আজ শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

Advertise

সাংবাদিকতার মূল্যবোধ ও চেতনা

জুয়েল রাজ  

মাছরাঙা টেলিভিশনের প্রচারিত সংবাদটি সবারই দেখা এসএসসি পাশ করা ছেলেমেয়েগুলো অনেক কিছুই জানে না। খুবই খারাপ খুবই খারাপ। সবাই ছিঃ ছিঃ করছেন। বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা গেল গেল করছেন। মাছরাঙার সেই সাংবাদিককে অনেকেই বাহবা দিচ্ছেন কাজের মতো একটা কাজ করেছেন। আমিও বলি কাজের মতো একটা কাজ করেছেন!

প্রথম দেখাতে চট করে আমার মাথায়ও তাই এসেছে হায় হায় একি অবস্থা। স্বাধীনতা দিবস জানে না? বিজয় দিবস জানে না? ২১ শে ফেব্রুয়ারি জানেনা? এরাই আগামীর বাংলাদেশের কাণ্ডারি!

এই দায় কি জিপিএ ফাইভ পাওয়া ছাত্রদের, শিক্ষাব্যবস্থার, নাকি পরিবারের কিংবা শিক্ষকের? এইসব প্রশ্নের উত্তর না জানাটা অবশ্যই লজ্জাজনক। কিন্তু এর দায় আমি কোনভাবেই ছাত্রদের দিতে পারিনা কিংবা এরা মেধাবী নয় এই অভিযোগে অভিযুক্ত করতে রাজী নই। আমরা অনেকেই অনেক কিছু জানিনা। গ্রন্থগত সাধারণ জ্ঞান কোনভাবেই মেধা যাচাইয়ের মাপকাঠি হতে পারেনা।

প্রত্যেকে শুধু নিজ সময়ের, ক্লাসের  প্রথম দ্বিতীয় হওয়া মুখগুলোকে একটু খুঁজতে চেষ্টা করলেই দেখতে পারবেন তাঁদের সিংহভাগ হারিয়ে গেছে। মাঝখানে থেকে মধ্যমানের ছাত্রছাত্রী যারা তাঁরাই পেশাগত জীবনে মেধার স্বাক্ষর রাখছেন।

বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা বারবার ব্যবচ্ছেদ করা হচ্ছে, আজকে পর্যন্ত একটা জায়গায় স্থির হতে পারেনি। ১৯৯৫ সালে সর্বশেষ লিখিত ও নৈর্ব্যক্তিক নিয়মে যে কোন একটায় ৩৩ নম্বর পেয়ে  পাশ করলেই  পাশ ছিল। সেই সময়ের 'ঐতিহাসিক' পপি গাইডের পাঁচশত নৈর্ব্যক্তিক প্রশ্ন মোটামুটি মুখস্থ  করলেই একজন  ছাত্র পাশ করে ফেলত, শুধু অংকে ১০০ মার্কস এর পরীক্ষা হতো।  অনেকেই সে সময় ৬/৭ টা লেটার নিয়ে স্টার মার্কস পেয়ে পাশ করেছিলেন। কেউ কেউ লিখিত পরীক্ষায় শূন্য পেয়ে ও প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হয়েছিলেন। ইতিহাস বলে এদের বেশিরভাগ হারিয়ে গিয়েছেন। দোষ তাঁদের হারিয়ে যাওয়াতে নয় দোষ ছিল এই পাশের পদ্ধতির।

আমরা ব্যস্ত হয়ে গেছি জিপিএ ফাইভে ফেইসবুকে, সেলফিতে, আস্তিকে নাস্তিকে, মুক্তিযুদ্ধে শহীদের সংখ্যা  ত্রিশ লক্ষ না তিন লক্ষ? শহীদ বেদিতে ফুল দেয়া শিরক, এসব হিন্দুয়ানী সংস্কৃতি। গোলাম আজম, মুজাহিদ, নিজামী, সাঈদী ইসলামী নেতা। পত্রিকা টেলিভিশনে অনলাইনে আপনি এসব প্রচার প্রচারণা করবেন, সাফাই গাইবেন, ঘণ্টার পর ঘণ্টা টেলিভিশনে ইনিয়ে বিনিয়ে জিয়াউর রহমান বাংলাদেশে স্বাধীনতার ঘোষক প্রমাণ করতে চাইবেন।

