আজ মঙ্গলবার, ১৫ অক্টোবর, ২০২৪

Advertise

পথশিশু: ‘জীবনে যাদের হররোজ রোজা’ তাদের আবার ঈদ কিসের!

শুভাশিস ব্যানার্জি শুভ  

বাঙালি মুসলিম জীবনে ঈদ উল ফিতর অন্যরকম একদিন। সবচেয়ে বড় আনন্দময় উৎসব জমে উঠে এই ঈদকে ঘিরেই। স্বভাবতই এই ঈদকে কেন্দ্র করে আয়োজনের ব্যাপ্তিও বেশি। ধনী দরিদ্র সবাই-ই ঈদ উল ফিতরকে উপভোগ করতে সাধ আর সাধ্যের সমন্বয়ে নানাবিধ প্রস্তুতি নিয়ে থাকেন। এই ঈদে মা, বাবা, ভাইবোন, আত্মীয়স্বজন সবার জন্যেই নতুন পোশাক, জামা-জুতা কেনা বড় এক অনুষঙ্গ।

এই ঈদে আত্মীয়স্বজনসহ প্রতিবেশী এবং গরিব-দুঃখী মানুষকে জামাকাপড় উপহার দেয়াসহ তাদের পাশে দাঁড়ানোটাও আমাদের ধর্মীয় চেতনার বড় অংশ। একই সাথে ঈদ উল ফিতরের দিনে প্রতিটি বাড়িতেই থাকে ভালো রান্নাবান্নার বাহারি রকমারি আয়োজন। প্রতিটি মানুষই এসব আয়োজন সবার সাথে ভাগ করে উপভোগ করে থাকেন। এই ঈদের আরেকটি বড় বৈশিষ্ট্য হলো-শহরের মানুষের শেকড়ে ফেরা এবং পরিবার পরিজনের সাথে মিলেমিশে ঈদ-আনন্দ উপভোগ করা।

এ কারণে আমরা প্রতিবছরই দেখি হাজার হাজার মানুষ শত বিড়ম্বনা পেরিয়েও কর্মস্থল শহর ছেড়ে প্রিয় নিজ গ্রামে চলে যাচ্ছেন। মা-বাবা, পরিবার-পরিজনের সাথে মিলে ঈদ উপভোগ করছেন। ঈদের আগের দিনতো ঢাকা শহরসহ বড় বড় শহর একধরনের ফাঁকাই হয়ে উঠে। এটি এখন বড় শহর, নগরের চিরায়ত দৃশ্য বলা যায়। চারিদিকে এখন ঈদ উল ফিতর উপভোগের পূর্ণ আয়োজন দৃশ্যমান। নগরীর দোকানপাটগুলোতে উপচে পড়া ভিড়। হাজারো মানুষ কেনাকাটায় ব্যস্ত। দোকানীদেরও কথা বলার ফুরসত নেই। বড় বড় শপিং মল, হকার্স মার্কেট কিংবা মহল্লার দোকান সবখানেতেই এখন ভিড় আর ভিড়। মনে হয় যেনো ঈদের কেনাকাটাতে কারো কোনো ধরনের ক্লান্তি নেই!

তবে বাঙালি মুসলিম জীবনে ঈদ উৎসব উপভোগেও আমরা প্রতিনিয়ত পরিবর্তন লক্ষ্য করছি। বিশ্বায়ন আর মিডিয়ার কারণে ঈদ উৎসব এখন আর সেই সনাতনি ধারার মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। আর এ কারণে শুধু শহুরে জীবন নয়, গ্রামীণ জীবনের ঈদ উৎসবেও যুক্ত হয়েছে নানা পরিবর্তন আর বর্ণিলতা। তবে সন্দেহাতীতভাবেই বলা যায়, গ্রামের ঈদ সবসময়ই বৈচিত্র্য ও বর্ণময়। সেই তুলনায় শহুরে ঈদ কিছুটা হলেও নাগরিক চরিত্রের মধ্যেই ডুবে থাকে।

