহকর্মীও সামনে এসে দাঁড়ায়নি। আর না দাঁড়ানোর প্রধান কারণ ধর্ম অবমাননার পক্ষে কেউ দাঁড়াতে সাহস পায়নি। শ্যামল কান্তি ভক্ত আপনার জন্য করুণা হয়। সব অমানুষ গড়েছেন একটাও মানুষ গড়তে পারেন নি।
শ্যামল কান্তি ভক্তর অপরাধ, ধর্মীয় অনুভূতিতে তিনি আঘাত করেছেন, এক ছাত্রকে ইবলিশ বলেছেন। সংবাদ ভাষ্যমতে, স্কুল শিক্ষার্থীকে বেধড়ক মারধর, ধর্মীয় অনুভূতি আঘাত সহ বিভিন্ন অনিয়মের অভিযোগে জনগণের রোষানলের শিকার একটি স্কুলের প্রধান শিক্ষককে শ্যামল কান্তি ভক্তকে জনসম্মুখে কান ধরে মুচলেকা দেওয়ার পর থানা পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। সেই সাথে স্কুলের প্রধান শিক্ষককে চাকুরিচ্যুত এবং স্কুল পরিচালনা কমিটির সভাপতি ফারুকুল ইসলামকে বহিষ্কার করে নতুন কমিটি গঠন করতে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে নির্দেশ দিয়েছেন নারায়ণগঞ্জ-৫ (শহর-বন্দর) আসনের সংসদ সদস্য সেলিম ওসমান।
সংসদ সদস্য সেলিম ওসমান স্থানীয় প্রশাসন ও অভিযুক্তের সাথে কথা বলে অভিযোগের সত্যতা পান। পরে সংসদ সদস্যের নির্দেশে স্কুলের প্রধান শিক্ষক শ্যামল কান্তি ভক্ত নিজের অপরাধ স্বীকার করে প্রকাশ্যে ক্ষমা চেয়ে কান ধরে মুচলেকা দেন। পরে তাকে পুলিশের কাছে সোপর্দ করে তাকে পুলিশ হেফাজতে রেখে চিকিৎসা প্রদান করে তাকে স্কুলের আয়-ব্যয়ের অনিয়মের ব্যাপারে জিজ্ঞাসাবাদ করার নির্দেশ দেন। সেই সাথে প্রধান শিক্ষক শ্যামল কান্তি ভক্তকে স্কুল থেকে চাকুরিচ্যুত এবং স্কুল পরিচালনা কমিটির সভাপতি ফারুকুল ইসলামকে কমিটি থেকে বহিষ্কার করে নতুন কমিটি গঠন করতে নির্দেশ দেন। আর নাটকের দৃশ্যটা এখানেই পরিষ্কার হয়ে যায়। মূলত কি কারণে এই নাটক মঞ্চায়ন। ধর্মীয় অনুভূতির সাথে স্কুলের আয় ব্যয় বা অনিয়মের সম্পর্ক কি। দুইটা বিষয় তো আলাদা হওয়ার কথা।
এই প্রধান শিক্ষক যদি শিক্ষক রাজনীতি কিংবা অনিয়মের সাথে জড়িত থাকেন, তাঁকে বহিষ্কার অথবা তাঁর পদত্যাগের দাবিতে বিক্ষোভ আন্দোলন সবই স্বাভাবিক। ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের অভিযোগ এনে এমন ঘৃণ্য রাজনীতির প্রয়োজন পড়ল কেন। তাও মাইকে ঘোষণা দিয়ে লোক সমাগম ঘটিয়ে নাটক মঞ্চায়ন কেন?
