আজ বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪

Advertise

বিবিসি ‘Independent Researchers’ বলতে তুমি কি বোঝ?

আরিফ রহমান  

১.
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে নিরীহ বাঙালী জনগোষ্ঠীর ওপর গণহত্যা পরিচালনাকারী সংগঠন জামায়াতে ইসলামী এর কিলিং স্কোয়াড আল-বদর বাহিনীর প্রধান নরঘাতক মতিউর রহমান নিজামীর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হবার পর আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমে বিষয়টি যথেষ্ট গুরুত্ব নিয়েই স্থান পেয়েছে। তবে আমরা উদ্বেগের সাথে লক্ষ্য করেছি এই মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হবার পর পৃথিবীর বিভিন্ন গন-মাধ্যমে (যাদের মধ্যে বিবিসি উল্লেখযোগ্য) আল-বদর বাহিনীর প্রধান নরঘাতক মতিউর রহমান নিজামীকে ‘ইসলামিক নেতা’,‘প্রধান বিরোধীদলীয় নেতা’ সহ বিভিন্ন উপনামে পরিচয় করিয়ে দেয়া হচ্ছে। যদিও আসল সত্য এই যে নিজামী বাংলাদেশে এমন একটি নাম যাকে রাজাকার কিংবা আলবদর শব্দের প্রতিশব্দ হিসেবে সাধারণ জনগণ ব্যবহার করে থাকে। আমাদের দেশের স্কুল কলেজে ‘যেমন খুশি তেমন সাজো প্রতিযোগিতায় কেউ রাজাকার সাজতে চাইলে তারা সবসময় নিজামীর ছবিটা দেখে নেয়। বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধের এক আইকনিক ফিগার মতিউর রহমান নিজামী।



আমরা জানি- পৃথিবীর যে কোন আদালতের যে কোন আইন দিয়ে যদি নিজামীর বিচার করা হতো তাহলে সেই আইনে তার সর্বোচ্চ শাস্তি হতো। কেউ ঠেকাতে পারতো না। কারণ নিজামীর বিরুদ্ধে ছিলো গণহত্যা পরিচালনাকারী সংগঠন আল-বদরের নেতৃত্বের অর্থাৎ ‘সুপিরিয়র রেসপন্সিবলিটি’র দায়।

১৯৭১ সালের জামায়াতে ইসলামের মুখপাত্র দৈনিক সংগ্রাম পত্রিকায় নিজামীর অসংখ্য কলাম, অসংখ্য বক্তব্য, অসংখ্য ছবি রয়েছে যেখানে নিজামী সরাসরি মানুষ হত্যা করতে নির্দেশ দিয়েছে। সেই সব তথ্যাদি সংকলিত আছে বিভিন্ন বই-পত্রে, বিভিন্ন আর্কাইভে। কেউ আগ্রহী থাকলে পড়ে দেখতে পারেন আলী আকবর টাবী রচিত ‘দৈনিক সংগ্রাম: মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী ভূমিকা’। যেমন উদাহরণ হিসেবে তার কিছু বক্তব্য থেকে উদ্ধৃত করা যায়-

‘যারা পাকিস্তান চায় না, তারা আমাদের শক্র। পাকিস্তানের অখণ্ডতা রুখতে হবে ও শক্রদের প্রতিহত করতে হবে।’
(১৪ই নভেম্বর ১৯৭১, দৈনিক সংগ্রাম)

‘ ...খোদাবী বিধান বাস্তবায়নের সেই পবিত্র ভূমি পাকিস্তান আল্লাহর ঘর। আল্লাহর এই পূত-পবিত্র ঘরে আঘাত হেনেছে খোদাদ্রোহী কাপুরুষের দল। এবারের শব-ই-কদরে ইসলাম ও পাকিস্তানের বিরুদ্ধে পরিচালিত উল্লেখিত যাবতীয় হামলা প্রতিহত করে, সত্যিকারের শান্তি ও কল্যাণ প্রতিষ্ঠার এই তীব্র অনুভূতি আমাদের মনে সত্যিই জাগবে কি?’
(১৬ই নভেম্বর ১৯৭১, দৈনিক সংগ্রাম)

