প্রধান সম্পাদক : কবির য়াহমদ
সহকারী সম্পাদক : নন্দলাল গোপ
টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
Advertise
দেব দুলাল গুহ | ১৪ জুন, ২০১৬
খুব স্পষ্ট মনে আছে আমার। ছোটবেলায় একবার, শুক্রবার দুপুরে, টিভি দেখছিলাম আর পড়ছিলাম। অনুষ্ঠানের এক পর্যায়ে, হঠাৎ আযান শুরু হলো। আমি পড়ায় মন দেবো ভেবে রিমোট হাতে নিয়ে সাউন্ড কমিয়ে দিতে উদ্যত হলে, বাবা বকা দিয়েছিলো। বলেছিলো, 'কমাবি কেনো? আযানের ধ্বনিটা কী সুন্দর, একবার মন দিয়ে শোন! অর্থটাও পরে জানিয়ে দেয়'।
সেদিন থেকে আযানের ধ্বনি আমার খুব ভালো লাগে। মফস্বলের সেই শহরটায়, মাঝে মাঝেই রাতে আমার ঘুম আসতো না। দেরিতে ঘুমানোর অভ্যাস খুব পুরনো। অনেক সময় দেখা যেতো, সারারাত পড়ে আযানের শব্দ শুনে ঘুমাতে যেতাম। দূর থেকে ভেসে আসা আযানের সুমধুর শব্দটা খুব আপন লাগতো। বাবা বলতো, এই সময়টাকে বলে ‘সুবাহ সাদিক’। এই আযানের ধ্বনিতে পৃথিবী থেকে সব অপশক্তি অতৃপ্ত আত্মা পালিয়ে যায়। অতঃপর সুন্দর এক ভোর আসে, নতুন দিন নতুন আশা নিয়ে।
এরপর সকাল হলেই ঠাকুর ঘরে মায়ের কণ্ঠে উলুধ্বনি শুনতাম। এই ধ্বনিটাও সমান ভালো লাগতো। আযানের ধ্বনি আর উলুধ্বনি-কীর্তন ঘণ্টা খোল করতাল শাঁখের শব্দের মাঝে পার্থক্য খুঁজতে যাইনি কখনও। আমার সবই ভালো লাগতো। ঈদ-পূজার দিন একে অন্যের বাসায় যেতাম। নাড়ু-খই আর জর্দা-পায়েসের মাঝে কোনো পার্থক্য খুঁজতে যেতাম না। আমাদের পরিবার আমাদেরকে সেভাবে গড়ে তোলেনি। আমরা একে অন্যের মতাদর্শকে শ্রদ্ধা করতাম। স্কুলে ‘মালাউন’ গালিটা যে একেবারে শুনিনি, তা নয়। একবারই শুনেছিলাম, সম্ভবত ক্লাস ফোরে। আমি আসলে বুঝতে পারিনি। বাসায় এসে বাবাকে বললে, বাবা বলেছিলো- এসব কিছুনা, এসব কথা যারা বলে তারা সংখ্যায় অল্প, এদেরকে এড়িয়ে চলবে।
এরপর আর কোনোদিন আমাকে এই শব্দটি শুনতে হয়নি মুখের ওপর। দায়িত্ব নিয়ে বলছি, স্কুলে পড়ার সময় আমার বন্ধুদের আড্ডায় কখনোই ধর্ম নিয়ে আলাপ বা বিদ্বেষ বাসা বাঁধেনি। আমরা একসাথে খেলেছি, ক্লাস করেছি। ভালো ছাত্র ছিলাম বলে আমাকে দিয়ে স্যারেরা জঙ্গল থেকে ছোট গুল্মগাছ তুলে এনে বেত বানিয়ে আনার দায়িত্ব দিতো। পড়া না পারার কারণে আমার যেসব বন্ধুরা সেই বেতের কারণে ব্যথা পেতো, তাদের জন্য আমারও খারাপ লাগতো। একদিন স্যারকে বললাম, আমি আর বেত আনতে পারবো না। আমার আনা বেত দিয়ে আমার বন্ধুদের মারা হয়, আমার খুব খারাপ লাগে। স্যার শুনে আমাকেও হাত পাততে বলেছিলেন। বলেছিলেন, ‘বন্ধুদের কেমন লাগে একবার চেখে দ্যাখ!’