এই নাটকে শ্যামল কান্তি যতোটা না অপমানিত হয়েছেন তাঁর চেয়ে বেশি হয়েছেন একজন শিক্ষক। একটি শ্রদ্ধার জায়গাকে ভূলুণ্ঠিত করা হয়েছে। শিক্ষক মানেই পুত পবিত্র নয়। পরিমল পান্নার বিচারের দাবিতে আমরা সোচ্চার ছিলাম। তেমনি শ্যামল কান্তির দুর্নীতি অনিয়মের বিরুদ্ধে ও প্রতিবাদ জানাই, যদি তিনি জড়িত থাকেন এর সাথে।
শিক্ষকরা জাতি গড়ার কারিগর এই বুলি না আওড়ে একবার মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়ান। প্রতিবাদ করুন। এই পচন রোধ করা না গেলে লাখ লাখ শ্যামল কান্তি ভক্ত অপেক্ষা করছেন বাংলাদেশ জুড়ে। এমন স্কুল খুঁজে পাওয়া কঠিন হবে যেখানে শিক্ষকদের মধ্যে বা কমিটির মধ্যে বিরোধ নেই। শুধু একটা মসজিদ লাগবে আর একটা মাইক লাগবে। পরবর্তী কান ধরে উঠবস আপনার জন্য অপেক্ষা করছে। সেখানে আপনার আমার শিক্ষক যে থাকবেন না এরও নিশ্চয়তা নেই। শিক্ষক সমাজ বেতন ভাতার জন্য আমরণ অনশনে যেতে পারেন নিজের সম্মান রক্ষা করতে নয় কেন? সম্মানের জায়গাটুকু সমুন্নত রাখা আপনাদেরও দায়িত্ব।
পুলিশ প্রশাসন সেখানে দাঁড়িয়ে ছিল, এমপি সাহেবের নির্দেশের অপেক্ষায়। ঘটনা ঘটার আগে ৪ দিন ধরে এলাকাবাসী ফুঁসছিল, পুলিশ জানল এলাকাবাসী ও জানল মাননীয় এমপি সাহেব জানলেন না। শুক্রবার সকাল ১১টায় এলাকার কয়েক হাজার ধর্মভীরু নারী পুরুষ একত্রিত হয়ে স্কুলের ভেতরে প্রধান শিক্ষক শ্যামল কান্তি ভক্তকে অবরুদ্ধ করে রাখে। এ সময় উত্তেজিতরা শ্যামল কান্তি ভক্তকে গণপিটুনি দিয়ে তার শরীরের জামা কাপড় ছিঁড়ে ফেলে। এর চার ঘণ্টা পরেই তিনি জানতে পারলেন। মাননীয় এমপি সাহেব পুলিশ প্রশাসন নিয়ে কানে ধরিয়ে জানে বাঁচিয়ে দিয়েছেন।
তাঁর মানে বুঝা গেল আইন, পুলিশ, সংসদ সদস্যের চেয়ে ও কানে ধরে উঠবস করা অনেক শক্তিশালী। বাংলাদেশের মানুষ এতো সভ্য হয়ে গেল কোনদিন? কান ধরে উঠবস করায় অপরাধ মাফ করে দেয়। মনে হচ্ছে আইন আদালত বিচারকের দিন ফুরিয়ে আসছে। জেল ফাঁসির দিন ফুরিয়ে আসছে। কান ধরে উঠবস করলেই এখন সাজা মওকুফ হওয়ার সুযোগ আছে!
মসজিদের মাইকে ঘোষণা দিয়ে আক্রমণ করার যে অভ্যাস গড়ে উঠছে, এই যে ফ্রি-লাইসেন্স দিয়ে দেয়া হচ্ছে, আজকে শ্যামল কান্তি ভক্ত শিকারে পরিণত হয়েছেন কাল যে আপনি হবেন না এর নিশ্চয়তা কি আছে। শ্যামল কান্তির পরিবার, সন্তানের কথা কি পাশে দাঁড়িয়ে থাকা পুলিশ, এমপ্ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা একবা,ও ভেবেছিলেন ?
ভিডিওটি যারা দেখেছেন খেয়াল করলে দেখবেন শাস্তি দেয়া অবস্থায় ''জয়বাংলা, জয়বাংলা'' বলে শ্লোগান ভেসে আসছিল। যতদূর জানি এমপি সাহেব জয়বাংলার লোক না। উনার অনুসারীরাও জয়বাংলা শ্লোগান দেয়ার কথা না। জয়বাংলা শ্লোগান দিয়ে আসলে এরা কি প্রমাণ করতে চেয়েছে?
