প্রধান সম্পাদক : কবির য়াহমদ
সহকারী সম্পাদক : নন্দলাল গোপ
টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
Advertise
চিররঞ্জন সরকার | ১১ জুন, ২০১৬
প্রতিকারহীন খুন আর হত্যার দেশে অবশেষে মুখ খুলেছেন প্রধানমন্ত্রী। আমরা অপেক্ষায় ছিলাম। এত এত হত্যা নিয়ে কেন তিনি কথা বলেছেন না? কেন তিনি নীরব রয়েছেন? এ দেশে তো প্রধানমন্ত্রী না চাইলে কিছুই হয় না। আশার আলোই বলি আর সান্ত্বনাই বলি, সেটা তো তিনিই। অথচ সেই তিনিই কেমন যেন মুখ ফিরিয়ে ছিলেন। মুণ্ডহীন লাশের মিছিল, সন্ত্রাসীদের দাপট-কোনো কিছুই যেন তাঁকে স্পর্শ করছিল না। কিন্তু চট্টগ্রামে এক পুলিশ কর্মকর্তার স্ত্রী খুন হওয়ার পর প্রধানমন্ত্রী মৌনতা ভেঙ্গেছেন। তিনি বলেছেন, এসব হত্যা-খুন কারা করছে, সব তথ্য তাঁর কাছে রয়েছে। তিনি বলেছেন, সরকার বসে নেই। খুনিদের গ্রেপ্তার করা হবে।
এরপর ঢাকঢোল পিটিয়ে দেশব্যাপী শুরু হলো পুলিশি অভিযান। এ অভিযানে হাজার হাজার মানুষকে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। অনেকে প্রশ্ন তুলছেন, ঢাকঢোক পিটিয়ে কখনও আসামী ধরা যায় নাকি? অনেকে বলছেন, এটা আইওয়াশ। হাজার হাজার মানুষকে গ্রেপ্তার করে কখনও ‘টার্গেটকিলিং’ বন্ধ করা যাবে না। কেউ কেউ এটাও বলছেন, এই গণগ্রেপ্তার আসলে পুলিশের ঈদবাণিজ্য। তারা যাকে খুশি তাকে গ্রেপ্তার করছে। এরপর টাকাপয়সার বিনিময়ে রফা হবে। অতীতেও তাই হয়েছে। এর মাধ্যমে কিছু নিরীহ মানুষ হয়রানির শিকার হবে। আর এই ডামাডোলে প্রকৃত অপরাধীরা ঠিকই সটকে পড়ার সুযোগ পাবে!
এদিকে পুলিশ ‘এনকাউন্টার’ ‘ক্রসফায়ার’ বাড়িয়ে দিয়েছে। কেউ কেউ এটা নিয়েও সমালোচনা করছেন। বলছেন, এটা ‘রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস’। বলছেন, ‘বিচার বহির্ভূত’ এই হত্যা বন্ধ করতে হবে।সন্ত্রাসীদের আইনের আওতায় এনে বিচার করতে হবে। সেটাই স্থায়ী সমাধান। গুলি করে মেরে ফেলা কোনো সভ্য রাষ্ট্রের কাজ নয়। আবার অনেকে এসব উদ্যোগকে সমর্থনও করছেন। বলছেন, চুপচাপ হাত গুটিয়ে বসে থাকার চেয়ে সরকার কিছু একটা তো করছে। এতে যদি হত্যা-সন্ত্রাস কিছুটা কমে। আর এ ধরনের ‘বড় অপারেশন’ করতে গেলে কিছু নিরীহ মানুষ হয়রানির শিকার হবেই। এটাকে মেনে নিতে হবে।
এই আলোচিত-সমালোচিত অভিযান যখন চলছে, তখন বেশ কিছু সত্যি কথা বলেছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেছেন, ‘বাংলাদেশ ভূখণ্ডের দিক দিয়ে ছোট। এখানে সবাই সবাইকে চিনতে পারে বা জানতে পারে। এগুলো খুঁজে বের করা খুব কঠিন কাজ না।’-এর চেয়ে সত্যি কথা আর কী হতে পারে? প্রশ্ন হলো, তাহলে আমাদের এত দিন অপেক্ষা করতে হলো কেন? এই ছোট্ট দেশে অল্প কিছু সন্ত্রাসী-ঘাতক নরককুণ্ড বানিয়ে ফেলছে, তাহলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও গোয়েন্দারা তাদের শায়েস্তা করতে পারছে না কেন? কেন ধরতে পারছে না? প্রধানমন্ত্রী বলেননি বলে? এরপর কী কাজ হবে? খুনিরা ধরা পরবে?