‘জাতির এই সংকটজনক মুহূর্তে প্রত্যেক রাজাকারের উচিত ইমানদারির সাথে তাদের উপর অর্পিত এ জাতীয় কর্তব্য পালন করা এবং ঐ সকল ব্যক্তিকে খতম করতে হবে যারা সশস্ত্র অবস্থায় পাকিস্তান ও ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত রয়েছে’
(১৫ সেপ্টেম্বর ১৯৭১, দৈনিক সংগ্রাম)

গণহত্যা, যুদ্ধাপরাধ, আন্তর্জাতিক অপরাধ, এ-সংক্রান্ত নিয়ে যৎসামান্য কিছুটা আগ্রহ থাকার কারণে খোঁজ-খবর করে যতটুকু বুঝেছি তাতে বলতে পারি- পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তের গণহত্যা নিয়ে কাজ করা কোন আইনজ্ঞকে যদি উপরের উদ্ধৃতিগুলো দেখানো হয় এবং এই বক্তব্যের ফলাফল হিসেবে সেই বাহিনী আলবদরের হাতে সংগঠিত হত্যাকাণ্ডগুলো সামনে নিয়ে আসা হয় তাহলে আর কোন সাক্ষী প্রমাণ ছাড়াই তার সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত হয়ে যাবে। মুক্তিযুদ্ধে বাঙালির বিজয়ের ঊষালগ্নে অসংখ্য বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করে আলবদর বাহিনী। দেশের বুদ্ধিজীবী শ্রেণীকে সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে ধ্বংস করার জন্য পরিকল্পিতভাবে আলবদর সদস্যরা গণহত্যা ঘটায়। জামায়াতের তৎকালীন ছাত্রসংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘ ও আলবদর বাহিনীর প্রধান হিসেবে ওই গণহত্যার দায় নিজামীর ওপর পড়ে।

সে-কারণেই নিজামীকে কোন মতেই একজন ‘ইসলামিক নেতা’ কিংবা ‘প্রধান বিরোধীদলীয় নেতা’ উপনামে পরিচয় করিয়ে দেয়ার কোন সুযোগ নেই। নিজামীর হাতে নির্যাতনের শিকার বহু মানুষ আমাদের দেশে জীবিত আছেন। নিজামী সম্পর্কে মন্তব্য করার আগে আন্তর্জাতিক সাংবাদিকদের উচিত ছিল সেইসব ভিকটিম পরিবার গুলোর সাক্ষ্য গ্রহণ করা।


 ২.

১১ই মে প্রকাশিত বিবিসি-র আলোচিত সেই প্রতিবেদনে  নিজামীকে ভুল ভাবে পরিচয় করিয়ে দেয়া ছাড়াও আরও একটি কাজ করা হয়েছে। সেটা হচ্ছে ১৯৭১ সালের গণহত্যা সম্পর্কে মিথ্যাচার। আলোচিত সেই প্রতিবেদনের শেষ লাইনে বাংলাদেশে পাকিস্তান সেনাবাহিনী এবং রাজাকার আলবদর বাহিনীর হাতে নিহত শহীদের সংখ্যা সম্পর্কে বলা হয়েছে-

“Exact number of people killed is unclear - Bangladesh says it is three million but independent researchers put the figure at up to 500,000 fatalities.”

যদিও সেই প্রতিবেদনে কথিত “independent researchers”-দের নাম উল্লেখ করা হয়নি। এই পর্যায়ে আসুন আজ দেখে নেয়া যাক আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে কয়েকজন গবেষক- ১৯৭১ সালে সংগঠিত গণহত্যা সম্পর্কে কি মন্তব্য করেছেন-

১) Dr.Ted Robert Gurr এবং Dr. Barbara Harff  দুজন গণহত্যা গবেষক। এঁদের মাঝে Ted Robert Gurr বর্তমানে Maryland বিশ্ববিদ্যালয়য়ের শিক্ষক আর Barbara Harff ইউএস নেভি একাডেমীতে পলিটিক্যাল সায়েন্সের শিক্ষক। তারা দুইজনই পলিটিক্যাল সায়েন্সের দুইজন দিকপাল হিসেবে পরিচিত। তাদের বিখ্যাত গ্রন্থ Toward Empirical Theory of Genocides and Politicides যেটা প্রকাশিত হয় ১৯৮৮ সালে, সেই বইতে উল্লেখ করেছেন ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে ১২,৫০,০০০ থেকে ৩০,০০,০০০ মানুষ নিহত হয়েছে।

