আজ শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪

Advertise

সালমান খানের অসংবেদী উক্তি ও ঘৃণা

চিররঞ্জন সরকার  

আরও কত ধর্ষণের ঘটনা ঘটলে আমরা সংবেদনশীল হতে শিখব? আরও কত পথ হাঁটলে আমরা ন্যূনতম সভ্যতার দিকে এগোতে পারব? আরও কত মোমবাতি মিছিল আমাদেরই ঘিরে থাকা অন্ধকারকে দূর করতে পারবে?

হিন্দি সিনেমার নায়ক সালমান খানের একটা বিবৃতি আমাদের নতুন করে এই প্রশ্নগুলোর মুখে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। শুটিংয়ের ক্লান্তি বোঝাতে ধর্ষিতার সঙ্গে নিজেকে তুলনা করেছেন হিন্দি ফিল্মি জগতের নামজাদা ব্যক্তি সালমান খান। ধর্ষণের মতো একটা ন্যক্কারজনক ঘটনা, তার শিকার যিনি তাঁর যন্ত্রণা-লাঞ্ছনা-অপমান মুহূর্তে লঘু হয়ে রাস্তায় লুটোতে থাকল সালমান খানের দায়িত্বজ্ঞানহীন মন্তব্যে। উল্লেখ্য, হিন্দি সিনেমা বাংলাদেশে খুবই জনপ্রিয়। আমাদের দেশের মানুষ যে পরিমাণে বাংলাদেশের সিনেমার নায়ক-নায়িকাদের চেনে তার চেয়ে বেশি চেনে হিন্দি সিনেমার নায়ক-নায়িকাদের। আমাদের শিক্ষিত-মধ্যবিত্ত যুব সমাজের হিন্দি সিনেমার নায়ক-নায়িকাদের প্রভাব ব্যাপক। তাই সালমান খানের এই উক্তি নিয়ে লিখতে বসা।

বস্তুত, সালমান বাধ্য করলেন আমাদের আয়নার সামনে দাঁড়াতে। আমরা ধর্ষণের ঘটনার যারা নিন্দা করি, বিবৃতি দিই, মিছিলে হাঁটি সোশ্যাল মিডিয়ার তুমুল তুফান তুলি, তারা সত্যিই সংবেদনশীল তো? রন্ধ্রে রন্ধ্রে যে পুরুষতান্ত্রিকতা, তা থেকে উত্তীর্ণ হয়ে মনুষ্যত্বের পথের যাত্রার জন্য আদৌ প্রস্তুত হতে পেরেছি তো?

এত কথা বলার কারণ,সোশ্যাল মিডিয়ায় সালমানের নিন্দার ঝড় উঠলেও কান পাতলে এর বাইরের দুনিয়ায় শোনা যাচ্ছে অন্য কথাও, ‘আরে ও তো কিছু মানে করে বলতে চায়নি, আর তাছাড়া এই কথায় ধর্ষিতার প্রতি অসম্মানটাও বা হল কোথায়?’

আদৌ বুঝতে কি পারলাম আমরা, সালমান কোথায় এবং কত বড় অন্যায়টা করেছেন?

সালমান খান অবশ্যই অন্যায় করেছেন। নির্বোধ, অবিবেচক অন্যায়। নিজের পরিশ্রান্ত-ধ্বস্ত অবস্থার বিবরণ দিতে গিয়ে ধর্ষিতা নারীর উপমা টেনে স্পষ্ট বুঝিয়ে দিয়েছেন, নারীদের এবং সামাজিক অনাচার বিষয়ে তিনি কতখানি অসংবেদনশীল। সুস্থির বিচারবুদ্ধিতে যে তিনি উপরের সারিতে বিচরণের যোগ্য নন, তাও পরিষ্কার হয়েছে। কার ক্লান্তি-শ্রান্তি নিজের সচেতন ইচ্ছা ভিত্তিক, আর কার ক্লান্তি-শ্রান্তি অন্য মানুষের আক্রমণের কারণে সঞ্জাত, এই পার্থক্য করবার মতো মানসিক স্থৈর্য সালমান খানের নেই। কথাটি বেফাঁস বলে ফেলার জন্য দুঃখিত, এইটুকু ক্ষমাপ্রার্থনার মর্যাদাবোধও তিনি দেখাতে পারেন নি। কিন্তু এটা কেবল সালমান খানের একার সমস্যা নয়। এই নির্লজ্জ পুরুষতান্ত্রিক সমাজে বহু মানুষই এমন ভাবে ভাবেন এবং এমন কথা বলেন। সমস্যা সেইখানেই। সমাজের নৈতিকতা রহিত বিনোদনপ্রিয়তার ফাঁপা চরিত্রটি দেখিয়ে দেয় এই ঘটনাটিই। এমন অসংস্কৃত-মনস্ক, অশালীন-ভাষী পুরুষরা তো নিজে হইতে দেশ-কাঁপানো নায়ক হন নাই, এই সমাজই তাঁদের এ ভাবে বরমাল্যভূষিত করে তুলেছে। পুরুষতান্ত্রিকতার অহংকার এবং অসংবেদশীলতার বিষয়ে নারী-পুরুষ উভয়কেই সচেতন হবে। যোগ্যদেরই বরমাল্য দিতে হবে। প্রয়োজনে ছুঁড়েও ফেলতে হবে। ঘৃণা করতে শিখতে হবে।