এর আগে একের পর এক লেখক, ‘ব্লগার’, ভিন্নচিন্তা, ভিন্ন মতের মানুষরা যখন খুন হয়, তখন কিন্তু আমরা বরং উল্টো কথা শুনেছিলাম। যারা খুন হয়েছেন, তাদের দোষী বানানোর একটা প্রবণতা আমরা লক্ষ করেছিলাম। কর্তাব্যক্তিদের কথায়, এমনকি পহেলা বৈশাখে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যেও ‘ব্লগার’, ভিন্নচিন্তা, ভিন্ন মতের মানুষদের প্রতি একটা ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ দেখা গিয়েছিল। সেই সময় ওই সব হত্যাকাণ্ডের সামাজিক সমর্থনের বাতাবরণ, স্বীকৃতির উৎসাহ তৈরি না হলে, হয়তো দেশে এতোগুলো হত্যাকাণ্ড ঘটতো না। একজন পুলিশ অফিসারের স্ত্রীর মৃত্যু যদি সরকারের মধ্যে ভাবান্তর সৃষ্টি করে, তাহলে সেটাকেও ইতিবাচকই ভাবতে হবে। প্রধানমন্ত্রী দৃঢ় কণ্ঠে বলেছেন, ‘এদের খুঁজে খুঁজে আমরা বের করব। বাংলাদেশে যাবে কোথায়? কেউ পার পাবে না। এর শাস্তি তারা পাবেই।’ প্রধানমন্ত্রীর কথায় আমরা ভরসা পেতে চাই! এনাফ ইজ এনাফ। এবার অন্তত কিছু একটা হোক!
দরিদ্র ও নিম্নবিত্ত, নাগরিক স্বপ্ন এবং হাতের কাছের সুবিধেটুকু নিয়ে বাঁচেন। মধ্যবিত্ত বাঁচেন হারাবার ভয় নিয়ে। পরিষেবা, নিরাপত্তা, সম্পদ। এবং সাধের প্রাণ। এই ভয় থেকে সঞ্জাত যে প্রতিবাদহীন নীরবতা, সেইখানে থাকে সন্ত্রাস। অজ্ঞাত ঘাতক আজ প্রতিবাদীকে আঘাত করতে উদ্যত। আমাদের রোজকার জীবনে সেই ত্রাসও এখন সঙ্গী।
গভীর অসহায়তা থেকে সমাজে শুধু বিচ্ছিন্নতাই তৈরি হয় না, নৈরাজ্যও সৃষ্টি হয়। মানুষ অসহায় মার খেতে থাকলে গোটা সমাজের মেরুদণ্ডে ক্ষয়রোগ এনে দেয়। বেঁচে থাকার তাগিদে এক অসহায় কোপ মারে অন্য অসহায়ের ঘাড়ে। কোন মূর্তিতে সেই কোপ আসে বোঝা সম্ভব নয়। কখনও তা আসতে পারে রাজনীতির রঙে, কখনও ধর্মের রূপে। কখনও বা অচেনা রূপে ভূতের মতো!
কিছু আদর্শহীন, লোভী, ভ্রষ্ট মানুষের হাতে জীবন ছেড়ে বসে আছি। অবমাননার সেখানেই শেষ নয়। মরণও যে অসম্মানের। কারণ, পিষ্ট-ছিন্ন-বিকৃত শবদেহ আগলে এ দেশের রাজনীতি শোক করে না, ভয়ানক দন্তপংক্তি প্রদর্শন করে পরস্পরের দিকে অভিযোগ ছুড়তে ছুড়তে নিজের দুকাঁধ মসৃণ, দায়হীন করে নিতে চায়, যাতে নিজের ক্ষমতার পথ অটুট থাকে। লুণ্ঠিত সম্পদ বয়ে নেওয়া যায়। আর সেই সম্পদের নাম লোভ, ক্ষমতা, নির্লজ্জ অগণতান্ত্রিক প্রভুত্বপরায়ণতা! এটা যখন প্রবল হয়, তখন কেবলই অন্ধকার এসে গ্রাস করে। সেই অন্ধকারে ঘাতক নির্বিঘ্নে ছিনিয়ে নেয় প্রাণ! অপশক্তিরা ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তার করে। আমরা অসহায় থেকে আরও অসহায় হই, বিপন্ন বোধ করি।
ভয় করে! তাই অন্ধকারকে ভীষণ ভয় করে! আর ভয় পেতে লজ্জা করে। অসহায়তার চেয়ে বড় লজ্জা আর কী আছে এ জগতে! প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য আমাদের অন্তঃকরণ জুড়ে ছড়িয়ে থাকা সেই প্রচণ্ড অন্ধকারে আলো জ্বালাক! ভয় কাটাক!
মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।
আপনার মন্তব্য