গ্রামের ঈদে দারুণ প্রাণচাঞ্চল্য লক্ষ্য করা যায়। একসময় গ্রামে ঈদের দিন নামাজ শেষে নানা ধরনের খেলাধুলোর আয়োজন করা হতো যেখানে গ্রামের নবীন-প্রবীণ সবাই অংশ নিতো। রশি টানা, দৌড় প্রতিযোগিতা, নৌকাবাইচ, নবীন আর প্রবীণের মাঝে ফুটবল খেলা, ভলিবল খেলা, হাডুডু খেলা, লাঠি খেলা এরকম নানাবিধ খেলাধুলার আয়োজন থাকতো। একইসাথে থাকতো নাটক, পালাসহ বিভিন্ন সাংস্কৃতিক বা বিচিত্র অনুষ্ঠানের আয়োজন। সেই ধারাবাহিকতায় এখনও আয়োজনের কোনো ঘাটতি নেই। তবে আগের তুলনায় আয়োজনে আরো বৈচিত্র্য বৃদ্ধি পেয়েছে। আবার আয়োজনে আধুনিকতা যুক্ত হওয়ার কারণে পুরনো অনেক কিছুই আবার বিযুক্তও হয়েছে। ঈদের পুরনো সংস্কৃতির অনেক কিছুই মিইয়ে গেছে তথ্য প্রযুক্তির কারণে।

এইতো খুব বেশিদিন আগের কথা নয়, প্রিয়জনকে ঈদ এলেই ঈদকার্ড পাঠানোর হিড়িক পড়ে যেতো। দোকানে রঙ বেরঙের ঈদকার্ড শোভা পেত। পোস্ট অফিসে লাইনে দাঁড়িয়ে সবাই ঈদ কার্ড পাঠাতো প্রিয়জনদের কাছে। কিন্তু বিস্তর মোবাইল আর ই-মেইল ব্যবহারের সুযোগ উন্মুক্ত হওয়ায় এখন আর খুব একটা কেউ ঈদকার্ড পাঠান না। মোবাইলে ক্ষুদে বার্তা (এসএমএস) অথবা ই মেইল বার্তা পাঠিয়ে ঈদের আনন্দ ভাগ করে নেন।

ঈদ আনন্দের এখন অন্যতম অনুষঙ্গ আবার স্যাটেলাইট চ্যানেলগুলো। এক দশক আগেও ঈদের রাতে শুধুমাত্র বাংলাদেশ টেলিভিশনের পর্দায় সবাই চোখ রাখতেন। সবচেয়ে জনপ্রিয় ঈদ ‘আনন্দমেলা’ অনুষ্ঠানটি দেখার জন্যে সবাই কমবেশি প্রস্তুতি নিতেন। কিন্তু গত এক দশকে ঘর-বিনোদনের জায়গাটি অসম্ভব রকম বিস্তৃত হওয়ার কারণে ঈদ উপভোগে চ্যানেলগুলোর প্রতিযোগিতামূলক আয়োজন এখন আমাদের নগর ও গ্রামীণ জীবনে অন্যরকম প্রভাব ফেলেছে। প্রায় সব চ্যানেলই পাল্লা দিয়ে ঈদ উপলক্ষে বিভিন্ন ধরনের অনুষ্ঠান নির্মাণ করছে। প্রতিটি চ্যানেলই এক নাগাড়ে ছয় থেকে সাতদিন শুধু ঈদের অনুষ্ঠানের জন্যে বরাদ্দ রেখেছে। ম্যাগাজিন অনুষ্ঠানসহ নাটক, টেলিফিল্ম, গান, রম্যবিতর্ক, টকশো, ফান শো, রান্নাবান্না, তারকালাপসহ নানাবিধ বর্ণিল আয়োজনের সমাহার থাকছে। আগে কেবলই শহরে মানুষের ঘরে টিভি থাকলেও যুগের চাহিদায় টেলিভিশন এখন বিত্তহীন, দরিদ্র, গরিব মানুষের ছেঁড়া-ফুটো ঘরেরও অলংকার। ফলে বলতে দ্বিধা নেই স্যাটেলাইট চ্যানেলগুলো বর্তমানে আমাদের ঈদ আনন্দকে আরো রূপময় করে তুলেছে।

