প্রধান সম্পাদক : কবির য়াহমদ
সহকারী সম্পাদক : নন্দলাল গোপ
টুডে মিডিয়া গ্রুপ কর্তৃক সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত।
Advertise
আজমিনা আফরিন তোড়া | ১৪ জুলাই, ২০১৬
হাসিমুদ্দিন ভরদুপুরে বিছানায় শুয়ে আছে। এমনি তে তার দিনের বেলা আলসেমি করার স্বভাব নাই। কিন্তু মন খারাপ থাকলে কথা ভিন্ন। আজ মনটা তার বিশেষ ভালো না। মন ভালো না থাকলে হাসিমুদ্দিন শুয়ে শুয়ে গান শোনে। আজ কাল কি সব তার ওয়ালা যন্ত্র পাওয়া যায়, কানে লাগিয়ে একা একা গান শোনা যায় তাতে। একজন কানে দিলে পাশের জন সেই গানের আওয়াজ শুনতে পায় না। যন্ত্রটা মন্দ না! আজ কাল গাঁও গেরামেও এই যন্ত্র পাওয়া যায়।
মন খারাপ থাকলে হাসিমুদ্দিন উদাস মনে আকাশের দিক তাকিয়ে এই যন্ত্র কানে লাগায়ে গান শোনে। বউটা কয়দিন হল কি এক ব্যামো ধরিয়েছে! বউয়ের ব্যামো, মন তাতে খারাপ না। মন খারাপ কারণ বউটা সারাক্ষণ কানের কাছে ঘ্যাণ ঘ্যাণ করছে ওষুধ-পানির জন্য। তার ধারণা ডাক্তারের কাছে গেলেই ব্যামো সেরে যাবে। বউটা ছাই বোঝে না, এই সামান্যতে ডাক্তারের কাছে যাবার কোন অর্থই হয় না, শুধু শুধু পয়সা নষ্ট। আরে মেয়ে মানুষের অমন একটু আধটু পেট ব্যথা মাস শেষে হর হামেশাই হয়। তাতে আবার পথ্য-পানির দরকার কি! তার মা দাদিরা এমন কথা স্বামীকে দূরে থাক, ননদ শাশুড়ির সামনে পর্যন্ত মুখে আনতে পারেনি। এখনকার বউগুলো হয়েছে বজ্জাত। স্বামীর সামনে লাজ লজ্জা বলতে কিচ্ছু নাই।
“বেহায়া মেয়ে ছেলে কোথাকার!”- মনে মনে ভাবে হাসিমুদ্দিন। মুখে বলে না। কথা বলতেও আজ তার মেজাজ খারাপ হচ্ছে।
কথায় আছে- যায় দিন ভালো, আসে দিন খারাপ। হাসিমুদ্দিনের জীবনে এটা অক্ষরে অক্ষরে মিলে গেছে। মা বেঁচে থাকতে সাত গ্রাম খুঁজে ধরে বিয়ে দিল রোকসানা বেগমের সাথে। রোকসানা বেগম সুন্দরী ছিল বটে কিন্তু মাইয়া ছিল বাজা। ২ বছর চেষ্টা আত্তি করার পরও একটা বাচ্চা বিয়াইতে পারল না! শেষমেশ রাগ সামলাতে না পেরে হাসিমুদ্দদিন দিল তালাক। “এক তালাক, দুই তালাক, তিন তালাক”!
“ও মা গো”!- হাসিমুদ্দিনের ধ্যান ভাঙে বউয়ের গোঙানিতে। মাগিটা ম’ল। সামান্য এক পেট ব্যথায় মাগি পাড়া এক করার উপক্রম করছে। লজ্জা শরমের মাথা থাকল না আর!
তালাকের পর হাসিমুদ্দিন আর দেরি করেনি। রোকসানা যেদিন কাঁদতে কাঁদতে বিদেয় হল, তার তিন দিনের মাথায় ঘরে আনল শাপলা বানুকে। নাহ, এবার আর মায়ের পছন্দে বিয়ে করেনি সে। যে রাস্তা দিয়ে রোকসানা চলে গেল, সে রাস্তা দিয়েও শাপলাকে আনেনি। যদি বাজা মেয়ের ছায়া পড়ে! সেই আগের শোবার ঘর ও বদল হল। সবই করল একটা সুস্থ ছেলে সন্তানের আশায়।
শাপলা বানুর চেহারা রোকসানার মত সুন্দর না হলে হবে কি, বছর ঘুরতে না ঘুরতেই পোয়াতি হল শাপলা বানু। বাড়ির সবার সে কি আনন্দ! আবেগে তো হাসিমুদ্দিন ২ জোড়া নতুন কাপড় এনে দিল বউটারে। যদিও একটার বেশী দেয়া উচিৎ হয় নাই!
বাড়ির সবাই খুশী। সবচেয়ে খুশী হাসিমুদ্দিন নিজে। আজ বাদে কাল ছেলের বাপ হবে। কিন্তু ওই যে, যায় দিন ভালো, আসে দিন খারাপ! শাপলা জন্ম দিল মাইয়ার। মেজাজ বেজায় খারাপ হল। কিন্তু হাসিমুদ্দিন তা প্রকাশ করল না। নিজেরে বুঝ দিল, “আরো তো পোলাপান হবে! এইটাই তো শ্যাষ না!”