আবার আপনার সন্তানের  কাছ থেকে এসব বিষয়ে  সঠিক উত্তর আশা করবেন তা কেমন করে। রবীন্দ্রনাথ হিন্দু কবি, নজরুল ইসলামী কবি এইসব তথ্য শিক্ষা দিবেন তাহলে এরচেয়ে ভাল আর কি শিখবে। চিন্তার আকাশে সীমারেখা টেনে দিয়ে মহাকাশ সম্পর্কে জানতে চাওয়ার মতোই অবস্থা। হাত পা বেঁধে পানিতে সাঁতার দিতে বলছেন শিশুদের। বই-এর জাহাজ কাঁধে চাপিয়ে দিয়ে শুধু বলছেন পড়ো, পড়ো আর পড়ো ! স্কুলে যাও, কোচিং-এ যাও, বাসায় আবার গৃহশিক্ষক এরপর ধর্মীয় শিক্ষা। শিক্ষা যখন পণ্য তখন, কর্পোরেট বাহ্যিক চাকচিক্যটাই আমাদের আকৃষ্ট করছে বেশি। আমার সন্তান জিপিএ ফাইভ পেয়েছে সেটা ফেইসবুকে সেলফি দেয়াটাই সবচেয়ে বড় কথা। কি শিখলো কি জানলো সেটা বড় কথা নয়।

নচিকেতার একটা গানের চমৎকার কিছু লাইন আছে "ভিড় করে ইমারত আকাশটা ঢেকে দিয়ে চুরি করে নিয়ে যায় বিকালের সোনারোদ। ছোট ছোট শিশুদের শৈশব চুরি করে গ্রন্থ কীটের দল বানায় নির্বোধ। এর পর চুরি গেলে বাবুদের ব্রিফকেস অথবা গৃহিণীর শোনার নেকলেস সকলে সমস্বরে চিৎকার করে বলে চুর চুর। প্রতিদিন চুরি যায় মূল্যবোধের সোনা আমাদের স্বপ্ন আমাদের চেতনা’’।

সেই মূল্যবোধ আর চেতনার জায়গা হারিয়ে গেছে দিন দিন। সাংবাদিকতাকে এক সময় বলা হয়তো মহান পেশা এখন কি বলা হয় একটু খোঁজ নিলেই জানতে পারবেন। আড়ালে আবডালে অনেকে বলেন বাংলাদেশে "পুলিশ আর সাংবাদিক সবচেয়ে বড় সন্ত্রাসী’’। ধর্ষক এর ছবি না দিয়ে আপনি  ধর্ষিতার ছবি ছাপবেন, পত্রিকা বা অনলাইনের জনপ্রিয়তা বাড়াতে ভিডিওসহ সংবাদ দিবেন যা এক ধরণের পর্ণ ভিডিওর পর্যায়ে পড়ে। এর জন্য সাংবাদিকতা বিষয়ে ডিগ্রীর প্রয়োজনীয়তা আছে বলে মনে হয়না।

বাংলাদেশে যারা সাংবাদিকতা করেন এর কয়জন পড়ালেখা করা সাংবাদিক? আমি নিজে ও পড়ালেখা ছাড়া সাংবাদিক। নূন্যতম মূল্যবোধের  জন্য সাংবাদিকতা বিষয়ে সার্টিফিকেট অবশ্যই জরুরী নয়।

আমার এসএসসি পাশের পর অনেক কিছু আমিও জানতাম না, পড়াশুনা শেষ করে একবার ব্যাংকের চাকুরীতে ইন্টারভিউ দিয়েছিলাম সব সাধারণ জ্ঞানের প্রশ্ন ছিল সেখানে দেখলাম আমি অনেককিছুই জানিনা, বহু দেশের টাকার নাম জানিনা, বহু আর্থিক সংস্থার পুরো নাম আমি জানিনা সেই উত্তরপত্র যদি এখন ফাঁস হয় আমার অবস্থা কি হবে! এটা মনে করেই তো ঘাম শুরু হয়ে গেছে আমার।