এসব তো গেল ঈদ আনন্দের আনন্দময় নতুন সব আয়োজনের কথা। কিন্তু ঈদ উৎসবের অন্যতম একটি বিষয় হলো-সম্প্রীতি, সৌহার্দ আর ঐক্যের মহামিলন। ধর্ম মতে, ঈদ উৎসব ধনী, গরিব নির্বিশেষে এক কাতারে নিয়ে আসে। তাই প্রতিটি ঈদে আমরাও এমনটি কাম্য করি-কোনো বিরোধ বা অপচর্চা নয়, চাই মানুষের মাঝে সম্প্রীতির মিলনমেলা। চাই প্রতিটি মানুষের জীবনে ঘটুক ঈদ আনন্দের প্রতিফলন। কিন্তু রাষ্ট্রীয় অনেক ঘটনায় এর ব্যত্যয় হয়। ঈদুল ফিতর সবার ঘরে আনন্দ বয়ে আনলেও দেশের প্রায় সাড়ে ৮ লাখ পথ শিশুর জীবনে এই দিনটি কাটে অন্যের মুখের পানে চেয়ে, তাদের করুণার পাত্র হয়ে। ‘জীবনে যাদের হররোজ রোজা’ তাদের আবার ঈদ কিসের!

ওরা আশায় বুক বেঁধে থাকে। এই ক’দিনে বেচাবিক্রি একটু ভালো হলে সেই পয়সায় একটু নতুন জামা হয়তো কেনা যাবে! নয়তো কেউ তাদের জামা দিতে আসবে। যা পরে ওরা ঈদের দিন একটু ঘুরে বেড়াবে। ঈদের দিনে অন্য আর দশটা শিশুর মতো ফিরনী, সেমাই খাবার বায়না নেই ওদের। ওরা অন্যসব দিনের মতোই রোজগারের আশায় ফুল, চকলেট বিক্রি করতে নামবে পথে; নয়তো বোতল টোকাবে। ঈদের দিনে পথশিশুদের আশা করে থাকতে হয়, কখন তাদের কেউ ডেকে একটু সেমাই কিংবা পোলাও খেতে দেবে। মায়ের হাতের খাবার তাদের ভাগ্যে জোটে না। পথশিশুদের জীবনে ঈদ কখনো খুশির ঈদ হয়ে আসবে না। তবুও তারা স্বপ্ন দেখে; আশায় বুক বাঁধে, হয়তো কোন হৃদয়বান ব্যক্তি তাদের জন্যে একদিন জামা-জুতা, ভালো খাবার নিয়ে আসবে! দারিদ্র্য আর না পাওয়ার মাঝে বেড়ে ওঠা ওদের জীবনে একটুখানি পাওয়াই অসীম আনন্দ বয়ে আনে। ঈদের নতুন জামা বা ভালো খাবার খেতে না পারার জন্যে ওদের মনে কোন আক্ষেপ নেই। কারণ এটাই নিয়তি বলে ধরে নিয়েছে ওরা। ওরা জেনে গিয়েছে, কেউ খাবার জন্যে দিনভর কাজ করবে আর কেউ খাবার নষ্ট করবে। এটাই পৃথিবীর নির্মম পরিহাস, এরই নামই নিয়তি!

ঈদ উৎসবেও আমরা তাই সামগ্রিকতা আনতে ব্যর্থ হই। বিশেষ করে রাজনৈতিক দলগুলোর মাঝে ঐক্যের তুমুল টানাপড়েন থাকার কারণে আমরা দেখেছি আমাদের জাতীয় স্বার্থসংশ্লিষ্ট অনেককিছুই মুখ থুবড়ে পড়ে। এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, আমাদের জাতীয় জীবনে অন্তহীন সমস্যা রয়েছে। একদিনে যেমন রয়েছে শত নাগরিক বিড়ম্বনা, তেমনি অন্যদিকে রয়েছে রাজনৈতিক কাদা ছোড়াছুড়ি। ঈদের সময় আমরা আরেকটা বিষয় খেয়াল করেছি সড়ক, মহাসড়কে দুর্ঘটনা সংঘটিত হওয়া। প্রতিবছরেই অনেক পরিবারের ঈদের আনন্দ মাটি হয়েছে শুধুমাত্র সড়ক দুর্ঘটনা কারণে।