২ টা বছর কাটল খুব সাধারণ ভাবে। বন্দরের দোকানটা নিয়েই হাসিমুদ্দিন ব্যস্ত থাকল।হঠাৎ-ই একদিন আবিষ্কার করল ২ বছরের মেয়ে আয়না রাতে চোখে দেখতে পায় না, রাত কানা মাইয়া! হাসিমুদ্দিনের কান্না পেল না। রাগে মাইয়াটার গলা টিপে ধরতে মন চাইল। আগে বুঝলে অবশ্য আঁতুড়ঘরে এই কাজ করা যাইত! কিন্তু এখন করলে কোট কাচারির ঝামেলা হতে পারে! এর পর অবশ্য শাপলারেও তালাক দিতে মন চাইছে। জন্মে পাপ না থাকলে তো আর রাত কানা মাইয়া জন্মে না! পাড়া প্রতিবেশীদের অনুনয়েই না শাপলার সাথে সংসারটা টিকল! অবশ্য তারপর শাপলা ২ টা পোলা জন্ম দিছে। তাই এ যাত্রা শাপলার সাথে সংসারটা টিকল। নতুন বিয়া করতে অবশ্য হাসিমুদ্দিনের অতটা খারাপ লাগে না! মাইনসে কয়, “কপাল ওয়ালার বউ মরে আর পোড়া কপালির মরে গরু!” পুরুষ মানুষ, মন চাইলে করতেই পারে! এতে দোষের কিছু নাই। সে তো করলে বিয়াই করবে, নষ্টামি তো আর করবে না!
এই শাপলাই এখন আবার নতুন করে জ্বালাচ্ছে। মাগি সামান্য পেট ব্যথায় সারাদিন মাগো, পেট জ্বলে গেল রে- বলে গোঙায়। বেহায়া মাগি কোনখানকার। সেদিন মাত্র হাসিমুদ্দিনকে না জানায়ে বাড়ির উঠতি খাসিটা বিক্রি করে দিল টাকা নিয়ে ডাক্তার দেখাবে বলে! কত্ত বড় সাহস মাগির! হাসিমুদ্দিন অবশ্য দোকান থেকে তড়িঘড়ি এসে সেই টাকা হাত করেছে। নইলে বড্ড বেশী লস হয়ে যেত! এত টাকা দিয়ে কেনা খাসিটা তার!
গ্রামের মানুষের আবার শাপলা বানুর জন্য বেজায় দরদ। এই সেদিন, ইশকুলের আপা এসে বলে, “হাসিমুদ্দিন, বউটারে এ ধাক্কায় বাঁচাতে চাও তো হাসপাতালে নিয়ে ভর্তি করাও। পেটের আলসারে তোমার বউটা কিন্তু আর বেশী দিন টিকবে না! সরকারী হাসপাতালে চিকিৎসার খরচ লাগে না। বউটারে পারলে কালই নিয়ে ভর্তি করাও।”
“আরে বাবা, অত দরদ, তো তোমারাই নিয়ে যাও না রে বাপু! এত ট্যাকা কই আমার? এমনিতেই একটা কানা মাইয়ারে টানা লাগতাসে! সারা জীবনেও তো এইটা ঘাড় থেকে নামব না!”- শিক্ষিত মানুষ ইশকুলের আপা। তাই মুখে বলার সাহস হয় না হাসিমুদ্দিনের! “কি আজিব কথা! চিকিৎসা হবে বিনা পয়সায়। যত্তোসব মিথ্যা কথা!”
তাছাড়া শাপলা বানু হাসপাতালে থাকলে তার বাড়ি ঘর সামলাবে কে? সময় মত পেটে খাবার না পড়লে আবার তার মন মেজাজ বিগড়ে যায়! আর মন মেজাজ খারাপ থাকলে কি আর ব্যবসায় মন দেয়া যায়?
এত সব কথা ভাবতে ভাবতেই হাসিমুদ্দিনের খেয়াল হয় কোন ফাঁকে বিকাল হয়ে গেছে। বউটার গো-গো শুনতেও আর ভাল্লাগছে না। ঘর থেকে বের হয়ে সে বাজারের পথে হাঁটা দেয়। হাঁটতে হাঁটতে অন্যমনস্ক হয়। আবার পকেট থেকে যন্ত্রটা বের করে কানে দেয়। মন খারাপ থাকলে গান শুনতে তার ভালোই লাগে।
“নাহ, যন্ত্রটা একেবারে মন্দ না! খাসা বানিয়েছে!”- ভাবতে ভাবতে দিগন্তের দিকে মিলিয়ে যায় হাসিমুদ্দিন...
-জীবনের সব গল্পই নিছক গল্প নয়। কিছু কিছু গল্প শুধু গল্প হলেই বোধ হয় ভালো হত। সাহিত্য করতে গেলে খানিকটা কল্পনার আশ্রয় নিতেই হয়! কল্পনাটুকু বাদ দিয়ে এই হাসিমুদ্দিন আমার বাস্তব জীবনেই দেখা এক চরিত্র। শাপলা বানুকে কাল সকালে আমার হাসপাতালে নিয়ে ভর্তি করাবার কথা ছিল। আফসোস, লিখতে লিখতেই খবর এল- আর প্রয়োজন নেই হাসপাতালে যাবার। পেটের আলসারে মারা গেছে শাপলা বানু।
এবার হয়ত হাসিমুদ্দিনের আরেকটা বিয়ে করা হবে। তাছাড়া নতুন বিয়া করতে হাসিমুদ্দিনের অতটা খারাপ লাগে না! পুরুষ মানুষ, মন চাইলে করতেই পারে! এতে দোষের কিছু নাই। সে তো করলে বিয়াই করবে, নষ্টামি তো আর করবে না...
মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। sylhettoday24.com-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে sylhettoday24.com আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।
আপনার মন্তব্য