যারা বাম রাজনীতি করেন তাঁদের কাছে  কোন সাংবাদিক কি  কোনদিন জানতে চেয়েছেন  মার্কসবাদ কি, লেনিনবাদ কি তাঁরা জানেন কিনা। আমি অনেককেই জানি তাঁরা জানে না।

আওয়ামী লীগ করেন ছাত্রলীগ করেন  জানেন  না আওয়ামী লীগের মূল নীতি কি? ছাত্রলীগ না আওয়ামী লীগ, কোনটা আগে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতির নাম কি? মুজিবনগর সরকার কবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, মন্ত্রী পরিষদের সদস্য কারা ছিলেন; দেখুন ফলাফল কি আসে?  আমার মনে হয় মন্ত্রী পরিষদে যদি এইসব ইন্টারভিউ নিতে যান অনেক মন্ত্রী ও আটকে যেতে পারেন।

আসুন এবার সাংবাদিক দের ছোটখাটো একটা ইন্টারভিউ নিয়ে দেখি কয়জন জিপিএ ফাইভ পেয়ে পাশ করেন।
১. বারনামা কোন দেশের  সংবাদ সংস্থা?
২ সেন্ট্রাল নিউজ এজেন্সি কোন দেশের সংবাদ সংস্থা?
৩. মিনা (MINA ) কোন দেশের সংবাদ সংস্থা?
৪. রয়টার্স কোন দেশের সংবাদ সংবাদ সংস্থা?
৫. রয়টার্স এর সদর দপ্তর কোথায় অবস্থিত?
৬. বাংলাদেশের প্রথম সংবাদপত্র কোনটি?
৭. বিবিসি বাংলা কতো সালে শুরু হয়?
৮. কবি কাজী নজরুল সম্পাদিত পত্রিকার নাক কি?
৯. বাংলাদেশে কতো সালে টেলিভিশন সম্প্রচার শুরু হয়?
১০. বাংলাদেশে  টেলিভিশন সম্প্রচার সরকারী না বেসরকারি ভাবে শুরু হয়েছিল?

সাংবাদিকদের এই ইন্টারভিউটা নিয়ে দেখতে পারেন যে কেউ। উত্তর আপনার না জানলে ও চলবে কারণ বেশিরভাগই দেখবেন মাছরাঙার ইন্টারভিউ দেয়া বালকদের মতো বলবে আমি জানি না!

সবশেষে সাংবাদিক নিয়ে একটা কৌতুক দিয়ে শেষ করছি  ‘‘একবার ১ জন সাংবাদিক, ১ জন হুজুর, ১ জন রাজনীতিবিদ একসাথে হাটছিলেন। হঠাৎ রাত হয়ে গেলো। তারা আশ্রয়ের জন্য একটি বাসায় গেলেন। বাসার মালিক তাদেরকে রাখতে রাজি হলেন। কিন্তু বাসায় ২ জনের বেশি থাকতে দেয়া যাবে না। তিনি বললেন পাশে একটা গোয়ালঘর আছে। আপনারা কেউ যদি পারেন ওখানে থাকুন। শুধু একটা গরু আছে। প্রথমে হুজুর বললেন , "গোয়ালে আমিই থাকবো। সারারাত দোয়া কালাম পড়ে কাটিয়ে দিতে পারব। তো তিনি গেলেন। কিন্তু ৫ মিনিটের মধ্যে ফিরে আসলেন। বললেন, "অনেক গন্ধ থাকতে পারছি না। তারপর গেলেন রাজনীতিক। ৫ মিনিট পর দরজায় ধাক্কা। তিনি ফিরে এসেছেন। বললেন, গরুটা অনেক নড়াচড়া করে। থাকতে পারলাম না।

তারপর সাংবাদিক বললেন,"আমিই যাই আমি অনেক যায়গায় থেকেছি, আমি পারবো থাকতে।" তার যাওয়ার ৩০ মিনিট পর আবার দরজায় ধাক্কা দরজা খুলে দেখা গেলো স্বয়ং গরুই উঠে এসেছে। সে বলল," কারে পাঠাইছেন? খালি প্রশ্ন করে। ঘুমাইতেই দিলো না।

জুয়েল রাজ, সম্পাদক, ব্রিকলেন; যুক্তরাজ্য প্রতিনিধি, দৈনিক কালেরকন্ঠ

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪১ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬২ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩০ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯০ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৫ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