সবশেষে আরেকটি কথা না বললেই নয়, খোড়া অজুহাত কিংবা রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার হয়ে সরকারে নেই এমন রাজনীতিবিদসহ এরকম অনেকেই হাজত বা জেলে রয়েছেন। পরিবার পরিজনের সাথে ঈদ আনন্দ উপভোগ করার অধিকার তাদেরও রয়েছে। বিষয়টি সরকারের ভাবনাতে আনা উচিত। তাহলেই নিরাপত্তা, ঐক্য, সম্প্রীতিতে জাতীয় জীবনে ঈদ হবে আরো আনন্দময়। এই প্রত্যাশা আমাদের তথা সকল দেশবাসীর। সকলের প্রতি রইলো ঈদ শুভেচ্ছা।

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।

আপনার মন্তব্য

লেখক তালিকা অঞ্জন আচার্য অধ্যাপক ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী ৪৮ অধ্যাপক ডা. শেখ মো. নাজমুল হাসান ২৭ অসীম চক্রবর্তী আজম খান ১১ আজমিনা আফরিন তোড়া ১০ আনোয়ারুল হক হেলাল আফসানা বেগম আবদুল গাফফার চৌধুরী আবু এম ইউসুফ আবু সাঈদ আহমেদ আব্দুল করিম কিম ৩২ আব্দুল্লাহ আল নোমান আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল ১০ আমিনা আইরিন আরশাদ খান আরিফ জেবতিক ১৮ আরিফ রহমান ১৬ আরিফুর রহমান আলমগীর নিষাদ আলমগীর শাহরিয়ার ৫৪ আশরাফ মাহমুদ আশিক শাওন ইনাম আহমদ চৌধুরী ইমতিয়াজ মাহমুদ ৭১ ইয়ামেন এম হক এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন একুশ তাপাদার এখলাসুর রহমান ৩৭ এমদাদুল হক তুহিন ১৯ এস এম নাদিম মাহমুদ ৩৪ ওমর ফারুক লুক্স কবির য়াহমদ ৬৪ কাজল দাস ১০ কাজী মাহবুব হাসান কেশব কুমার অধিকারী খুরশীদ শাম্মী ১৭ গোঁসাই পাহ্‌লভী ১৪ চিররঞ্জন সরকার ৩৫ জফির সেতু জহিরুল হক বাপি ৪৪ জহিরুল হক মজুমদার জাকিয়া সুলতানা মুক্তা জান্নাতুল মাওয়া জাহিদ নেওয়াজ খান জুনাইদ আহমেদ পলক জুয়েল রাজ ১০৯ ড. এ. কে. আব্দুল মোমেন ১২ ড. কাবেরী গায়েন ২৩ ড. শাখাওয়াৎ নয়ন ড. শামীম আহমেদ ৪২ ডা. আতিকুজ্জামান ফিলিপ ২০ ডা. সাঈদ এনাম ডোরা প্রেন্টিস তপু সৌমেন তসলিমা নাসরিন তানবীরা তালুকদার তোফায়েল আহমেদ ৩২ দিব্যেন্দু দ্বীপ দেব দুলাল গুহ দেব প্রসাদ দেবু দেবজ্যোতি দেবু ২৭ নিখিল নীল পাপলু বাঙ্গালী পুলক ঘটক প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ ফকির ইলিয়াস ২৪ ফজলুল বারী ৬২ ফড়িং ক্যামেলিয়া ফরিদ আহমেদ ৪৩ ফারজানা কবীর খান স্নিগ্ধা বদরুল আলম বন্যা আহমেদ বিজন সরকার বিপ্লব কর্মকার ব্যারিস্টার জাকির হোসেন ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ ১৮ ভায়লেট হালদার মারজিয়া প্রভা মাসকাওয়াথ আহসান ১৯৩ মাসুদ পারভেজ মাহমুদুল হক মুন্সী মিলন ফারাবী মুনীর উদ্দীন শামীম ১০ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ১৫৩ মো. মাহমুদুর রহমান মো. সাখাওয়াত হোসেন মোছাদ্দিক উজ্জ্বল মোনাজ হক ১৪ রণেশ মৈত্র ১৮৩ রতন কুমার সমাদ্দার রহিম আব্দুর রহিম ৫৫ রাজু আহমেদ ২১ রুমী আহমেদ রেজা ঘটক ৩৮ লীনা পারভীন শওগাত আলী সাগর শাওন মাহমুদ শাখাওয়াত লিটন শাবলু শাহাবউদ্দিন