২) Milton Leitenberg এর গবেষণা পত্র “Deaths in Wars and Conflicts in the 20th Century”। যেটা প্রকাশিত হয় coronell university থেকে, Deaths in Wars and Conflicts in the 20th Century শীর্ষক সেই প্রবন্ধে লেখা আছে মুক্তিযুদ্ধে নিহতের সংখ্যা ১.৫ মিলিয়ন অর্থাৎ ১৫ লক্ষ

৩) Compton’s Encyclopedia তাদের গণহত্যা পরিচ্ছেদে মুক্তিযুদ্ধে শহীদের সংখ্যা লিখেছে ৩০ লক্ষ।

৪) Encyclopedia Americana তাদের 2003 সালের সংস্করণে বাংলাদেশ নামক অধ্যায়ে একাত্তরে মৃত মানুষের সংখ্যা উল্লেখ করেছে তিরিশ লক্ষ।

৫) গণহত্যা গবেষক লিও কুপার তাঁর বিখ্যাত জেনসাইড বইতে উল্লেখ করেছেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লক্ষ মানুষ শহীদ হয়েছে।

৬) বিশিষ্ট রাজনীতি বিজ্ঞানী Rudolph Joseph Rummel এর লেখা  STATISTICS OF DEMOCIDE, বইটিকে দাবি করা হয়ে থাকে বিশ্বে গণহত্যা নিয়ে সংখ্যাগতভাবে অন্যতম কমপ্রিহেন্সিভ বই। বইটির অষ্টম অধ্যায়ে ‘Statistics Of Pakistan’s Democide Estimates, Calculations, And Sources’ নিবন্ধে তিনি দেখিয়েছেন বাংলাদেশে ১৯৭১ সালের মুক্তির সংগ্রামে ১৫,০৩,০০০ থেকে সর্বোচ্চ ৩০,০৩,০০০ মানুষ প্রাণ হারিয়েছে।

৭) পুলিৎসার পুরস্কার বিজয়ী লেখিকা "Samantha Power" এর লেখা গণহত্যা সম্পর্কিত সর্বাধিক বিক্রি হওয়া একটি বই "A Problem from Hell": America and the Age of Genocide"। এই বইয়ের ভেতর ১৯৭১ সালে শহিদের সম্পর্কে সংখ্যাটি ১০ থেকে ৩০ লক্ষ বলা হয়েছে।


সুতরাং একটা বিষয় পরিষ্কার ভাবেই বলা যায় বিশ্বময় অনেক গণহত্যা গবেষকদের গবেষণাই বলছে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে শহীদের সংখ্যা ৩০ লাখের কাছাকাছি। বরং আরও গভীর ভাবে চিন্তা করলে দেখা যায়  যুদ্ধের পূর্ব এবং পরবর্তী সময়ের জনসংখ্যা ঘাটতি বিবেচনায়, ভারতে শরণার্থী শিবিরে নিহত মানুষদের বিবেচনা করলে, যুদ্ধের সময় বিভিন্ন রোগে-শোকে, খাদ্যের ঘাটতিতে নিহত মানুষদের বিবেচনা করলে শহীদের সংখ্যা ৩০ লাখের অনেক বেশি হবে সেটা নিঃসন্দেহে বলা যায়।

আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম গুলোর সচেতন হওয়া উচিত এসব মিথ্যা তথ্য প্রচারের ব্যাপারে। তাদের যথেষ্ট সতর্কতা এবং যাচাই বাছাই করেই তথ্য তুলে ধরা উচিত কারণ আমাদের জাতিসত্তা দাঁড়িয়ে আছে যে তিরিশ লক্ষ শহীদের রক্তে ওপর তাদের অসম্মান করার অধিকার কোন গণমাধ্যমের থাকতে পারে না। বিবিসির মত দায়িত্বশীল সংবাদ মাধ্যমের কাছ থেকে এ-ধরণের মিথ্যাচার আমারা কখনোই আশা করি না।    

আরিফ রহমান, লেখক, অনলাইন এক্টিভিষ্ট

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪২ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬৩ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩১ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯০ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৬ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