পুরুষতন্ত্রকে ধ্বংস করার জন্য সব মেয়েকে যুক্তিবাদী হতে হবে-এমনটা প্রয়োজনীয় নয়। নারীর দরকার হলো তার মধ্যকার ‘চিরন্তনী অনুগত নারী’র প্রতিমূর্তিটাকে ধ্বংস করা। নারী যখন ফেসবুকে গালিগালাজ করে পুরুষের গুষ্টি উদ্ধারের ‘ধৃষ্টতা’ দেখায়, তখন পুরুষতন্ত্র খেপে উঠে কারণ সে নিজের বিদায়ঘণ্টা শুনতে পায়। নারী যখন গরমের দিনে কালো বোরখা ফেলে রেখে পাতলা টিশার্ট আর স্কার্ট পড়ে বেরোয়, তখন পুরুষতন্ত্র নারীর নিন্দা করে কারণ সে নিজের মৃত্যুদূত দেখতে পায়। ‘নারী যখন ধর্ষণ থেকে বাঁচতে পুরুষের লিঙ্গে কষে লাথি মেরে অক্ষত অবস্থাতেই উঠে দাঁড়ায়, তখন সে লাথি মারে পুরুষতন্ত্রেরই প্রাণভোমরায়।’ হ্যাঁ, এভাবে আঘাত  করতে শিখতে হবে। সংবেদনশীল হতে শেখাতে হবে। কখনও প্রতিবাদে, কখনও কর্কশ চিৎকারে।
**
কবি আল মাহমুদ ‘প্রকৃতি’ কবিতাটি শুরু করেছিলেন একটি প্রশ্ন দিয়ে: ‘কতদূর এগোলো মানুষ?’ এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া দিন কে দিন কঠিন হয়ে যাচ্ছে। প্রগতিশীলতার কারণে মানুষ নাকি অনেক এগিয়েছি, মানুষ নাকি পেরিয়ে গেছে সভ্যতার অজস্র অধ্যায় নানা উত্থান পতনে, মানুষ নাকি ফেলে এসেছে বর্বরতা অনেক পেছনে। কিন্তু আমাদের কুমিল্লার তনুর ঘটনাটি, মাদারীপুরে মা-মেয়েকে নৌকায় উঠিয়ে ধর্ষণ, বাউফলের আদাবাড়িয়া ইউনিয়নের মাধবপুর বাজারে প্রকাশ্যে ৪ সংখ্যালঘু নারীকে বিবস্ত্র করে পেটানো-এ ধরনের নানান ঘটনা, সভ্যতার মাদকতাময় অগ্রযাত্রার আকর্ষণীয় বিবরণকে প্রায়শই অস্বস্তিতে ফেলে। ফরাসি বিপ্লবের অন্যতম সড়কনির্মাতা জাঁ-জ্যাক রুশো বিশ্বাস করতেন না প্রগতিতে, তাঁর কাছে তথাকথিত বর্বরতা ছিল তথাকথিত সভ্যতার চেয়ে অনেক বেশি মানবিক, তাই তিনি প্রত্যাশা করেছিলেন মানুষ সেই আদিম জীবনের সামাজিক চুক্তির পুনঃবাস্তবায়ন ঘটাবে আধুনিক জীবনে এবং জটিল নাগরিকতার প্রতিস্থাপন ঘটাবে সরল আরণ্যকতায়। রুশোর প্রত্যাশা অনিবার্য কারণেই ব্যর্থ হয়ে গেলেও আজও এমন ঘটনা ঘটে যে হয়ে উঠতে ইচ্ছা করে রুশোপন্থী, তছনছ করে ফেলতে ইচ্ছে করে সভ্যতার সমস্ত দালানকোঠা। কবি অরুণকুমার সরকারের ভাষায় বলতে ইচ্ছে করে:


শুধু প্রেম নয়, কিছু ঘৃণা রেখো মনে,
যেমন অনেক বৃক্ষ কোমলাঙ্গ কাঁটা দিয়ে ঢাকে।
আছে লালসার দাঁত, লোভের বিকট জিহ্বা, প্রভুত্বের লোমশ লাঙ্গুল
ব্যাঙ্গের কুঠার, ঈর্ষা, অন্যায়ের সহসা ছোবল
সইবে কেমনে?
শুধু প্রেম নয় তাই যুগপত্ ঘৃণা রেখো মনে।
ক্ষমা মহাত্মার সজ্জা। তুমি আমি সাধারণ লোক
ছোট কি মাঝারি গাছ, আমাদের দরিদ্র শরীরে
বর্ম কি বল্কল নেই কিংবা জ্যোতির্ময় গয়নাগাঁটি।
আমাদের ক্ষমা শুধু পিছু হটা, চোখ বুজে থাকা, দুর্বলতারই অন্য নাম।
চারিদিকের পশুদের নখ, দাঁত, তর্জনে গর্জনে
ক্ষমা নয়, প্রেম নয়; কাঁটা, বিষ, ঘৃণা রেখো মনে।
(শুধু প্রেম নয়, অরুণকুমার সরকার)
 

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৭ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এনামুল হক এনাম ৪২ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৩ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬৩ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০২ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪১ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩১ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নাজমুল হাসান ২৪ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪২ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯০ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ১৬ রাজেশ পাল ২৮ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