আমার খুব ছেলেবেলার কথা মনে পড়ছে, আমার গৃহশিক্ষক সুভাষ স্যারের কথা মনে পড়ছে, যিনি কোলে নিয়ে সারা উঠান হেঁটে হেঁটে ছড়া, কবিতা শিখিয়েছিলেন। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক আশুতোষ স্যারের কথা মনে পড়ছে, যিনি আমাকে প্রথম শ্রেণি থেকে তৃতীয় শ্রেণীতে প্রমোশন দিয়েছিলেন। আমাদের গ্রামের হাইস্কুল শরৎচন্দ্র নন্দলাল পাবলিক উচ্চবিদ্যালয়, যেখানে আমি কয়েক বছর পড়েছিলাম। সেই হাইস্কুল জীবনে আমাদের আতংক বিএসসি স্যার, সাত্তার স্যারকে মনে পড়ছে, স্যারের বেতের বাড়ি না খাওয়া ছাত্রছাত্রী শরৎচন্দ্র নন্দলাল পাবলিক উচ্চ বিদ্যালয়ে কেউ আছে কিনা আমার জানা নেই। যার কাছে পড়ার চেয়ে আমি হাতের লেখা বিশ্রী হওয়ার কারণে মার খেয়েছি বহুবার। বহু বছর পর এক অনুষ্ঠানে আমার হাতের লেখা দেখে স্যার অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করেছিলেন এটা তোর হাতের লেখা? আমি বলেছিলাম স্যার এটা আপনার বেতের বাড়ির অবদান! সবার প্রিয় মৌলভী স্যারকে মনে পড়ছে। সামনের বেঞ্চে পড়া ধরে স্যার যখন দ্বিতীয় সারিতে ঢুকেছেন আস্তে করে স্যারের ক্ষয়ে যাওয়া পাঞ্জাবির কোনা ধরে শক্ত করে বসে পড়েছি স্যার যখন হাটতে চেষ্টা করেছেন ধুম করে ছিঁড়ে গেছে। এবং সেটা ইচ্ছে করে করেছি, যাতে করে পুরাতন পাঞ্জাবিটা স্যার না পরেন। এই স্যারদের সাথে এক সময় সম্পর্কটা অনেকটাই অভিভাবকের সম্পর্ক হয়ে গিয়েছিল, বাড়িতে গেলে একবার না হয় দেখা করার চেষ্টা করতাম, স্যারেরাও কেউ কেউ খোঁজ নিতেন কিংবা রাস্তাঘাটে দেখা হলে পরামর্শ দিতেন, ভয় পাওয়া সাত্তার স্যারই যখনই এলাকায় কোন কিছু করতে চেয়েছি সবার আগে হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। একেবারেই প্রত্যন্ত গ্রাম অঞ্চল, প্রধান শিক্ষক কৃষ্ণপদ দাশ। আমার পিসির (ফুফু) ভাসুর সেই হিসাবে আমার পিসা (ফুফা) আমার বাবার খুব ভাল বন্ধুও ছিলেন তিনি। স্কুল শেষে প্রতিদিন হাতে ন্যাশনাল প্যানাসনিক টেপ আর সানলাইট ব্যাটারির বক্স নিয়ে হাজির হতেন আমাদের বাড়িতে। বাবা আর আমাদের হেডস্যার কি নিয়ে কথা বলতেন জানিনা, কখনো বাড়ীর উঠানে, কখনো বারান্দায়, কখনো ঘরের ভিতর বসে তাঁদের দীর্ঘ আলাপচারিতা চলত। আর আমি সেই ৫/৬ বছর বয়সে মুখস্থ করে ফেলেছি সন্ধ্যা, লতা, আরতি, সাগর সেন, চিন্ময়, মানবেন্দ্র মোহাম্মদ রফির নাম চেহারা। দুই-একটা গানের কলিও বোধহয়। সেই স্যার ক্লাস সিক্সে পড়াকালীন সময়ে স্কুলে অনিয়মিত ক্লাস নেয়ার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার পরিকল্পনার কথা পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় নিজের কানে শুনে ফেলেছিলেন। আমার সাথে আর কে কে জড়িত জানতে অফিসে ডেকে নিয়ে জালিবেত দিয়ে কঠিন শাস্তি দিয়েছিলেন। সেদিন কারও নাম আমার মুখ দিয়ে বের করতে পারেন নি।
স্যার আপনারা ভাগ্যবান আমার কোন ধর্মীয় অনুভূতি ছিল না! কাজী কাদের নেওয়াজের কবিতার শেষ চরণগুলো আওরাচ্ছি -
উচ্ছ্বাস ভরে শিক্ষকে আজি দাঁড়ায়ে সগৌরবে
কুর্ণিশ করি বাদশাহে তবে কহেন উচ্চরবে-
"আজ হতে চির-উন্নত হল শিক্ষাগুরুর শির,
সত্যই তুমি মহান উদার বাদশাহ আলমগীর।”
মনে হচ্ছে বারবার একটা ভুল কবিতা শিখে বড় হয়েছি মনে হয়। কাজী কাদের নেওয়াজ মনে হয় ধর্মীয় অনুভূতির কথাটা জানতেন না। ধর্মীয় অনুভূতির কাছে পরাজিত হয়ে গেল ছাত্রশিক্ষক সম্পর্ক।
মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।
আপনার মন্তব্য