এভাবেই বন্ধুদের ব্যথা ভাগ করে নিতাম। সম্পর্কটা ছিলো বন্ধুত্বের, ধর্ম বা ধর্মীয় রীতিনীতি আমাদের মাঝে তখন বাধা হয়ে দাঁড়াত না। ইসলাম শিক্ষা ক্লাসের সময় আমরা আলাদা কক্ষে চলে যেতাম। কোনোদিন কোনো কারণে ক্লাস না হলে ইসলাম শিক্ষার ক্লাস শুনেছি। তবে আমাদের বাধ্য করা হতো না ক্লাসে বসে থাকতে। চাইলে বাইরেও যাওয়া যেতো। আমার এখনও মনে আছে, শচীন স্যার, গাইন স্যার, প্রীতিলতা দিদিমনি যেমন আপন ছিলেন, তেমনি ছিলেন ফজলে রাব্বি স্যার, মোফাজ্জল স্যারেরা। সবাই মেধাবিদের ভালোবাসতেন আর ফাঁকিবাজদের বকা দিতেন। সর্বোপরি নিজের সন্তানের মতো দেখতেন।
খুব বেশি আগের কথা নয়। ১০-১৫ বছর আগেও অবস্থাটা এমনই ছিলো। আমাদের ছেলেবেলায়, ‘সম্প্রদায়’ শব্দটার সঙ্গে আমরা পরিচিত ছিলাম না। হঠাৎ করে কেমন যেনো অনেক কিছুই বদলে গেলো। স্কুল-কলেজের পড়া শেষ করে একেকজন একেক জায়গায় গেলাম। নিজ নিজ জেলার সাম্প্রদায়িক অবস্থার ওপর ভিত্তি করে অনেকেই পরিবর্তিত হয়ে গেলো। এখন অনেকের সাথেই আর আগের মতো মত মেলে না। সব বিষয়ে খোলামেলা কথাও বলা যায়না। আবার, আমার ভার্সিটি জীবনের সবচেয়ে কাছের বন্ধুগুলোই অন্য ধর্মের। আমার কষ্টের দিনগুলোয়, যখন নিজের হল থেকে শুধুমাত্র রাজনীতিতে সক্রিয় থাকতে চাইনি বলে আমাকে বিতাড়িত করা হয়েছিলো, তখন আমাকে আশ্রয় দিয়েছিলো যে বন্ধুরা, তারাও তো বিধর্মী। আমার সামনেই রুমে নামাজ পড়েছে। একবারও রুমের বাইরে যেতে তো বলেনি! ওরা আমার জন্য যা করেছে, আমি ওদের ঋণ কোনোদিন শোধ করতে পারবো না।
অনেক হতাশার মাঝেও, আমরা আশার আলো দেখার আশায় থাকি। সবাই মিলে রোজার মাসে ইফতার পার্টি আয়োজন করি। অফিসে নিজেরাই চাঁদা তুলে ইফতারের কেনাকাটা ও ইফতার তৈরি করে সবাই মিলে এক গামলা থেকে নিয়ে খাই। এখানে তো কখনও ধর্মের প্রশ্ন আসে না! কে হিন্দু আর কে মুসলিম, কে রোজা রেখেছে আর কে রাখেনি- সে প্রশ্ন তো কেউ করেনা! তবু কোথায় যেন অজানা আতংকে মনটা ভরে ওঠে। ঘুম ভেঙেই গলাকাটা লাশ দেখে দিনটা শুরু করা আর ফেসবুকের মেসেজে শত শুভাকাঙ্ক্ষীর দেশ-বিদেশ থেকে সতর্কবাণী।
গতকালও সাবধানে থাকতে বললেন নিউ ইয়র্ক পুলিশ ডিপার্টমেন্টের এক বাংলাদেশী বড় ভাই। আমি বলি, আমিতো কোনো ধর্মের বিরুদ্ধে নই, বরং সকল ধর্মের সহাবস্থানে বিশ্বাসী। আমি বিশ্বাস করি, আল্লাহ বলুন, ঈশ্বর কিংবা ভগবান বলুন-- তিনি একজনই। তিনি আমাদের সৃষ্টি করেছেন, লালন-পালন করছেন। আমরা শুধু আলাদা আলাদা রীতিতে তাঁর আরাধনা করি মাত্র। এখানে বিদ্বেষের কী আছে?
তবুও তাঁদের শঙ্কা যায়না। কারণ, আজকাল নাকি কারো জীবনই নিরাপদ নয়!
মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।
আপনার মন্তব্য